ইরাক যুদ্ধ উসকে দেওয়া পশ্চিমা সুর ইরান সংঘাতেও শোনা যাচ্ছে কি
Published: 24th, June 2025 GMT
‘এক বিপজ্জনক ও আগ্রাসী শাসনব্যবস্থা ভেঙে একটি জাতিকে মুক্ত করার আরও বড় সক্ষমতা আছে আজ আমাদের। বেসামরিক লোকজনের বিরুদ্ধে সহিংসতা না চালিয়েই নতুন কৌশল ও নির্ভুল অস্ত্রের মাধ্যমে আমরা সামরিক লক্ষ্য অর্জন করতে পারি।’
কথাগুলো শুনে মনে হতে পারে যে ইরানে যুক্তরাষ্ট্রের হামলা করার পর গতকালই যেন এটি বলা হয়েছে। কিন্তু আসলে তা নয়।
২০০৩ সালের ১ মে মার্কিন বিমানবাহী রণতরী ইউএসএস আব্রাহাম লিংকনে দাঁড়িয়ে এসব কথা বলেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ। সে সময় তিনি ইরাকে বড় আকারের সামরিক অভিযান শেষ হওয়ার ঘোষণা দেন।
এখন ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র যখন ইরানের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়েছে, তখন পশ্চিমা নেতারা এমন সব কথা বলছেন, যা ইরাক যুদ্ধ উসকে দেওয়া বিভিন্ন বক্তব্যের সঙ্গে ভীষণভাবে মিলে যাচ্ছে।
ইরানকে কখনোই পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করতে দেওয়া যাবে না। যুক্তরাষ্ট্র সেই হুমকি কমাতে পদক্ষেপ নিয়েছে।কিয়ার স্টারমার, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রীচেনা হুঁশিয়ারি, একই রকম অজুহাতইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র দাবি করেছে, ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করা থেকে বিরত রাখার উদ্দেশ্যে তারা দেশটিতে সামরিক হামলা চালিয়েছে। তবে ইরান জোর দিয়ে বলেছে, তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ ও শুধু বেসামরিক উদ্দেশ্যেই পরিচালিত।
তিন দশকের বেশি সময় ধরে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর মুখে বারবার একটি কথা শোনা গেছে। তা হলো ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির দ্বারপ্রান্তে রয়েছে।
নেতানিয়াহু ২০০২ সালে মার্কিন কংগ্রেসের প্রতি ইরাকে আক্রমণ করার আহ্বান জানান। সে সময় তিনি দাবি করেন, বাগদাদ গণবিধ্বংসী অস্ত্র তৈরি করছে। একই সঙ্গে দাবি করেন, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করছে।
পরে যুক্তরাষ্ট্র ২০০৩ সালে ইরাক আক্রমণ করে। কিন্তু দেশটিতে কোনো গণবিধ্বংসী অস্ত্র পাওয়া যায়নি।
যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের সাম্প্রতিক উসকানিমূলক বক্তব্য শুধু ইরানের কথিত পারমাণবিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচির মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এসব বক্তব্য ক্রমশ ইরানের সরকার পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে দীর্ঘদিন ধরে বিতর্কিতভাবে সরকার পরিবর্তনে ভূমিকা রাখছে।
আরও পড়ুনইরানের পারমাণবিক চুক্তি নিয়ে কী বললেন রুশ উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী২ ঘণ্টা আগেইতিহাসের পুনরাবৃত্তিযুক্তরাষ্ট্র ও দেশটির মিত্রদের পরিচালিত যুদ্ধ ইরাককে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছিল। এতে লাখ লাখ ইরাকি নিহত হন। প্রায় সাড়ে চার হাজার মার্কিন সেনাও প্রাণ হারান এবং সাম্প্রদায়িক সংঘাতে দেশটির পরিস্থিতি চরম অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে।
পেছনে ফিরে তাকালে দেখা যায়, যেসব বক্তব্য ইরাকে আগ্রাসনের পথ তৈরি করেছিল, সেসব বক্তব্য আজ উদ্বেগজনকভাবে বেশ পরিচিত মনে হচ্ছে।
