অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করার তাগিদেই মানুষ একটি সংগঠিত কাঠামোর সন্ধান করেছে। সেখান থেকেই রাষ্ট্রের উদ্ভব। ইতিহাসের পরিক্রমায় একে একে আমরা দেখেছি রাজতন্ত্র, একনায়কতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্রের মতো শাসন ব্যবস্থা, যেখানে রাষ্ট্রের সব ক্ষমতা সীমাবদ্ধ ছিল একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর হাতে। রেনেসাঁর পর থমাস হবস, জ্যা-জ্যাঁক রুশো, জন লকের মতো দার্শনিকের চিন্তাধারা আধুনিক রাষ্ট্রের গোড়াপত্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আটলান্টিক রেভল্যুশন থেকে ফরাসি বিপ্লব, রুশ বিপ্লব হয়ে লাতিন আমেরিকার বিপ্লবগুলো ছড়িয়ে দেয় স্বাধীনতার মশাল। গড়ে তোলে আধুনিক গণতন্ত্রের কাঠামো।

বিশ শতকের বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তীকালে গণতন্ত্র সব অঞ্চলে শিকড় গাড়তে পারেনি। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের মতো অঞ্চলে পরিবর্তন ও কল্যাণ রাষ্ট্রের বাণী শুনিয়ে সামরিক বা ভিন্ন কৌশলে ক্ষমতা দখলকারী শাসকরা পরিণত হয়েছেন নতুন শোষকে। তাদের দমনপীড়নের ফলস্বরূপ একুশ শতকে আমরা বিশ্বজুড়ে দেখেছি রোজ বিপ্লব, অরেঞ্জ বিপ্লব, টিউলিপ বিপ্লব ও আরব বসন্ত, যার মধ্য দিয়ে ২০১১ সালে সরকারই পাল্টে যায়। এসব আন্দোলন স্বৈরাচারী শাসকদের পতন ঘটাতে প্রাথমিকভাবে সফল হলেও, গণতন্ত্র ও স্থিতিশীলতায় তাদের সাফল্য ছিল অত্যন্ত সীমিত। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে পরিস্থিতি আগের চেয়েও খারাপ হয়েছিল।

ঠিক এমনই ঐতিহাসিক বিশ্ব-প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে আমরা দেখি বাংলাদেশে জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থান। কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন যে এভাবে একটি দীর্ঘমেয়াদি স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থার পতন ঘটাবে, তা ছিল অভাবনীয়। এই অভ্যুত্থান শুধু সরকারের পরিবর্তন নয়। এটি ছিল বৈষম্যহীন একটি সমাজ, জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্র এবং জুলুম-নিপীড়নমুক্ত বাংলাদেশের স্বপ্ন। প্রায় দুই হাজার শহীদের জীবন এবং ১৫ হাজার মানুষের আহতের বিনিময়ে অর্জিত এই পরিবর্তন সেই স্বপ্নকে কতটা বাস্তবায়ন করল? 

আট মাস পেরিয়ে যখন আমরা সেই আত্মত্যাগ এবং স্বপ্ন বাস্তবতার নিক্তিতে মাপি, তখন গভীর হতাশা দেখা দেয়। হাজার হাজার আহত প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ও পুনর্বাসন সুবিধা না পেয়ে নিদারুণ কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন। দুর্ভাগ্যজনক, শুধু রাজনৈতিক ক্ষমতার হাতবদল হয়েছে বলেই মনে হচ্ছে। জনগণের মৌলিক আকাঙ্ক্ষাগুলো উপেক্ষিতই রয়ে গেছে।
বিপ্লবের মূল লক্ষ্য ছিল শুধু সরকার পরিবর্তন নয়; রাষ্ট্রের কাঠামো এবং বিভিন্ন জনগুরুত্বপূর্ণ খাতে মৌলিক সংস্কার। কিন্তু আট মাস পরও এসব সেক্টরে কাঙ্ক্ষিত ও কার্যকর সংস্কারের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। সঙ্গে যোগ হয়েছে রাজনৈতিক অঙ্গনের পুরোনো সংকটের পুনরাবৃত্তি। নতুন রাজনৈতিক সমীকরণ তৈরি হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু রাজনৈতিক শক্তিগুলোর মধ্যে ঐক্যের পরিবর্তে পারস্পরিক দোষারোপ, কাদা ছোড়াছুড়ি এবং ক্ষমতার দ্বন্দ্বই মুখ্য হয়ে উঠেছে। সবচেয়ে বেদনাদায়ক বিষয় হলো, গত ১৫ বছরে যারা সীমাহীন দুর্নীতি, লুটপাট ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য দায়ী ছিল, তাদের বিচারের আওতায় আনার ক্ষেত্রে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। 

