সমুদ্রের তাপ বৃদ্ধির কারণে ক্লাউনফিশের অস্তিত্ব সংকটে
Published: 23rd, September 2025 GMT
বিখ্যাত অ্যানিমেশন সিনেমা ‘ফাইন্ডিং নিমো’ দেখেছেন অনেকেই। সেই সিনেমার মূল চরিত্রে ছিল একটি ক্লাউনফিশ। উজ্জ্বল কমলা রঙের ও ডোরাকাটা মাছ ক্লাউনফিশ। সমুদ্রের বন্য পরিবেশে সি অ্যানিমোনি নামের সামুদ্রিক উদ্ভিদের বনে তারা সুরক্ষা ও আশ্রয় পায়। সাম্প্রতিক সময়ে সমুদ্রের তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে ক্লাউনফিশ কঠিন পরীক্ষার মুখে পড়ছে। গত তিন বছরে লোহিত সাগরের গ্রীষ্মমণ্ডলীয় তাপমাত্রা স্বাভাবিক ৮৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট থেকে ৯০ ডিগ্রি ফারেনহাইট বেড়ে গেছে। এই তাপমাত্রা বৃদ্ধি ক্লাউনফিশসহ বিভিন্ন মাছের জীবনকে অস্বস্তিকর করে তুলছে।
ক্লাউনফিশ ও সামুদ্রিক অ্যানিমোনি একে অপরের ওপর নির্ভরশীল। ক্লাউনফিশ অ্যানিমোনির হুলযুক্ত শুঁড়ের মধ্যে লুকিয়ে থাকে। এ ছাড়া ডিম পাড়া ও শিকারিদের হাত থেকে সুরক্ষিত থাকার নিরাপত্তা দেয়। ক্লাউনফিশ অ্যানিমোনিকে পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করে। এ ধরনের পারস্পরিক সহযোগিতা মহাসাগর জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
অ্যানিমোনিরাও তাদের কোষে বসবাসকারী ক্ষুদ্র শৈবাল জুওক্সান্থেলের ওপর নির্ভর করে। এই শৈবাল তাদের শক্তির প্রধান উৎস। এই একই ধরনের শৈবাল কোরালের মধ্যে বাস করে। যখন সমুদ্রের তাপমাত্রা খুব বেশি বেড়ে যায়, তখন শৈবাল মরে যায়। এ ঘটনাকে ব্লিচিং বলা হয়। ব্লিচিং হওয়া অ্যানিমোনি সাদা রং ধারণ করে। শৈবাল না থাকায় তারা ধীরে ধীরে অনাহারে মারা যেতে শুরু করে। এতে সামগ্রিকভাবে সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ২০২২ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে গবেষকেরা সৌদি আরবের কেন্দ্রীয় উপকূল বরাবর তিনটি প্রবালপ্রাচীরে লোহিত সাগরের ক্লাউনফিশ ও তাদের আশ্রয়দাতা অ্যানিমোনিকে নিয়ে গবেষণা করেন। এই সময়ে পুরো অঞ্চল ২০২৩ সালে একটি বড় সামুদ্রিক তাপপ্রবাহের শিকার হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন ইউনিভার্সিটির মেরিন ইভল্যুশনারি ইকোলজি ল্যাবরেটরির বিজ্ঞানী মরগান বেনেট-স্মিথ বলেন, ‘আমরা সব সময় আশা করি, অ্যানিমোনি ও ক্লাউনফিশের দল ব্লিচিংয়ের ঘটনার পরে ফিরে আসবে। গত ১০ বছরে বারবার এমনটা দেখে যায়। যদিও এবার ভিন্ন এক চরম পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। অ্যানিমোনি প্রায় ছয় মাস ধরে ব্লিচিংয়ের শিকার হয়েছে। এর ফলে ৯৪ থেকে ১০০ শতাংশ ক্লাউনফিশ মারা যায়। আর অ্যানিমোনি ৬৬ থেকে ৯৪ শতাংশ মারা যায়।’
এক দশকের বেশি সময় ধরে বিজ্ঞানীরা মাছ ও সামুদ্রিক উদ্ভিদের এ সম্পর্ক পর্যবেক্ষণ করছেন। বিজ্ঞানী বেনেট-স্মিথ বলেন, এটি বেশ বেদনাদায়ক। লোহিত সাগর এমন একটি জায়গা, যেখানে এটি তাপীয় আশ্রয়স্থল হিসেবে কাজ করবে বলে অনেকেই আশা করেন। এই তাপীয় আশ্রয়স্থল বিভিন্ন উপায়ে ভেঙে পড়ছে।
