নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব এড. আবু আল ইউসুফ খান টিপু বলেছেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আমরা ত্যাগী ও নির্যাতিত নেতাদের মধ্য থেকে মনোনয়ন চাই।

নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনে মহানগর বিএনপির যে সকল ত্যাগী ও নির্যাতিত নেতারা রয়েছে তাদের মধ্যে দলীয় প্রার্থী দিতে হবে। আর যদি আমাদের অভিভাবক তারেক রহমান দলের স্বার্থে এমুকে-তেমুককে নমিনেশন দিলে সেই সময় আমরা তার নির্দেশ পালন করতে বাধ্য। 

আমরা জানি জিয়া পরিবার সবচেয়ে ত্যাগী ও নির্যাতিত, সুতরাং তারা সবসময় খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান ত্যাগী ও নির্যাতিত নেতাদের তাদের পাশে ও পক্ষে থাকবেন এবং মনোনয়ন দিবেন। আর আজকে অনেকেই বসন্তের কোকিল হয়ে এসেছে। তারা ৩০শে মে পালন করে গাড়ি বহন নিয়ে লাখ লাখ টাকা খরচ করেন।

এখন তারা মসজিদ দান করে ও রাস্তার উন্নয়নের কাজে নিজেদেরকে নিয়োজিত রেখেছেন আরে ভাই বিগত ১৬টি বছর আপনারা কোথায় ছিলেন। এই ১৬টি বছর কি আমরা জিয়াউর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকী পালন করি নাই।

আমরাও মসজিদ মাদ্রাসায় দান করি রাস্তাঘাটের কাজ করেছি। আমরা কিন্তু হঠাৎ করে মসজিদ মাদ্রাসায় দান ও রাস্তার উন্নয়ন কাজ করতে যাই নাই। 

নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপির অন্তর্গত সদর থানা বিএনপির আওতাধীন ১৪নং ওয়ার্ড বিএনপির প্রাথমিক সদস্য নবায়ন ও নতুন সদস্য ফরম কার্যক্রম বিতরণ পূর্বে প্রধান বক্তার বক্তব্যে তিনি এসব কথাগুলো বলেন।

শুক্রবার (৪ জুলাই) বিকেল শহরের নন্দিপাড়ায় শেরে বাংলা প্রাইমারি স্কুলে ১৪নং ওয়ার্ড বিএনপির উদ্যোগে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। 

তিনি বলেন,  শেখ হাসিনা তার বাবার মতন সেও বাকশাল তৈরি করে দীর্ঘ ১৬টি বছর অবৈধভাবে ক্ষমতায় ছিলেন। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় দেশে এদেশের গণতন্ত্রকে হত্যা করলেন, মানুষের ভোটের অধিকার ও বাকস্বাধীনতাকে হরণ করলেন। বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীদের উপরে তিনি ইস্টিমরোলার চালালেন। 

সর্বশেষ তিনি হত্যা, গুন খুন ও আয়না করে প্রতিষ্ঠা করে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চেয়েছিলেন। যেই শেখ হাসিনার অন্যায়ের বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুলে প্রতিবাদ করত তাকে রাতের অন্ধকারে তাকে গ্রেফতার করে আয়না ঘরে বন্দী করতো।

তার উপরে চলতো নির্মল অত্যাচার অবিচার। দুই চার বছরও তার কোন আর কোন খোঁজ খবর থাকতো না তাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিত। 

তাহলে আপনারাই দেখেন দীর্ঘ ১৬ টি বছর কি শেখ হাসিনা বাংলাদেশের মানুষের জন্য ভালো কিছু করেছে। আমাদের দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে মিথ্যা মামলায় দীর্ঘ নয়টি বছর গৃহবন্দি করে রেখেছিল তাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে চেয়েছিল।

আর আমাদের নেতা তারেক রহমান ১৬টি বছর অসুস্থ অবস্থায় লন্ডনের চিকিৎসাধীন থেকেও হ্যামিলিয়নের বাঁশিওয়ালার মতন আমাদেরকে দিকনির্দেশনা দিয়ে নেতাকর্মীদেরকে সুসংগঠিত করে আন্দোলনকে ত্বরান্বিত করেছিল।

