ইসরায়েলের আগ্রাসন যেভাবে ভীতিকর বিশ্বব্যবস্থা তৈরি করছে
Published: 22nd, June 2025 GMT
(মিডলইস্ট আইয়ে প্রকাশিত জোনাথন কুকের মতামতটির বাংলায় অনুবাদ প্রকাশিত হয় আজ রোববার প্রথম আলোর ছাপা সংস্করণে। যুক্তরাষ্ট্রের ইরান আক্রমণের মধ্য দিয়ে ইরান–ইসরায়েল সংঘাত নতুন মাত্রা পেয়েছে। প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় প্রথম আলোর অনলাইন সংস্করণে লেখাটি প্রকাশিত হলো।)
ইসরায়েলের স্পষ্টতই আক্রমণাত্মক যুদ্ধকে ‘আত্মরক্ষামূলক’ পদক্ষেপ হিসেবে উপস্থাপন করতে গিয়ে পশ্চিমা রাজনীতিবিদ ও গণমাধ্যম এক অসম্ভব কিছুকে বাস্তব হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টায় জট পাকিয়ে ফেলছে। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পর গাজায় গণহত্যা চালানোর ক্ষেত্রে ইসরায়েলের পক্ষে যেমন যুক্তি বা অজুহাত ছিল, এবার তেমন কিছু ছিল না।
কিন্তু পশ্চিমা বিশ্ব আবারও আনন্দের সঙ্গে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সেই পুরোনো দাবি ফিরিয়ে আনল, ইসরায়েল নাকি বাধ্য হয়েছে হামলা চালাতে। কারণ, ইরান পারমাণবিক বোমা তৈরির দ্বারপ্রান্তে ছিল। অথচ এই দাবি তিনি ১৯৯২ সাল থেকেই করে আসছেন এবং তার কোনোটিই বাস্তবতার সঙ্গে মেলেনি।
ইসরায়েল ইরানকে আঘাত করে ঠিক তখনই, যখন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রকাশ্যে আশা প্রকাশ করেছিলেন যে তেহরানের সঙ্গে একটি পারমাণবিক চুক্তি সম্ভব হতে পারে এবং যখন দুই দেশের আলোচকেরা আবার আলোচনায় বসার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। গত মার্চের শেষ দিকে ট্রাম্পের জাতীয় গোয়েন্দাপ্রধান তুলসী গ্যাবার্ড মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার বার্ষিক মূল্যায়নের অংশ হিসেবে স্পষ্টভাবে বলেছিলেন: ‘ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করছে না এবং সর্বোচ্চ নেতা (আলী) খামেনিই ২০০৩ সালে যে পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচি স্থগিত করেছিলেন, তা আবার অনুমোদন দেননি।’
এই সপ্তাহে সিএনএনকে দেওয়া তথ্যে এই মূল্যায়নের সঙ্গে পরিচিত চারটি সূত্র জানিয়েছে, ইরান কোনো বোমা তৈরি করছে না, তবে তারা যদি তাদের অবস্থান পরিবর্তন করে, তাহলেও তাদের একটি পারমাণবিক ‘ওয়ারহেড’ তৈরি ও লক্ষ্যে পাঠাতে কমপক্ষে তিন বছর সময় লাগবে। তবু ট্রাম্প ইসরায়েলের হামলায় যোগ দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে মনে হচ্ছে। তিনি প্রকাশ্যে নিজের গোয়েন্দাপ্রধানের মূল্যায়নকে অস্বীকার করেন, যুক্তরাজ্য ও স্পেন হয়ে মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন যুদ্ধবিমান পাঠান, ইরানের ‘নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ’ দাবি করেন এবং খামেনিকে হত্যারও আভাস দেন।
