পাখিদের সঙ্গে থেকেও তোমরা তাদের ভাষা বোঝোনি, তারাদের সান্নিধ্যে থেকেও বোঝোনি উজ্জলতার মূল্য! শোনো, প্রজাপতিদের উড়াল দেখেই শিখতে হয় ওড়ার নিয়ম, কীভাবে পুরো শরীরটাকে বানাতে হয় মন
আলোর যেমন জীবন আছে, আছে অন্ধকারেরও; দুই জীবনের ক্ষমতাই অসীম, দুই জীবন মিলেই তৈরি হয় আত্মা; আলোর সঙ্গে থেকে আমরা আলোর ভাষা বুঝেছি, অন্ধকারের সঙ্গে থেকে বুঝেছি অন্ধকারের ভাষা—
আমরা যদি তোমাদের আলো দিয়ে দিই, তোমরাও আমাদের মতো ওদের জড়িয়ে রেখো। যদি অন্ধকার দিয়ে দিই, অন্ধকারকে সমান যত্নে রেখো; তবে তোমরাও নিজেদের আত্মার সঙ্গে কথা বলতে পারবে, বুঝবে গাছের সঙ্গে কোন ভাষায় কথা বলতে হয়, কোন ভাষায় কথা বলতে হয় মাটির সঙ্গে.
২
ওই বিরল বনের নির্জনতাও তোমরা কিনতে চাও, কিনতে চাও ঈগলের উড়ে যাওয়া; ওই যে ছোট্ট পাখিটি গাইছে, তার সরল গানও—আমি কান পেতে যে মাটিপোকার গান শুনেছি, সেই সংগীত কতটা বিক্রিযোগ্য, আমি ভেঙে যাওয়া পাতার মর্মর শুনেছি, সেই মর্মর আমি বিক্রি করব কী করে! আমার অসংখ্য স্মৃতি আছে, সেগুলো বিক্রি সম্ভব?
এই যে তোমাদের মানুষ নিরুদ্দেশ হয়ে যায়—কারও অনুপস্থিতি কি বিক্রি সম্ভব! আমি বহুদিন ঝোপের ধারে বসে ব্যাঙের ঝগড়া শুনেছি, ওই ঝগড়া বিক্রির মালিক আমি হতেই পারি না।
৩
মনে রেখো, এই মাটি তোমার পূর্বপুরুষের শরীর থেকে তৈরি। এই মাটিতেই তোমার পূর্বপুরুষ গান পুঁতে গেছে; এখন যে শস্য দেখছ, এখন যে বাতাসের সুর শুনছ, এসব তোমার পূর্বপুরুষের ধমণিতে বয়ে চলা রক্তের গান।
এই মাটি তোমাকে জন্ম দিয়েছে এবং একদিন এই মাটিকে তুমিও জন্ম দেবে। পৃথিবীর জন্য এই দুই জন্মই ভীষণ মূল্যবান। তুমি এই মাটিকে স্পর্শ করো, যদি মনে করো নিজেকে স্পর্শ করেছ, তবেই মনে করবে তুমি পুরো পৃথিবীর সমান, প্রকৃতিরও।
৪
লাল মানুষটার ছায়া দেখো, ছায়া দেখো সাদা মানুষটার—তারপর ভাগ করো; আর ওই সরু পাইনগাছটা, মাথার ওপর দাঁড়াতে চাইছে ঠায়—তার ছায়াটাও দেখো; ওই যে প্রেইরির পাহাড়, ঘন ছায়া ঢেলে দেয়া মেঘ—সবার ছায়া জড়ো করো; দেখো ছায়ারাও কথা বলে, ওদেরও হৃদয়ের ধ্বনি আছে, ওদেরও আছে প্রাণসঞ্চারের ভাষা—এবং ওরা যেন অস্তিত্বময় একই ভূমির, ঈশ্বরের অংশ—প্রেইরিতে ঘুরে বেড়ানো প্রতিটি ছায়াই ভাই ভাই;
চলো ছায়াদের আত্মা দিয়ে মানুষ বানাই।
৫
নিজেকে বিক্রির জন্য মানুষ এতটা পাগল হয় কী করে, আমি বুঝি না—সমস্ত মানুষ এখন শুধু নিজেকে বিক্রি নিয়ে ব্যস্ত—কথা বিক্রি হচ্ছে, হাসি বিক্রি হচ্ছে, দুঃখও বিক্রি হচ্ছে, কেউ কেউ তো বিক্রি করে দেয় নিজের তাবৎ স্বপ্নও, কেউ দেখছি পরকালও!