ঠিক তখনই কি আসলো বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন। যখন ডিবি হারুন বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ৬ সমন্বয়কে গ্রেফতার করে ডিবি অফিসের নিয়ে গেল তখন তারা আন্দোলন স্থগিত করার ঘোষণা দিল ঠিক তখনই আমাদের নেতা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত রপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বাকি ৬৫ জন সমন্বয়কদের সাথে কথা বলে তাদেরকে সুসংগঠিত করে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান।

বিএনপি, যুবদল, ছাত্রদলের পাশাপাশি ২০ দলীয় নেতাকর্মীদেরকে তিনি রাজপথে নামিয়ে দিলেন। পরবর্তীতে বৈষম্য বিরোধী ছাত্রদের কোটা আন্দোলন থেকে সেই আন্দোলন এক দফা আন্দোলনে রূপান্তরিত হলে সেটি চূড়ান্ত আন্দোলনের মাধ্যমে ফ্যাসিস শেখ হাসিনার পদত্যাগ করতে বাধ্য করেছিল। 

তিনি আরও বলেন, আপনারা কি আবারো আওয়ামী লীগের সেই জাহিলিয়া যুগে যেতে চান। আমরা আমাদের বাক স্বাধীনতা চাই ভোটের অধিকার ফিরে চাই। আমরা গণতন্ত্র ফিরে পেতে চাই সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ফিরে পেতে চাই। আমরা দেশের ২০ কোটি মানুষের মুখে হাসি ফোটা চাইতে চাই বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে চাই। 

শেখ হাসিনা পলিয়ে যাওয়ার পর আমরা আশা করেছিলাম যে অন্তবর্তী কালীন সরকার আসবে তারা এসে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা করবে। বিগত ১৬ টি বছর আওয়ামী লীগ যে মানুষের ভোটের অধিকার কেড়ে নিয়েছিল সে অধিকার তারা ফিরিয়ে দিবে। কারণ ফ্যাসিস শেখ হাসিনার দিনের ভোট রাতে সরকারি সংস্থাদের দিয়ে সীল মেরে নিয়ে গিয়েছিল। 

আমরা মনে করেছি এই সরকার দ্রুত সম্ভব একটি নির্বাচনের আয়োজন করবে কিন্তু আমরা কি দেখলাম এই সরকার সংস্কার সংস্কার বলে নির্বাচনকে পিছিয়ে দিচ্ছে। নতুন করে বাংলাদেশ মানুষকে আর আন্দোলনের দিকে ঠেলে দিয়েন না।

কারণ বাঙালি জাতি ৫২ ভাষা আন্দোলন ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধসহ ২৪ শে ফ্যাসিস শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত করতে সুতরাং আপনার সেই ভুল করবে না যাতে করে আপনার বিরুদ্ধে আমরা আবারো আন্দোলন সংগ্রাম করি এবং আপনি ক্ষমতা চূর্ণ হন। সুতরা অতি শীঘ্রই আপনি নির্বাচনের ব্যবস্থা করেন। 

মহানগর ১৪নং ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি হাজী মনির হোসেনের সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশিদ রানার সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক এড.

সাখাওয়াত হোসেন খান, প্রধান বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব এড. আবু আল ইউসুফ খান টিপু, বিশেষ অতিথি নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক এড. জাকির হোসেন, যুগ্ম আহ্বায়ক মনির হোসেন খান, যুগ্ম আহ্বায়ক ফতেহ মোহাম্মদ রেজা রিপন, সদর থানা বিএনপির সভাপতি মাসুদ রানা, সাধারণ সম্পাদক এড. এইচ এম আনোয়ার প্রধান।

এছাড়াও আরও উপস্থিত ছিলেন, মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য এড. রফিক আহমেদ, রাশিদা জামাল, মাকিত মোস্তাকিম শিপলু, মহানগর মহিলা দলের সভানেত্রী দিলারা মাসুদ ময়না, মহানগর যুবদলের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক মোয়াজ্জেম হোসেন মন্টি,১৪নং ওয়ার্ড বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক শওকত হোসেন প্রমুখ। 
 