আজ আশঙ্কা হচ্ছে, বাংলাদেশের জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানও কি তবে ‘আরব বসন্ত’র মতোই ব্যর্থতার পথে হাঁটছে? আরব বসন্তের ব্যর্থতার প্রধান কারণগুলোর মধ্যে ছিল মূলত নেতৃত্বের অভাব; বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে ঐক্যের ঘাটতি; শক্তিশালী গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্বলতা; রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বাহিনীর প্রভাব; আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ; অর্থনৈতিক সংকট এবং চরমপন্থি গোষ্ঠীর উত্থান। বিভিন্ন গোষ্ঠী একত্র হয়ে শাসককে ক্ষমতাচ্যুত করলেও তারা ভবিষ্যৎ রাষ্ট্র গঠন বা শাসনভার পরিচালনার ক্ষেত্রে ঐক্যবদ্ধ হতে পারেনি।
যেমনভাবে আরব বসন্তের আন্দোলনের বেশির ভাগই ছিল স্বতঃস্ফূর্ত এবং এর পেছনে কোনো একক বা শক্তিশালী সমন্বিত নেতৃত্ব ছিল না। তেমনিভাবে আমাদের গণঅভ্যুত্থানের পেছনে একক কোনো শক্তির ভূমিকা ছিল না। ধর্মনিরপেক্ষ, ইসলামপন্থি, তরুণ আন্দোলনকারী, আদিবাসী একত্র হয়ে আওয়ামী লীগ সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করেছে। কিন্তু গণঅভ্যুত্থানের পর এর কৃতিত্ব নেওয়াকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছে নানা বিতর্ক এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অনৈক্য। যদি বাংলাদেশের রাজনৈতিক শক্তিগুলো জনগণের আকাঙ্ক্ষা ভুলে সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থ এবং ক্ষমতার দ্বন্দ্বে লিপ্ত থাকে এবং শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আইনসহ মৌলিক সেক্টরগুলোর সংস্কার উপেক্ষিত হয়, তবে জুলাই বিপ্লবের ব্যর্থতা হয়তো অনিবার্য।

রক্ত দিয়ে লেখা যে গণঅভ্যুত্থান এসেছে, সেটা যদি শুধু ক্ষমতার পট পরিবর্তনের দলিল হয়ে থাকে; জনগণের মুক্তির সনদ না হয়, তবে তা হবে শহীদদের আত্মত্যাগের প্রতি চরম বিশ্বাসঘাতকতা। সময় এখনও শেষ হয়ে যায়নি। ঝরে যাওয়া রক্তকে সম্মান জানিয়ে, আত্মত্যাগকারীদের স্বপ্নকে পাথেয় করে রাজনৈতিক শক্তিগুলোকে অবশ্যই জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে এবং সুস্থ, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও জবাবদিহিমূলক রাজনীতির পথে ফিরতে হবে। অন্যথায় ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হবে এবং আমাদের গণঅভ্যুত্থান ব্যর্থতার করুণ অধ্যায় হিসেবেই লিপিবদ্ধ হবে।

আনিসুর রহমান: শিক্ষার্থী, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: গণঅভ য ত থ ন গণঅভ য ত থ ন র জন ত ক ক ষমত র জনগণ র সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

বিএনপি ও জামায়াত কে কোন ফ্যাক্টরে এগিয়ে

ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের তারিখ এখনো জানা যায়নি, তবে সময় দ্রুত এগিয়ে আসছে। এখন সরকার বা কোনো দলের পক্ষেই নির্বাচনের বাস্তবতা থেকে পিছিয়ে আসার সুযোগ নেই। কোন দল কতটা প্রস্তুত, কোন দলের জনসমর্থন কেমন এবং কে আসবে ক্ষমতায়—চায়ের কাপের আড্ডা থেকে শুরু করে সর্বত্র এ নিয়েই আলোচনা চলছে।

