অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করার তাগিদেই মানুষ একটি সংগঠিত কাঠামোর সন্ধান করেছে। সেখান থেকেই রাষ্ট্রের উদ্ভব। ইতিহাসের পরিক্রমায় একে একে আমরা দেখেছি রাজতন্ত্র, একনায়কতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্রের মতো শাসন ব্যবস্থা, যেখানে রাষ্ট্রের সব ক্ষমতা সীমাবদ্ধ ছিল একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর হাতে। রেনেসাঁর পর থমাস হবস, জ্যা-জ্যাঁক রুশো, জন লকের মতো দার্শনিকের চিন্তাধারা আধুনিক রাষ্ট্রের গোড়াপত্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আটলান্টিক রেভল্যুশন থেকে ফরাসি বিপ্লব, রুশ বিপ্লব হয়ে লাতিন আমেরিকার বিপ্লবগুলো ছড়িয়ে দেয় স্বাধীনতার মশাল। গড়ে তোলে আধুনিক গণতন্ত্রের কাঠামো।
বিশ শতকের বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তীকালে গণতন্ত্র সব অঞ্চলে শিকড় গাড়তে পারেনি। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের মতো অঞ্চলে পরিবর্তন ও কল্যাণ রাষ্ট্রের বাণী শুনিয়ে সামরিক বা ভিন্ন কৌশলে ক্ষমতা দখলকারী শাসকরা পরিণত হয়েছেন নতুন শোষকে। তাদের দমনপীড়নের ফলস্বরূপ একুশ শতকে আমরা বিশ্বজুড়ে দেখেছি রোজ বিপ্লব, অরেঞ্জ বিপ্লব, টিউলিপ বিপ্লব ও আরব বসন্ত, যার মধ্য দিয়ে ২০১১ সালে সরকারই পাল্টে যায়। এসব আন্দোলন স্বৈরাচারী শাসকদের পতন ঘটাতে প্রাথমিকভাবে সফল হলেও, গণতন্ত্র ও স্থিতিশীলতায় তাদের সাফল্য ছিল অত্যন্ত সীমিত। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে পরিস্থিতি আগের চেয়েও খারাপ হয়েছিল।
ঠিক এমনই ঐতিহাসিক বিশ্ব-প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে আমরা দেখি বাংলাদেশে জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থান। কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন যে এভাবে একটি দীর্ঘমেয়াদি স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থার পতন ঘটাবে, তা ছিল অভাবনীয়। এই অভ্যুত্থান শুধু সরকারের পরিবর্তন নয়। এটি ছিল বৈষম্যহীন একটি সমাজ, জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্র এবং জুলুম-নিপীড়নমুক্ত বাংলাদেশের স্বপ্ন। প্রায় দুই হাজার শহীদের জীবন এবং ১৫ হাজার মানুষের আহতের বিনিময়ে অর্জিত এই পরিবর্তন সেই স্বপ্নকে কতটা বাস্তবায়ন করল?
আট মাস পেরিয়ে যখন আমরা সেই আত্মত্যাগ এবং স্বপ্ন বাস্তবতার নিক্তিতে মাপি, তখন গভীর হতাশা দেখা দেয়। হাজার হাজার আহত প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ও পুনর্বাসন সুবিধা না পেয়ে নিদারুণ কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন। দুর্ভাগ্যজনক, শুধু রাজনৈতিক ক্ষমতার হাতবদল হয়েছে বলেই মনে হচ্ছে। জনগণের মৌলিক আকাঙ্ক্ষাগুলো উপেক্ষিতই রয়ে গেছে।
বিপ্লবের মূল লক্ষ্য ছিল শুধু সরকার পরিবর্তন নয়; রাষ্ট্রের কাঠামো এবং বিভিন্ন জনগুরুত্বপূর্ণ খাতে মৌলিক সংস্কার। কিন্তু আট মাস পরও এসব সেক্টরে কাঙ্ক্ষিত ও কার্যকর সংস্কারের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। সঙ্গে যোগ হয়েছে রাজনৈতিক অঙ্গনের পুরোনো সংকটের পুনরাবৃত্তি। নতুন রাজনৈতিক সমীকরণ তৈরি হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু রাজনৈতিক শক্তিগুলোর মধ্যে ঐক্যের পরিবর্তে পারস্পরিক দোষারোপ, কাদা ছোড়াছুড়ি এবং ক্ষমতার দ্বন্দ্বই মুখ্য হয়ে উঠেছে। সবচেয়ে বেদনাদায়ক বিষয় হলো, গত ১৫ বছরে যারা সীমাহীন দুর্নীতি, লুটপাট ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য দায়ী ছিল, তাদের বিচারের আওতায় আনার ক্ষেত্রে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
আজ আশঙ্কা হচ্ছে, বাংলাদেশের জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানও কি তবে ‘আরব বসন্ত’র মতোই ব্যর্থতার পথে হাঁটছে? আরব বসন্তের ব্যর্থতার প্রধান কারণগুলোর মধ্যে ছিল মূলত নেতৃত্বের অভাব; বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে ঐক্যের ঘাটতি; শক্তিশালী গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্বলতা; রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বাহিনীর প্রভাব; আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ; অর্থনৈতিক সংকট এবং চরমপন্থি গোষ্ঠীর উত্থান। বিভিন্ন গোষ্ঠী একত্র হয়ে শাসককে ক্ষমতাচ্যুত করলেও তারা ভবিষ্যৎ রাষ্ট্র গঠন বা শাসনভার পরিচালনার ক্ষেত্রে ঐক্যবদ্ধ হতে পারেনি।
