জাতীয় উন্নয়ন কৌশলের কেন্দ্র ঠিক করুন
Published: 23rd, June 2025 GMT
দশকের পর দশক বাংলাদেশের স্কুল ও উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে নীতিনির্ধারক, শিক্ষাবিদ ও সচেতন নাগরিকদের মধ্যে আলোচনা চলেছে। প্রতিটি শিল্পবিপ্লবের সঙ্গে এসেছে নতুন বাস্তবতা ও চ্যালেঞ্জ। আর বিশ্বের অনেক দেশই সেই পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শিক্ষা ব্যবস্থায় কাঠামোগত রূপান্তর ঘটিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে সে অর্থে কোনো মৌলিক রূপান্তর ঘটেনি। ফলে শিক্ষা আজ জীবনের প্রয়োজন মেটানোর মাধ্যম না হয়ে পরিণত হয়েছে ব্যবস্থার ভার বহনের এক আনুষ্ঠানিকতায়।
সাম্প্রতিক সময়ে আবারও একটি নতুন শিক্ষা কমিশন গঠনের দাবি জোরালোভাবে উঠছে। অতীতেও একাধিক শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়েছিল, যারা নানা স্তরের অংশগ্রহণ ও গবেষণার মাধ্যমে সুপরিকল্পিত প্রতিবেদন ও বাস্তবসম্মত সুপারিশ করেছিল। কিন্তু রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব, আমলাতান্ত্রিক স্থবিরতা, ধারাবাহিকতা না থাকায় এসব উদ্যোগ কাগজ-কলমেই সীমাবদ্ধ থেকে গেছে। শিক্ষা যেমন এক দিনে বদলায় না, তেমনি তা কেবল একটি কমিশনের রিপোর্টেই আমূল রূপান্তর হয় না। এ জন্য প্রয়োজন ধারাবাহিক রাজনৈতিক অঙ্গীকার ও কাঠামোগত সমাধান।
আজকের বিশ্ব দ্রুত পরিবর্তনশীল, যার অন্যতম চালিকাশক্তি চতুর্থ শিল্পবিপ্লব। স্বয়ংক্রিয়তা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবটিক্স, জেনারেটিভ এআই, ব্লকচেইন এবং ডিজিটাল কানেক্টিভিটির যুগে দাঁড়িয়ে কেবল প্রথাগত পাঠ্যবইভিত্তিক শিক্ষায় এগিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। শিক্ষার্থীরা যদি বিশ্লেষণ, অভিযোজন, সমস্যা সমাধান ও জীবনব্যাপী শিক্ষার সক্ষমতা অর্জন না করে, তবে তারা ভবিষ্যতে চাকরি বা উদ্যোগ– কোনোটিতেই কার্যকরভাবে টিকে থাকতে পারবে না। যথাযথ দিকনির্দেশনার অভাবে শিক্ষিত তরুণরা যুগোপযোগী দক্ষতা অর্জনে ব্যর্থ হবে, যা তাদের বাস্তব জীবনের চাহিদা পূরণ ও চাকরির বাজারে প্রতিযোগিতা সক্ষমতায় বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে।
বাংলাদেশ যদি বৈশ্বিক পরিবর্তনের গতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগোতে না পারে, তবে আমাদের বিপুল তরুণ জনগোষ্ঠী সম্ভাবনার উৎস না হয়ে এক সময় হতাশা ও বেকারত্বের ভারে দেশের ওপর বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। আমাদের উচ্চশিক্ষা এবং স্কুলশিক্ষা ব্যবস্থা গভীর সংকটে নিমজ্জিত। বাংলা মাধ্যম, ইংরেজি মাধ্যম ও মাদ্রাসা– এই তিন ধারার মধ্যে বিভক্ত শিক্ষা ব্যবস্থা একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, বৈষম্যহীন সমাজ গঠনের অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। মুখস্থনির্ভর পাঠ্যপুস্তক ও পরীক্ষাভিত্তিক মানদণ্ডের কারণে শিক্ষার্থীরা বাস্তব জীবনে প্রয়োজনীয় সৃজনশীলতা, বিশ্লেষণ ও নৈতিক দক্ষতা অর্জনে পিছিয়ে পড়ছে। শিশুরা ভারী ব্যাগে বই বহন করলেও চিন্তা বহন করতে শেখে না। ফলে আমরা তথ্যবহুল কিন্তু জ্ঞানশূন্য একটি প্রজন্ম গড়ে তুলছি। এই প্রেক্ষাপটে একটিমাত্র শিক্ষা কমিশন দিয়ে স্কুল ও উচ্চশিক্ষা– এই দুটি স্তরের স্বতন্ত্র সংকট ও প্রয়োজনীয়তা পূরণ সম্ভব নয়। কারণ দুটি স্তরের কাঠামো, লক্ষ্য, পদ্ধতি ও চ্যালেঞ্জ ভিন্ন। অতএব, এখন সময় হয়েছে দুটি পৃথক কমিশন গঠনের– একটি স্কুল শিক্ষা কমিশন, অপরটি উচ্চশিক্ষা কমিশন।