সুস্থ অ্যানিমোনি ছাড়া ক্লাউনফিশ বিপদে পড়ে গেছে। এই ছোট মাছ তাদের বাসস্থান থেকে খুব বেশি দূরে সাঁতার কাটতে যায় না। বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, সাম্প্রতিক তাপীয় ঘটনার প্রতিক্রিয়া হিসেবে ক্লাউনফিশের জনসংখ্যার প্রায় ১০০ শতাংশ বিলুপ্তির মুখে পড়ছে।
লোহিত সাগরসহ বিভিন্ন সাগরে এমন অবস্থা দেখা যাচ্ছে। একই ধরনের ব্লিচিং ঘটনা বিশ্বের অন্যান্য অংশেও আঘাত হেনেছে। বিজ্ঞানীরা এখন পাপুয়া নিউগিনিতে কী ঘটছে, তা পর্যবেক্ষণ করছেন। সেখানে ক্লাউনফিশ ও অ্যানিমোনিরা ঝুঁকির মধ্যে আছে। তাপের চাপ থেকে বাঁচতে পাপুয়া নিউগিনির ক্লাউনফিশের সংখ্যা সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। সেখানকার মাছগুলো তাদের শরীরকে সংকুচিত করে ফেলছে। এসব তথ্য এনপিজে বায়োডাইভার্সিটি জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।
সূত্র: আর্থ ডটকম
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
বিবাহে ‘মোহরে ফাতেমি‘ কী?
“মোহরে ফাতেমি” মুসলিম বিবাহে একটি বহুল আলোচিত ধারণা, যাকে মূলত নারীর অধিকার, সম্মান ও আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রতীক বলা যায়।
‘মোহর’ বা ‘মাহর’ শব্দটি আরবি “মাহর” থেকে এসেছে, যার অর্থ, স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে নির্ধারিত অর্থ বা সম্পদ, যা বিবাহের অধিকার হিসেবে বাধ্যতামূলকভাবে প্রদান করতে হয়।
‘মোহরে ফাতেমি’ বলতে বোঝানো হয় সেই পরিমাণ মাহর, যা নবীজি (স.) তাঁর কন্যা ফাতিমা (রা.)-এর বিয়েতে নির্ধারণ করেছিলেন। এটি মুসলিম ইতিহাসে আদর্শ মাহরের মানদণ্ড হিসেবে বিবেচিত হয়।
মোহরে ফাতেমির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
রাসুলুল্লাহ (স.)-এর কন্যা ফাতিমা (রা.)-এর বিয়ে হয়েছিল আলী ইবনে আবি তালিব (রা.)-এর সঙ্গে। এই বিয়েতে নবীজি (স.) যে পরিমাণ মোহর নির্ধারণ করেছিলেন, সেটিই পরে “মোহরে ফাতেমি” নামে পরিচিত হয়।
ইমাম বায়হাকি ও ইবনে মাজাহ-এর বর্ণনা অনুযায়ী, মোহরে ফাতেমি ছিল ৫০০ দিরহাম রূপা (প্রায় ১.৫ কেজি রূপা)। (সুনান ইবনে মাজাহ, হাদিস: ১৮৮৭; আল-বায়হাকি, আস-সুনান আল-কুবরা, খণ্ড ৭, পৃ. ২৩৩)
আরও পড়ুনমুসলিম বিবাহে ‘কুফু’ অর্থ কী২৩ অক্টোবর ২০২৫মোহরের গুরুত্ব
কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, “তোমরা নারীদের মাহর (মোহরানা) স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রদান করো।” (সুরা আন-নিসা, আয়াত: ৪)
অর্থাৎ, এটি কোনো উপহার নয়, বরং স্ত্রীর ন্যায্য অধিকার।
নবীজি (স.) বলেছেন, “সবচেয়ে উত্তম বিবাহ হলো সেই বিবাহ, যার মোহর সবচেয়ে সহজ।” (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস: ১৮৮৭)