এ আলোচনা হচ্ছে পারিবারিক খাবার টেবিলে, গ্রামগঞ্জে, চায়ের দোকানে, শহরের ক্যাফেতে; আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তো বটেই। ইন্টারনেটের যুগে এসব আলোচনার কোনো ভৌগোলিক সীমাবদ্ধতা নেই।

তবে বেশির ভাগ আলোচনাই এখনো সাময়িক বা টেনটেটিভ—পরিপক্বতার পর্যায়ে পৌঁছায়নি। জনগণের রাজনৈতিক চিন্তাভাবনাকে কেন্দ্র করেই আমাদের এ আলোচনা।

রাজনীতিতে জনগণ খুঁজছে কিছু আকাঙ্ক্ষিত ফ্যাক্টর

জনগণ এখনো পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারছে না—দলগুলোর অবস্থান তাদের চাওয়া-পাওয়ার সঙ্গে কতটা মেলে এবং কোন দল সত্যিকারে দেশের শাসনক্ষমতা নিয়ে একটি সম্ভাবনাময় সরকার গঠন করতে পারবে। তবে অনেক অনিশ্চয়তার মধ্যেও কিছু বিষয় স্পষ্ট হয়ে উঠছে। বেশির ভাগ মানুষ এখনো দলগত সমর্থনে স্থায়ী বা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়নি। জনগণ তাদের আশা, আকাঙ্ক্ষা ও চাওয়া-পাওয়ার উপাদানগুলোকে দলগুলোর সঙ্গে মেলাতে চেষ্টা করছে।

যেসব দল শৃঙ্খলাবোধ প্রদর্শন করতে পারছে এবং নিজেদের রাজনৈতিক শিষ্টাচার জনগণের সামনে উপস্থাপন করতে পারছে, এখন পর্যন্ত তারাই তুলনামূলকভাবে বেশি লাভবান বলে মনে হচ্ছে।

একটা বিষয় স্পষ্ট—দেশের জনগণ চায়, প্রতিটি দল তাদের নেতিবাচক কার্যকলাপ থেকে বেরিয়ে আসুক। রাজনীতিতে ক্রমাগত বিশৃঙ্খলা দেখতে দেখতে মানুষ ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।

আরেকটি বিষয়, যা সাধারণ জনগণের খুবই অপছন্দ, তা হলো রাজনীতিবিদদের বাগাড়ম্বর। যাঁরা সফল হতে চান, তাঁদের শৃঙ্খল ও শালীন হতে হবে।

সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকারের পরিকল্পনা উপদেষ্টা অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, ‘রাজনীতিতে ডান ও বামের বিভাজন মুছে যাচ্ছে।’

সত্যিকার অর্থে দেশের মানুষ এখন আর আদর্শিক রাজনীতিতে বিশ্বাস করে না। গত ৩৫ বছরে আদর্শিক রাজনীতি ‘প্রমোট’ ও প্রচার করতে গিয়ে রাজনীতিবিদেরা দেশে চরম বিশৃঙ্খলা ও বিভাজন সৃষ্টি করেছেন। তাঁদের সেই আদর্শ জনগণের কোনো উপকারে আসেনি।

তাই আপাতত আদর্শ ও দফাভিত্তিক রাজনীতি সম্ভবত অকার্যকর হয়ে পড়েছে। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বামপন্থী দলগুলো। তারা আদর্শের কলহে রাজনীতির বেশির ভাগ সময় ব্যয় করেছে।

আরেকটি বিষয় এখনো খুব আলোচনায় আসেনি, সেটি হলো, বাংলাদেশে রাজনীতিতে ধর্মভিত্তিক দলগুলোর পদচারণকে দেশের জনগণ ইতিবাচকভাবে দেখছে। তবে এককভাবে ধর্মভিত্তিক দলগুলোকে নির্বাচনী রাজনীতিতে জনগণ আগে কখনো পূর্ণমাত্রায় সমর্থন দেয়নি।

আরও পড়ুনবিএনপি-জামায়াতের চার যুগের বন্ধুত্বের কী হলো১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫

দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মুসলিমপ্রধান দেশগুলো (পাকিস্তান থেকে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত) প্রায় সব ক্ষেত্রেই বিষয়টি প্রযোজ্য। কোনো রাজনৈতিক দলের নামে ‘ইসলাম’ শব্দটি থাকলেই যে আমাদের দেশের ধর্মভীরু মানুষ দলবদ্ধভাবে তাদের ভোট দেবে, তা কখনো হয়নি এবং সম্ভবত ভবিষ্যতেও হবে না।

যেসব রাজনৈতিক দল বৃহত্তর পরিসরে সাংগঠনিকভাবে আমাদের সমাজ ও জনগণের মতোই দেখতে, তারাই সব সময় ব্যাপকভাবে জনগণের স্বীকৃতি পাবে।

যেসব উপাদান বা ফ্যাক্টর বিবেচনা করে জনগণ এবার রাজনৈতিক দলগুলোকে বিচার করতে পারে, সেগুলো হলো—

১. সুশৃঙ্খল ও রাজনৈতিক শিষ্টাচার;

২. নেতিবাচক কার্যকলাপ পরিহার এবং শুদ্ধ রাজনীতির ধারক হওয়া;

৩. ভারসাম্যপূর্ণ ও বহুত্ববাদী সংমিশ্রণে দলীয় সংগঠন গঠন;

৪. আদর্শের রাজনীতি নয়, বরং দেশ পরিচালনায় বাস্তব সক্ষমতা।

এ পর্যায়ে আমরা বর্তমান বড় দুই রাজনৈতিক দল—বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী নিয়ে কথা বলব এবং দেশের রাজনৈতিক সংলাপে তাদের অবস্থানকে এই চার ফ্যাক্টরের নিরিখে মূল্যায়ন করব।

এনসিপি: ‘চাপের রাজনীতি’ ছাড়তে হবে

এ আলোচনা থেকে আমরা এনসিপিকে বাইরে রাখব দুটি কারণে। প্রথম কারণ হলো, এনসিপির রাজনৈতিক পরিচিতি এখনো বিকশিত হচ্ছে। দ্বিতীয় কারণ হলো, এখন পর্যন্ত এনসিপির সব কার্যক্রম শুধু জুলাই আন্দোলনকে ঘিরে। ভোটের রাজনীতিতে তাদের খুব উৎসাহভরে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দেখা যাচ্ছে না। ভবিষ্যতে এনসিপি নিশ্চয়ই বাস্তবতা মেনে নিয়ে নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নিজেদের আরও প্রসারিত করবে।

এনসিপি সম্বন্ধে একটা মন্তব্য এখানে বোধ হয় অপ্রাসঙ্গিক হবে না। সেটি হলো, তারা দলীয়ভাবে ‘চাপের রাজনীতি’কে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। যেমন শাপলা প্রতীক দিতেই হবে এবং অন্য সব বিষয়ও তাদের চাওয়ামতো হতে হবে। তাদের এই ‘চাপের রাজনীতি’ যে জনগণ খুব পছন্দ করছে না, তা তাদের বুঝতে হবে।

বিএনপি আগেও ক্ষমতায় ছিল। তাদের দলে অনেক পরিচিত নেতা রয়েছেন, যাঁরা আগেও দেশের বিভিন্ন পর্যায়ে সরকার চালিয়েছেন। এটাও সত্য, তাদের কিছু নেতার বিতর্কিত অতীত রয়েছে। বিএনপিতে তরুণ একটা উচ্চশিক্ষিত গ্রুপও অপেক্ষা করছে নেতৃত্বে যোগ দিতে। তাঁদের অনেকেই নিজেদের মা–বাবার হাত ধরে বিএনপিতে এসেছেন। সব মিলিয়ে বিএনপি দাবি করতে পারে, তারা দেশ পরিচালনায় সক্ষম একটা রাজনৈতিক দল। বিএনপির ঘাটতি ও শক্তি কোথায়