উৎস: Narayanganj Times

কীওয়ার্ড: ব এনপ ন র য়ণগঞ জ ত র ক রহম ন গণতন ত র আওয় ম ল গ ত র ক রহম ন ব এনপ র স স ব ধ নত আম দ র ক ষমত আপন র সরক র সদস য

এছাড়াও পড়ুন:

প্রতিবিপ্লবী রাজনীতি ও গণমাধ্যম

গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে কামাল আহমেদের লেখা ও পর্যবেক্ষণ আমাদের সবার জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি লিখেছেন, ‘গণতন্ত্রকে প্রাণবন্ত ও কার্যকর করে তোলায় মুক্তবাজার অর্থনীতির যুগে শুধু রাষ্ট্রীয় প্রচারমাধ্যমের স্বায়ত্তশাসন যথেষ্ট নয়। ব্যক্তি খাতে গণমাধ্যমে কালোটাকার দৌরাত্ম্য, প্রভাবক ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ এবং নৈতিক মানের অনুপস্থিতির মতো বিষয়গুলোতে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ প্রয়োজন।’

তাঁর (কামাল আহমেদ) সঙ্গে আমরা একমত। তবে তিনি লিবারেল ইকোনমিক পলিসি নামে পরিচিত ‘মুক্তবাজার অর্থনীতির যুগ’কে যে ইতিবাচক চোখে দেখেন এবং নির্বিচার গ্রহণ করেন, আমি সেভাবে দেখি না, গ্রহণও করি না।

মুক্তবাজার অর্থনীতি গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে না। ইউরোপে বাজারব্যবস্থা বিকাশের সঙ্গে গণতন্ত্রের আবির্ভাব ও বিকাশের সম্বন্ধ আছে বটে, কিন্তু একালের কাছাখোলা মুক্তবাজার অর্থনীতি গণতন্ত্রের সহায়ক নয়; বরং গণতন্ত্রের, বিশেষত গণমাধ্যমের ঘাতক। পাশ্চাত্যের গণমাধ্যমগুলোর দিকে তাকালেই সেটা বোঝা যায়।

২.

কামাল আহমেদ ‘জুলাই সনদে কী থাকছে, কী থাকা উচিত’ (২৬ জুন ২০২৫) নিবন্ধটিতে অন্তর্বর্তী সরকারের ‘জুলাই ঘোষণা’ দিতে বাধা দেওয়া নিয়ে কিছু বলেননি। জনগণকে বাদ দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সমঝোতার দলিল হিসেবে ‘জুলাই সনদ’ ঘোষণার সিদ্ধান্তে কোনো রাজনৈতিক বা আইনি সমস্যা দেখেননি।

আরও পড়ুনজুলাই ঘোষণা, জুলাই সনদ এবং গণমাধ্যম২১ ঘণ্টা আগে

৫ আগস্টে গণ–অভ্যুত্থান হয়েছে, কিন্তু ৮ আগস্টে বিদ্যমান সংবিধান ও রাষ্ট্রব্যবস্থা বহাল রাখার সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ প্রতিবিপ্লবী রাজনীতির বৃত্তে প্রবেশ করে। কামাল আহমেদ ৮ আগস্টের সাংবিধানিক প্রতিবিপ্লব এবং পরবর্তী সময়ে জনগণকে সজ্ঞানে বাদ দেওয়ার প্রতিবিপ্লবী রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকেও ৫ আগস্ট থেকে আলাদা করতে পারেননি।

অন্তর্বর্তীকালীন উপদেষ্টা সরকার লুটেরা ও মাফিয়াশ্রেণির সঙ্গে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত করছে লুটেরা ও মাফিয়াশ্রেণির রাজনৈতিক আধিপত্য নিশ্চিত করার জন্য। এটাও তাঁর কাছে সমস্যা মনে হচ্ছে না।

৩.

