‘এক বিপজ্জনক ও আগ্রাসী শাসনব্যবস্থা ভেঙে একটি জাতিকে মুক্ত করার আরও বড় সক্ষমতা আছে আজ আমাদের। বেসামরিক লোকজনের বিরুদ্ধে সহিংসতা না চালিয়েই নতুন কৌশল ও নির্ভুল অস্ত্রের মাধ্যমে আমরা সামরিক লক্ষ্য অর্জন করতে পারি।’

কথাগুলো শুনে মনে হতে পারে যে ইরানে যুক্তরাষ্ট্রের হামলা করার পর গতকালই যেন এটি বলা হয়েছে। কিন্তু আসলে তা নয়।

২০০৩ সালের ১ মে মার্কিন বিমানবাহী রণতরী ইউএসএস আব্রাহাম লিংকনে দাঁড়িয়ে এসব কথা বলেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ। সে সময় তিনি ইরাকে বড় আকারের সামরিক অভিযান শেষ হওয়ার ঘোষণা দেন।

এখন ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র যখন ইরানের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়েছে, তখন পশ্চিমা নেতারা এমন সব কথা বলছেন, যা ইরাক যুদ্ধ উসকে দেওয়া বিভিন্ন বক্তব্যের সঙ্গে ভীষণভাবে মিলে যাচ্ছে।

ইরানকে কখনোই পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করতে দেওয়া যাবে না। যুক্তরাষ্ট্র সেই হুমকি কমাতে পদক্ষেপ নিয়েছে।কিয়ার স্টারমার, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রীচেনা হুঁশিয়ারি, একই রকম অজুহাত

ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র দাবি করেছে, ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করা থেকে বিরত রাখার উদ্দেশ্যে তারা দেশটিতে সামরিক হামলা চালিয়েছে। তবে ইরান জোর দিয়ে বলেছে, তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ ও শুধু বেসামরিক উদ্দেশ্যেই পরিচালিত।

তিন দশকের বেশি সময় ধরে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর মুখে বারবার একটি কথা শোনা গেছে। তা হলো ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির দ্বারপ্রান্তে রয়েছে।

নেতানিয়াহু ২০০২ সালে মার্কিন কংগ্রেসের প্রতি ইরাকে আক্রমণ করার আহ্বান জানান। সে সময় তিনি দাবি করেন, বাগদাদ গণবিধ্বংসী অস্ত্র তৈরি করছে। একই সঙ্গে দাবি করেন, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করছে।

পরে যুক্তরাষ্ট্র ২০০৩ সালে ইরাক আক্রমণ করে। কিন্তু দেশটিতে কোনো গণবিধ্বংসী অস্ত্র পাওয়া যায়নি।

যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের সাম্প্রতিক উসকানিমূলক বক্তব্য শুধু ইরানের কথিত পারমাণবিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচির মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এসব বক্তব্য ক্রমশ ইরানের সরকার পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে দীর্ঘদিন ধরে বিতর্কিতভাবে সরকার পরিবর্তনে ভূমিকা রাখছে।

আরও পড়ুনইরানের পারমাণবিক চুক্তি নিয়ে কী বললেন রুশ উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী২ ঘণ্টা আগেইতিহাসের পুনরাবৃত্তি

যুক্তরাষ্ট্র ও দেশটির মিত্রদের পরিচালিত যুদ্ধ ইরাককে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছিল। এতে লাখ লাখ ইরাকি নিহত হন। প্রায় সাড়ে চার হাজার মার্কিন সেনাও প্রাণ হারান এবং সাম্প্রদায়িক সংঘাতে দেশটির পরিস্থিতি চরম অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে।

পেছনে ফিরে তাকালে দেখা যায়, যেসব বক্তব্য ইরাকে আগ্রাসনের পথ তৈরি করেছিল, সেসব বক্তব্য আজ উদ্বেগজনকভাবে বেশ পরিচিত মনে হচ্ছে।