ইরানে হামলার জন্য ইসরায়েল যে অজুহাত তৈরি করেছে, সেটা ১৯৪৫ সালের ন্যুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনালে ‘সর্বোচ্চ আন্তর্জাতিক অপরাধ’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে বর্তমানে যেসব আলোচনা চলছে, সেগুলোর প্রয়োজনই হতো না, যদি না প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিজের প্রথম মেয়াদে ডোনাল্ড ট্রাম্প ইসরায়েলি চাপের মুখে পড়ে তেহরানের সঙ্গে করা চুক্তি বাতিল না করতেন।
ওই চুক্তি তাঁর পূর্বসূরি বারাক ওবামা করেছিলেন। যার উদ্দেশ্য ছিল, ইসরায়েলের ধারাবাহিক চাপ ও হামলার আহ্বানকে স্তিমিত করা। এই চুক্তির মধ্য দিয়ে তেহরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ এমন মাত্রায় সীমিত করা হয়েছিল, যা একটি বোমা তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় পর্যায়ে পৌঁছানোর আগেই বাধা দিত, একে বলা হতো ‘ব্রেকআউট পয়েন্ট’।
এর বিপরীতে ইসরায়েলকে অনুমতি দেওয়া হয়েছে কমপক্ষে ১০০টি পারমাণবিক ওয়ারহেড মজুত করে রাখার, যদিও তারা ইরানের মতো নয়; ইসরায়েল পারমাণবিক অস্ত্র নিষেধ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেনি এবং আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার পরিদর্শকদের প্রবেশও অস্বীকার করে আসছে।
পশ্চিমা দেশগুলোর এই ভণ্ডামিপূর্ণ সহযোগিতা, যেখানে তারা ইসরায়েলের পারমাণবিক অস্ত্রকে একটি ‘গোপন বিষয়’ হিসেবে দেখায়, যা ইসরায়েলের ভাষায় ‘অস্পষ্টতা’ নীতি; এর একমাত্র কারণ হলো, যুক্তরাষ্ট্র কোনো দেশকে সামরিক সহায়তা দিতে পারে না, যদি সেই দেশ পারমাণবিক অস্ত্র থাকার ঘোষণা দিয়ে থাকে। অথচ ইসরায়েল মার্কিন সহায়তার সবচেয়ে বড় গ্রহীতা।
কট্টর বর্ণবাদী ছাড়া কোনো বিবেকবান মানুষ কখনোই বিশ্বাস করেন না যে যদি পারমাণবিক অস্ত্র থেকে থাকেও ইরান এমনকি আত্মঘাতী হয়েও ইসরায়েলের দিকে তা ছুড়ে মারবে। ইসরায়েল বা যুক্তরাষ্ট্রের আসল উদ্বেগের জায়গা এটি নয়। সত্যি কথা হলো, এই দ্বিমুখী নীতিমালা বলবৎ রাখা হয়েছে যেন ইসরায়েল মধ্যপ্রাচ্যে একমাত্র পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র হিসেবে থেকে যায়, যাতে তারা নির্বিঘ্নে তাদের সামরিক আধিপত্য বজায় রাখতে পারে। বিশেষ করে এই তেলসমৃদ্ধ অঞ্চলটিকে যেকোনো মূল্যে নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায় পশ্চিমা বিশ্ব।