এই হাদিস থেকে বোঝা যায়, ইসলাম চায় না মোহর এমন ভারী হোক যাতে বিবাহ কঠিন হয়ে যায়। বরং, সহজ, পরিমিত ও সম্মানজনক পরিমাণ হওয়াই সুন্নাহ।
মোহরে ফাতেমির প্রতীকী অর্থ
“মোহরে ফাতেমি” কেবল একটি অর্থমূল্য নয়, বরং এটি মুসলিম সমাজে নারীর মর্যাদা ও আত্মসম্মানের প্রতীক। এর মাধ্যমে নবীজি (স.) মুসলিম সমাজকে একটি বার্তা দিয়েছেন যে, নারী কোনো বোঝা নয়, বরং মর্যাদাপূর্ণ একজন মানুষ, যার নিজের অধিকার আল্লাহ নির্ধারণ করেছেন।
একইসাথে এটি ইসলামে সামাজিক ভারসাম্যের একটি নিদর্শন—যেখানে মোহর এমন নির্ধারণ করা হয়, যা গরিব ও ধনীর উভয়ের জন্যই বাস্তবসম্মত।
মোহরে ফাতেমির আর্থিক মান
ইতিহাসবিদ ইমাম নববী ও ইবনে হাজার আসকালানি উল্লেখ করেছেন, এক দিরহাম প্রায় ২.৯৭৫ গ্রাম রূপা সমান।
তাহলে ৫০০ দিরহাম × ২.৯৭৫ গ্রাম = প্রায় ১৪৮৭.৫ গ্রাম (১.৫ কেজি রূপা)।
বর্তমান সময়ের হিসাবে, বাংলাদেশে যদি প্রতি ভরি (প্রায় ১১.৬৬ গ্রাম) রূপার দাম ধরা হয় প্রায় ১৫০০ টাকা, তাহলে মোহরে ফাতেমির আর্থিক মান দাঁড়ায় প্রায় ১ লক্ষ ৯০ হাজার টাকা। বাজারদর অনুসারে পরিবর্তনশীল।
এই হিসাব শুধুমাত্র একটি রেফারেন্স—মূল উদ্দেশ্য হলো, মাহর যেন পরিমিত, বাস্তবসম্মত ও সম্মানজনক হয়।
আরও পড়ুননারীর প্রতি সহিংসতা নিয়ে কী বলে ইসলাম২৮ আগস্ট ২০২৫মোহরে ফাতেমি কি বাধ্যতামূলক?
না, মোহরে ফাতেমি বাধ্যতামূলক নয়। ইসলামি শরিয়তে প্রতিটি বিবাহের মোহর দুই পক্ষের আর্থিক ও সামাজিক অবস্থার ওপর নির্ভরশীল।
তবে নবীজি (স.)-এর কন্যার মোহরকে আদর্শ ধরা হয়, কারণ এটি বিনয়, সরলতা ও ন্যায়ের প্রতীক। ইমাম আবু হানিফা (রহ.) বলেন, “মোহরে ফাতেমি একটি সুন্নাহস্বরূপ নির্ধারণ। চাইলে এর কম বা বেশি নির্ধারণ করা বৈধ।” (আল-ফাতাওয়া আল-হিন্দিয়া, খণ্ড ১, পৃ. ২৯৪, দারুল ইহইয়া, কায়রো সংস্করণ)
অতএব, কেউ মোহরে ফাতেমি পরিমাণ নির্ধারণ করলে তা মুস্তাহাব (পছন্দনীয়), কিন্তু তার চেয়ে কম বা বেশি করলেও বিবাহ বৈধ।
আধুনিক প্রেক্ষাপটে মোহরে ফাতেমির তাৎপর্য
বর্তমান সমাজে অনেকেই মোহরকে “আনুষ্ঠানিকতা” মনে করেন, আবার কেউ কেউ মোহরকে “চাপ বা মূল্য” হিসেবে বিবেচনা করেন—যা ইসলামের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ ভুল।
মোহর নারীর আত্মসম্মানের প্রতীক, পুরুষের দায়িত্ববোধের প্রকাশ এবং বিবাহ বন্ধনের আর্থিক নিশ্চয়তা।
একজন আধুনিক মুসলিম নারী হিসেবে ফাতিমা (রা.) ছিলেন নবীজির গৃহের মর্যাদার কেন্দ্রবিন্দু। তাঁর নামেই নির্ধারিত এই মোহর আজও মুসলিম সমাজে “সুন্নাহ মোহর” হিসেবে সম্মানিত।
সমাজে বিবাহ সহজ করা ও নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার দৃষ্টিকোণ থেকে, মোহরে ফাতেমি আমাদের সামনে এক সমতা ও সংযমের মডেল হিসেবে দাঁড়ায়।
অতএব, মুসলিম সমাজের উচিত মোহরকে বোঝা নয়, বরং ভালোবাসা, দায়িত্ব ও সম্মানের প্রতিশ্রুতি হিসেবে দেখা।
আরও পড়ুনবিবাহের সুন্নত 'ওয়ালিমা'১২ জানুয়ারি ২০১৮