রাজনৈতিক প্রতিনিধিদের জনগণের প্রতিনিধি গণ্য করা এবং তাঁদের সঙ্গেই আপসরফা করা আদতে পুরোনো ব্যবস্থাকেই পুনর্বাসিত করা। অধ্যাপক ইউনূস এই ভুল করছেন।

লুটেরা ও মাফিয়াশ্রেণির প্রতিনিধিদের সঙ্গেই আপসরফার প্রক্রিয়া গণ-অভ্যুত্থানের মর্মের বিরোধী এবং তিনি সেটা করছেন জনগণকে বাদ দিয়ে। এটাই প্রহসনের জায়গা। কারণ, এই লুটেরা ও মাফিয়াশ্রেণি যদি জনগণের প্রতিনিধি হতো, তাহলে তাদের নেতৃত্বেই গণ–অভ্যুত্থান হতো।

৮ আগস্টের সাংবিধানিক প্রতিবিপ্লবের পর তথাকথিত সংস্কার কমিশন ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন আদতে প্রতিবিপ্লবকেই বৈধতা ও ন্যায্যতা দেওয়ার প্রক্রিয়া।

‘জুলাই সনদ’ বানানোর প্রক্রিয়া জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের স্পিরিট বা মর্মের বিরোধী এবং সাংবিধানিক প্রতিবিপ্লবকে বৈধতা দেওয়ার রাজনৈতিক প্রক্রিয়া।

তথাকথিত জুলাই সনদ লুটেরা ও মাফিয়াশ্রেণির প্রতিনিধিদের সঙ্গে বন্দোবস্তের দলিলের অধিক কিছু নয়, অধিক কিছু হয়ে ওঠা অসম্ভব।

৪.

ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে প্রধান উপদেষ্টা ‘জুলাই ঘোষণা’ দিতে দেননি। ৬ জুন ২০২৫ তিনি জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে সব রাজনৈতিক দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে জুলাই মাসেই একটি ‘জুলাই সনদ’ প্রস্তুত করে জাতির সামনে উপস্থাপন করার কথা বলেছেন।

তিনি বলেছেন, তথাকথিত ‘জুলাই সনদে’ একটা জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্র নির্মাণের জন্য সংস্কার কমিশন যে প্রস্তাবগুলো দিয়েছে, সেগুলোর মধ্য থেকে রাজনৈতিক দলগুলো যে কটিতে একমত, তার তালিকা থাকবে। সেই জুলাই সনদে স্বাক্ষর করে রাজনৈতিক দলগুলো নাকি জাতির কাছে সেগুলো বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করবে।

ব্যস। এতগুলো মানুষ শহীদ হলো আর এতগুলো মানুষ পঙ্গুত্বের জীবন বরণ করে নিল কেন? লুটেরা ও মাফিয়াশ্রেণি নিজেদের
মধ্যে কোথায় কোন বিষয়ে একমত হলো, সেই সনদের জন্য?

যে রাজনৈতিক দলগুলো শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট শক্তি ও রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে কার্যত কিছুই করতে পারেনি, তারা এখন আমাদের ‘জাতীয় সনদ’ উপহার দেবে!

জুলাই সনদ সাংবিধানিক প্রতিবিপ্লবকে বৈধতা ও ন্যায্যতা দেওয়ার দলিল; গণ–অভ্যুত্থানের ঘোষণাকে নস্যাৎ করার প্রক্রিয়ার ধারাবাহিকতা।

‘জুলাই সনদ’ প্রকৃতপক্ষে ৫ আগস্টের মৌলিক গঠনতান্ত্রিক মুহূর্তকে (কনস্টিটুয়েন্ট মোমেন্ট) অস্বীকার করার কৌশল, যেখানে জনগণ বিদ্যমান রাষ্ট্রশক্তির বাইরে নতুন রাজনৈতিক কর্তৃত্ব হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল।

জুলাই ঘোষণার অধিকার কেড়ে নেওয়া মানে জনগণের অভিপ্রায় ও আকাঙ্ক্ষাকে ‘অদৃশ্য’ করে ফেলা।

৫.