অথচ তার কোনো কিছু বিক্রির অধিকার নেই—যে পাতাটা তাকে নিশ্বাস দিয়ে বাঁচায়, যে শস্য তার ক্ষুধা নিবারণ করে, যে পানীয় তার তৃষ্ণা মেটায়... তাদের অনুমতি ছাড়া সে কিছুই বিক্রি করতে পারে না... কারণ, তার নিশ্বাসের ভেতর ঢুকে আছে সেই পাতার নিশ্বাস, তার হাড়-মাংসে ঢুকে আছে সেই সব শস্যের প্রাণরস, তার ধমণিতে বইছে সেই সব জলের প্রবাহ...
৬
নদীর জলে যে প্রতিচ্ছবি পড়ল—ওটা তোমার নয়, ঈশ্বরের। ঈশ্বরই মানুষকে এভাবে হাঁটিয়ে হাঁটিয়ে নদীর সামনে নিয়ে আসে আর শেখায়—তোমার ভেতর তুমি এক ঈশ্বরকে বয়ে নিয়ে যাচ্ছ, কিন্তু সে মোটেও অতীন্দ্রিয় নয়। এই যে দেখো, তুমিই তোমার ঈশ্বর।
নদীর জলে যে প্রতিচ্ছবি দেখছ—কখনো ঢেউয়ে ঢেউয়ে নেচে উঠছ—মনে রেখো, ঠিক এভাবেই প্রতি মুহূর্তে মুহূর্তে তুমি ভাবনার বিচ্ছিন্নতায় জড়িয়ে পড়ছ—বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছ নিজের থেকে, ঈশ্বরের থেকেও...
৭
যদি বিশ্বাস করো, পাইনগাছের প্রতিটি পাতা পবিত্র, আসন্ন মেঘের ফাঁকে উঁকি দেয়া প্রতিটি আলোর রেখা পবিত্র, তবে এটাই সত্যি, তোমার ভেতর লুকিয়ে থাকা প্রতিটি স্বপ্নই পবিত্র; কেননা মানুষ তার স্বপ্নের সমান পবিত্র।
সুতরাং নিজেকে বিশ্বাস করো, তুমি দেখতে এই বিশাল জীবতরঙ্গের এক ছোট্ট কণা হয়েও সমস্তকে ধারণ করছ, তোমার হাতে ধারণ করছ সমস্তের বাঁশি—কেবল বিশ্বাস দিয়ে ধরে রাখছ পুরো সৃষ্টির পবিত্রতা।
৮
তুমি যদি বাবা হও, তবে ওই তৃণলতাটারও তুমি বাবা, তুমি যদি মা হও, তবে ওই কদর্য কুকুরটারও তুমি মা, তুমি যদি ভাই হও, তবে তুমি বনমোরগেরও ভাই, তুমি যদি বোন হও, তবে ওই বামনটারও বোন, তুমি যদি ছেলে হও, তবে ওই কীটেরও তুমি ছেলে, যদি মেয়ে হও, তবে কালো পাখিটারও তুমি মেয়ে;
কেননা তুমি মনে রেখো, তুমিই সৃষ্টি।
৯
যখন শিশু জন্ম নেয়—আমরা ভাবি পৃথিবীতে নতুন স্পন্দন জন্ম নিল, প্রকৃতিতে জন্ম নিল নতুন প্রশ্বাস, জন্ম নিল নতুন বাতাস; একদিন এই স্পন্দন বিস্তীর্ণ বিরানে ঘুরে বেড়াবে, একদিন এই প্রশ্বাস বেলাভূমি ও বনাঞ্চলকে চঞ্চল করবে এবং একদিন এই বাতাস মেঘমালার মতো জীবনের অর্থ দাঁড় করাবে
আর তোমাদের শিশু জন্ম নিলে তোমরা শহর বানাও, একটার পর একটা দেয়াল দাঁড় করাও; দেয়ালের দুর্যোগে হারিয়ে যাওয়া স্পন্দনেরা কীভাবে সভ্য মানুষ হয়, আমি বুঝি না...
