দশকের পর দশক বাংলাদেশের স্কুল ও উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে নীতিনির্ধারক, শিক্ষাবিদ ও সচেতন নাগরিকদের মধ্যে আলোচনা চলেছে। প্রতিটি শিল্পবিপ্লবের সঙ্গে এসেছে নতুন বাস্তবতা ও চ্যালেঞ্জ। আর বিশ্বের অনেক দেশই সেই পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শিক্ষা ব্যবস্থায় কাঠামোগত রূপান্তর ঘটিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে সে অর্থে কোনো মৌলিক রূপান্তর ঘটেনি। ফলে শিক্ষা আজ জীবনের প্রয়োজন মেটানোর মাধ্যম না হয়ে পরিণত হয়েছে ব্যবস্থার ভার বহনের এক আনুষ্ঠানিকতায়।

সাম্প্রতিক সময়ে আবারও একটি নতুন শিক্ষা কমিশন গঠনের দাবি জোরালোভাবে উঠছে। অতীতেও একাধিক শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়েছিল, যারা নানা স্তরের অংশগ্রহণ ও গবেষণার মাধ্যমে সুপরিকল্পিত প্রতিবেদন ও বাস্তবসম্মত সুপারিশ করেছিল। কিন্তু রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব, আমলাতান্ত্রিক স্থবিরতা, ধারাবাহিকতা না থাকায় এসব উদ্যোগ কাগজ-কলমেই সীমাবদ্ধ থেকে গেছে। শিক্ষা যেমন এক দিনে বদলায় না, তেমনি তা কেবল একটি কমিশনের রিপোর্টেই আমূল রূপান্তর হয় না। এ জন্য প্রয়োজন ধারাবাহিক রাজনৈতিক অঙ্গীকার ও কাঠামোগত সমাধান।
আজকের বিশ্ব দ্রুত পরিবর্তনশীল, যার অন্যতম চালিকাশক্তি চতুর্থ শিল্পবিপ্লব। স্বয়ংক্রিয়তা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবটিক্স, জেনারেটিভ এআই, ব্লকচেইন এবং ডিজিটাল কানেক্টিভিটির যুগে দাঁড়িয়ে কেবল প্রথাগত পাঠ্যবইভিত্তিক শিক্ষায় এগিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। শিক্ষার্থীরা যদি বিশ্লেষণ, অভিযোজন, সমস্যা সমাধান ও জীবনব্যাপী শিক্ষার সক্ষমতা অর্জন না করে, তবে তারা ভবিষ্যতে চাকরি বা উদ্যোগ– কোনোটিতেই কার্যকরভাবে টিকে থাকতে পারবে না। যথাযথ দিকনির্দেশনার অভাবে শিক্ষিত তরুণরা যুগোপযোগী দক্ষতা অর্জনে ব্যর্থ হবে, যা তাদের বাস্তব জীবনের চাহিদা পূরণ ও চাকরির বাজারে প্রতিযোগিতা সক্ষমতায় বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে।

বাংলাদেশ যদি বৈশ্বিক পরিবর্তনের গতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগোতে না পারে, তবে আমাদের বিপুল তরুণ জনগোষ্ঠী সম্ভাবনার উৎস না হয়ে এক সময় হতাশা ও বেকারত্বের ভারে দেশের ওপর বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। আমাদের উচ্চশিক্ষা এবং স্কুলশিক্ষা ব্যবস্থা গভীর সংকটে নিমজ্জিত। বাংলা মাধ্যম, ইংরেজি মাধ্যম ও মাদ্রাসা– এই তিন ধারার মধ্যে বিভক্ত শিক্ষা ব্যবস্থা একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, বৈষম্যহীন সমাজ গঠনের অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। মুখস্থনির্ভর পাঠ্যপুস্তক ও পরীক্ষাভিত্তিক মানদণ্ডের কারণে শিক্ষার্থীরা বাস্তব জীবনে প্রয়োজনীয় সৃজনশীলতা, বিশ্লেষণ ও নৈতিক দক্ষতা অর্জনে পিছিয়ে পড়ছে। শিশুরা ভারী ব্যাগে বই বহন করলেও চিন্তা বহন করতে শেখে না। ফলে আমরা তথ্যবহুল কিন্তু জ্ঞানশূন্য একটি প্রজন্ম গড়ে তুলছি। এই প্রেক্ষাপটে একটিমাত্র শিক্ষা কমিশন দিয়ে স্কুল ও উচ্চশিক্ষা– এই দুটি স্তরের স্বতন্ত্র সংকট ও প্রয়োজনীয়তা পূরণ সম্ভব নয়। কারণ দুটি স্তরের কাঠামো, লক্ষ্য, পদ্ধতি ও চ্যালেঞ্জ ভিন্ন। অতএব, এখন সময় হয়েছে দুটি পৃথক কমিশন গঠনের– একটি স্কুল শিক্ষা কমিশন, অপরটি উচ্চশিক্ষা কমিশন।