বিএনপির কেন্দ্রীয় ও জেলাভিত্তিক নেতারা গত ১৫ বছর সেই দিনটির জন্য অপেক্ষা করে আছেন, যেদিন অনুকূল পরিবেশে কে কোথায় শীর্ষ প্রতিনিধি বা সংসদ সদস্য হবেন, তা নির্ধারিত হবে। কোনো কোনো এলাকায় বিএনপির ১৫ থেকে ২০ জন সম্ভাব্য প্রার্থী দাঁড়িয়ে আছেন। একক প্রার্থী নির্ধারণ করতে গিয়ে তারা যত বেশি বিশৃঙ্খলা দেখাবে, ততই দলের নেতিবাচকতা বাড়বে।

বিএনপির চাঁদাবাজি, দখলদারি—এসব নেতিবাচক দিক এমনিতেই দিন দিন ‘আয়তনে’ বাড়ছে। দলকে শুদ্ধ করার তাদের ‘দন্তহীন’ প্রচেষ্টাগুলো কোনো কাজ দেয়নি। ডাকসু নির্বাচনের পরেই বলেছিলাম, বিএনপিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে হবে। পরবর্তী সময়ে জাকসু, চাকসু ও রাকসুর ফলাফলেও তা প্রতিফলিত হয়েছে।

ধারণা করি, শিবিরের ‘ভালোত্ব’ নয়, আদতে বিএনপির জন্যই ছাত্রদল তলিয়ে যাচ্ছে। ছাত্রদলের দুর্ভোগ বিএনপির নির্বাচনী ভাগ্যেকে কতটুকু পিছিয়ে দেবে, সেদিকে সবারই চোখ থাকবে।

আরও পড়ুনবিএনপি ও এনসিপির টানাপোড়েনে ‘প্রিজনার্স ডিলেমায়’ পড়তে পারে দেশ ১৩ আগস্ট ২০২৫ডাকসুতে ছাত্রদলের হার, বিএনপিকে যা ভাবতে হবে

বিএনপির সবচেয়ে বড় সুবিধা, তারা আমাদের দেশের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীকে সমানভাবে প্রতিনিধিত্ব করছে। তাদের ছোট-বড় যেকোনো সমাবেশে গেলে সেগুলোকে আমাদের দেশের জনগোষ্ঠীর একটা ভালো নমুনা মনে হবে। তাদের মধ্যে কিছুটা মৌলবাদী ঘরানার, কিছুটা ভাসানী–সমর্থক ঘরানার, কিছুটা মুজিবীয় ঘরানার, কিছুটা জাতীয়তাবাদী, কিছুটা বামপন্থী—সবই পাওয়া যাবে।

বিএনপির সবচেয়ে বড় শক্তি—দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী বিএনপির এই বহুত্ববাদী রঙে আশ্বস্ত হবে। বৃহত্তর সমাজের ভারসাম্য বজায় না রাখতে পারলে যে উত্তাল অবস্থা হবে, তাতে কেউ–ই নিরাপদ থাকবে না।

বিএনপি আগেও ক্ষমতায় ছিল। তাদের দলে অনেক পরিচিত নেতা রয়েছেন, যাঁরা আগেও দেশের বিভিন্ন পর্যায়ে সরকার চালিয়েছেন। এটাও সত্য, তাদের কিছু নেতার বিতর্কিত অতীত রয়েছে। বিএনপিতে তরুণ একটা উচ্চশিক্ষিত গ্রুপও অপেক্ষা করছে নেতৃত্বে যোগ দিতে। তাঁদের অনেকেই নিজেদের মা–বাবার হাত ধরে বিএনপিতে এসেছেন।

সব মিলিয়ে বিএনপি দাবি করতে পারে, তারা দেশ পরিচালনায় সক্ষম একটা রাজনৈতিক দল। বাংলাদেশে অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষে এ দাবি করা সহজ হবে না। যতই ভোটের সময় কাছে আসবে, ততই ‘দেশ পরিচালনায় সক্ষমতা’ ফ্যাক্টর বিএনপির জন্য সহায়ক হবে।

দুর্নীতিমুক্ত দল হিসেবে জামায়াত নিজেদের জন্য একটা ইমেজ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে। এই ইমেজ অনেকটা তুলনামূলক। যেমন ৫ আগস্টের পর বিএনপির নেতা–কর্মীদের যত নেতিবাচক ঘটনা জনগণের চোখে ধরা পড়েছে, সে তুলনায় জামায়াতের ঘটনা অনেক কম। সিলেটের সাদাপাথর দুর্নীতিতে দুদকের প্রতিবেদনে যেহেতু সব দলই জড়িত ছিল, সেহেতু সে ঘটনা জামায়াতকে এককভাবে কলঙ্কিত করেনি।জামায়াতে ইসলামী কোথায় এগিয়ে