যেমনভাবে আরব বসন্তের আন্দোলনের বেশির ভাগই ছিল স্বতঃস্ফূর্ত এবং এর পেছনে কোনো একক বা শক্তিশালী সমন্বিত নেতৃত্ব ছিল না। তেমনিভাবে আমাদের গণঅভ্যুত্থানের পেছনে একক কোনো শক্তির ভূমিকা ছিল না। ধর্মনিরপেক্ষ, ইসলামপন্থি, তরুণ আন্দোলনকারী, আদিবাসী একত্র হয়ে আওয়ামী লীগ সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করেছে। কিন্তু গণঅভ্যুত্থানের পর এর কৃতিত্ব নেওয়াকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছে নানা বিতর্ক এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অনৈক্য। যদি বাংলাদেশের রাজনৈতিক শক্তিগুলো জনগণের আকাঙ্ক্ষা ভুলে সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থ এবং ক্ষমতার দ্বন্দ্বে লিপ্ত থাকে এবং শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আইনসহ মৌলিক সেক্টরগুলোর সংস্কার উপেক্ষিত হয়, তবে জুলাই বিপ্লবের ব্যর্থতা হয়তো অনিবার্য।
রক্ত দিয়ে লেখা যে গণঅভ্যুত্থান এসেছে, সেটা যদি শুধু ক্ষমতার পট পরিবর্তনের দলিল হয়ে থাকে; জনগণের মুক্তির সনদ না হয়, তবে তা হবে শহীদদের আত্মত্যাগের প্রতি চরম বিশ্বাসঘাতকতা। সময় এখনও শেষ হয়ে যায়নি। ঝরে যাওয়া রক্তকে সম্মান জানিয়ে, আত্মত্যাগকারীদের স্বপ্নকে পাথেয় করে রাজনৈতিক শক্তিগুলোকে অবশ্যই জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে এবং সুস্থ, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও জবাবদিহিমূলক রাজনীতির পথে ফিরতে হবে। অন্যথায় ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হবে এবং আমাদের গণঅভ্যুত্থান ব্যর্থতার করুণ অধ্যায় হিসেবেই লিপিবদ্ধ হবে।
আনিসুর রহমান: শিক্ষার্থী, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: গণঅভ য ত থ ন গণঅভ য ত থ ন র জন ত ক ক ষমত র জনগণ র সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
ধারাবাহিক অস্থিরতা ও জনসাধারণের মতামত
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শাহরিয়ার আলম সাম্য হত্যাকাণ্ডে প্রতিবাদমুখর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। গত মঙ্গলবার দিবাগত রাতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ছুরিবিদ্ধ হয়ে নিহত সাম্য জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের নেতা। এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের পেছনে যেমন নানা ঘটনার কথা জানা যাচ্ছে, তেমনি সামনে আসছে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় নিরাপত্তাহীনতার প্রসঙ্গ। অবশ্য নিরাপত্তাহীন এখন সারাদেশের মানুষই। পর্যুদস্ত আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির প্রত্যাশিত উন্নতি কোনোভাবেই হয়ে উঠছে না। খুন-জখম-মারপিট নিত্যকার স্বাভাবিকতায় পরিণত হয়েছে। এদিকে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ একের পর এক দাবি নিয়ে রাজপথে হাজির হচ্ছে। যখন তখন যেখানে সেখানে অবস্থান নেওয়ার কারণে রাজধানী প্রায়ই নিশ্চল হয়ে উঠছে। দুঃসহ যানজটে মানুষের কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। গত সপ্তাহে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা আবাসিক সুবিধাসহ তিন দফা দাবিতে কাকরাইলে রাস্তা অবরোধ করেন। বুধবার শাহবাগ মোড় অবরোধ করেন ডিপ্লোমাপড়ুয়া নার্সরা। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নগর ভবন তিন দিন ধরে অবরুদ্ধ বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে মেয়র পদে বসানোর দাবিতে। সশস্ত্র বাহিনীর চাকরিচ্যুত সদস্যরা চার দফা দাবিতে রোববার জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন।
এ কথা সত্য, দেড় দশকে গণতন্ত্রহীনতার কারণে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশায় অব্যবস্থাপনা ও শৃঙ্খলাহীনতার পাহাড় জমে উঠেছে। গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী শাসন অবসানের সঙ্গে সঙ্গে সংগত কারণেই প্রায় সব সেক্টরে বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতিতে নিষ্পেষিতরা রাজপথে দাবিদাওয়া জানাতে শুরু করেন। প্রথমদিকে যুক্তিগ্রাহ্য হলেও অন্তর্বর্তী সরকারের ৯ মাসেরও বেশি সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর এলোপাতাড়ি দাবিদাওয়া ও ধারাবাহিক বিশৃঙ্খলায় প্রশ্ন করতেই হয়– সরকার কেন শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হচ্ছে? সরকার বিভিন্ন বিষয়ে উদ্যোগও নিচ্ছে; তাহলে সুশাসন অনুপস্থিত কেন? তাদের অগ্রাধিকার তবে কোন কোন ক্ষেত্রে?