জাতীয় ঐকমত্য কমিশন, তথাকথিত ‘সংস্কার কমিশন’, ‘জুলাই সনদ’ প্রভৃতি মূলত লুটেরা ও মাফিয়াশ্রেণির রাজনৈতিক প্রতিনিধি এবং বিদেশি স্বার্থান্বেষী শক্তির মধ্যকার নতুন বোঝাপড়ার প্রক্রিয়া ও দলিল।

এতে স্পষ্টতই জনগণের অভিপ্রায়ের কথা নেই, আছে ‘অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ’ করে রাস্তায় নামা জনগণকে বাদ দিয়ে ‘ঐকমত্যের নামে’ সংলাপভিত্তিক রাজনৈতিক ক্ষমতা পুনর্বিন্যাসের সমঝোতা।

কামাল আহমেদের লেখায় সংস্কারপন্থী বিবেচনা, যেমন বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন, পুলিশ, জনপ্রশাসন ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে ‘গণতন্ত্রের কার্যকারিতা’ স্থাপনের দাবি করা হয়েছে।

কিন্তু এগুলো এমন এক প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর সংস্কারচেষ্টা, যার মৌলিক ভিত্তি হলো জনগণ থেকে কর্তৃত্ব কেড়ে নিয়ে শাসকশ্রেণির মধ্যে
ভাগ করে দেওয়া। জনগণের রাজনৈতিক ক্ষমতা এখানে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত; বরং এই সংস্কার বিদ্যমান ফ্যাসিস্ট ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার একটা কারিগরি বা কৌশল।

কামাল আহমেদের লেখার সবচেয়ে বিপজ্জনক প্রবণতা হলো ‘সবার ঐকমত্যে নতুন বাংলাদেশ নির্মাণ’—এই ভাষ্য। বাস্তবে এই ‘ঐকমত্য’ কীভাবে নির্ধারিত হচ্ছে? কে ঠিক করছে, কোন সুপারিশ গ্রহণযোগ্য, কোনটি নয়?

জনগণের পক্ষ থেকে কোনো গণপরিষদ, গণশুনানি বা প্রতিনিয়ত সংলাপ তো দেখা যাচ্ছে না। জনগণকে বাদ দিয়ে রাজনৈতিক দলের মধ্যে ঐকমত্য স্থাপনের মধ্য দিয়ে যে ‘সনদ’ তৈরি হয়, তা কোনোভাবেই জনগণের সার্বভৌমত্ব কায়েম করতে পারে না।

৬.

কামাল আহমেদের লেখাটিতে গণমাধ্যম সংস্কারের ঘাটতি ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে যে উদ্বেগ জানানো হয়েছে, সেটা ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থার অভ্যন্তরে বসে এবং সেই ব্যবস্থাকে অক্ষত রেখে কিছু ‘নৈতিক সংশোধন’ কামনা করা।

কামাল আহেমদের চিন্তাভাবনার মধ্য দিয়ে সংবাদমাধ্যমকে একপ্রকারের ‘সরকারি বা করপোরেট স্বাধীনতা’ দেওয়ার চিন্তা ফুটে উঠেছে, যেখানে জনগণের তথ্য নিরীক্ষণের অধিকার ও জনগণের ভাষ্য নির্মাণের অধিকার মোটেও স্বীকৃত নয়।

কামাল আহমেদ শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি, নিরাপত্তা, অধিকার ইত্যাদি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। কিন্তু সেটা শূন্য বুলি ছাড়া কিছু হয়ে ওঠে না। কারণ, সাংবাদিক হিসেবে তিনি জানেন, এই তথাকথিত সনদ বা কমিশনের মধ্যে শ্রমিকদের কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই। এই অবস্থান শ্রমিকশ্রেণিকে ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে সরিয়ে রেখে তাদের আবার ‘সক্ষম শাসকদের দয়া’র অধীন করার চেষ্টা মাত্র।

৭.

‘সংস্কার’ কথাটির বিপজ্জনক ব্যবহার সংস্কারপন্থীরা বুঝলেও অনেকে বুঝতে পারেন না। ‘সংস্কার’ শব্দটি ব্যবহৃত হচ্ছে এমনভাবে, যেন শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থার দু–এক জায়গায় স্বল্প সংশোধন মানেই গণতন্ত্র। এতেই বুঝি জনগণের অধিকার আদায় হয়ে যাবে।