২০০৩ সালে ইরাক যুদ্ধ চলাকালে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য একসঙ্গে পুরো বিশ্বকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিল, ইরাকের কাছে গণবিধ্বংসী অস্ত্র রয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র ও দেশটির মিত্রদের পরিচালিত যুদ্ধ ইরাককে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছিল। এতে লাখ লাখ ইরাকি নিহত হন। প্রায় সাড়ে চার হাজার মার্কিন সেনাও প্রাণ হারান এবং সাম্প্রদায়িক সংঘাতে দেশটির পরিস্থিতি চরম অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে।

ইরানে চলমান সংঘাতের পেছনেও পশ্চিমারা একই সুরে কথা বলছে। ইসরায়েল দীর্ঘ সময় ধরে বলছে, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির দ্বারপ্রান্তে। যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, ইরানকে কখনো পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে দেওয়া হবে না।

ইরানকে কোনোভাবেই পারমাণবিক বোমা তৈরি করতে দেওয়া উচিত হবে না বলে সম্প্রতি মন্তব্য করেছেন ন্যাটোর মহাসচিব মার্ক রুটও। ইরানে মার্কিন হামলার বিষয়ে তিনি বলেছেন, ‘আমার মতে, যুক্তরাষ্ট্র যা করেছে, তা আন্তর্জাতিক আইনের বিরুদ্ধে নয়।’

যুক্তরাষ্ট্রের ইরানে হামলার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার বলেন, ‘ইরানকে কখনোই পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করতে দেওয়া যাবে না। যুক্তরাষ্ট্র সেই হুমকি কমাতে পদক্ষেপ নিয়েছে।’

আরও পড়ুনইরানে হামলার সিদ্ধান্ত গত বছরই নেন নেতানিয়াহু, গোপন বৈঠকে হয় হত্যার তালিকা২ ঘণ্টা আগে

একই সুরে ২০০৩ সালের ইরাক যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী ডোনাল্ড রামসফেল্ড বলেন, ‘তাঁর (ইরাকের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন) শাসনব্যবস্থার কাছে বিপুল পরিমাণ রাসায়নিক ও জৈব অস্ত্রের মজুত রয়েছে, যার হিসাব নেই.

..এবং তাঁর একটি সক্রিয় কর্মসূচি রয়েছে, যার মাধ্যমে তিনি পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি ও উন্নয়নের চেষ্টা করছেন।’

এদিকে ইরানে সরকার পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিয়েছেন ট্রাম্প। নিজ মালিকানাধীন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে তিনি লিখেছেন, ‘“সরকার পরিবর্তন” শব্দটি ব্যবহার করা রাজনৈতিকভাবে সঠিক নয়। তবে বর্তমান ইরান সরকার যদি “ইরানকে আবার মহান” করতে না পারে, তবে সরকার পরিবর্তন হবে না কেন? ইরানকে আবার মহান করে তুলুন!’

ইরাক যুদ্ধ শুরুর আগে ঠিক এ সুরেই কথা বলেছিলেন বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। ২০০২ সালের ২০ সেপ্টেম্বর তিনি যুক্তরাষ্ট্রের হাউস কমিটি অন গভর্নমেন্ট রিফর্মের সামনে বক্তব্য দিতে গিয়ে বলেন, ‘আপনি যদি সাদ্দাম ও সাদ্দামের শাসনব্যবস্থাকে অপসারণ করেন, আমি আপনাকে নিশ্চয়তা দিচ্ছি, এর প্রভাব ওই অঞ্চলে বিশাল ইতিবাচক প্রতিধ্বনি সৃষ্টি করবে...শুধু শাসনব্যবস্থা উৎখাত করাই নয়, বরং সেই সমাজকে রূপান্তর করাও হবে আসল পরীক্ষা। এর মাধ্যমেই আরব বিশ্বে গণতন্ত্রায়ণের প্রক্রিয়া শুরু হবে।’

আরও পড়ুনইরান যুদ্ধবিরতিতে সম্মতি দেয়নি, ট্রাম্প আবারও মিথ্যা বলছেন: তেহরান টাইমস৩ ঘণ্টা আগে

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: য ক তর ষ ট র ও য ক তর ষ ট র র শ সনব যবস থ ২০০৩ স ল মন ত র কর ছ ল দ শট র ইসর য

এছাড়াও পড়ুন:

বিবাহে ‘মোহরে ফাতেমি‘ কী?

