হিমাচলে এক তরুণীকে দুই ভাইয়ের বিয়ে, সমালোচনার জবাবে কী বলছেন তাঁরা
Published: 9th, August 2025 GMT
ভারতের হিমাচল প্রদেশে দুই ভাই মিলে একই তরুণীকে বিয়ে করেছেন। এ নিয়ে সাধারণ মানুষ ও ভারতের গণমাধ্যমে ব্যাপক হইচই হয়েছে। তবে তাঁরা বলছেন, জনসমালোচনা তাঁদের কোনোভাবেই প্রভাবিত করতে পারেনি, বরং তাঁরা গর্ব বোধ করেন। কারণ, এটি হট্টি গোষ্ঠীর শত শত বছরের পুরোনো প্রথা।
হিমাচল প্রদেশের শিল্লাই এলাকার ঠিন্ডো পরিবারের নেগি ভাইয়েরা ঐতিহ্যবাহী বহুপতিত্বের ‘জোড়িদার প্রথা’ অনুযায়ী কুনহাট গ্রামের সুনীতা চৌহানকে বিয়ে করেছেন। তাঁরা জানান, এ সিদ্ধান্ত শুধু ব্যক্তিগত বিশ্বাসের বিষয় নয়, বরং জোড়িদার নামে পরিচিত এই প্রথা একজন স্ত্রীর একাধিক ভাইকে স্বামী হিসেবে গ্রহণের সাংস্কৃতিক গুরুত্বও তুলে ধরে।
ফেসবুকে দেওয়া এক ভিডিওতে প্রদীপ নেগি বলেন, ‘হট্টি গোষ্ঠিতে এই প্রথা বহু প্রজন্ম ধরে চলছে এবং চলতে থাকবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কেউ গালাগাল দিচ্ছে, তাতে আমার কিছু যায়–আসে না।’
প্রদীপ আরও বলেন, জোড়িদার প্রথা শুধু তাঁদের অঞ্চলে নয়, উত্তরাখন্ডের জৌনসার-বাওয়ার এলাকাতেও প্রচলিত। সেখানে এ ধরনের বিয়েতে দুই বর একই কনের সঙ্গে মালা বদল করে থাকেন।
প্রদীপের ভাই কপিল নেগি বলেন, তাঁদের বিয়ে সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায় হয়েছে, জোরপূর্বক নয়। তাঁরা দুই ভাই, তাঁদের স্ত্রী এবং দুই পরিবারের সবার সম্মতিতেই এ বিয়ে হয়েছে।
প্রদীপ বলেন, ‘আমি আমাদের প্রথা ও সংস্কৃতির পক্ষে কথা বলতেই থাকব। যাঁরা আমাদের রীতি জানেন না, তাঁরাও মতামত দিচ্ছেন। আমরা সবাই মিলেই বিয়েতে রাজি হয়েছি, আমাদের পরিবার ও সমাজ এতে খুশি।’
প্রদীপ বলেন, তাঁদের পরিবার আর্থিকভাবে দুর্বল, জমিজমাও খুব কম। খ্যাতি পাওয়ার কোনো বাসনাও তাঁদের নেই।
প্রদীপের ভাই কপিল বলেন, ‘আমরা খবরের শিরোনাম হওয়ার জন্য বিয়ে করিনি।’
প্রদীপ শেষ করেন এই বলে, ‘আমাদের বিয়ের একমাত্র উদ্দেশ্য একসঙ্গে থাকা ও একে অপরকে ভালোবাসা। মানুষকে অনুরোধ করব, আমাদের সমালোচনা করবেন না। আমাদের নিজেদের জীবন আছে, আর আমরা এতে সুখী।’
এই দুই ভাইয়ের বিয়ের অনুষ্ঠান হয়েছে শিল্লাই গ্রামের সিরমৌর জেলার ট্রান্স-গিরি এলাকায়। গত ১২ জুলাই শুরু হয়ে তিন দিন ধরে চলে এই বিয়ের অনুষ্ঠান। এতে ছিল নাচ, স্থানীয় লোকগান আর গ্রামীণ উৎসবের আমেজ।
এই পুরোনো প্রথা পাহাড়ি কৃষি সম্প্রদায়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এতে পৈতৃক জমি ভাগাভাগি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। এ ধরনের বিয়েতে সাধারণত বড় ভাইকে সন্তানের আইনগত পিতা হিসেবে ধরা হয়।
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
বিবাহে ‘মোহরে ফাতেমি‘ কী?