১০
আমাদের সব বাইসনকে তোমরা একে একে হত্যা করছ—আমরা দেখছি একটা একটা করে তোমরা ঈশ্বরকেই হত্যা করছ; আমাদের সব বন্য ঘোড়াকে তোমরা বন্দী করে পোষ মানাচ্ছ—আমরা দেখছি বনের কাছ থেকে তোমরা কেড়ে নিচ্ছ বন্যতা; আমাদের সব বনে বনে তোমরা ঢুকে পড়েছ, আমরা দেখছি তোমরা মেরে ফেলছ সব নির্জনতা—আমাদের সব বন তাঁবুবাড়ি তোমরা পুড়িয়ে দিয়েছ—আমরা দেখছি তোমরা পুড়িয়ে দিচ্ছ তোমাদেরকেই।
১১
তোমরা আমাদের ভূমি কিনতে চাও, বাতাস কিনতে চাও, আকাশের নক্ষত্ররাজি আর মেঘমালা কিনতে চাও; এই যে আমাদের বনহরিণীর ডাক, এই যে পাহাড়ের প্রতিধ্বনি... সব কিনে নিতে চাও। এই যে ভূমি দেখছ, এটাও আমি; ওই যে বাতাস দেখছ, ওটাও আমি; ওই যে আকাশের নক্ষত্র–মেঘ, অপার নীল... ওগুলোও আমিই; আমাদের বনহরিণীর ডাক বা ধরো পর্বতের গা–ঘেঁষা প্রতিধ্বনি আমিই...
আমরা জানি না, নিজেদের কীভাবে বিক্রি করতে হয়। আমরা জানি না, নিজেদের কীভাবে অন্যদের হাতে তুলে দিতে হয়। জানি না নিজেকে সবকিছু থেকে আলাদা করে ফেলতে...
১২
তুমি কাকে পরিবার বলো, প্রতিদিন যে পালকবিছানায় তুমি ঘুমাও, যার উজ্জ্বলতা নাও, প্রতিদিন যে শিশিরবিন্দু দেখে তুমি আপ্লুত হও, যে ঝিঙেনাচ দেখে তোমার চোখ বিস্ফারিত হয়, পাহাড়ের যেসব খাঁজ তোমার সঙ্গে গোপন সুরে কথা বলে, যেসব ফুল তোমার জন্য ফোটে, যে বনহাঁস তোমার জন্য উড়াল দেয়, যে ঘোড়া তোমাকে বয়ে বেড়ায়—তারা তোমার আত্মীয় নয়?
আমি বুঝি না পাখির কলতান, খরগোশের লাফিয়ে চলা কীভাবে মানুষের পরিবার হয় না...