ইসরায়েলের পারমাণবিক অস্ত্রভান্ডার দেশটিকে একরকম অপ্রতিরোধ্য ও জবাবদিহিহীন করে তুলেছে। এর ফলে তারা তাদের প্রতিবেশীদের ভয় দেখাতে পারে এমন হুমকি দিয়ে, অস্তিত্বগত হুমকির মুখে পড়লে তারা পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করবে। ইসরায়েলের জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী ইতামার বেন গেভির এ সপ্তাহে ইরানের উদ্দেশে এমন এক হুমকির ইঙ্গিত দিয়েছেন: ‘ভবিষ্যতে আরও কঠিন দিন আসছে, কিন্তু হিরোশিমা ও নাগাসাকির কথা সব সময় মনে রাখবেন।’
বুঝতে হবে, ইসরায়েল সরকার যেকোনো হুমকিকে ‘অস্তিত্বগত হুমকি’ হিসেবে বিবেচনা করে, এমনকি সেটা যদি হয় তাদের বর্তমান উপনিবেশবাদী রাষ্ট্র হিসেবে টিকে থাকার বিরুদ্ধে কোনো প্রতিরোধ বা ফিলিস্তিনিদের নিজ ভূমিতে ফিরে আসার চেষ্টা। এ পারমাণবিক অস্ত্রই ইসরায়েলকে আঞ্চলিকভাবে যা খুশি তা–ই করার স্বাধীনতা দিয়েছে, যার মধ্যে গাজায় গণহত্যা চালানোও রয়েছে এবং তা কোনো জবাবদিহি বা পাল্টা আঘাতের ভয় ছাড়াই।
ইসরায়েল যে ইরানে হামলা চালিয়ে ‘নিজেকে রক্ষা করছে’—এই দাবি ফ্রান্স, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জি-৭ এবং যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সমর্থন পেয়েছে; এটা আন্তর্জাতিক আইনের মৌলিক নীতিগুলোর ওপর আরও একটি আঘাত হিসেবে দেখা উচিত।
দাবিটি দাঁড় করানো হয়েছে এই যুক্তির ওপর যে ইসরায়েলের হামলাটি ছিল ‘প্রতিষেধকমূলক’ (প্রিএমটিভ); অর্থাৎ এটা তখনই আইনসম্মত হতে পারে, যদি ইসরায়েল প্রমাণ করতে পারে যে ইরান থেকে একটি আসন্ন, বিশ্বাসযোগ্য ও গুরুতর হামলার হুমকি ছিল এবং যেটা অন্য কোনো উপায়ে ঠেকানো যেত না।
এমনকি যদি আমরা ধরে নিই, ইসরায়েলের এমন কোনো প্রমাণ আছে (যা আদতে নেই), তবু এটা সত্য যে ইরান তখন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে আলোচনায় ব্যস্ত ছিল। এটা সেই ‘প্রতিষেধকমূলক’ হামলার যুক্তিকে অকার্যকর করে তোলে। এর বদলে ইসরায়েলের যে দাবি, ইরান ভবিষ্যতে কখনো হুমকি হয়ে উঠতে পারে এবং সেই হুমকি এখনই নিরস্ত করতে হবে, এটা আন্তর্জাতিক আইনের দৃষ্টিতে নিঃসন্দেহে অবৈধ।
ইসরায়েলের ইরানে হামলা আরও নানাভাবে আন্তর্জাতিক আইনের নির্লজ্জ লঙ্ঘন। নেতানিয়াহু, যিনি এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের চোখে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য পলাতক, গাজার জনগণকে ক্ষুধার মাধ্যমে হত্যা করার দায়ে অভিযুক্ত, তিনি এখন সর্বোচ্চ আন্তর্জাতিক অপরাধের দায়েও অপরাধী।
তবে এসব কিছুই জানা যাবে না, যদি কেউ শুধু পশ্চিমা রাজনীতিক কিংবা ধনকুবেরদের মালিকানাধীন গণমাধ্যমের কথা শোনেন। সেখানে আবারও একই পুরোনো কাহিনি: ‘একটি সাহসী ইসরায়েল, একা লড়ছে; এক অস্তিত্বগত হুমকি মোকাবিলা করছে; বর্বর সন্ত্রাসীদের দ্বারা হুমকির শিকার হচ্ছে; ইসরায়েলি জনগণের অনন্য দুর্ভোগ আর মানবতা; আর নেতানিয়াহু একজন শক্তিশালী নেতা, যুদ্ধাপরাধী নন।’