দুর্নীতিমুক্ত দল হিসেবে জামায়াত নিজেদের জন্য একটা ইমেজ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে। এই ইমেজ অনেকটা তুলনামূলক। যেমন ৫ আগস্টের পর বিএনপির নেতা–কর্মীদের যত নেতিবাচক ঘটনা জনগণের চোখে ধরা পড়েছে, সে তুলনায় জামায়াতের ঘটনা অনেক কম। সিলেটের সাদাপাথর দুর্নীতিতে দুদকের প্রতিবেদনে যেহেতু সব দলই জড়িত ছিল, সেহেতু সে ঘটনা জামায়াতকে এককভাবে কলঙ্কিত করেনি।

জামায়াতকে তাদের মনোনীত প্রার্থী নিয়ে খুব বিশৃঙ্খলায় পড়তে হবে না। দলের নেতারাও মোটামুটি একই সুরে কথা বলবেন। তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী দল একক প্রার্থী নির্ধারণ করতে গিয়ে যত বেশি বিশৃঙ্খলায় পড়বে, ততই জামায়াতের ইমেজ ভালো দেখাবে। শৃঙ্খলা ও রাজনৈতিক শিষ্টাচার জামায়াতের জন্য ইতিবাচক হিসেবে কাজ করবে।

জামায়াতে ইসলামীর বিগত কয়েকজন আমিরকে যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা বলবেন, বর্তমান আমির শফিকুর রহমানই তুলনামূলকভাবে অধিক নমনীয় এবং পরিবর্তনীয়। তিনি লেখাপড়া করেছেন চিকিৎসাবিজ্ঞানে, ছাত্রাবস্থায় জাসদের রাজনীতি করতেন। তিনি যেহেতু ডগমা বা প্রচলিত সূত্র ধরে জামায়াতের রাজনীতিতে আসেননি, তাই তাঁর রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি আরও প্রসারিত।

শফিকুর রহমানের কিছু কিছু উদ্যোগ জামায়াতের জন্য ইতিবাচক মনে করা হয়।

সংখ্যালঘুদের জানমালের নিরাপত্তায় শফিকুর রহমানের উদ্যোগ—তাদের মন্দিরে গিয়ে অভয় প্রদান—অনেকের কাছে নির্ভেজাল মনে হয়েছে। তিনি হিন্দু জনগণকে জামায়াতকে সমর্থন করার আহ্বান জানিয়েছেন এবং তাঁদের জামায়াত থেকে মনোনয়ন দেওয়ার কথাও বলেছেন। তবে জামায়াতের ধর্মভিত্তিক রাজনীতি ও অবকাঠামো যত দিন না বদলাবে, শফিকুর রহমানের একক প্রচেষ্টা সফল হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। তাই জামায়াত এখনো একটা সমজাতীয় বা হোমোজেনাস দল এবং এটা তাদের জন্য নেতিবাচক হয়েই থাকবে।

আরও পড়ুনজামায়াত এগিয়ে, বিএনপি কেন পিছিয়ে ০৪ অক্টোবর ২০২৫

জামায়াতকে এখনো বিশেষ আদর্শ বা মতবাদের বাহক হিসেবে গণ্য করা হয়। জামায়াত তাদের আদর্শ ও মতবাদের ভিত্তিতে বড় কোনো সুবিধা পাবে না। আবার যাঁরা জামায়াতকে পাকিস্তানপন্থী বা একাত্তরে পাকিস্তানিদের সহযোগী হিসেবে চিহ্নিত করে পরাস্ত করতে চান, তাঁরাও খুব সুবিধা করতে পারছেন না।

তবে এটা এখনকার অবস্থা—ভবিষ্যতে ‘একাত্তরের ইতিহাস’ হাওয়াইয়ের সুপ্ত আগ্নেয়গিরির মতো যে কখন জামাতের জন্য বিস্ফোরিত হবে, তা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারবে না। তবে এখন অন্য ফ্যাক্টরগুলোই বেশি গুরুত্ব নিয়ে সামনে আসছে।

আরেকটা ফ্যাক্টর জামায়াতের বিপক্ষে কাজ করবে। সেটি হলো, দলের ওপরের সারির দু-চারজন নেতা ছাড়া অন্যরা সাধারণ জনগণের কাছে একদম অপরিচিত। একটা কর্মশীল সরকার গঠন এবং সুষ্ঠুভাবে আধুনিক রাষ্ট্র পরিচালনায় তাঁরা কতটুকু সক্ষম? কারা দেশের নেতা হবেন?