আসলে ‘সংস্কার’ কথাটি জনগণের অভ্যুত্থান, বিদ্রোহ কিংবা নতুন গঠনতান্ত্রিক শক্তির দাবিয়ে রাখা বা নির্মূল করার ভাষিক অস্ত্র। জনগণের সার্বভৌম অধিকার হলো নিজেদের নিজেরা রাজনৈতিকভাবে গঠন করার ক্ষমতা, নিজেদের গঠনতন্ত্র, রাষ্ট্রকাঠামো এবং বিশ্বব্যবস্থায় নিজেদের যোগ্য স্থান নির্ধারণের অধিকার—সেটা লুটেরা ও মাফিয়াশ্রেণির প্রতিনিধিদের রাজনৈতিক দলের ‘ঐকমত্যে’ বন্দী হতে পারে না।

৮.

কামাল আহমেদের লেখা গুরুত্বপূর্ণ হলেও শেষমেশ লেখাটি সাংবিধানিক প্রতিবিপ্লবকে কৌশলে রক্ষা করার একটি দুর্বল ভাষ্য হয়ে রইল, তার অধিক কিছু হয়ে উঠতে পারল না।

গণমাধ্যম শুধু জনগণের সামষ্টিক অভিপ্রায়ের কাছে জবাবদিহি করে, কিন্তু কোনো করপোরেট স্বার্থ, রাষ্ট্র, আমলাতন্ত্র বা পুলিশি ব্যবস্থার কাছে নয়। গণসার্বভৌমত্বের আলোকে চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা নিয়ে কীভাবে আমরা ভাবব এবং গণমাধ্যমে চর্চা করব, তার কোনো নীতি বা দিশা কামাল আহমেদ দিতে পারলেন না। জনগণের অভ্যুত্থান গণসার্বভৌমত্ব কায়েমের মধ্য দিয়ে নিজেদের নতুনভাবে গঠন এবং একটি গণতান্ত্রিক গঠনতন্ত্র প্রণয়নের প্রক্রিয়া শুরু করার জন্য এটা আমাদের প্রয়োজন।

৯.

জুলাই ঘোষণা হলো জনগণের নতুন গাঠনিক ক্ষমতার ঘোষণা; লুটেরা ও মাফিয়াশ্রেণির সঙ্গে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের জন্য জনগণ অকাতরে শহীদ হয়নি।

গণসার্বভৌমত্ব কায়েমের অভিপ্রায় এবং জনগণের সামষ্টিক গাঠনিক ক্ষমতা ও গঠনের কর্তব্য ইত্যাদি সবকিছুকে পাশ কাটিয়ে পুরোনো শাসকেরাই নতুন মুখোশ পরে পুরোনো ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থাই বহাল রাখছে।

একে বলা যায় প্রতিবিপ্লবকে (লিগ্যালাইজড কাউন্টার রেভল্যুশন) বৈধতা ও ন্যায্যতা দেওয়ার কৌশল। ফলে সংস্কারের নামে পুরোনো শাসকশ্রেণি ও শাসনকেই চিরস্থায়ী করার আয়োজন চলছে।

কিন্তু জনগণ কি তা মেনে নেবে?

ফরহাদ মজহার  কবি, লেখক ও চিন্তক

*মতামত লেখকের নিজস্ব

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • এ. কে. আজাদের বাড়িতে চড়াও হওয়ার ঘটনায় গণতন্ত্র মঞ্চের নিন্দা
  • এ. কে. আজাদের বাড়িতে চড়াও, গণতন্ত্র মঞ্চের নিন্দা
  • প্রতিবিপ্লবী রাজনীতি ও গণমাধ্যম
  • তিন যুগের লড়াইয়েও গণতন্ত্র অধরা মিয়ানমারে
  • জুলাইয়ের বিপ্লবী ছাত্র-জনতা ‘মব’ না: তথ্য উপদেষ্টা
  • শেখ হাসিনা বার বার জাতির সাথে বেইমানি করেছে : সালাম
  • আনুপাতিক ভোট আরও বেশি স্বৈরতন্ত্রের দিকে ঠেলে দেবে: রিজভী
  • বাকশাল থেকে বহুদলীয় গণতন্ত্রের রচনা বিএনপি করেছে: তারেক রহমান
  • কেউ কেউ হাসিনার ষড়যন্ত্রে পা দিয়েছে: দুদু