বাস্তবতা বা প্রেক্ষাপট যা–ই হোক না কেন, এই একই নাটকীয় গল্প বারবার চালানো হয়। আর এটিই যথেষ্ট প্রমাণ যে পশ্চিমা দর্শকেরা প্রকৃত সত্য জানতে পারছেন না; বরং তাঁরা নতুন এক যুদ্ধপ্রচার অভিযানের শিকার।
ইসরায়েলের আগ্রাসী যুদ্ধের ভিত্তি বা অজুহাতগুলো একটি চলমান লক্ষ্য, যা ধরা কঠিন। কারণ, তা বারবার পরিবর্তিত হচ্ছে। যদি নেতানিয়াহু শুরুতে দাবি করেন যে ইরানের পরমাণু কর্মসূচি একটি আসন্ন হুমকি, তবে তিনি দ্রুতই যুক্তি দেন যে ইরানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচির সম্ভাব্য হুমকি দূর করাও ইসরায়েলের আগ্রাসী যুদ্ধের কারণ ছিল।
সর্বোচ্চ অহংকারের এক দৃষ্টান্ত হিসেবে, ইসরায়েল প্রমাণ হিসেবে উল্লেখ করেছে যে তারা ইরানের ক্ষেপণাস্ত্রের জবাব দিচ্ছে, যা তেহরান থেকে ইসরায়েলের ওপর ক্ষেপণাস্ত্র বর্ষণের সরাসরি প্রতিক্রিয়া হিসেবে চালানো হয়েছে। ইসরায়েলের নাগরিকদের মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ার ব্যাপারে তাদের আপত্তি দুটি অস্বস্তিকর সত্যকে উপেক্ষা করেছে, যা ইসরায়েলের দ্বিচারিতাকে স্পষ্ট করে তুলত, যদি পশ্চিমা মিডিয়া তা লুকিয়ে রাখতে এত চেষ্টা না করত।
প্রথমত, ইসরায়েল তার নিজের বেসামরিক জনসংখ্যাকে ‘মানবঢাল’ হিসেবে ব্যবহার করেছে। কারণ, তাদের গুরুত্বপূর্ণ সামরিক প্রতিষ্ঠান, যেমন গুপ্তচর সংস্থা ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ঘনবসতিপূর্ণ তেল আবিবের কেন্দ্রে অবস্থিত এবং তারা শহরের ভেতর থেকে রকেট প্রতিরক্ষা চালাচ্ছে। স্মরণ করুন, গত ২০ মাসে ইসরায়েল হামাসকে দায়ী করেছে গাজার অসংখ্য ফিলিস্তিনির মৃত্যুর জন্য; এটি মূলত একটি প্রমাণহীন দাবি যে হামাসের যোদ্ধারা জনসাধারণের মধ্যে লুকিয়ে ছিলেন। এখন সেই একই যুক্তি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করা যেতে পারে ও সেটা করা উচিত।
দ্বিতীয়ত, ইসরায়েল স্পষ্টভাবে নিজেই ইরানের আবাসিক এলাকাগুলো লক্ষ্যবস্তু করছে, ঠিক যেমন আগে গাজার প্রায় সব বাড়িঘর, হাসপাতাল, স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয় ও বেকারিগুলো ধ্বংস করেছিল। নেতানিয়াহু ও ট্রাম্প—উভয়ই ইরানিদের তেহরান শহর তৎক্ষণাৎ ত্যাগ করার আহ্বান জানিয়েছেন, যা প্রায় এক কোটি মানুষের জন্য খুব কম সময়ে অসম্ভব। তাদের এই দাবি একটি প্রশ্ন তোলে: যদি ইসরায়েল ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির চেষ্টা বন্ধ করতে চায়, তাহলে কেন তারা তেহরানের আবাসিক এলাকাগুলোয় এত বেশি হামলা করছে?