স্কুল শিক্ষা কমিশন কাজ করবে মৌলিক শিক্ষা দক্ষতা, পাঠ্যক্রম সংস্কার, মূল্যায়ন পদ্ধতির আধুনিকায়ন, শিক্ষক প্রশিক্ষণ এবং তিন ধারার শিক্ষার (বাংলা, ইংরেজি ও মাদ্রাসা) সমন্বয়ের লক্ষ্যে। এটি ভবিষ্যৎমুখী ও অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষা ব্যবস্থা গঠনে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে।
অপরদিকে উচ্চশিক্ষা কমিশনের দায়িত্ব হবে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি, গবেষণা সম্প্রসারণ, আন্তর্জাতিকীকরণ, নতুন পেশাভিত্তিক কারিকুলাম; বিশ্ববিদ্যালয়কে কেবল শিক্ষালয় নয়– উদ্ভাবন, শিল্প সংযোগ ও উদ্যোক্তা তৈরির প্ল্যাটফর্ম হিসেবে গড়ে তোলা।
একবিংশ শতাব্দীর বিশ্ববিদ্যালয়কে হতে হবে সমাজের সমস্যা সমাধানের কেন্দ্র; শুধু ডিগ্রি বিতরণের নয়।
যদিও এ দুটি কমিশন আলাদা কাঠামোতে কাজ করবে, তবুও তাদের অভিন্ন উদ্দেশ্য– দেশের সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থার পুনর্গঠন। স্কুল ও উচ্চশিক্ষা একটি ধারাবাহিক পরিক্রমার অংশ। একটির ব্যর্থতা অপরটির ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে। তাই এ দুটি কমিশনের মধ্যে সমন্বয়, তথ্য ও অভিজ্ঞতা বিনিময় এবং অভিন্ন জাতীয় লক্ষ্য নির্ধারণ অপরিহার্য।
আমাদের সামনে সময় সীমিত। পরিবর্তনের জানালা দ্রুত বন্ধ হয়ে আসছে। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে আজকের শিক্ষানীতির ওপর। তরুণ জনগোষ্ঠীকে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের উপযোগী করে গড়ে তুলতে হলে শিক্ষা খাতকে জাতীয় উন্নয়ন কৌশলের কেন্দ্রস্থলে আনতেই হবে। এখনই সময় দ্বিধাহীন, সুস্পষ্ট ও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ পদক্ষেপ নেওয়ার।
nএম এম শহিদুল হাসান: ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর, ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ব যবস থ
এছাড়াও পড়ুন:
পেঁয়াজের কেজি ৮০–৮৫ টাকা, সবজিও চড়া
বাজারে পেঁয়াজ ও ফার্মের মুরগির ডিমের দাম হঠাৎ বেড়েছে। খুচরা পর্যায়ে ১৫–২০ টাকা বেড়ে ৮০ থেকে ৮৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি পেঁয়াজ। প্রতি ডজনে ডিমের দাম বেড়েছে ১০ টাকা। এ ছাড়া বেশির ভাগ সবজির দামও আগের তুলনায় চড়া।
খুচরা বিক্রেতারা জানান, বাজারে পেঁয়াজের সরবরাহ কিছুটা কমেছে। আর ডিমের চাহিদা বেড়েছে, সে তুলনায় সরবরাহ বাড়েনি। এ কারণে পণ্য দুটির দাম আগের চেয়ে বেড়েছে। সরবরাহ ঠিক হলে দাম কমে আসবে। গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেট, টাউন হল বাজার ও কারওয়ান বাজার ঘুরে এবং বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
তাতে গতকাল বিভিন্ন বাজারে এক কেজি পেঁয়াজ ৮০ থেকে ৮৫ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে।রাজধানীর খুচরা বাজারগুলোতে চার–পাঁচ দিন আগেও মানভেদে প্রতি কেজি পেঁয়াজ কেনা যেত ৬০ থেকে ৬৫ টাকায়। তবে হঠাৎ কেজিতে ১৫–২০ টাকা বেড়েছে। তাতে গতকাল বিভিন্ন বাজারে এক কেজি পেঁয়াজ ৮০ থেকে ৮৫ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, এ বছর কৃষকের ঘরে মজুত থাকা অনেক পেঁয়াজ নষ্ট হয়েছে। এতে বাজারে পণ্যটির সরবরাহ কমেছে। আবার বৃষ্টির কারণেও সরবরাহে বিঘ্ন ঘটেছে। মূলত এই দুই কারণে পেঁয়াজের দাম এখন বাড়তি।
