এনজিওকর্মীদের টার্গেট পূরণ, ঋণ করে চল্লিশা এবং কাটা ঘায়ে ‘ঋণের’ ছিটা
Published: 22nd, September 2025 GMT
ছোটবেলায় পড়েছিলাম, ‘ঋণ করলে আত্মার স্বাধীনতা নষ্ট হয়।’ এখন সব দেখেশুনে একটি গানের প্যারোডি করে বলতে ইচ্ছে করছে, ‘ঋণই এখন জীবন-মরণ, ঋণই যেন প্রাণ...।’ ঋণের দায়ে আত্মহত্যার খবর হরহামেশাই গণমাধ্যমে দেখা যায়। কিন্তু ঋণের দায়ে এক পরিবারের চারজনের লাশ উদ্ধার। এরপরে ঋণ করেই তাঁদের চল্লিশা—এমন খবর পড়ার পরে কোনো গানের প্যারোডি আর মাথায় আসে না। প্রতিক্রিয়া জানানোর ভাষা খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে একটি গ্রামীণ প্রবাদ মনে আসে, ‘কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা।’ এই প্রবাদটাকে একটু ঘুরিয়ে বললে এই রকম দাঁড়ায়, ‘কাটা ঘায়ে “ঋণের” ছিটা।’ এ ছাড়া আর বলার কিছু নেই।
মিনারুল ইসলাম (৩৫) রাজশাহীর পবা উপজেলার বামনশিকড় গ্রামের রুস্তম আলীর ছেলে। তাঁদের বাড়িতে ওই চল্লিশার আয়োজন করা হয়। গত ১৫ আগস্ট নিজ বাড়ি থেকে মিনারুল ইসলাম, তাঁর স্ত্রী মনিরা খাতুন (৩০), ছেলে মাহিম (১৪) ও মেয়ে মিথিলার (৩) মরদেহ উদ্ধার করা হয়। ছেলে মাহিন অষ্টম শ্রেণিতে পড়ত। আর বাবা মিনারুল কৃষিকাজ করতেন। লাশের পাশে চিরকুট পাওয়া যায়, যাতে মিনারুলের স্ত্রী ও দুই সন্তানকে হত্যার কথা স্বীকার করেন। ওই চিরকুটে মিনারুল আরও লেখেন, ‘আমরা মরে গেলাম ঋণের দায়ে আর খাওয়ার অভাবে। এত কষ্ট আর মেনে নিতে পারছি না। তাই আমরা বেঁচে থাকার চেয়ে মরে গেলাম, সেই ভালো হলো। কারও কাছে কিছু চাইতে হবে না।’
১৩ সেপ্টেম্বর তাঁদের চল্লিশা অনুষ্ঠিত হয়েছে। গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, লাখ খানেক টাকা খরচ করে এই অনুষ্ঠান করা হয়েছে। আত্মীয়স্বজন ও সমাজের মিলিয়ে ১ হাজার ২০০ মানুষের আয়োজন করা হয়েছিল। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাঈদ আলী বলেছেন, ‘ইসলামের দৃষ্টিতে এটা নেই। কিন্তু কেউ মারা গেলে এটা করতে হয়। এটা আমাদের এলাকার রেওয়াজ।’
রাজশাহীর পবায় গত ১৬ জুলাই বিকেলে অটোরিকশাচালক শামসুদ্দিনের (৩২) ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করা হয়। মৃতদেহের পাশে একটি সুইসাইড নোট পাওয়া যায়। তার এক জায়গায় লেখা ছিল, ‘সুদ দিও না, কিস্তি দিও না।’ তাঁর স্ত্রী শিলা খাতুন বলছেন, ঋণের দায়েই তাঁর স্বামী আত্মহত্যা করেছেন। তাঁর অনেক ঋণ আছে। ঋণের জন্য মামলা হয়েছে। সেদিন মামলার হাজিরার দিন ছিল। হাজিরা না দিয়ে তিনি আত্মহত্যা করেছেন। তাঁর বাড়ি রাজশাহীর তানোর থানার তালন্দ বাজার এলাকার সামাসপুর গ্রামে। তাঁর বাবার নাম এমাদউদ্দীন মণ্ডল।
