দেশের নগরগুলোর মাত্র ২২ শতাংশ শিশু টিকা পায়। শহরের বস্তির শিশুদের ২৪ শতাংশ খর্বকায়। কিছু ক্ষেত্রে শহরের হাসপাতালগুলোতে জীবন রক্ষাকারী ওষুধ পাওয়া যায় না। ওষুধের খরচ থেকে মানুষকে সুরক্ষা দিতে পৃথক সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি প্রণয়ন করা দরকার।

গতকাল সোমবার রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে ‘নগর স্বাস্থ্য ও বেসরকারি খাতের সম্পৃক্ততা’ শীর্ষক জাতীয় সংলাপে অর্থনীতিবিদ, জনস্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞ এবং স্বাস্থ্য–গবেষকেরা এ কথা বলেছেন। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এমিনেন্স অ্যাসোসিয়েটস অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট এবং বাংলাদেশ আরবান হেলথ নেটওয়ার্ক যৌথভাবে এ সংলাপের আয়োজন করে। এতে সহায়তা করে ইউনিসেফ ও সুইডিশ দূতাবাস।

অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ হোসেন জিল্লুর রহমান সাম্প্রতিক একটি গবেষণার উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, দেশের ৫২ শতাংশ পরিবারে দীর্ঘস্থায়ী রোগের রোগী আছে। এসব পরিবারকে দীর্ঘদিন ওষুধ কিনে যেতে হবে। এ ধরনের পরিবারকে ওষুধের খরচ থেকে সুরক্ষা দিতে তিনি সামাজিক কর্মসূচি প্রবর্তনের সুপারিশ করেন। তিনি বলেন, অন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির মতো স্বাস্থ্য খাতে নিরাপত্তা কর্মসূচি দরকার। এতে মানুষের ওষুধের নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এই উপদেষ্টা বলেন, সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নসহ দেশের প্রায় সব ক্ষেত্রে গতির ঘাটতি লক্ষ করা যাচ্ছে। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু ধীরগতিতে। এটা বিলাসিতার মতো। এই সময়ের চাহিদা হচ্ছে দ্রুতগতির। সেই চাহিদা পূরণ হচ্ছে না। তিনি আরও বলেন, ৪০ শতাংশ যে শূন্য পদ আছে, তাতে জনবল নিয়োগ দিলেই স্বাস্থ্য খাতে গতি আসবে। এর জন্য কোনো সংস্কারের প্রয়োজন নেই।

শহরে স্বাস্থ্যসেবা তত ভালো নয়

অনুষ্ঠানে প্রথম উপস্থাপনায় এমিনেন্স অ্যাসোসিয়েটস অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্টের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো.

শামীম হায়দার তালুকদার বলেন, নগরস্বাস্থ্যের উন্নতিতে

ভারত, কেনিয়া ও থাইল্যান্ডে সাফল্য আছে। বাংলাদেশে নগরস্বাস্থ্যে ঘাটতি আছে। তিনি

বলেন, দেশের নগর ও শহরের ৬৬ শতাংশ শিশু আরোগ্য সেবা পায়, গ্রামে পায় ৯৫ শতাংশ শিশু। গ্রামের ৯৩ শতাংশ শিশু টিকা পায়, শহরে পায় মাত্র ২২ শতাংশ শিশু। অন্যদিকে গ্রামের ৮৩ শতাংশ শিশু পরিবার পরিকল্পনা সেবার আওতায়, শহরে তা মাত্র ৩৯ শতাংশ।

দ্বিতীয় উপস্থাপনায় আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) বিজ্ঞানী ও স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশনের সদস্য আহমেদ এহসানূর রহমান বলেন, দেশের বস্তিতে বসবাসকারী মানুষের স্বাস্থ্য খারাপ, কোনো কোনো সূচকে তা গ্রামের মানুষের চেয়েও খারাপ। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, সর্বশেষ জাতীয় জরিপ অনুযায়ী পাঁচ বছরের কম বয়সী গ্রামের ২২ শতাংশ শিশুর উচ্চতা বয়সের তুলনায় কম। শহরের বস্তিতে তা ৩৪ শতাংশ।