“মোহরে ফাতেমি” মুসলিম বিবাহে একটি বহুল আলোচিত ধারণা, যাকে মূলত নারীর অধিকার, সম্মান ও আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রতীক বলা যায়।
‘মোহর’ বা ‘মাহর’ শব্দটি আরবি “মাহর” থেকে এসেছে, যার অর্থ, স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে নির্ধারিত অর্থ বা সম্পদ, যা বিবাহের অধিকার হিসেবে বাধ্যতামূলকভাবে প্রদান করতে হয়।
‘মোহরে ফাতেমি’ বলতে বোঝানো হয় সেই পরিমাণ মাহর, যা নবীজি (স.) তাঁর কন্যা ফাতিমা (রা.)-এর বিয়েতে নির্ধারণ করেছিলেন। এটি মুসলিম ইতিহাসে আদর্শ মাহরের মানদণ্ড হিসেবে বিবেচিত হয়।
মোহরে ফাতেমির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
রাসুলুল্লাহ (স.)-এর কন্যা ফাতিমা (রা.)-এর বিয়ে হয়েছিল আলী ইবনে আবি তালিব (রা.)-এর সঙ্গে। এই বিয়েতে নবীজি (স.) যে পরিমাণ মোহর নির্ধারণ করেছিলেন, সেটিই পরে “মোহরে ফাতেমি” নামে পরিচিত হয়।
ইমাম বায়হাকি ও ইবনে মাজাহ-এর বর্ণনা অনুযায়ী, মোহরে ফাতেমি ছিল ৫০০ দিরহাম রূপা (প্রায় ১.৫ কেজি রূপা)। (সুনান ইবনে মাজাহ, হাদিস: ১৮৮৭; আল-বায়হাকি, আস-সুনান আল-কুবরা, খণ্ড ৭, পৃ. ২৩৩)
আরও পড়ুনমুসলিম বিবাহে ‘কুফু’ অর্থ কী২৩ অক্টোবর ২০২৫মোহরের গুরুত্ব
কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, “তোমরা নারীদের মাহর (মোহরানা) স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রদান করো।” (সুরা আন-নিসা, আয়াত: ৪)
অর্থাৎ, এটি কোনো উপহার নয়, বরং স্ত্রীর ন্যায্য অধিকার।
নবীজি (স.) বলেছেন, “সবচেয়ে উত্তম বিবাহ হলো সেই বিবাহ, যার মোহর সবচেয়ে সহজ।” (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস: ১৮৮৭)
এই হাদিস থেকে বোঝা যায়, ইসলাম চায় না মোহর এমন ভারী হোক যাতে বিবাহ কঠিন হয়ে যায়। বরং, সহজ, পরিমিত ও সম্মানজনক পরিমাণ হওয়াই সুন্নাহ।
মোহরে ফাতেমির প্রতীকী অর্থ
“মোহরে ফাতেমি” কেবল একটি অর্থমূল্য নয়, বরং এটি মুসলিম সমাজে নারীর মর্যাদা ও আত্মসম্মানের প্রতীক। এর মাধ্যমে নবীজি (স.) মুসলিম সমাজকে একটি বার্তা দিয়েছেন যে, নারী কোনো বোঝা নয়, বরং মর্যাদাপূর্ণ একজন মানুষ, যার নিজের অধিকার আল্লাহ নির্ধারণ করেছেন।
একইসাথে এটি ইসলামে সামাজিক ভারসাম্যের একটি নিদর্শন—যেখানে মোহর এমন নির্ধারণ করা হয়, যা গরিব ও ধনীর উভয়ের জন্যই বাস্তবসম্মত।