“মোহরে ফাতেমি” মুসলিম বিবাহে একটি বহুল আলোচিত ধারণা, যাকে মূলত নারীর অধিকার, সম্মান ও আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রতীক বলা যায়।

‘মোহর’ বা ‘মাহর’ শব্দটি আরবি “মাহর” থেকে এসেছে, যার অর্থ, স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে নির্ধারিত অর্থ বা সম্পদ, যা বিবাহের অধিকার হিসেবে বাধ্যতামূলকভাবে প্রদান করতে হয়।

‘মোহরে ফাতেমি’ বলতে বোঝানো হয় সেই পরিমাণ মাহর, যা নবীজি (স.) তাঁর কন্যা ফাতিমা (রা.)-এর বিয়েতে নির্ধারণ করেছিলেন। এটি মুসলিম ইতিহাসে আদর্শ মাহরের মানদণ্ড হিসেবে বিবেচিত হয়।

মোহরে ফাতেমির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

রাসুলুল্লাহ (স.)-এর কন্যা ফাতিমা (রা.)-এর বিয়ে হয়েছিল আলী ইবনে আবি তালিব (রা.)-এর সঙ্গে। এই বিয়েতে নবীজি (স.) যে পরিমাণ মোহর নির্ধারণ করেছিলেন, সেটিই পরে “মোহরে ফাতেমি” নামে পরিচিত হয়।

ইমাম বায়হাকি ও ইবনে মাজাহ-এর বর্ণনা অনুযায়ী, মোহরে ফাতেমি ছিল ৫০০ দিরহাম রূপা (প্রায় ১.৫ কেজি রূপা)। (সুনান ইবনে মাজাহ, হাদিস: ১৮৮৭; আল-বায়হাকি, আস-সুনান আল-কুবরা, খণ্ড ৭, পৃ. ২৩৩)

আরও পড়ুনমুসলিম বিবাহে ‘কুফু’ অর্থ কী২৩ অক্টোবর ২০২৫

মোহরের গুরুত্ব

কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, “তোমরা নারীদের মাহর (মোহরানা) স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রদান করো।” (সুরা আন-নিসা, আয়াত: ৪)

অর্থাৎ, এটি কোনো উপহার নয়, বরং স্ত্রীর ন্যায্য অধিকার।

নবীজি (স.) বলেছেন, “সবচেয়ে উত্তম বিবাহ হলো সেই বিবাহ, যার মোহর সবচেয়ে সহজ।” (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস: ১৮৮৭)

এই হাদিস থেকে বোঝা যায়, ইসলাম চায় না মোহর এমন ভারী হোক যাতে বিবাহ কঠিন হয়ে যায়। বরং, সহজ, পরিমিত ও সম্মানজনক পরিমাণ হওয়াই সুন্নাহ।

মোহরে ফাতেমির প্রতীকী অর্থ

“মোহরে ফাতেমি” কেবল একটি অর্থমূল্য নয়, বরং এটি মুসলিম সমাজে নারীর মর্যাদা ও আত্মসম্মানের প্রতীক। এর মাধ্যমে নবীজি (স.) মুসলিম সমাজকে একটি বার্তা দিয়েছেন যে, নারী কোনো বোঝা নয়, বরং মর্যাদাপূর্ণ একজন মানুষ, যার নিজের অধিকার আল্লাহ নির্ধারণ করেছেন।

একইসাথে এটি ইসলামে সামাজিক ভারসাম্যের একটি নিদর্শন—যেখানে মোহর এমন নির্ধারণ করা হয়, যা গরিব ও ধনীর উভয়ের জন্যই বাস্তবসম্মত।