সাধারণভাবে ইসরায়েলের যুক্তি, তেহরানকে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র থেকে বঞ্চিত করতে হবে। এর মানে, শুধু ইসরায়েল ও তার মিত্রদেরই কোনো ধরনের সামরিক প্রতিরোধক্ষমতা থাকার অনুমতি রয়েছে। এ থেকে মনে হচ্ছে, ইরানকে শুধু পারমাণবিক অস্ত্র সংগ্রহে বাধা দেওয়া হয় না, ইসরায়েল যখন যুক্তরাষ্ট্রের সরবরাহ করা ক্ষেপণাস্ত্র তেহরানের দিকে ছুড়ছে, ইরানকে তা তখন প্রতিহত করার সুযোগও দেওয়া হবে না।
ইসরায়েল কার্যত চাচ্ছে ইরানকে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের বড় সংস্করণে পরিণত করতে: একটি আনুগত্যশীল, হালকা সশস্ত্র শাসনব্যবস্থা, যা সম্পূর্ণরূপে ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণে থাকবে। এটাই মূলত ইসরায়েলের বর্তমান ইরান হামলার লক্ষ্য: তেহরানে ক্ষমতার পরিবর্তন ঘটানো।
খামেনির পরবর্তী সর্বোচ্চ নেতা আলী খামেনি ২০০৩ সালে একটি ধর্মীয় ঘোষণা জারি করেছিলেন, যার মধ্য দিয়ে ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি থেকে বিরত থাকতে বলা হয়। তিনি এটিকে ইসলামিক আইনের লঙ্ঘন হিসেবে বিবেচনা করেন। এ কারণেই ইরান বোমা তৈরি করতে অনিচ্ছুক ছিল বলে ধারণা করা হয়।
ইরান এর পরিবর্তে দুটি কাজ করেছে, যা আসলেই ইসরায়েলের আগ্রাসন যুদ্ধের মূল কারণ। প্রথমত, ইরান নিজেকে ইসরায়েলি ও পশ্চিমা আগ্রাসন থেকে রক্ষার জন্য সব থেকে উন্নত বিকল্প সামরিক কৌশল তৈরি করেছে। দ্বিতীয়ত, শিয়া নেতৃত্বাধীন একটি রাষ্ট্র হিসেবে ইরান লেবানন, সিরিয়া, ইরাক, ইয়েমেন এবং অন্যান্য জায়গায় থাকা একই সম্প্রদায়ের মানুষের সঙ্গে এটি শক্তিশালী সম্পর্ক গড়ে তুলেছে।
ইরানের নেতারা বুঝতে পেরেছিলেন যে তাঁরা লক্ষ্যবস্তু। ইরানের প্রচুর তেল ও গ্যাস মজুত রয়েছে। কিন্তু প্রতিবেশী আরব অঞ্চলের শাসক দলের মতো এটি পশ্চিমের পুতুল নয়। তারা হরমুজ প্রণালির প্রধান প্রবেশদ্বার বন্ধ করার ক্ষমতাও রাখে, যার মাধ্যমে তেল ও গ্যাস পশ্চিমা বিশ্ব ও এশিয়ায় সরবরাহ করা হয়।
ইসরায়েলের আরেকটি উদ্বেগ ছিল, ইরান ও তার মিত্ররা ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতি ইসরায়েলের কয়েক দশকের দখল ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে দৃঢ় সমর্থন প্রকাশ করেছে। ইরান অবরুদ্ধ গাজায় হামাসকে সাহায্য প্রদান করেছিল, যা এখনো ইসরায়েলের বর্ণবৈষম্যমূলক শাসন ও জাতিগত উৎখাতের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে প্রস্তুত প্রধান ফিলিস্তিনি সংগঠন।
ইসরায়েলের অবরোধে দমবন্ধ হয়ে হামাস এক দিনের জন্য গাজার কনসেনট্রেশন ক্যাম্প থেকে বের হয়ে শক্তির প্রদর্শনী করে। ইসরায়েল এই সুযোগে দুটি কাজ সম্পন্ন করার সিদ্ধান্ত নেয়: এক.