২.
দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে নতুন করে কিছু বলবার নেই। জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে পুলিশকে অপব্যবহারের ফলে এই বাহিনীর যে মনোবল ভাঙে, তা ফিরিয়ে আনবার যথাযথ ব্যবস্থা করতে ব্যর্থ হয়েছে সরকার। এখানেই ক্ষান্ত হয়নি; পূর্বাপর বিবেচনা না করে নানা তুঘলকি সিদ্ধান্ত পুলিশ বাহিনীর ওপর চাপানো হচ্ছে। সর্বশেষ বলা হয়েছে, পুলিশের হাতে মারণাস্ত্র থাকবে না! হায় বিধি! সশস্ত্র সন্ত্রাসী নিধনে নিরস্ত্র পুলিশ বাহিনী আদৌ কী করে মোকাবিলা করতে যাবে– এই বিবেচনাও সরকার করছে না। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা যখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় একের পর এক হিমশিম খাওয়ার দৃষ্টান্ত রাখছেন, তখন এই ব্যক্তিকে একাধারে কৃষি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বও দেওয়া হয়েছে। এর মানে কী? আমাদের দেশে কৃষি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রধান খাতের একটি– স্বরাষ্ট্র নিয়ে হাবুডুবু খাওয়া ভদ্রলোককেই কেন কৃষি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করতে হবে? দেশে কৃষিবিষয়ক বিশেষজ্ঞ নেই!
একইভাবে কোন বিবেচনায় বা মাপকাঠিতে কোনো কোনো উপদেষ্টার হাতে তিন-চারটি করে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়, তা কেউ জানে না। দেশে কাজ করবার মতো ব্যক্তিবর্গের এত অভাব? এত যে সংস্কার বলে সরকারি তরফ থেকে উচ্চ নিনাদে বারতা জানানো হচ্ছে বারংবার; মন্ত্রণালয় বা আমলাতন্ত্র পরিচালনায় সরকারের ৯ মাসে আদৌ কোনো রকম সংস্কার প্রস্তাব বা উদ্যোগ দেখা গিয়েছে? না, যায়নি। যে গড্ডল প্রবাহে আওয়ামী লীগ বা আগের সরকারগুলো মন্ত্রণালয় ও আমলাতন্ত্র পরিচালনা করেছে, সেই একই ধারায় বর্তমান সরকারও নিজেদের কাজ চালাচ্ছে। কোনো পরিবর্তন নেই।
৩.
চট্টগ্রাম বন্দরের সবচেয়ে বড় ও লাভজনক নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল বিদেশিদের হাতে ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় ২০২৩ সালের মার্চ মাসে আওয়ামী লীগ সরকার। বন্দরের শ্রমিক-কর্মচারীরা তখনই সিদ্ধান্তটির বিরোধিতা করেন। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘যারা বন্দরের ব্যবস্থাপনায় অভিজ্ঞ, পৃথিবীর সেরা যারা, তাদের দিয়ে এ কাজ করাতে হবে, যেভাবেই হোক’ (প্রথম আলো, ১৫ মে ২০২৫)।
আমরা জানি, একটি রাষ্ট্রের যে কোনো কিছুর সাফল্য নির্ভর করে সুশাসনের ওপর। সুশাসনই তদারকি নিশ্চিত করে। যথাযথ তদারকি বা জবাবদিহি না থাকলে বিদেশি প্রতিষ্ঠানও ব্যর্থ হতে বাধ্য। তবে এই বিতর্ক এখন কেন? কিংবা মিয়ানমার করিডোর? সেন্টমার্টিন নিয়ে প্রচুর কথাবার্তা! দেশের মানুষের সামনে বর্তমানে বন্দর ব্যবস্থাপনা, করিডোর বা সেন্টমার্টিন বেশি জরুরি, নাকি দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা বেশি জরুরি?