শহরের হাসপাতালগুলোতে ওষুধের প্রাপ্যতা নিয়ে তথ্য উপস্থাপনের সময় আহমেদ এহসানূর রহমান বলেন, সর্বশেষ স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান জরিপে ২৭ শতাংশ জেলা হাসপাতালে মায়ের জীবন রক্ষায় ব্যবহৃত ওষুধ অক্সিটসিন পাওয়া যায়নি। অন্যদিকে শিশুদের নিউমোনিয়া চিকিৎসায় এমোক্সিসিলিন পাওয়া গিয়েছিল শহরের ৩৯ শতাংশ হাসপাতালে এবং গ্রামের ৯৫ শতাংশ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে।

শামীম হায়দার তালুকদার ও আহমেদ এহসানূর রহমানের উপস্থাপনায় বোঝানের চেষ্টা হয় যে প্রাথমিক স্বাস্থ্যের কিছু সূচকে শহরের পরিস্থিতি খারাপ। কিছু সূচকে গ্রামের চেয়ে শহরের বস্তির অবস্থা বেশ খারাপ।

স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বাড়ানোর দাবি জানিয়ে স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশনের সদস্য ও বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিলের সভাপতি অধ্যাপক সায়েবা আক্তার বলেন, ‘স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলোর বাস্তবায়ন দেখতে পাচ্ছি না। এটা দুঃখজনক।’

বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও বিশ্বব্যাংকের সাবেক পুষ্টিবিশেষজ্ঞ জিয়াউদ্দীন হায়দার বলেন, দেশের প্রত্যেক নাগরিকের জন্য একক স্বাস্থ্য কার্ড প্রবর্তনের কথা চিন্তা করছে বিএনপি।

মুক্ত আলোচনায় অংশ নিয়ে বেশ কয়েকজন বক্তা অভিযোগ করেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের মধ্যে বোঝাপড়ার ঘাটতি থাকার কারণে শহর এলাকায় প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিস্থিতি খারাপ। কেউ বলেন, ক্লিনিক্যাল মাইন্ড সেট দিয়ে জনস্বাস্থ্য সমস্যা সমাধান সম্ভব নয়। কেউ বলেন, শহরে স্বাস্থ্যসেবার পুরো কর্তৃত্ব স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হাতে থাকা উচিত। আলোচনায় অংশ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ বলেন, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে বাদ দিয়ে নগরে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া সম্ভব নয়।

অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য দেন বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেন্টাল অনুষদের ডিন শাখাওয়াত হোসেন, সুইডিশ দূতাবাসের স্বাস্থ্য উপদেষ্টা জহিরুল ইসলাম এবং স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশনের সদস্য অধ্যাপক সৈয়দ আকরাম হোসেন।

অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন নাগরিক সংগঠন সুস্বাস্থ্যের বাংলাদেশের আহ্বায়ক কাজী

সাইফুদ্দিন বেননূর।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: অন ষ ঠ ন র রহম ন পর ব র র বস ত শহর র সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

জুমার দিনের করণীয় ও বর্জনীয়

জুমার দিন—মুসলমানদের জন্য এক বিশেষ বরকতময় দিন।

এটি শুধু সাপ্তাহিক নামাজের দিন নয়, বরং আত্মশুদ্ধি, সামাজিক সংহতি ও আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের মহান সুযোগ।

নবীজি (সা.) বলেছেন—“জুমার দিনই দিনসমূহের মধ্যে শ্রেষ্ঠ দিন। এ দিনেই আদম (আ.) সৃষ্টি হয়েছেন, এ দিনেই জান্নাতে প্রবেশ করেছেন, এবং এ দিনেই পৃথিবীতে প্রেরিত হয়েছেন।” (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৮৫৪)