মোহরে ফাতেমির আর্থিক মান
ইতিহাসবিদ ইমাম নববী ও ইবনে হাজার আসকালানি উল্লেখ করেছেন, এক দিরহাম প্রায় ২.৯৭৫ গ্রাম রূপা সমান।
তাহলে ৫০০ দিরহাম × ২.৯৭৫ গ্রাম = প্রায় ১৪৮৭.৫ গ্রাম (১.৫ কেজি রূপা)।
বর্তমান সময়ের হিসাবে, বাংলাদেশে যদি প্রতি ভরি (প্রায় ১১.৬৬ গ্রাম) রূপার দাম ধরা হয় প্রায় ১৫০০ টাকা, তাহলে মোহরে ফাতেমির আর্থিক মান দাঁড়ায় প্রায় ১ লক্ষ ৯০ হাজার টাকা। বাজারদর অনুসারে পরিবর্তনশীল।
এই হিসাব শুধুমাত্র একটি রেফারেন্স—মূল উদ্দেশ্য হলো, মাহর যেন পরিমিত, বাস্তবসম্মত ও সম্মানজনক হয়।
আরও পড়ুননারীর প্রতি সহিংসতা নিয়ে কী বলে ইসলাম২৮ আগস্ট ২০২৫মোহরে ফাতেমি কি বাধ্যতামূলক?
না, মোহরে ফাতেমি বাধ্যতামূলক নয়। ইসলামি শরিয়তে প্রতিটি বিবাহের মোহর দুই পক্ষের আর্থিক ও সামাজিক অবস্থার ওপর নির্ভরশীল।
তবে নবীজি (স.)-এর কন্যার মোহরকে আদর্শ ধরা হয়, কারণ এটি বিনয়, সরলতা ও ন্যায়ের প্রতীক। ইমাম আবু হানিফা (রহ.) বলেন, “মোহরে ফাতেমি একটি সুন্নাহস্বরূপ নির্ধারণ। চাইলে এর কম বা বেশি নির্ধারণ করা বৈধ।” (আল-ফাতাওয়া আল-হিন্দিয়া, খণ্ড ১, পৃ. ২৯৪, দারুল ইহইয়া, কায়রো সংস্করণ)
অতএব, কেউ মোহরে ফাতেমি পরিমাণ নির্ধারণ করলে তা মুস্তাহাব (পছন্দনীয়), কিন্তু তার চেয়ে কম বা বেশি করলেও বিবাহ বৈধ।
আধুনিক প্রেক্ষাপটে মোহরে ফাতেমির তাৎপর্য
বর্তমান সমাজে অনেকেই মোহরকে “আনুষ্ঠানিকতা” মনে করেন, আবার কেউ কেউ মোহরকে “চাপ বা মূল্য” হিসেবে বিবেচনা করেন—যা ইসলামের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ ভুল।
মোহর নারীর আত্মসম্মানের প্রতীক, পুরুষের দায়িত্ববোধের প্রকাশ এবং বিবাহ বন্ধনের আর্থিক নিশ্চয়তা।
একজন আধুনিক মুসলিম নারী হিসেবে ফাতিমা (রা.) ছিলেন নবীজির গৃহের মর্যাদার কেন্দ্রবিন্দু। তাঁর নামেই নির্ধারিত এই মোহর আজও মুসলিম সমাজে “সুন্নাহ মোহর” হিসেবে সম্মানিত।
সমাজে বিবাহ সহজ করা ও নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার দৃষ্টিকোণ থেকে, মোহরে ফাতেমি আমাদের সামনে এক সমতা ও সংযমের মডেল হিসেবে দাঁড়ায়।
অতএব, মুসলিম সমাজের উচিত মোহরকে বোঝা নয়, বরং ভালোবাসা, দায়িত্ব ও সম্মানের প্রতিশ্রুতি হিসেবে দেখা।
আরও পড়ুনবিবাহের সুন্নত 'ওয়ালিমা'১২ জানুয়ারি ২০১৮