১৩
আমরা আমাদের শিশুদের নদীর মমতা শেখাই, গাছের ধৈর্য শেখাই, মাঠের প্রাচুর্য শেখাই আর শেখাই বাতাসের বিস্ময়।
বাতাস—যে তোমাকে জন্ম দিয়েছে, তাকে তুমি সদা পবিত্র রেখো; নদী—যে তোমাকে জীবনের বয়ে চলার গল্প শেখাচ্ছে তাকে তুমি পবিত্র রেখো; গাছ—যে তোমাকে জীবনতরঙ্গে অটলতা শেখাচ্ছে, তাকে তুমি পবিত্র রেখো; মাঠ—যে তোমার শরীর পুরুষ্ঠ করছে, তাকে তুমি পবিত্র রেখো—
কেননা এই সব ছাড়া তুমি কখনোই তুমি নও।
১৪
কী অবলীলায় তোমরা মানুষ খুন করছ আর আমরা দেখছি, তোমরা পৃথিবীকে খুন করছ; তোমরা আমাদের গাছ কেটে বন ধ্বংস করছ আর আমরা দেখছি তোমরা পৃথিবীকে খুন করছ; তোমরা আমাদের বুনো মহিষগুলো মেরে সাফ করছ আর আমরা দেখছি তোমরা পৃথিবীকে খুন করছ; তোমরা পাহাড়গুলো কেটে রাস্তা বানাচ্ছ আর আমরা দেখছি তোমরা পৃথিবীকে খুন করছ।
এই পৃথিবী আমাদের মা। তোমরা আসলে মাকেই খুন করো। আর আমাদের বলো খুনি, আমাদের বলো পাপী। আমরা তোমাদের খুন করি সত্যি, কিন্তু সেটা খুন নয়। মায়ের খুনিকে খুন করা আমাদের পুণ্যের কাজ। আমরা তোমাদের খুন করি, যেন তোমাদের দেহাবশেষ থেকে জন্ম হয় পবিত্র মাটির।
১৫
তোমার সাদা শরীরে যেমন মানুষের গন্ধ আছে, আমার লাল শরীরেও তা–ই; তবে আমার শরীরে বন আছে, পাহাড় আছে, আছে প্রজাপতি; ওই যে দূরের অপার আকাশ, সে–ও আছে; ওই যে বেলাভূমি দেখছ, আছে সে–ও; সেই সব বনফুল, ক্যাকটাসের কষ কিংবা ধরো রাতের আঁধার, সে–ও মিশে আছে আমার শরীরে।
তোমরা বলতেই পারো, কীভাবে সম্ভব! তবে শোনো, আসলে এভাবেই আমরা আমাদের শরীরে ঈশ্বরকে লুকিয়ে রাখি।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: একদ ন এই ছ আর আমর আম দ র ব দ র সব ব জন ম ন ল খ ন করছ র জন য এই ম ট খ ন কর
এছাড়াও পড়ুন:
যৌনকর্মীদের কাছে কনডম নেই, এইচআইভি সংক্রমণের ঝুঁকি
যশোরের বাবুবাজার যৌনপল্লিতে প্রায় ১৫ বছর ধরে আছেন যৌনকর্মী আশা (ছদ্মনাম)। স্বাস্থ্য সুরক্ষায় কনডমের ব্যবহার সম্পর্কে তাঁর স্পষ্ট ধারণা আছে। তবে ধারণা থাকলে কী হবে, সেই সুরক্ষাসামগ্রী এখন আর বিনা পয়সায় পাচ্ছেন না তিনি। বছর দুয়েক হলো এ সমস্যা। এখন কনডমের সংকট চরমে, জানান আশা।
যৌনপল্লিতে এখন খদ্দের অনেক কম বলে জানান তিনি। এরপর শুরু হয়েছে কনডমের সংকট। আশার কথা, ‘নিজির টাকায় কনডম কিনতি হয় বাইরের দোকান থেইকে। অনেক দাম দিতি হয়। কাস্টমারের বেশির ভাগই কনডম আনে না। আর আমার ঘরে কনডম না থাকলি কাস্টমার চলি যায়। কী আর করব, খাবার জোটাই মুশকিল। এখন কনডম কিনতি খরচ বেশি।’
খদ্দেরদের কাছে যদি কনডম না থাকে তখন এটা ছাড়াই যৌনকাজ করতে হয় বলে জানান আশা।