অতএব, জুমা শুধু ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়—এটি ইসলামি সভ্যতার একটি কেন্দ্রবিন্দু।

এই দিনে কিছু কাজকে বিশেষভাবে উৎসাহিত করা হয়েছে, আবার কিছু কাজ থেকে কঠোরভাবে বারণ করা হয়েছে।

আরও পড়ুনইসলামোফোবিয়া মোকাবিলায় মুসলিম নারীর করণীয়২৬ আগস্ট ২০২৫জুমার দিনের করণীয়

১. গোসল করা

নবীজি (সা.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি জুমার দিনে গোসল করে, উত্তমভাবে পবিত্রতা অর্জন করে, তারপর মসজিদে আসে, নীরবে খুতবা শোনে ও নামাজ পড়ে, তার এক জুমা থেকে পরের জুমা পর্যন্ত গুনাহ মাফ করা হয়।” (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৮৮৩)

জুমার দিনের এই গোসল বিশেষ ইবাদত হিসেবে গণ্য হয়।

২. পরিচ্ছন্ন পোশাক ও সুগন্ধি ব্যবহার

জুমার নামাজে যাওয়ার আগে মুসলমানকে সুন্দর পোশাক পরা ও সুগন্ধি ব্যবহার করতে উৎসাহিত করা হয়েছে।

নবীজি (সা.) বলেছেন, “জুমার দিনে তোমাদের জন্য সুন্দর পোশাক পরা এবং সুগন্ধি ব্যবহার করা উত্তম।” (মুসনাদে আহমদ, হাদিস: ১৫২৪৮)

এটি সামাজিক মর্যাদা ও আধ্যাত্মিক পবিত্রতার প্রতীক।

৩. তাড়াতাড়ি মসজিদে যাওয়া

জুমার নামাজে আগে পৌঁছানোর জন্য বড় ফজিলত রয়েছে।

নবীজি (সা.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি প্রথম ঘণ্টায় জুমার জন্য যায়, সে যেন উট কোরবানি করল; দ্বিতীয় ঘণ্টায় গেলে গরু কোরবানি করল; তৃতীয় ঘণ্টায় গেলে ভেড়া কোরবানি করল; চতুর্থ ঘণ্টায় গেলে মুরগি কোরবানি করল; আর পঞ্চম ঘণ্টায় গেলে ডিম দান করল।” (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৮৮১)

অর্থাৎ, যত আগে যাবে, তত বেশি সওয়াব।

৪. খুতবা মনোযোগ দিয়ে শোনা

নবীজি (সা.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি খুতবা চলাকালীন তার সঙ্গীকে বলে ‘চুপ করো’, সে-ও অনর্থক কথা বলল।” (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৯৩৪)

খুতবা চলাকালীন কথা বলা, ফোন ব্যবহার করা বা অমনোযোগ হওয়া নিষিদ্ধ।

৫. সুরা কাহফ তেলাওয়াত করা

জুমার দিনে সূরা কাহফ পড়ার বিশেষ ফজিলত রয়েছে।

নবীজি (সা.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি জুমার দিনে সূরা কাহফ তেলাওয়াত করবে, তার জন্য দুই জুমার মধ্যবর্তী সময় আলোকিত হয়ে যাবে।” (মুসতাদরাকে হাকিম, হাদিস: ৩৩৯২)

৬. দোয়া করা ও দরুদ পাঠ করা

জুমার দিনে এমন একটি সময় আছে, যখন দোয়া কবুল হয়।

নবীজি (সা.) বলেন, “জুমার দিনে এমন একটি মুহূর্ত আছে, যেখানে কোনো মুসলমান নামাজে দাঁড়িয়ে আল্লাহর কাছে কিছু চাইলে আল্লাহ তা অবশ্যই কবুল করেন।” (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৯৩৫)

অনেক আলেমের মতে, এই সময়টি আসরের পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত।