২০০৩ সালে ইরাক যুদ্ধ চলাকালে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য একসঙ্গে পুরো বিশ্বকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিল, ইরাকের কাছে গণবিধ্বংসী অস্ত্র রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র ও দেশটির মিত্রদের পরিচালিত যুদ্ধ ইরাককে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছিল। এতে লাখ লাখ ইরাকি নিহত হন। প্রায় সাড়ে চার হাজার মার্কিন সেনাও প্রাণ হারান এবং সাম্প্রদায়িক সংঘাতে দেশটির পরিস্থিতি চরম অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে।ইরানে চলমান সংঘাতের পেছনেও পশ্চিমারা একই সুরে কথা বলছে। ইসরায়েল দীর্ঘ সময় ধরে বলছে, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির দ্বারপ্রান্তে। যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, ইরানকে কখনো পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে দেওয়া হবে না।
ইরানকে কোনোভাবেই পারমাণবিক বোমা তৈরি করতে দেওয়া উচিত হবে না বলে সম্প্রতি মন্তব্য করেছেন ন্যাটোর মহাসচিব মার্ক রুটও। ইরানে মার্কিন হামলার বিষয়ে তিনি বলেছেন, ‘আমার মতে, যুক্তরাষ্ট্র যা করেছে, তা আন্তর্জাতিক আইনের বিরুদ্ধে নয়।’
যুক্তরাষ্ট্রের ইরানে হামলার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার বলেন, ‘ইরানকে কখনোই পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করতে দেওয়া যাবে না। যুক্তরাষ্ট্র সেই হুমকি কমাতে পদক্ষেপ নিয়েছে।’
আরও পড়ুনইরানে হামলার সিদ্ধান্ত গত বছরই নেন নেতানিয়াহু, গোপন বৈঠকে হয় হত্যার তালিকা২ ঘণ্টা আগেএকই সুরে ২০০৩ সালের ইরাক যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী ডোনাল্ড রামসফেল্ড বলেন, ‘তাঁর (ইরাকের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন) শাসনব্যবস্থার কাছে বিপুল পরিমাণ রাসায়নিক ও জৈব অস্ত্রের মজুত রয়েছে, যার হিসাব নেই.
এদিকে ইরানে সরকার পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিয়েছেন ট্রাম্প। নিজ মালিকানাধীন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে তিনি লিখেছেন, ‘“সরকার পরিবর্তন” শব্দটি ব্যবহার করা রাজনৈতিকভাবে সঠিক নয়। তবে বর্তমান ইরান সরকার যদি “ইরানকে আবার মহান” করতে না পারে, তবে সরকার পরিবর্তন হবে না কেন? ইরানকে আবার মহান করে তুলুন!’
ইরাক যুদ্ধ শুরুর আগে ঠিক এ সুরেই কথা বলেছিলেন বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। ২০০২ সালের ২০ সেপ্টেম্বর তিনি যুক্তরাষ্ট্রের হাউস কমিটি অন গভর্নমেন্ট রিফর্মের সামনে বক্তব্য দিতে গিয়ে বলেন, ‘আপনি যদি সাদ্দাম ও সাদ্দামের শাসনব্যবস্থাকে অপসারণ করেন, আমি আপনাকে নিশ্চয়তা দিচ্ছি, এর প্রভাব ওই অঞ্চলে বিশাল ইতিবাচক প্রতিধ্বনি সৃষ্টি করবে...শুধু শাসনব্যবস্থা উৎখাত করাই নয়, বরং সেই সমাজকে রূপান্তর করাও হবে আসল পরীক্ষা। এর মাধ্যমেই আরব বিশ্বে গণতন্ত্রায়ণের প্রক্রিয়া শুরু হবে।’
আরও পড়ুনইরান যুদ্ধবিরতিতে সম্মতি দেয়নি, ট্রাম্প আবারও মিথ্যা বলছেন: তেহরান টাইমস৩ ঘণ্টা আগেউৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: য ক তর ষ ট র ও য ক তর ষ ট র র শ সনব যবস থ ২০০৩ স ল মন ত র কর ছ ল দ শট র ইসর য
এছাড়াও পড়ুন:
সরাসরি: ২২ বছর আগের শোনা কথার প্রতিধ্বনি হচ্ছে ২০২৫ সালে ইরানেও
“আজ আমাদের কাছে এমন এক শক্তি আছে, যা দিয়ে একটি বিপজ্জনক ও আগ্রাসী শাসনব্যবস্থাকে ভেঙে ফেলার মাধ্যমে একটি জাতিকে মুক্ত করা সম্ভব। নতুন কৌশল ও নিখুঁত অস্ত্রের মাধ্যমে আমরা সামরিক লক্ষ্য অর্জন করতে পারি, বেসামরিক নাগরিকদের ওপর সহিংসতা না চালিয়েই।”