ইসরায়েল শুরু করে গাজা ধ্বংস করার মধ্য দিয়ে, সেখানকার জনগণকে হত্যা ও দুর্ভিক্ষপীড়িত করার মধ্য দিয়ে। এরপর ইসরায়েল লেবাননের হিজবুল্লাহকে দুর্বল করার দিকে এগোয়। সিরিয়ার বাশার আল-আসাদশাসনের পতনের পর ইসরায়েল সিরিয়ার কিছু অংশ দখল করতে সক্ষম হয়; সামরিক অবকাঠামোর অবশিষ্টাংশ ধ্বংস করে এবং ইরানে বিমান হামলার পথ পরিষ্কার করে। এ সবই ছিল ইরানের বিরুদ্ধে চলমান আগ্রাসন যুদ্ধ শুরু করার পূর্বশর্ত।
ইসরায়েলের সফলতা আসতে পারে দুটি উপায়ে: তেহরানে একটি নতুন কর্তৃত্ববাদী শাসককে ক্ষমতায় বসানোর মাধ্যমে, যেমন শাহের ছেলে, যিনি ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের আদেশ পালন করবেন। অথবা ইসরায়েল ইরানকে এতটাই ধ্বংসস্তূপে পরিণত করবে যে সেখানে জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সংঘাত বৃদ্ধি পাবে, দেশটি গৃহযুদ্ধের আবর্তে নিমজ্জিত থাকবে এবং তখন তারা পারমাণবিক বোমা তৈরির বা প্রতিরোধ সংগঠনের জন্য শক্তি ব্যয় করতে পারবে না।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত এটি মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্র শুধু নতুন করে আঁকার বিষয় নয় এবং কেবল তেহরানের শাসকদের উৎখাতের বিষয়ও নয়, এটি পেন্টাগনের ‘বিশ্বব্যাপী পূর্ণাঙ্গ আধিপত্য’ পরিকল্পনার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটি এমন একটি বিশ্ব, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা আন্তর্জাতিক আইনের ঊর্ধ্বে থাকবে; যদি আপনি মানবাধিকার, ক্ষমতার জবাবদিহি, সামরিক আগ্রাসনের আগে কূটনীতির ব্যবহার ও স্বাধীনতায় বিশ্বাসী হন, তাহলে এই ‘নতুন বিশ্ব’ আপনার জন্য নিশ্চিতভাবে ভীতিকর হবে।
মিডলইস্ট আই থেকে নেওয়া
জোনাথন কুক সাংবাদিক ও ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংঘাত নিয়ে তিনটি বইয়ের লেখক।
সংক্ষিপ্তকরণ ও অনুবাদ মনজুরুল ইসলাম
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: য ক তর ষ ট র র ল র আগ র স ধ ব স কর কর ছ ল ন ইসর য় ল লক ষ য র জন য প রক শ এই দ ব ক ষমত ইসর য ন ইসর অপর ধ
এছাড়াও পড়ুন:
ঘুষে চলে যায় বরাদ্দের অর্ধেক
সড়ক পাকাকরণের কাজ হয়েছে ৬০ শতাংশ। ঠিকাদার মোট বিলের ৮০ শতাংশ তুলে নিয়ে তিন বছর ধরে লাপাত্তা। এক কিলোমিটার সড়ক পাকাকরণের কাজ থমকে যাওয়ায় দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে পথচারীদের।
এ চিত্র দেখা গেছে সিরাজগঞ্জের তাড়াশে নওগাঁ মাজার থেকে রংমহল পর্যন্ত প্রায় এক কিলোমিটার সড়কের। ইতোমধ্যে সড়কে বিছানো খোয়া উঠে গেছে। ধুলাবালি জমে সামান্য বৃষ্টিতে কাদাপানিতে একাকার সড়ক।