আশার মতো দেশের লক্ষাধিক যৌনকর্মী সুরক্ষা বা কনডমের স্বল্পতায় ঝুঁকির মধ্যে পড়েছেন। এদিকে দেশে প্রতিবছর যৌনবাহিত রোগ এইডসে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। এই বাবুবাজার যৌনপল্লিতেই চলতি বছর একাধিক যৌনরোগবাহিত নারী যৌনকর্মীর সন্ধান পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন সেখানকার এক স্বাস্থ্যকর্মী।
গত সোমবার (১ ডিসেম্বর) পালিত হয়েছে বিশ্ব এইডস দিবস। চলতি বছর দিনটির প্রতিপাদ্য ছিল, ‘চ্যালেঞ্জ পেরিয়ে, নতুনভাবে এইডস প্রতিরোধ গড়ে তোলা।’
নতুনভাবে এইডসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার কথা বললেও, সুরক্ষাসামগ্রীর অভাব এই রোগের ঝুঁকিতে থাকা লক্ষাধিক যৌনকর্মীকে নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। যৌনকর্মী, বিভিন্ন সংগঠন এবং বিশেষজ্ঞদের কথা, যৌনপল্লি এবং ভাসমান যৌনকর্মীদের সুরক্ষাসামগ্রী দেওয়ার কাজটি মূলত বেসরকারি সংগঠনগুলোই করত। মূলত এইচআইভি থেকে সুরক্ষায় এই কনডম দেওয়া হতো। এখন এ খাতে বিশেষত বৈদেশিক সহযোগিতা একেবারেই কমে গেছে। আর তাতে বাড়ছে এই নারীদের ঝুঁকি।
বাড়ছে এইডস রোগ
চলতি বছর এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে ১ হাজার ৮৯১ জন এইডস রোগের ভাইরাস এইচআইভিতে সংক্রমিত হয়েছেন। একই সময়ে দেশে এইডসে মারা গেছেন ২১৯ জন। গতকাল বিশ্ব এইডস দিবস উপলক্ষে রাজধানীতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জাতীয় এইডস ও এসটিডি নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে এ তথ্য জানা যায়।
এ সময় আরও বলা হয়, মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মধ্যে এ বছর ২১৭ জন এইচআইভিতে সংক্রমিত হয়েছেন। আর দেশে এখন এইচআইভিতে সংক্রমিত ব্যক্তির মোট অনুমিত সংখ্যা ১৭ হাজার ৪৮০। বাংলাদেশে ১৯৮৯ সালে প্রথম এইচআইভি (এইডসের ভাইরাস) পজিটিভ ব্যক্তি শনাক্ত হন। এরপর প্রতিবছর এইডসে আক্রান্ত ব্যক্তি পাওয়া গেছে। দু-এক বছর এইডসে আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা কমে গেলেও বেড়ে যাওয়ার প্রবণতাই ছিল বেশি। গত বছর (২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে ২০২৪ সালের অক্টোবর পর্যন্ত) ১ হাজার ৪৩৮ জন নতুন করে সংক্রমিত হন। এ সময় এইডসে মারা যান ১৯৫ জন।
সরকারি হিসাব অনুযায়ী, গত এক বছরে আক্রান্তদের মধ্যে ৫২ শতাংশের বেশি বিবাহিত। আক্রান্তদের মধ্যে ৮১ শতাংশ পুরুষ।