স্কুল শিক্ষা কমিশন কাজ করবে মৌলিক শিক্ষা দক্ষতা, পাঠ্যক্রম সংস্কার, মূল্যায়ন পদ্ধতির আধুনিকায়ন, শিক্ষক প্রশিক্ষণ এবং তিন ধারার শিক্ষার (বাংলা, ইংরেজি ও মাদ্রাসা) সমন্বয়ের লক্ষ্যে। এটি ভবিষ্যৎমুখী ও অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষা ব্যবস্থা গঠনে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে।
অপরদিকে উচ্চশিক্ষা কমিশনের দায়িত্ব হবে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি, গবেষণা সম্প্রসারণ, আন্তর্জাতিকীকরণ, নতুন পেশাভিত্তিক কারিকুলাম; বিশ্ববিদ্যালয়কে কেবল শিক্ষালয় নয়– উদ্ভাবন, শিল্প সংযোগ ও উদ্যোক্তা তৈরির প্ল্যাটফর্ম হিসেবে গড়ে তোলা।

একবিংশ শতাব্দীর বিশ্ববিদ্যালয়কে হতে হবে সমাজের সমস্যা সমাধানের কেন্দ্র; শুধু ডিগ্রি বিতরণের নয়।
যদিও এ দুটি কমিশন আলাদা কাঠামোতে কাজ করবে, তবুও তাদের অভিন্ন উদ্দেশ্য– দেশের সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থার পুনর্গঠন। স্কুল ও উচ্চশিক্ষা একটি ধারাবাহিক পরিক্রমার অংশ। একটির ব্যর্থতা অপরটির ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে। তাই এ দুটি কমিশনের মধ্যে সমন্বয়, তথ্য ও অভিজ্ঞতা বিনিময় এবং অভিন্ন জাতীয় লক্ষ্য নির্ধারণ অপরিহার্য।
আমাদের সামনে সময় সীমিত। পরিবর্তনের জানালা দ্রুত বন্ধ হয়ে আসছে। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে আজকের শিক্ষানীতির ওপর। তরুণ জনগোষ্ঠীকে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের উপযোগী করে গড়ে তুলতে হলে শিক্ষা খাতকে জাতীয় উন্নয়ন কৌশলের কেন্দ্রস্থলে আনতেই হবে। এখনই সময় দ্বিধাহীন, সুস্পষ্ট ও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ পদক্ষেপ নেওয়ার।

­nএম এম শহিদুল হাসান: ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর, ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি 
 

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ব যবস থ

এছাড়াও পড়ুন:

অভিনন্দন বিশ্ব, এখন শান্তির সময়: ট্রাম্প

কাতার ও ইরাকে মার্কিন ঘাঁটিতে ইরানের হামলার পর নিজের ট্রুথ সোশ্যাল মিডিয়ায় একাধিক পোস্ট দিয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। লিখেছেন, ‌‌‘অভিনন্দন বিশ্ব, এখন শান্তির সময়।’

ইরানের হামলার বিষয়ে তিনি লিখেছেন, ইরানের প্রতিক্রিয়া ‘খুবই দুর্বল’। ‘আমাদের আগেই নোটিশ দেওয়ার জন্য’ তাদের ধন্যবাদ।

ট্রুথ সোশ্যালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেছেন, ‘ইরান তাদের পারমাণবিক স্থাপনা ধ্বংসের প্রতিক্রিয়া খুবই দুর্বলভাবে দিয়েছে, যা আমরা আশা করেছিলাম এবং খুবই কার্যকরভাবে প্রতিহত করা হয়েছে।’ ওই অঞ্চলের শান্তির জন্য কাতারের আমির যা করেছেন, সেজন্য তাকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন ট্রাম্প।

তিনি বলেছেন, ইরান ১৪টি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে যার ১৩টি ‘ধ্বংস’ করা হয়েছে। আরেকটি অন্যদিকে চলে গেছে। ওই হামলায় কোনা আমেরিকানের ক্ষতি হয়নি। ‘তেমন কোনো সম্পদের ক্ষয়-ক্ষতিও হয়নি।’ এমনকি কাতারের কোনো বাসিন্দাও নিহত বা আহত হয়নি।’

 ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন, ‘সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, তারা তাদের ‘সিস্টেম’ থেকে সবকিছু বের করে এনেছে। আশা করি, আর কোনো ঘৃণা থাকবে না। আমাদের আগেই নোটিশ দেওয়ায় আমি ইরানকে ধন্যবাদ জানাতে চাই। সম্ভবত ইরান এখন এই অঞ্চলের শান্তি ও সম্প্রীতির দিকে এগোতে পারে। আমি উৎসাহের সঙ্গে ইসরায়েলকেও একই কাজ করতে বলবো।’

সম্পর্কিত নিবন্ধ