তিন দিকে মোড় নিতে পারে সংঘাত পরিস্থিতি
Published: 22nd, June 2025 GMT
ইরানে যুক্তরাষ্ট্রের হামলার পর মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাত পরিস্থিতি যে কোনো সময় নতুন দিকে মোড় নিতে পারে। এ ক্ষেত্রে তিনটি পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। ইরান হামলা বাড়িয়ে দিতে পারে অথবা রণে ভঙ্গ দেওয়ার কৌশল নিতে পারে এবং যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে সংঘাত থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারে। দ্য কনভারসেশনের বিশ্লেষণে এসব কথা বলা হয়েছে।
রোববার ভোরে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের ফর্দো, নাতাঞ্জ ও ইস্পাহান পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালায়। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েল গাজায় যে হামলা শুরু করেছিল, এই হামলা সেই ধারাবাহিকতার অংশ। এর পর ইসরায়েল ধারাবাহিকভাবে ইরানসমর্থিত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে দুর্বল করে ফেলার কৌশল নেয়। গাজায় হামাসকে দমানোর পর তারা লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহকে দুর্বল করে ফেলে। এর পর সিরিয়ায় হামলা করে ইরানকে পিছু হটাতে বাধ্য করে। ফলে সিরিয়ায় ইরানসমর্থিত আসাদ সরকারের পতন ঘটে।
ইরান বরাবরই শক্তিশালী ভূমিকায় ছিল। ইসরায়েলের সঙ্গে সংঘাতেও দেশটি ব্যাপক শক্তি প্রদর্শন করে। এই অবস্থায় নেতানিয়াহু মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ওপর ইরানে হামলার জন্য চাপ সৃষ্টি করেন। ট্রাম্প নেতানিয়াহুর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেই ৩০ হাজার পাউন্ডের বাঙ্কার বাস্টার বোমা হামলা চালান ইরানে। এই হামলার পর ট্রাম্পের কড়া সমালোচনা করেছেন বিশ্বনেতারা।
বড় হামলার কৌশল নিতে পারে ইরান
যুক্তরাষ্ট্রের হামলার পরিপ্রেক্ষিতে ইরান নিজের শক্তি প্রদর্শনে ব্যাপক পরিসরে হামলা চালানোর নীতি গ্রহণ করতে পারে। যদিও তারা জানে, যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়াই করে টিকে থাকার শক্তি তাদের নেই। তার পরও ইরানি জনগণকে আশ্বস্ত করতে প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে উঠতে পারে দেশটি। সর্বোচ্চ নেতা আলি খামেনির নীতি এটাই। এর আগেও একই নীতি গ্রহণ করেছিল ইরান। ২০২০ সালে যখন ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পসের প্রধান কাসেম সোলেইমানিকে হত্যা করেছিল যুক্তরাষ্ট্র, তখনও প্রতিশোধ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল তেহরান। পরবর্তী সময়ে মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে বড় হামলা হয়। কোনো মার্কিন সেনা নিহত না হলেও কৌশলে অবকাঠামো গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। এবারও একই কৌশল নিতে পারে ইরান। তবে এবার মার্কিন ঘাঁটি লক্ষ্যবস্তু নাও বানাতে পারে তারা। এ ক্ষেত্রে ইসরায়েলের ওপর ধারাবাহিক ও বড় হামলা অব্যাহত রাখতে পারে। আর এটা নির্ভর করবে তাদের হাতে কতগুলো ক্ষেপণাস্ত্র বা ড্রোন রয়েছে তার ওপর। কারণ, ইতোমধ্যে ৪০০টির বেশি ক্ষেপণাস্ত্র তারা ব্যবহার করে ফেলেছে। ফলে সমরাস্ত্রের মজুত কমে যাচ্ছে।
রণে ভঙ্গ দিতে পারে তেহরান