শিলা খাতুনের ভাষ্য অনুযায়ী, ‘ঘটনার দিন তাঁর স্বামীকে খাওয়ার জন্য ভাত বেড়ে দেন। তাঁর দুই মেয়ে আছে। তারা বাবার গা চুলকে দিচ্ছিল। আর তিনি আরেকটি তরকারি বাড়তে গিয়েছিলেন। এই ফাঁকে তার স্বামী না খেয়ে উঠে গাড়ি নিয়ে বের হচ্ছিলেন। মেয়ে দুটো দৌড় দিয়ে গিয়ে বাবার গাড়ি চেপে ধরে। তখন স্বামী বললেন, “বাচ্চাদের ধর, আমি গাড়ি চালাতে যাব।” তারপর বিকেলে মারা যাওয়ার খবর পান।’ এসব খবর পাঠ করা যায় না। গলা ধরে আসে। মেয়ে দুটি বাবার গা চুলকে দিচ্ছিল। যাওয়ার সময় গাড়ি ধরেছে। এই দৃশ্য ভোলা যায় না।
অনেক সময় মৃত্যুর চেয়ে বেঁচে থাকাও অনেক দুঃসহ। রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলার বিড়ালদহ নয়াপাড়া গ্রামের জহুরুল ইসলামের কাহিনিটা সে রকম। জহুরুল ইসলামের স্ত্রী নাজমা বেগম এনজিও কর্মীদের প্রশ্ন করেছিলেন, ‘ডায়াবেটিসের রোগী যদি মইরি যা, তোমরা কিস্তির ট্যাকা কী কইরি তুলবে?’ তারা বলেছিলেন, ‘মরুক, মাফ করে দিব কিন্তু এখন সময় দেওয়া যাবে না।’ এরপরেও সদ্য বিবাহিতা মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে জহুরুল ইসলামকে (৫২) দুই এনজিও কর্মী অপমান শুরু করেন। একপর্যায়ে ওই এনজিও কার্যালয়ে গিয়ে তিনি বিষ পান করেন। গত ২৯ এপ্রিল দুপুরে পুঠিয়ার বানেশ্বর এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। পরে চিকিৎসায় তিনি বেঁচে যান। কিন্তু নিজের মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে তিনি আর লজ্জায় যেতে পারেন না।
রাজশাহীর চারঘাটের মুংলি গ্রামে সেলিম হোসেনের ইলেকট্রনিকস পণ্যের দোকান ছিল। ভালো ব্যবসা হচ্ছিল। কিছু জায়গাজমিও আছে। একতলা ছাদের বাড়ি। সচ্ছল পরিবার। কিছুদিন থেকে ধারকর্জ নিয়ে আর শোধ করতে পারছিলেন না। গত ফেব্রুয়ারি মাসে গভীর রাতে তিনি সপরিবার বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। তিনি কোথায় আছেন, কেউ বলতে পারছেন না।
গত ২৫ ফেব্রুয়ারি মুংলি বাজারে গিয়ে দেখা যায়, সেলিম হোসেনের দোকান বন্ধ রয়েছে। নাম সেলিম স্টোর। বাজারে পেছনেই বাড়ি। বাড়িতে গিয়ে তার মা হোসনে আরা বেগমকে পাওয়া যায়। উঠানে বসে নাতির পোষা কাকাতুয়া পাখিকে খাবার দিচ্ছিলেন। একা বাড়িতে আছেন, খাওয়াদাওয়া করছেন কীভাবে—জানতে চাইলে বললেন, ‘পাশেই তার মেয়ের বাড়ি রয়েছে। তিনি এখন মেয়ের বাড়িতে খাওয়াদাওয়া করছেন।’ কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘একলা মানুষ কি এত বড় বাড়িতে থাকা যায়?’ ছেলে বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার পর পাঁচ থেকে সাতজন টাকার জন্য এসেছেন। তাঁরা কেউ বলছেন, পাঁচ লাখ টাকা পাবেন, কেউ বলছেন আট লাখ পাবেন। ছেলে তাঁকে এসবের কিছু বলে যায়নি। রাত একটার সময় চলে গেছে।
যাওয়ার দিনের ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘ছেলে শুধু বুইললি, মা, দুইর (দরজা) দেও। আর তুমি বুবুর বাড়িতে খাইয়ো।’ তিনি বলেন, ‘নাতি যাওয়ার সময় আমাক ধইরি কানতে কানতে কইলি, দাদি আমার পাখিটাক দেখি রাইখো। কবে তুমার সাথে আর দেখা হবি জানিনি। আব্বা লিয়া যাচ্ছে, তাই যাচ্চি। ছেলের বউও কানতে লাইগলি।’ এটুকু বলেও হোসনে আরা নিজেও কাঁদতে লাগলেন। হোসনে আরা ঘরের ভেতরে নিয়ে গিয়ে দেখালেন, তার নাতিদের জামাকাপড় এখনো রয়ে গেছে। দুই নাতনির দোলনাটা খালি ঝুলছে।