নির্বাচন যত কাছে আসবে, এই প্রশ্নগুলো আরও সামনে আসবে এবং অধিকতর গুরুত্ব পাবে।

চাই শুদ্ধতা ও বাস্তববাদী সংমিশ্রণ

নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসবে, জনগণের মধ্যে এই উপকরণগুলোর যাচাই-বাছাই আরও বাড়বে। কোন কোন উপকরণের গুরুত্ব আস্তে আস্তে বাড়বে কিংবা কোনগুলোর গুরুত্ব কিছুটা কমবে, তার ফয়সালা হতে আরও সময় লাগবে।

কিছু কিছু অনুমান হয়তো করা যায়, তবে এক্ষুনি কোনো শেষ কথা বলা ঠিক হবে না। যেমন একটা পর্যায়ে জনগণ শুধু ‘শুদ্ধ রাজনীতি’ কিংবা ‘দেশ পরিচালনায় সক্ষমতা’-কে বেশি গুরুত্ব দিয়ে ভোটকেন্দ্রের দিকে যাবে। আবার এমনটা না–ও হতে পারে; হয়তো তারা সব ফ্যাক্টর বিবেচনা করেই ভোট দেবে।

আরেকটি দেখার বিষয় হলো, ৫ আগস্টের আগে বিএনপি ৪০ শতাংশ জনসমর্থন অধিকারে রাখা দল ছিল। এখন তাদের যারা প্রতিদ্বন্দ্বী, সেই জামায়াত ছিল ৫ শতাংশ লোকের সমর্থন পাওয়া দল। শুধু বিএনপির নেতিবাচকতা দিয়ে জামায়াত কি জনসমর্থনের এই বিরাট ব্যবধান এত সহজে ঘুচাতে পারবে?

বিশ্বজুড়ে এখন একটা অস্থিরতা চলছে। বিভিন্ন উন্নয়নকামী দেশের জনগণ নিজেদের দারুণভাবে প্রতারিত ভাবছে। এ অবস্থায় আমাদের দেশের জনগণ রাজনীতিতে খুঁজছে শুদ্ধতা ও বাস্তববাদী সংমিশ্রণ। যেসব রাজনৈতিক দল জনগণের চাওয়া–পাওয়ার ফ্যাক্টরগুলোর সঙ্গে তাল মিলিয়ে সামনের নির্বাচনে এগিয়ে আসবে, তারাই বেশি সুফল পাবে এবং সফল হবে।

সালেহ উদ্দিন আহমদ লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

ই-মেইল: salehpublic711@gmail

*মতামত লেখকের নিজস্ব

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • জ্বালানি সুবিচার নিশ্চিতে সংগ্রাম, শপথ যুব সংসদের সদস্যদের
  • বন্দরে বিএনপি নেতা তাওলাদের উপর হামলাকারীদের গ্রেপ্তারে আল্টিমেটাম
  • সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠাই এখন জাতির দাবি
  • জনগণের বৃহত্তর ঐক্য ছাড়া এই ফ্যাসিস্ট ব্যবস্থার পতন হবে না: সাকি
  • রূপগঞ্জে ৩১ দফা বাস্তবায়নের লক্ষে লিফলেট বিতরণ 
  • বিএনপি ও জামায়াত কে কোন ফ্যাক্টরে এগিয়ে
  • দ্রুত নির্বাচনের গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি করুন: আকবর খান
  • শাবিতে জুলাই গণঅভ্যুত্থান নিয়ে জাতিসংঘের তদন্ত প্রতিবেদনের ওপর সেমিনার
  • আন্তর্জাতিক সংকট যেভাবে স্বৈরশাসকদের শক্তিশালী করে
  • সরকার এখন প্রতারকের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েছে: মান্না