ইরানের সামনে সংঘাত থেকে পিছু হটার কৌশলও রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র হামলা করার আগে ইরান বারবার বলে আসছিল, ইসরায়েল হামলা বন্ধ করলে তারাও হামলা বন্ধ করে দেবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশটি আপসের পথ গ্রহণ করতে পারে। ইসরায়েল যুদ্ধবিরতি ঘোষণা দিলে তারা আবারও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পারমাণবিক কর্মসূচিতে একটি চুক্তিতে পৌঁছাতে রাজি হতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে সমস্যা করবে ইসরায়েল। নেতানিয়াহু পরমাণু আলোচনা চালিয়ে যাওয়ায় বিশ্বাসী নন। ইসরায়েল পরমাণু কর্মসূচির সম্পূর্ণ ধ্বংস দাবি করে হামলা চালিয়ে যাওয়ার নীতি নিয়েছে। ফলে চতুর নেতানিয়াহু ইরানের জ্বালানি অবকাঠামোসহ বেসামরিক স্থাপনায় হামলা অব্যাহত রাখতে পারে। আশির দশকে ইরাকের সঙ্গে যুদ্ধের সময়ও ইরান রণে ভঙ্গ দিয়েছিল মার্কিন ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর। পরবর্তী সময়ে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে যুদ্ধবিরতিতে যায় তেহরান। চলমান সংঘাতের ক্ষেত্রেও দেশটি একই কৌশল নিতে পারে। খামেনি তাঁর শাসন ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে ও সমরাস্ত্র সক্ষমতার কথা বিবেচনা করে পিছু হটার কৌশল নিতে পারেন।
সংঘাত থেকে বিরত থাকতে পারে যুক্তরাষ্ট্র
চলমান সংঘাত থেকে যুক্তরাষ্ট্র যদি নিজেকে সরিয়ে নেয়, তাহলে যুদ্ধ পরিস্থিতি শান্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। দ্য ইকোনমিস্টের সাম্প্রতিক জরিপে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ুক তা চায় না ট্রাম্পের রিপাবলিকান দলের ৫৩ শতাংশ সমর্থক। যুদ্ধের পক্ষে মাত্র ১৬ শতাংশের অবস্থান। এই অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের ইরানে হামলার বিষয়টি জনপ্রিয়তা পায়নি, তা স্পষ্ট। বরং আলোচনার মাধ্যমে সংঘাত বন্ধের পদক্ষেপ নিলে ট্রাম্পকে দেশটির জনগণ স্বাগত জানাতে প্রস্তুত। সংঘাতে ওয়াশিংটন যদি আরও জড়িয়ে পড়ে কিংবা মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন স্বার্থের ওপর হামলা হয়, তাহলে নাগরিকদের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সম্মুখীন হবে ট্রাম্প প্রশাসন। তাছাড়া ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি সম্পূর্ণ ধ্বংস হবে কিনা, তাও অজানা। দেশটি নতুন করে আগামীতে কর্মসূচি চালিয়ে নিতেও পারে। এই বিষয়টিও যুক্তরাষ্ট্রকে যুদ্ধ থেকে বিরত রাখতে পারে।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ইসর য় ল য ক তর ষ ট র র পর স থ ত ইসর য় ল র ওপর
এছাড়াও পড়ুন:
বিবাহে ‘মোহরে ফাতেমি‘ কী?
“মোহরে ফাতেমি” মুসলিম বিবাহে একটি বহুল আলোচিত ধারণা, যাকে মূলত নারীর অধিকার, সম্মান ও আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রতীক বলা যায়।
‘মোহর’ বা ‘মাহর’ শব্দটি আরবি “মাহর” থেকে এসেছে, যার অর্থ, স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে নির্ধারিত অর্থ বা সম্পদ, যা বিবাহের অধিকার হিসেবে বাধ্যতামূলকভাবে প্রদান করতে হয়।
‘মোহরে ফাতেমি’ বলতে বোঝানো হয় সেই পরিমাণ মাহর, যা নবীজি (স.) তাঁর কন্যা ফাতিমা (রা.)-এর বিয়েতে নির্ধারণ করেছিলেন। এটি মুসলিম ইতিহাসে আদর্শ মাহরের মানদণ্ড হিসেবে বিবেচিত হয়।
মোহরে ফাতেমির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
রাসুলুল্লাহ (স.)-এর কন্যা ফাতিমা (রা.)-এর বিয়ে হয়েছিল আলী ইবনে আবি তালিব (রা.)-এর সঙ্গে। এই বিয়েতে নবীজি (স.) যে পরিমাণ মোহর নির্ধারণ করেছিলেন, সেটিই পরে “মোহরে ফাতেমি” নামে পরিচিত হয়।
ইমাম বায়হাকি ও ইবনে মাজাহ-এর বর্ণনা অনুযায়ী, মোহরে ফাতেমি ছিল ৫০০ দিরহাম রূপা (প্রায় ১.৫ কেজি রূপা)। (সুনান ইবনে মাজাহ, হাদিস: ১৮৮৭; আল-বায়হাকি, আস-সুনান আল-কুবরা, খণ্ড ৭, পৃ. ২৩৩)