মোহরে ফাতেমির আর্থিক মান

ইতিহাসবিদ ইমাম নববী ও ইবনে হাজার আসকালানি উল্লেখ করেছেন, এক দিরহাম প্রায় ২.৯৭৫ গ্রাম রূপা সমান।

তাহলে ৫০০ দিরহাম × ২.৯৭৫ গ্রাম = প্রায় ১৪৮৭.৫ গ্রাম (১.৫ কেজি রূপা)।

বর্তমান সময়ের হিসাবে, বাংলাদেশে যদি প্রতি ভরি (প্রায় ১১.৬৬ গ্রাম) রূপার দাম ধরা হয় প্রায় ১৫০০ টাকা, তাহলে মোহরে ফাতেমির আর্থিক মান দাঁড়ায় প্রায় ১ লক্ষ ৯০ হাজার টাকা। বাজারদর অনুসারে পরিবর্তনশীল।

এই হিসাব শুধুমাত্র একটি রেফারেন্স—মূল উদ্দেশ্য হলো, মাহর যেন পরিমিত, বাস্তবসম্মত ও সম্মানজনক হয়।

আরও পড়ুননারীর প্রতি সহিংসতা নিয়ে কী বলে ইসলাম২৮ আগস্ট ২০২৫

মোহরে ফাতেমি কি বাধ্যতামূলক?

না, মোহরে ফাতেমি বাধ্যতামূলক নয়। ইসলামি শরিয়তে প্রতিটি বিবাহের মোহর দুই পক্ষের আর্থিক ও সামাজিক অবস্থার ওপর নির্ভরশীল।

তবে নবীজি (স.)-এর কন্যার মোহরকে আদর্শ ধরা হয়, কারণ এটি বিনয়, সরলতা ও ন্যায়ের প্রতীক। ইমাম আবু হানিফা (রহ.) বলেন, “মোহরে ফাতেমি একটি সুন্নাহস্বরূপ নির্ধারণ। চাইলে এর কম বা বেশি নির্ধারণ করা বৈধ।” (আল-ফাতাওয়া আল-হিন্দিয়া, খণ্ড ১, পৃ. ২৯৪, দারুল ইহইয়া, কায়রো সংস্করণ)

অতএব, কেউ মোহরে ফাতেমি পরিমাণ নির্ধারণ করলে তা মুস্তাহাব (পছন্দনীয়), কিন্তু তার চেয়ে কম বা বেশি করলেও বিবাহ বৈধ।

আধুনিক প্রেক্ষাপটে মোহরে ফাতেমির তাৎপর্য

বর্তমান সমাজে অনেকেই মোহরকে “আনুষ্ঠানিকতা” মনে করেন, আবার কেউ কেউ মোহরকে “চাপ বা মূল্য” হিসেবে বিবেচনা করেন—যা ইসলামের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ ভুল।

মোহর নারীর আত্মসম্মানের প্রতীক, পুরুষের দায়িত্ববোধের প্রকাশ এবং বিবাহ বন্ধনের আর্থিক নিশ্চয়তা।

একজন আধুনিক মুসলিম নারী হিসেবে ফাতিমা (রা.) ছিলেন নবীজির গৃহের মর্যাদার কেন্দ্রবিন্দু। তাঁর নামেই নির্ধারিত এই মোহর আজও মুসলিম সমাজে “সুন্নাহ মোহর” হিসেবে সম্মানিত।

সমাজে বিবাহ সহজ করা ও নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার দৃষ্টিকোণ থেকে, মোহরে ফাতেমি আমাদের সামনে এক সমতা ও সংযমের মডেল হিসেবে দাঁড়ায়।

অতএব, মুসলিম সমাজের উচিত মোহরকে বোঝা নয়, বরং ভালোবাসা, দায়িত্ব ও সম্মানের প্রতিশ্রুতি হিসেবে দেখা।

আরও পড়ুনবিবাহের সুন্নত 'ওয়ালিমা'১২ জানুয়ারি ২০১৮

সম্পর্কিত নিবন্ধ