এই কথাগুলো শুনলে মনে হতে পারে, এগুলো গতকালই ইরানে যুক্তরাষ্ট্রের হামলার পর কোনো মার্কিন নেতা বলেছেন। কিন্তু বাস্তবতা তা নয়।
এই কথাগুলো বলেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ; ২০০৩ সালের ১ মে, ইউএসএস আব্রাহাম লিঙ্কনে দাঁড়িয়ে, যখন তিনি ইরাকে বড় ধরনের সামরিক অভিযান শেষ হওয়ার ঘোষণা দিচ্ছিলেন। আজ যখন ইরানের সঙ্গে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র ক্রমবর্ধমান সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছে, তখন বিশ্বনেতারা এমন ভাষা ও বক্তব্য ব্যবহার করছেন, যা আশঙ্কাজনকভাবে ২০ বছর আগের ইরাক যুদ্ধের প্রাক্কালীন সময়ের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে।
আরো পড়ুন:
প্রতিশোধ: ইসরায়েলে নতুন করে জোরদার হামলা শুরু করেছে ইরান
পুতিন বলছেন, ইরানের বিরুদ্ধে আগ্রাসন ‘অকারণ’
পরিচিত সতর্কতা, একই রকম যুক্তি
ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র দাবি করছে, তারা ইরানের বিরুদ্ধে সামরিক হামলা চালাচ্ছে যাতে দেশটি পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে না পারে। অন্যদিকে, ইরান দৃঢ়ভাবে বলছে, তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি সম্পূর্ণভাবে শান্তিপূর্ণ ও বেসামরিক উদ্দেশ্যে পরিচালিত হচ্ছে।
গত তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বারবার একই দাবি করে আসছেন, ইরান শিগগিরই পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করে ফেলবে। ২০০২ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে উপস্থিত হয়ে ইরাকে হামলার আহ্বান জানান, দাবি করেন বাগদাদে গণবিধ্বংসী অস্ত্র (ডব্লিউএমডি) তৈরি হচ্ছে। একইসঙ্গে তিনি ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির চেষ্টার কথাও তখন বলেছিলেন।
পরবর্তীতে ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র ইরাকে আগ্রাসন চালায় কিন্তু সেখানে কোনো ডব্লিউএমডি খুঁজে পাওয়া যায়নি।
যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের সাম্প্রতিক উস্কানিমূলক বক্তব্য ইরানের কথিত পারমাণবিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও ক্ষেপণাস্ত্র সক্ষমতার সীমা ছাড়িয়ে এখন স্পষ্টভাবে ‘শাসনব্যবস্থা পরিবর্তনের’ ইঙ্গিত দিচ্ছে।সেই একই পথ, ইরাকের মতো। যা মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্র বহুবার বিতর্কিতভাবে করে গেছে।
আবার কি ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হচ্ছে?
২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের তথাকথিত ‘ঐচ্ছিক জোট’ পরিচালিত যুদ্ধ ইরাককে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছিল। এতে লাখো ইরাকি নিহত হন, প্রায় ৪ হাজার ৫০০ মার্কিন সেনা প্রাণ হারান এবং দেশটিতে গভীর সাম্প্রদায়িক বিভাজন ও স্থায়ী অস্থিরতা সৃষ্টি হয়।
পেছনে ফিরে তাকালে সেই ২০০৩ সালের যুদ্ধের আগে ব্যবহৃত ভাষ্যগুলো আজকে ইরানের সঙ্গে আশঙ্কাজনকভাবে সাদৃশ্যপূর্ণ মনে হয়। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য সে সময় পুরো বিশ্বকে বোঝাতে চেষ্টা করেছিল যে, ইরাকের কাছে গণবিধ্বংসী অস্ত্র রয়েছে; যদিও যুদ্ধের পর সেগুলোর কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি।
এখন ২০২৫ সালে ইরানকে কেন্দ্র করে যেন একই কৌশল আবার ফিরে এসেছে; একইরকম বক্তৃতা, একই ধরনের ‘বিপদ দেখানোর ভাষা’ এবং একই ধরনের সামরিক প্রস্তুতির যৌক্তিকতা তৈরি।
ঢাকা/রাসেল