আরও পড়ুনমুসলিম বিবাহে ‘কুফু’ অর্থ কী২৩ অক্টোবর ২০২৫মোহরের গুরুত্ব
কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, “তোমরা নারীদের মাহর (মোহরানা) স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রদান করো।” (সুরা আন-নিসা, আয়াত: ৪)
অর্থাৎ, এটি কোনো উপহার নয়, বরং স্ত্রীর ন্যায্য অধিকার।
নবীজি (স.) বলেছেন, “সবচেয়ে উত্তম বিবাহ হলো সেই বিবাহ, যার মোহর সবচেয়ে সহজ।” (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস: ১৮৮৭)
এই হাদিস থেকে বোঝা যায়, ইসলাম চায় না মোহর এমন ভারী হোক যাতে বিবাহ কঠিন হয়ে যায়। বরং, সহজ, পরিমিত ও সম্মানজনক পরিমাণ হওয়াই সুন্নাহ।
মোহরে ফাতেমির প্রতীকী অর্থ
“মোহরে ফাতেমি” কেবল একটি অর্থমূল্য নয়, বরং এটি মুসলিম সমাজে নারীর মর্যাদা ও আত্মসম্মানের প্রতীক। এর মাধ্যমে নবীজি (স.) মুসলিম সমাজকে একটি বার্তা দিয়েছেন যে, নারী কোনো বোঝা নয়, বরং মর্যাদাপূর্ণ একজন মানুষ, যার নিজের অধিকার আল্লাহ নির্ধারণ করেছেন।
একইসাথে এটি ইসলামে সামাজিক ভারসাম্যের একটি নিদর্শন—যেখানে মোহর এমন নির্ধারণ করা হয়, যা গরিব ও ধনীর উভয়ের জন্যই বাস্তবসম্মত।
মোহরে ফাতেমির আর্থিক মান
ইতিহাসবিদ ইমাম নববী ও ইবনে হাজার আসকালানি উল্লেখ করেছেন, এক দিরহাম প্রায় ২.৯৭৫ গ্রাম রূপা সমান।
তাহলে ৫০০ দিরহাম × ২.৯৭৫ গ্রাম = প্রায় ১৪৮৭.৫ গ্রাম (১.৫ কেজি রূপা)।
বর্তমান সময়ের হিসাবে, বাংলাদেশে যদি প্রতি ভরি (প্রায় ১১.৬৬ গ্রাম) রূপার দাম ধরা হয় প্রায় ১৫০০ টাকা, তাহলে মোহরে ফাতেমির আর্থিক মান দাঁড়ায় প্রায় ১ লক্ষ ৯০ হাজার টাকা। বাজারদর অনুসারে পরিবর্তনশীল।
এই হিসাব শুধুমাত্র একটি রেফারেন্স—মূল উদ্দেশ্য হলো, মাহর যেন পরিমিত, বাস্তবসম্মত ও সম্মানজনক হয়।
আরও পড়ুননারীর প্রতি সহিংসতা নিয়ে কী বলে ইসলাম২৮ আগস্ট ২০২৫মোহরে ফাতেমি কি বাধ্যতামূলক?
না, মোহরে ফাতেমি বাধ্যতামূলক নয়। ইসলামি শরিয়তে প্রতিটি বিবাহের মোহর দুই পক্ষের আর্থিক ও সামাজিক অবস্থার ওপর নির্ভরশীল।
তবে নবীজি (স.)-এর কন্যার মোহরকে আদর্শ ধরা হয়, কারণ এটি বিনয়, সরলতা ও ন্যায়ের প্রতীক। ইমাম আবু হানিফা (রহ.) বলেন, “মোহরে ফাতেমি একটি সুন্নাহস্বরূপ নির্ধারণ। চাইলে এর কম বা বেশি নির্ধারণ করা বৈধ।” (আল-ফাতাওয়া আল-হিন্দিয়া, খণ্ড ১, পৃ. ২৯৪, দারুল ইহইয়া, কায়রো সংস্করণ)
অতএব, কেউ মোহরে ফাতেমি পরিমাণ নির্ধারণ করলে তা মুস্তাহাব (পছন্দনীয়), কিন্তু তার চেয়ে কম বা বেশি করলেও বিবাহ বৈধ।
আধুনিক প্রেক্ষাপটে মোহরে ফাতেমির তাৎপর্য
বর্তমান সমাজে অনেকেই মোহরকে “আনুষ্ঠানিকতা” মনে করেন, আবার কেউ কেউ মোহরকে “চাপ বা মূল্য” হিসেবে বিবেচনা করেন—যা ইসলামের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ ভুল।
মোহর নারীর আত্মসম্মানের প্রতীক, পুরুষের দায়িত্ববোধের প্রকাশ এবং বিবাহ বন্ধনের আর্থিক নিশ্চয়তা।
একজন আধুনিক মুসলিম নারী হিসেবে ফাতিমা (রা.) ছিলেন নবীজির গৃহের মর্যাদার কেন্দ্রবিন্দু। তাঁর নামেই নির্ধারিত এই মোহর আজও মুসলিম সমাজে “সুন্নাহ মোহর” হিসেবে সম্মানিত।
সমাজে বিবাহ সহজ করা ও নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার দৃষ্টিকোণ থেকে, মোহরে ফাতেমি আমাদের সামনে এক সমতা ও সংযমের মডেল হিসেবে দাঁড়ায়।
অতএব, মুসলিম সমাজের উচিত মোহরকে বোঝা নয়, বরং ভালোবাসা, দায়িত্ব ও সম্মানের প্রতিশ্রুতি হিসেবে দেখা।
আরও পড়ুনবিবাহের সুন্নত 'ওয়ালিমা'১২ জানুয়ারি ২০১৮