যে গণতন্ত্রের দাবিতে, জাতিসংঘের হিসাবমতে ১ হাজার ৪০০ জন প্রাণ হারিয়েছেন, সেই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠাই নিঃসন্দেহে বর্তমান সরকারের প্রধান কর্তব্য। সেটি অনুপস্থিত হয়ে অনুল্লেখ্য কর্তব্যে সরকার মনোযোগী হয়ে ওঠায় চারদিকে নানা খাতে অস্থিরতা ও অবিশ্বাস ঘন হয়ে উঠছে। সেই কাজে সরকার গত ৯ মাসে কতখানি আগ্রহ দেখিয়েছে, তা এরই মধ্যে নানা সন্দেহের অবতারণা করেছে। ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলের বৈঠক, নানা কথাবার্তা– এসবে সাধারণ মানুষের ক্লান্তি আরও বাড়ে। সাধারণ মানুষের মতামতের ভিত্তিতে একটি জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করতে এত ঢাকঢাক গুড়গুড় করতে হয় কেন? অন্তর্বর্তী সরকার নিশ্চিত করবে যাতে নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে থাকে; মানুষ ইচ্ছামতো নিজের ভোট দিতে পারে। এ জন্য ন্যূনতম যতখানি পরিবেশ-পরিস্থিতি তৈরি জরুরি, তা নিয়ে সরকারকে ব্যগ্র হতে দেখি না। বরং প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব যমুনা টেলিভিশনের প্রশ্নের উত্তরে বলেন, ‘(বন্দর ব্যবস্থাপনা) মতৈক্যের বিষয় না। কয়দিন পরে বলবেন, আপনাদের মতৈক্য ছাড়া ট্যাক্সও উঠাবেন না।... আমি বিপ্লবের ম্যান্ডেট নিয়ে এসেছি এখানে। (বন্দর ব্যবস্থাপনা) বিদেশিদের হাতে দিলে জব তৈরি হবে। দশ-পনের বছর ধরে উন্নয়নের গল্প করেছেন, কিন্তু জব ছিল না। ইয়াংম্যান আর অ্যাংরি, ইয়াংওম্যান আর অ্যাংরি!’ (১৭ মে, যমুনা টেলিভিশন)।
বিপ্লবের ম্যান্ডেট? দুঃখিত, জনগণের ম্যান্ডেট এভাবে দাবি করবার বিষয় নয়। এই ভাষা ও ভঙ্গি অগণতান্ত্রিক। যে দেশে গত দেড় দশকে অন্তত তিনটি প্রহসনের নির্বাচনে মানুষকে অপমান ও লাঞ্ছিত করার পরিণতি কড়ায় গণ্ডায় ক্ষমতালোভীদের বুঝিয়ে দিয়েছে এ দেশের ছাত্র-জনতা; সেই দেশে গণতন্ত্রের বিকল্প আর কিছুই হতে পারে না। সাধারণ মানুষ তার দরজায় ভোটপ্রার্থীর নম্র চেহারাই দেখতে চায়। স্বৈরাচারের উদ্ধত-অহংকারী দম্ভের পরাজয় ঘটবার ৯ মাস পরও আকাঙ্ক্ষিত গণতন্ত্রের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের সংকল্প ও নিষ্ঠার সুস্পষ্ট প্রকাশের ঘাটতি আপত্তিকর। তার বদলে অপ্রয়োজনীয় কাজের জানালা খোলার চেষ্টাও উদ্বেগ সৃষ্টি করে।
আমরা ঘরপোড়া জাতি। সিঁদুরে মেঘ দেখলে তাই ভয় পাই। এ দেশে ক্ষমতার চেয়ার বড়ই আরামদায়ক। ক্ষমতাবানেরা সব পেয়েছির বাদশায় পরিণত হন। আমরা বিশ্বাস করতে চাই, গণতন্ত্রের জন্য যে বিপুল আত্মত্যাগ ও সুদীর্ঘ আন্দোলনের পথরেখা, তার প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখে অতিদ্রুত সরকার সুনির্দিষ্ট নির্বাচনী রোডম্যাপ প্রকাশ করবে। সরকার তার অগ্রাধিকার কার্যতালিকা ঘোষণা করলেই বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মধ্যে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ অপেক্ষমাণ হয়ে শান্ত হবে। প্রত্যেকেই বিশ্বাস করতে চায়– তার ভোটে নির্বাচিত সরকার এসে ধাপে ধাপে সকলের দাবি পূরণে কাজ শুরু করবে।
মাহবুব আজীজ: উপসম্পাদক, সমকাল; সাহিত্যিক
mahbubaziz01@gmail.com