করলা, কাঁকরোল, বরবটিসহ বেশির ভাগ সবজির কেজি এখন ৮০ টাকার আশপাশে। আমদানি করা টমেটোর কেজি ১৪০-১৫০ টাকা। অন্যদিকে বেগুনের দাম ২০–৩০ টাকা বেড়ে ১০০-১২০ টাকা হয়েছে।গত দুই–তিন সপ্তাহে মৌসুমি বৃষ্টির কারণে চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে সবজি। যেমন গতকাল রাজধানীর বিভিন্ন খুচরা বাজারে প্রতি কেজি কাঁচা মরিচ ১৮০ থেকে ২০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। মাসখানেক আগে মরিচের দাম ছিল ৮০ থেকে ১২০ টাকা। এ ছাড়া করলা, কাঁকরোল, বরবটিসহ বেশির ভাগ সবজির কেজি এখন ৮০ টাকার আশপাশে। আমদানি করা টমেটোর কেজি ১৪০-১৫০ টাকা। অন্যদিকে বেগুনের দাম ২০–৩০ টাকা বেড়ে ১০০-১২০ টাকা হয়েছে।
সপ্তাহখানেকের মধ্যে দাম বেড়েছে মুরগির ডিমের। রাজধানীর খুচরা বাজারে গতকাল ফার্মের মুরগির এক ডজন বাদামি ডিম বিক্রি হয়েছে ১৩৫-১৪০ টাকায়। পাড়ামহল্লায় এ দাম আরও কিছুটা বেশি। গত সপ্তাহে ডিমের ডজন ছিল ১২০–১২৫ টাকা। এদিকে তিন সপ্তাহ ধরেই বাজারে আগের চেয়ে বাড়তি দামে মুরগি বিক্রি হচ্ছে। গতকাল রাজধানীতে এক কেজি ব্রয়লার মুরগি ১৭০ থেকে ১৮০ টাকায় ও সোনালি মুরগি ৩০০ থকে ৩৩০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। আগে এ দাম কেজিতে ২০-৩০ টাকা কম ছিল।
ফার্মের মুরগির এক ডজন বাদামি ডিম বিক্রি হয়েছে ১৩৫-১৪০ টাকায়। পাড়ামহল্লায় এ দাম আরও কিছুটা বেশি। গত সপ্তাহে ডিমের ডজন ছিল ১২০–১২৫ টাকা।চার মাস পর আবার মূল্যস্ফীতি বাড়লমূল্যস্ফীতি নিয়ে শঙ্কা কাটছে না। টানা চার মাস কমার পর মূল্যস্ফীতি আবার বেড়েছে। গত মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি কিছুটা বেড়ে ৮ দশমিক ৫৫ শতাংশ হয়েছে। জুনে এই হার ছিল ৮ দশমিক ৪৮ শতাংশ। গতকাল বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) জুলাই মাসের মূল্যস্ফীতি চিত্র প্রকাশ করেছে। অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, বর্ষা ও বন্যার মৌসুমের কারণে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়তে পারে।
গত জুন মাসে দেশের যে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল, তা বিগত ৩৫ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। বিবিএসের হিসাব অনুসারে, জুলাই মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ। আর খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি হয় ৯ দশমিক ৩৮ শতাংশ। দুই খাতেই আগের মাসের চেয়ে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে।
রাজধানীতে এক কেজি ব্রয়লার মুরগি ১৭০ থেকে ১৮০ টাকায় ও সোনালি মুরগি ৩০০ থকে ৩৩০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।মূল্যস্ফীতির বৃদ্ধির কারণ হলো, জুলাইয়ে বাজারে সব ধরনের চালের দাম কেজিতে ৫-৬ টাকা বেড়েছে। শাকসবজির দামও ছিল চড়া।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান প্রথম আলোকে বলেন, বাজারের মৌলিক বিষয়গুলো কাজ করছে না। বিশেষ করে সরবরাহব্যবস্থা বিঘ্নিত হয়েছে। গত মাসে চালের দাম বেড়েছে। এখন চলছে বর্ষা ও বন্যার মৌসুম। এই সময়ে নিত্যপণ্যের ঘাটতি থাকে, যা মূল্যস্ফীতিকে উসকে দিতে পারে। তাই সরকারের উচিত, এখনই প্রস্তুতি নিয়ে পণ্যের চাহিদা ও জোগানে ভারসাম্য আনা। তিনি মনে করেন, শুধু সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়।