এ বিষয়ে কথা বলতে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স সাব্বির এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী আলম হোসেনের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল দেওয়া হয়। এক পর্যায়ে কল রিসিভ করলেও তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একজন জানান, কার্যাদেশ পাওয়ার মোট বরাদ্দের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ প্রকৌশলী, অফিস সহকারীসহ বিভিন্ন জনকে দিতে হয়। কাজ চলাকালে উপজেলা প্রকৌশল অফিসের যেসব কর্মকর্তা বা কর্মচারী সাইটে যান, তাদের ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকা হাজিরা হিসাবে দিতে হয়। এভাবে বরাদ্দের অর্ধেক টাকা চলে যায় ঘুষের পেছনে। যে টাকা থাকে, তা দিয়ে মানসম্মত কাজ করা সম্ভব হয় না। এ কারণে অনেক ঠিকাদার কিছুদিন কাজ করার পর বরাদ্দের টাকা তুলে লাপাত্তা হয়ে যান। কর্তারা তাদের কীভাবে বিল ছাড় করেন, তারাই বলতে পারবেন। অবৈধ আর্থিক লেনদেনের বিষয়টি উপজেলা প্রকৌশল অফিসের কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী স্বীকার করেননি।
২০২১-২২ অর্থবছরে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গুরুত্বপূর্ণ পল্লি অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প ৩-এর আওতায় নওগাঁ ইউনিয়নের নওগাঁ মাজার থেকে রংমহল পর্যন্ত এক কিলোমিটার সড়ক পাকাকরণের উদ্যোগ নেয় স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)। এ কাজের প্রাক্কলিত ব্যয় নির্ধারণ করা হয় ৬৯ লাখ ৫৯ হাজার ৮৯৪ টাকা। সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে ৬৬ লাখ ১১ হাজার ৮৯৯ টাকায় কার্যাদেশ পায় মেসার্স সাব্বির এন্টারপ্রাইজ। ২০২২ সালের ৩০ জুলাইয়ের মধ্যে কাজ শেষ করার কথা। এর পর তিন বছর পেরিয়ে গেলেও তা শেষ হয়নি।
২০২১ সালের ২২ অক্টোবর তৎকালিন সংসদ সদস্য অধ্যাপক ডা. আব্দুল আজিজ সড়ক পাকাকরণ কাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। এর পর ঠিকাদার সড়কের উভয় পাশে মাটি খুঁড়ে বালু ফেলে খোয়া বিছিয়ে দেন। এর মধ্যে সড়কের কাজ হয়েছে ৬০ শতাংশ। কিন্তু ঠিকাদার ৮০ শতাংশ কাজের বিল তুলে লাপাত্তা। তিন বছর ধরে সড়কটি বেহাল পড়ে আছে।
সড়কের কাজ শেষ করতে এলজিইডি কর্তৃপক্ষ বারবার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে চিঠি দিলেও
সাড়া মেলেনি। নিরুপায় হয়ে সংশ্লিষ্ট বিভাগ কার্যাদেশ বাতিল করেছে। এখন চলছে পুনঃদরপত্র আহ্বানের প্রক্রিয়া।
সড়কটি দিয়ে নওগাঁয় হজরত শাহ শরিফ জিন্দানী (র.)-এর মাজার, নওগাঁ জিন্দানী ডিগ্রি কলেজ, নওগাঁ ফাজিল মাদ্রাসা, নওগাঁ হাটবাজার, নওগাঁ সোনালী ব্যাংক, নওগাঁ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ নানা গুরুত্বপূর্ণ অফিসে যাতায়াত করতে হয়।
উপজেলা প্রকৌশলী ফজলুল হক বলেন, ‘প্রকল্প পরিচালক সড়কটি পরিদর্শন করেছেন। ঠিকাদার প্যালাসাইডিং, সাববেজ, সেন্ট ফিলিং ও ডব্লিউবিএম করেছে। সে অনুযায়ী বিল পাঠিয়েছি। বাকি কাজ না করায় বেশ কয়েকবার তাগাদা দিয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। সাড়া না পাওয়ায় ঠিকাদারের চুক্তিপত্র বাতিল করা হয়েছে।’