গত ৪ মার্চ ‘দায় মাথায় কেউ ঘরছাড়া কেউ নিঃস্ব’ শিরোনামে খবর প্রকাশের পর হোসনে আরা বেগমের নাতির সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছিল। এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার জন্য ছেলেটার ভীষণ আকুতি ছিল। সব শুনে স্থানীয় ইউএনও বলেছিলেন, বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক যদি ছেলেটার দায়িত্ব নেন, তাহলে পরীক্ষা কেন্দ্রের দায়িত্ব তিনি নেবেন, যাতে কোনো ঝামেলা না হয়। শেষ পর্যন্ত ছেলেটার পরীক্ষা দেওয়া হয়নি।
এই গ্রামের আরও দুই পরিবার পাকা বাড়িঘর রেখে ঋণের দায়ে আত্মগোপন করেছে। এ রকম অসংখ্য আত্মগোপনের কাহিনি গ্রাম-শহরে রয়েছে।
এসব দেখে একটি সহজ প্রশ্ন মাথায় আসে, ঋণ দেওয়ার আগে সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়েছে কি না। অধিকাংশ ‘কেস স্টোরি’ শুনে মনে হয়েছে, এই লোকগুলো একাধিক জায়গা থেকে ঋণ নিয়েছেন। এনজিওকর্মীরা তাঁদের ঋণ প্রদানের টার্গেট পূরণের জন্য কোনো রকম যাচাই-বাছাই না করেই ঋণ দিয়েছেন। আর গ্রামের মহাজনেরা তো এসবের ধারই ধারেন না। তাঁরা ফাঁকা স্ট্যাম্পে সই নিয়ে পরে ইচ্ছেমতো পাওনা বসিয়ে নেন।
এই ফাঁদ থেকে বাঁচার জন্য ভুক্তভোগীরা এনজিও থেকে ঋণ দেন। একটার কিস্তি দেওয়ার জন্য আরেকটি থেকে নেন। রাজশাহী নগরের বাজে কাজলা মহল্লার এক নারী এভাবে ৩১টি সংস্থার ঋণে জড়িয়েছিলেন। মূল ঋণের ওপরে তার সুদের হার দাঁড়িয়েছিল ৫৫১ শতাংশ। এ নিয়ে প্রথম আলোতে একটি প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়েছিল।
এ দেশের গরিব মানুষের জীবনটাই একটা কাটা ঘা। পরিশোধের সক্ষমতা যাচাই না করে তাদের ঋণ দেওয়া মানে সেই কাটা ঘায়ে নুনের (ঋণের) ছিটা দেওয়া। মিনারুলের স্ত্রী ও দুই শিশুসন্তানের আত্মা, পরীক্ষা না দিতে পারা সেলিম হোসেনের ছেলে, জহুরুলের নববিবাহিতা কন্যা, অটোরিকশাচালক শামসুদ্দিনের দুই শিশুকন্যা আমাদের কোনো দিন ক্ষমা করবেন না।
আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ নিজস্ব প্রতিবেদক, প্রথম আলো, রাজশাহী
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র ল ইসল ম ঋণ র দ য় পর ব র পর ক ষ র জন য খবর প এনজ ও
এছাড়াও পড়ুন:
আজ টিভিতে যা দেখবেন (৭ নভেম্বর ২০২৫)
চতুর্থ যুব ওয়ানডেতে আজ মুখোমুখি বাংলাদেশ–আফগানিস্তান। ফিফা অনূর্ধ্ব-১৭ বিশ্বকাপে আছে ব্রাজিলের ম্যাচ।৪র্থ যুব ওয়ানডে
বাংলাদেশ–আফগানিস্তান
সকাল ৯টা, টি স্পোর্টস
ইংল্যান্ড–হাইতি
সন্ধ্যা ৬–৩০ মি., ফিফা+ টিভি
ব্রাজিল–ইন্দোনেশিয়া
রাত ৯–৪৫ মি., ফিফা+ টিভি
ব্রেমেন–ভলফসবুর্গ
রাত ১–৩০ মি., সনি স্পোর্টস টেন ২
এলচে–রিয়াল সোসিয়েদাদ
রাত ২টা, রাজধানী টিভি ও বিগিন অ্যাপ