দেশের সবচেয়ে বড় যৌনপল্লি রাজবাড়ীর দৌলতদিয়ায়। সেখানকার যৌনকর্মী মালিহা (ছদ্মনাম) দুই বছর ধরে এ পাড়ায় আছেন। এখানে আসার পর বিনা মূল্যে কনডম পেলেও এখন একেবারেই সেই সরবরাহ নেই বলে জানান তিনি।যৌন রোগ বাড়ছে
যশোরের বাবুবাজার যৌনপল্লিতে পিএসটিসি নামের একটি সংগঠন যৌনকর্মীদের স্বাস্থ্য সহায়তা দেয়। তবে তাঁদের কনডম দেওয়ার কর্মসূচি এখন আর নেই। এ সংগঠনের কর্মী সালমা খাতুন জানিয়েছেন, যৌনকর্মীদের মধ্যে কনডম বিতরণের কর্মসূচি এখন প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় নানা ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। এতে মেয়েরা নানা রোগ এবং গর্ভধারণের শিকার হচ্ছে।
চলতি বছর এ যৌনপল্লিতে ছয়জন নারী সিফিলিসে আক্রান্ত হয়েছে বলে জানান সালমা। গর্ভধারণ ও গর্ভপাতের সংখ্যা ছয়। তিনি বলেন, ‘আগের বছর এ রকম কেস পাইনি। তবে এ বছর রোগ বাড়তিছে মেয়েদের মধ্যে।’
আগে পাড়াগুলোতে এনজিওদের কাজ ছিল। এখন তো কোনো কাজই নেই। মেয়েগুলো অসহায়। কনডম না থাকার কারণে বড় ঝুঁকি আছে।মোর্চা সেক্স ওয়ার্কার্স নেটওয়ার্কের সভাপতি নূর নাহারদেশের সবচেয়ে বড় যৌনপল্লি রাজবাড়ীর দৌলতদিয়ায়। সেখানকার যৌনকর্মী মালিহা (ছদ্মনাম) দুই বছর ধরে এ পাড়ায় আছেন। এখানে আসার পর বিনা মূল্যে কনডম পেলেও এখন একেবারেই সেই সরবরাহ নেই বলে জানান তিনি।
দেশের যৌনকর্মীদের সংগঠনগুলোর মোর্চা সেক্স ওয়ার্কার্স নেটওয়ার্কের হিসাব অনুযায়ী, দেশের ১১টি যৌনপল্লিতে ৪ হাজার ৫৩১ জন যৌনকর্মী আছেন। নেটওয়ার্কের সভাপতি নূর নাহার (রানু)। প্রথম আলোকে বলছিলেন, ‘আগে পাড়াগুলোতে এনজিওদের কাজ ছিল। এখন তো কোনো কাজই নেই। মেয়েগুলো অসহায়। কনডম না থাকার কারণে বড় ঝুঁকি আছে।’
ভাসমান যৌনকর্মীদের নিয়ে বড় ঝুঁকি
সেক্স ওয়ার্কার্স নেটওয়ার্ক বাংলাদেশের তথ্য অনুযায়ী, দেশে এখন ১ লাখ ২০ হাজারের বেশি যৌনকর্মী আছে ভাসমান। কনডমের সরবরাহ কমে যাওয়ায় যৌনপল্লিগুলোর চেয়ে এই ভাসমান যৌনকর্মীরা অনেক বেশি ঝুঁকিতে আছেন বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
কনডম সরবরাহের হার এখন অনেক কমে গেছে। এখন হাতে গোনা কিছু প্রতিষ্ঠান সরবরাহ দেয়। আগে যেখানে মেয়েরা ১০টি কনডম পেত, সেখানে এখন বড়জোর ৩টি পায়।কল্যাণময়ী নারী সংঘের সভাপতি রীনা বেগমরাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায় যৌনকাজ করেন মর্জিনা (ছদ্মনাম)। তিনি বলছিলেন, ‘এখন চেয়েচিন্তে কনডম নেওয়া লাগে। রাস্তার লোক তো কনডম রাহে না। আমাদেরই রাকতে অয়। কিন্তু আমরা কিনে কিনে কত দিন চালাব?’