এছাড়া, জুমার দিনে বেশি বেশি দরুদ পাঠ করার নির্দেশও এসেছে, “তোমরা জুমার দিনে আমার প্রতি বেশি দরুদ পাঠ করো, কারণ তোমাদের দরুদ আমার কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়।” (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস: ১৫৩১)

আরও পড়ুনপ্রাকৃতিক দুর্যোগে করণীয় আমল২২ আগস্ট ২০২৪জুমার দিনের বর্জনীয়

১. জুমার নামাজ ত্যাগ করা

নবীজি (সা.) কঠোরভাবে সতর্ক করেছেন, “যে ব্যক্তি অলসতা বা উদাসীনতার কারণে তিনটি জুমা ত্যাগ করে, আল্লাহ তার হৃদয় সিল করে দেন।” (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস: ১০৫২)

অর্থাৎ, ইচ্ছাকৃতভাবে জুমা বাদ দেওয়া ইমানের জন্য ভয়ংকর বিপদ।

২. জুমা বাদ দিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্যে ব্যস্ত থাকা

কোরআনে আল্লাহ বলেন, “হে মুমিনগণ! যখন জুমার আহ্বান দেওয়া হয়, তখন আল্লাহর স্মরণে ছুটে যাও এবং ক্রয়-বিক্রয় বন্ধ করো।” (সুরা আল-জুমা, আয়াত: ৯)

জুমার সময় ব্যবসা-বাণিজ্য, অনলাইন কেনাকাটা বা অন্য ব্যস্ততা বড় গোনাহ।

৩. উচ্চৈঃস্বরে কথা বলা

মসজিদে অন্যদের বিরক্ত করা, ফোনে কথা বলা, এমনকি নামাজের আগে অপ্রয়োজনে গল্প করা জুমার আদববিরোধী কাজ।

৪. খুতবার সময় চলাফেরা করা

খুতবা চলাকালে যেকোনো অযথা নড়াচড়া বা সামনে যাওয়া, নবীজি (সা.) বলেছেন, এতে “সওয়াব নষ্ট হয়।” (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৮৫৭)

৫. নামাজ শেষে গাফেল থাকা

জুমার পরপরই নামাজ বা দোয়া না করে তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে যাওয়া উচিত নয়। আল্লাহ বলেন, “যখন নামাজ শেষ হবে, তখন পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ো এবং আল্লাহর অনুগ্রহ অন্বেষণ করো, কিন্তু আল্লাহকে অধিক পরিমাণে স্মরণ করো।” (সুরা জুমা, আয়াত: ১০)

অর্থাৎ, কাজ করবে ঠিকই, কিন্তু মনে যেন আল্লাহর স্মরণ থাকে।

জুমার দিনের তাৎপর্য

জুমা মুসলমানদের জন্য সামাজিক ঐক্যের প্রতীক। এদিনে মসজিদগুলোতে ধনী-গরিব, নেতা-জনতা, শিক্ষিত-অশিক্ষিত সবাই এক কাতারে দাঁড়ায়।

নবীজি (সা.) বলেছেন, “জুমার দিনে একবার নামাজ আদায় করা সাত দিনের গোনাহ মাফের সমান।” (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৮৫৬)

জুমার দিন আমাদের আত্মার পরিশুদ্ধি, সমাজের ঐক্য এবং আল্লাহর রহমত লাভের সোনালি সুযোগ।

এই দিনে গোসল, পরিষ্কার পোশাক, সময়মতো নামাজে যাওয়া, খুতবা শোনা, সূরা কাহফ পাঠ ও দোয়া করা—সবই মুসলিম জীবনের সৌন্দর্য বাড়ায়।

অন্যদিকে অলসতা, ব্যবসা, ও অমনোযোগিতা আমাদের ইমানকে দুর্বল করে।

অতএব, প্রতিটি মুসলমানের উচিত জুমাকে কেবল ছুটির দিন নয়, বরং “আত্মার নবজাগরণের দিন” হিসেবে পালন করা।

আরও পড়ুনসাহাবিদের প্রতি মহানবী (সা.)-এর শেষ উপদেশ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