ঢাকার ভাসমান যৌনকর্মীদের নিয়ে কাজ করে কল্যাণময়ী নারী সংঘ। এ সংগঠনের সভাপতি রীনা বেগম বলছিলেন, ‘কনডম সরবরাহের হার এখন অনেক কমে গেছে। এখন হাতে গোনা কিছু প্রতিষ্ঠান সরবরাহ দেয়। আগে যেখানে মেয়েরা ১০টি কনডম পেত, সেখানে এখন বড়জোর ৩টি পায়।’
এইচআইভি থেকে সুরক্ষায় কমছে সহায়তা
জাতীয় পর্যায়ের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ সামগ্রিকভাবে এখনো নিম্ন বিস্তৃতির দেশ হলেও গত কয়েক বছরে নতুন সংক্রমণ বাড়ছে। ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী—যার একটি অংশ যৌনকর্মী ও তাঁদের খদ্দের—তাঁদের মধ্যে সুরক্ষাহীন যৌন সম্পর্কই সংক্রমণ বৃদ্ধির সবচেয়ে বড় কারণ হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। এইচআইভি বাড়লেও এ খাতে দেশে দাতাদের সহায়তা কমছে ব্যাপক হারে। এ চিত্র শুধু বাংলাদেশের না।
বিশ্ব এইডস দিবস উপলক্ষে ইউএনএইডসের ‘ওভারকামিং ডিসরাপশন: ট্রান্সফরমিং দ্য এইডস রেসপন্স’ নামের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক স্তরে এইচআইভি খাতে সহায়তা কমে যাওয়ায় মারাত্মক প্রভাব পড়ছে। জাতীয় এইডস ব্যয় মূল্যায়ন সম্পন্ন করা আটটি দেশের (বাংলাদেশ, বেলিজ, বেনিন, কোত দিভোয়ার, মোজাম্বিক, নাইজেরিয়া, পাকিস্তান, পাপুয়া নিউগিনি) তথ্য বলছে—বিভিন্ন বেসরকারি সংগঠন এ খাতে ৯৯ শতাংশ অর্থসহায়তা পায় দাতাদের কাছে থেকে। দেশের নিজস্ব উৎস থেকে পাওয়া সহায়তা মোট ব্যয়ের শূন্য দশমিক ১ শতাংশেরও কম।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উপপরিচালক জুবাইদা নাসরিন বলেন, ‘যৌনপল্লিগুলোতে কনডম সরবরাহ কমে গেছে, তা জানি। এর মূল কারণ ইউএসএইডসহ দাতারা এ খাতে যে অর্থ দিতেন তা কমে গেছে। আমরা কিছু দাতা সংস্থার সঙ্গে কথা বলেছি এ খাতে এগিয়ে আসতে।’
সরকারের পক্ষ থেকে কনডম বা লুব্রিকেন্টের যে সরবরাহ তাতে ঘাটতি নেই। যৌনপল্লি বা ভাসমানদের মধ্যে কনডমের সংকটের কথাটা শুনলাম।স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (এইচআইভি/এসটিডি) মো. খায়রুজ্জমানস্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে জানানো হয়, দেশের ৩১টি ড্রপ-ইন সেন্টার থেকে নিয়মিত কনডমসহ প্রয়োজনীয় উপকরণ সরবরাহ করা হয়। তারা যৌনপল্লিতে সরবরাহের কাজ করে না। এটা কখনোই করা হতো না বলে জানান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (এইচআইভি/এসটিডি) মো. খায়রুজ্জমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে কনডম বা লুব্রিকেন্টের যে সরবরাহ তাতে ঘাটতি নেই। যৌনপল্লি বা ভাসমানদের মধ্যে কনডমের সংকটের কথাটা শুনলাম।
এইচআইভি ও এইডস প্রতিরোধে বৈশ্বিক সহায়তা কমে যাওয়ার কারণেই যৌনকর্মীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি অনেক বেশি উপক্ষিত এখন। এ ক্ষেত্রে সরকারের মনোযোগী হওয়াটা দরকার বলে মনে করেন গবেষক ডি এম অহিদুল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এইচআইভি–সংক্রান্ত কাজে গুরুত্ব ও অর্থায়ন নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। তরুণ এবং ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে নতুন সংক্রমণ বাড়ায় বাংলাদেশকে তার প্রতিরোধ ও চিকিৎসা কৌশল পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে।