দেশে ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ১৫ বছরে ৬১ সাংবাদিককে হত্যা করা হয়েছে। একই সময়ে হত্যা এবং নিপীড়নের শিকার হয়েছেন ৩ হাজার ৫৮৮ সাংবাদিক। হামলা–মামলা ও নির্যাতনের ৬৭ শতাংশ ঘটনায় তৎকালীন শাসক দলের নেতা–কর্মীরা জড়িত ছিলেন। এই তথ্য উঠে এসেছে ‘ফ্যাসিবাদী শাসনে সাংবাদিক হত্যা-নিপীড়ন’ শীর্ষক বাংলাদেশ সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্টের প্রকাশনায়।

এই প্রকাশনার মোড়ক উন্মোচন উপলক্ষে সোমবার সকালে চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের (ডিএফপি) সভাকক্ষে সেমিনারের আয়োজন করা হয়।

সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম। তিনি বলেন, কয়েকটি পত্রিকা জুলাই অভ্যুত্থান লেখে না। তারা (পত্রিকা) লেখে জুলাই আন্দোলন। তারা বলে, ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পরবর্তী সরকার। এর মানে দাঁড়ায়—এখানে দুই হাজার মানুষ শহীদ হননি। তারা (পত্রিকা) বলতে চায়—একটা চক্রান্ত হয়েছিল, হাসিনাকে উৎখাত করা হয়েছে।

সংবাদমাধ্যম এটা করতে পারে না উল্লেখ করে তথ্য উপদেষ্টা বলেন, এর পরও সেসব সংবাদমাধ্যম সরকার বন্ধ করেনি। তিনি বলেন, ‘আপনারা লেখেন, জনগণ আপনাদের দেখে নিবে। শহীদ ফ্যামিলি আপনাদের দেখে নিবে।.

..আপনারা ফ্যাসিবাদের পক্ষে সম্মতি উৎপাদন কইরেন না।’

আপনারা ফ্যাসিবাদের পক্ষে সম্মতি উৎপাদন কইরেন না।মাহফুজ আলম, তথ্য উপদেষ্টা

সেমিনারে তথ্যসচিব মাহবুবা ফারজানা জানান, গত আট মাসে সংবাদিকদের বিরুদ্ধে হওয়া ২৬৬টি মামলা নিয়ে কাজ করছে সরকার। এর মধ্যে ৭৪টি মামলা হয়রানিমূলক, এমন তথ্য পাওয়া গেছে। ব্যক্তিগত কারণে নালিশি মামলা করা হয়েছে ২৯টি। সরকার চাইলেই এটা তুলতে পারবে না। চারটি মামলা ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার সঙ্গে, বাকিগুলো রাজনৈতিক মামলা।

সিমেন্ট বা টিস্যু পেপারের ব্যবসা নয়

স্বাধীন সাংবাদিকতার জন্য সাংবাদিকদের আর্থিক নিরাপত্তার ওপর জোর দেন গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রধান কামাল আহমেদ। সেমিনারে তিনি বলেন, গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে খুব গুরুত্বের সঙ্গে সাংবাদিকদের আর্থিক সমস্যার কথা বলা হয়েছে। সাংবাদিকদের যদি অন্যের করুণার ওপরে, অন্যের পৃষ্ঠপোষকতার ওপর নির্ভরশীল থাকতে হয়, তাহলে যাদের ওপর তারা নির্ভরশীল থাকবে, তাদের কাছে স্বাধীনতা ছাড় দিতে হবে।

গণমাধ্যমকে টিকে থাকার মতো ব্যবসায়িক মডেল দাঁড় করাতে হবে বলে উল্লেখ করেন কামাল আহমেদ। তিনি বলেন, গণমাধ্যমের ব্যবসা আলু–তরকারির ব্যবসার মতো নয়; কিংবা সিমেন্ট বা টিস্যুপেপার বানানোর ব্যবসা নয় যে এটা অতিমাত্রায় লাভজনক হতে হবে। তবে টিকে থাকার মতো আয় করতে হবে। এ জন্য টেকসই বিজনেস মডেল দরকার। সে জন্য সংস্কার কমিশন নীতিসহায়তার কথা বলেছে। গণমাধ্যম যদি পৃষ্ঠপোষকতার ওপর নির্ভর থাকে, তাহলে স্বাধীন গণমাধ্যমের চেহারা কখনো দেখা যাবে না।

ফ্যাসিস্ট শাসনামলে ক্ষতিগ্রস্ত সংবাদমাধ্যম ও নির্যাতিত সাংবাদিকদের রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া উচিত বলেও মনে করেন কামাল আহমেদ।

ফ্যাসিস্ট শক্তি এখনো আছে
রাজনৈতিক হয়রানিমূলক সব মামলা একটি নির্বাহী আদেশে প্রত্যাহার করতে সেমিনার থেকে সরকারের প্রতি অনুরোধ জানান জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক শফিক রেহমান। তিনি বলেন, রাজনৈতিক মামলাগুলো কলমের এক খোঁচায় আপনারা প্রত্যাহার করুন।
সাংবাদিক নিপীড়ন বন্ধ চাইলে কী কী পরিবর্তন আনা দরকার, তা খুঁজে বের করার পরামর্শ দেন সংগ্রাম পত্রিকার সাবেক সম্পাদক আবুল আসাদ। তিনি বলেন, অনেক রাজনীতিবিদ সংস্কারের কথা বলেন; কিন্তু তাঁরা সংস্কার চান কি না, জানা নেই। যদি চান, তাহলে সংস্কারটা শেষ হোক। তারপর নির্বাচন সবাই মিলে করেন। নির্বাচন তো হবেই, হতেই হবে।

বাংলাদেশে এখনো ফ্যাসিস্ট শক্তি আছে বলে সেমিনারে মন্তব্য করেন আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমান। তিনি এনসিপি নেতা হাসনাত আবদুল্লাহর ওপর হামলার বিষয়টি উল্লেখ করে বলেন, যে ফ্যাসিস্টরা আক্রমণ করেছে, সেই একই ফ্যাসিস্টরা ২০১৮ সালে কুষ্টিয়ায় তাঁর ওপর আক্রমণ করে। এতে বোঝা যাচ্ছে, ফ্যাসিস্ট শক্তি এখনো বাংলাদেশে আছে।

যে মানসিকতা এবং যে প্রবৃত্তি গণমাধ্যমকে স্বাধীন হতে দিতে চায় না, সে শক্তিগুলো এখনো থেকে গেছে বলে সেমিনারে মন্তব্য করেন প্রথম আলোর নির্বাহী সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ। তিনি বলেন, স্বাধীনতার পর থেকে রাষ্ট্রের ফ্যাসিস্ট চরিত্র গড়ে তোলার জন্য যেসব আইনি ও সাংবিধানিক প্রক্রিয়া চালু ছিল, তার চূড়ান্ত ব্যবহার করেছেন শেখ হাসিনা। অনির্বাচিতভাবে ক্ষমতায় থেকে তিনি ক্রমাগত মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছেন এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতা চূড়ান্তভাবে খর্ব করেছেন।
সেমিনারে আরও বক্তব্য দেন বিএফইউজের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ওবায়দুর রহমান, সহসভাপতি খাইরুল বাসার, শীর্ষ নিউজের সম্পাদক একরামুল হক প্রমুখ। সেমিনারে উপস্থিত ছিলেন গত ১৫ বছরে নির্যাতিত এবং নিহত সাংবাদিকদের পরিবারের সদস্যরা। তাঁদের মধ্যে কয়েকজন বক্তব্য দেন। বক্তব্যে সবাই সাংবাদিক নির্যাতন ও জুলাই হত্যাকাণ্ডের দ্রুত বিচারের দাবি জানান।

ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠায় ‘দায়’

‘ফ্যাসিবাদী শাসনে সাংবাদিক হত্যা-নিপীড়ন’ শীর্ষক বাংলাদেশ সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্টের প্রকাশনায় বলা হয়, শুধু ২০২৪ সালেই আট সাংবাদিককে হত্যা করা হয়। গত ১৫ বছরের হত্যার ঘটনায় ৪৫ শতাংশ ক্ষেত্রে তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের নেতা বা ক্যাডারদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। ৩২ শতাংশ ক্ষেত্রে হত্যাকারীরা ধরা পড়েনি। ১৫ শতাংশ ঘটনায় পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জড়িত এবং ২৩ শতাংশ ক্ষেত্রে মাদক কারবারি ও সামাজিক অপরাধীরা জড়িত।

গত ১৫ বছরে সাংবাদিক নিপীড়নের পেছনের কারণও অনুসন্ধান করেছে সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্ট। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে গণতন্ত্রহীনতা, ভিন্নমত দমন, ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার অপচেষ্টা, বিচারহীনতা, পেশাগত অবক্ষয়, সম্পাদকীয় প্রতিষ্ঠা ধসে পড়া, কতিপয় সাংবাদিকের দলবাজি, সাংবাদিক সংগঠনগুলোর মধ্যে বিভক্তি এবং মামলা হলে প্রতিষ্ঠানের অসহযোগিতা।  

এ অবস্থা থেকে উত্তরণের কিছু পরামর্শ উল্লেখ রয়েছে সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্টের প্রকাশনায়। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করা, সাংবাদিক সংগঠনগুলোর মধ্যে ঐক্য গড়ে তোলা, সম্পদকীয় প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী করা, তৃণমূল সাংবাদিকতায় শৃঙ্খলা ফেরানো এবং সংবাদমাধ্যমকে সরকারের পক্ষ থেকে নীতিসহায়তা ও সুরক্ষা দেওয়া।

সেমিনারে প্রকাশনার সারসংক্ষেপ পড়ে শোনান সাংবাদিক কল্যাণ ট্র্রাস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ আবদুল্লাহ। তিনি এই সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন। তাঁর বক্তব্যে গত ১৫ বছরে বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে বাংলাদেশের ৪৪ ধাপ অবনমনের বিষয়টি উঠে আসে। পাশাপাশি ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠায় সাংবাদমাধ্যমের ‘দায়ের’ বিষয়টিও তুলে ধরেন তিনি।

মুহাম্মদ আবদুল্লাহ বলেন, তিনটি ভুয়া নির্বাচনকে সংবাদ মাধ্যমগুলো চ্যালেঞ্জ না করে উৎসাহের সঙ্গে স্বীকৃতি দিয়েছে। বিরোধী রাজনীতি নির্মূলে নিষ্ঠুরতম নিপীড়ন চললেও সংবাদমাধ্যম পেশাদার ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। দুর্নীতি-লুটপাটের বিরুদ্ধে সাহসী সাংবাদিকতার পরিবর্তে অনেক ক্ষেত্রে সংবাদ প্রতিষ্ঠানগুলো সহযোগী ও অংশীদার হয়ে উঠেছিল।

আরও পড়ুনআপনারা ফ্যাসিবাদের পক্ষে সম্মতি উৎপাদন কইরেন না: তথ্য উপদেষ্টা১০ ঘণ্টা আগে

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ব দ ক কল য ণ ট র স ট ত ১৫ বছর র ব যবস র জন ত উল ল খ সরক র ক ষমত র ওপর আপন র

এছাড়াও পড়ুন:

আরব দেশগুলো এই সুযোগ আর পাবে?

সব দিক থেকেই মনে হচ্ছে উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলো এক সন্ধিক্ষণে আছে। এই মুহূর্তে উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলোকে কৌশলগত প্রভাব বিস্তারের সুযোগ নিতে হবে। তা না হলে কেবল ধ্বংসস্তূপ সরানোর কাজই বাকি থাকবে। এক দশকের বেশি সময় ধরে যুক্তরাষ্ট্র চেষ্টা করছে এই অঞ্চলে তাদের বেশি শক্তি খরচের জায়গা থেকে বের হয়ে আসতে।

সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে মোড় ঘোরানো (পিভট টু এশিয়া) নীতির প্রবক্তা। এর পর থেকে প্রতিটি মার্কিন প্রশাসন মধ্যপ্রাচ্য থেকে সরে আসার চেষ্টা করেছে। কিন্তু প্রতিবারই এই অঞ্চলে কোনো না কোনো সংকটে তারা আবার  জড়িয়ে পড়েছে। অনেক সময় সেই সংকট তাদের তৈরি করা নয়। তা পুরোপুরি তাদের নিয়ন্ত্রণেও ছিল না।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদ শুরুতে কৌশলগতভাবে মধ্যপ্রাচ্য থেকে সরে আসার একটা বাস্তব সুযোগ তৈরি হয়েছিল। তাঁর প্রশাসন নব্য-রক্ষণশীল প্রভাব কমিয়ে ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতিতে জোর দেয়। এর মাধ্যমে উপসাগরীয় দেশগুলো একটি স্পষ্ট বার্তা পায় যে যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্য থেকে সরে যাচ্ছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্র সরে যাওয়ায় এই যে জায়গা খালি হবে, সেখানে এখন উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলোর কেবল অর্থ জোগানদাতা হিসেবে নয়, বরং কৌশলপ্রণেতা হিসেবে উঠে আসার সময়। 

কাতার, ওমান আর সৌদি আরব এই সুযোগ কাজে লাগাতে উদ্যোগী হয়েছিল। তারা ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য দূত স্টিভ উইটকফের সঙ্গে মিলে পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ে তেহরানের সঙ্গে নতুন এক কাঠামো গড়তে কাজ করছিল। একটি আঞ্চলিক মীমাংসার রূপরেখা তৈরি হচ্ছিল। উপসাগরীয় দেশগুলো মনে করেছিল, তারা আর শুধু পৃষ্ঠপোষক নয়, বরং এখন কৌশলপ্রণেতা। অর্থনৈতিক সংযুক্তি আর সমন্বিত পরিকল্পনার দিকে এগোচ্ছিল তারা। এভাবে এগোতে পারলে তা হতে পারত মধ্যপ্রাচ্যের জন্য এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত। যুদ্ধের বদলে জায়গা পেতে পারত পারস্পরিক নির্ভরতা আর অহিংস নেতৃত্ব। 

কিন্তু এই স্বপ্ন এক গুরুত্বপূর্ণ বাস্তবতাকে উপেক্ষা করেছিল। সেটি হলো ইসরায়েল। 

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের আক্রমণের পর ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু তাঁর দীর্ঘদিনের কৌশল বদলে ফেলেন। তিনি হয়ে উঠলেন চূড়ান্ত উগ্র, একপেশে। গাজায় হিজবুল্লাহকে তারা কার্যত ঠেকিয়ে দিয়েছে। দুর্বল করেছে তাদের নেতৃত্বকে। এই আংশিক সাফল্যে আত্মবিশ্বাসী হয়ে নেতানিয়াহু এবার ইরানের গভীরে আঘাত হানছেন। তাঁর লক্ষ্য ইরানের বর্তমান শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন আর যুক্তরাষ্ট্র-ইরান সমঝোতার সম্ভাবনা নষ্ট করা।

উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলোর কূটনৈতিক উদ্যোগ এগোনোর সঙ্গে সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে ইরানবিরোধী শক্তি কোণঠাসা হচ্ছিল। নেতানিয়াহু নিজের প্রভাব হারাচ্ছিলেন। এখন যুদ্ধ শুরু করে নেতানিয়াহু আবার কেন্দ্রে ফিরেছেন। তিনি ট্রাম্পকে দীর্ঘস্থায়ী এক সংঘাতে টেনে এনেছেন, যা ভন্ডুল করে দিতে পারে ইরান চুক্তি।

উপসাগরীয় দেশগুলো এই অঞ্চল নিজেদের মতো করে বদলে ফেলতে পারে। তাদের হাতে উপায় আছে। আছে সময়ও। কিন্তু তারা ভুগছে দ্বিধায়। ১৯৭৩ সালের তেল-সংকটের মতো এক পরিস্থিতির মুখোমুখি তারা। সেবার সৌদি আরব তেলকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিকে প্রভাবিত করেছিল। আজ  উপসাগরীয় দেশগুলোর হাতে আরও বেশি অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক আর জ্বালানি-সম্পর্কিত সামর্থ্য আছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের নীতিকে প্রভাবিত করতে সেই ক্ষমতা এখনো ব্যবহার করতে চায় না তারা। 

ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক থেকে শুরু করে হুতি বা হামাসের ওপর প্রভাব পর্যন্ত সবই আছে। তবু তারা লেনদেনভিত্তিক কূটনীতি বেছে নিয়েছে। ট্রাম্পকে বিনিয়োগ বা জ্বালানি চুক্তি দিয়ে খুশি করার চেষ্টা করছে। কিন্তু ইসরায়েলের শক্তি প্রদর্শনের পর এই কৌশল কাজ করছে না।

ইসরায়েল তার সব সামরিক প্রযুক্তি, গোয়েন্দা দক্ষতা ব্যবহার করছে। তারা যুক্তরাষ্ট্রের নীতিকে নিজেদের মতো করে গড়ে নিচ্ছে। এই নীতিগুলো যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থের পরিপন্থী। কিন্তু নেতানিয়াহুর তাতে কিছু এসে যায় না। যুক্তরাষ্ট্রকে মধ্যপ্রাচ্যে সামরিকভাবে জড়াতে পারলেই তাঁর লাভ।

ইরান কিন্তু ইরাক নয়। যুক্তরাষ্ট্র বা ইসরায়েল কেউই সেখানে স্থলসেনা পাঠাবে না। বরং তারা একটু একটু করে ইরানকে দুর্বল করার নীতি নেবে। একেকটা হামলা করে ইরানকে ফাঁপা করে তোলা হবে। যদি সর্বোচ্চ নেতা খামেনি নিহত হন, তাহলে দীর্ঘ আর জটিল উত্তরাধিকার সংকট শুরু হবে। শেষমেশ হয়তো আইআরজিসি-নেতৃত্বাধীন সামরিক স্বৈরশাসন তৈরি হবে। অথবা ইরান একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র হবে। উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলোর কাঁধে পড়বে সেই অস্থিরতার বোঝা। থাকবে এক বিধ্বস্ত প্রতিবেশী, ভাঙা সীমান্ত আর অসংখ্য সশস্ত্র নেটওয়ার্ক। 

শিয়া সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো ইরান বিপ্লবের আগেও ছিল। রাষ্ট্র ভেঙে গেলে তারা নতুনভাবে গড়ে উঠবে। হবে আরও বেপরোয়া। এক ভারসাম্যহীন মধ্যপ্রাচ্য তৈরি হবে। ইসরায়েল শত্রু ধ্বংস করতে পারবে, কিন্তু টেকসই কিছু তৈরি করতে পারবে না। আর উপসাগরীয় দেশগুলোকে ঘিরে থাকবে সশস্ত্র গোষ্ঠী—হিজবুল্লাহ, হুতি আর ইরানি মিলিশিয়া। মাঝেমধ্যে ইসরায়েল হামলা চালিয়ে এদের কিছুটা দমন করবে। কিন্তু স্থিতিশীলতা ফিরবে না। আর নেতানিয়াহুর অধীনে ইসরায়েল এখন যুদ্ধপ্রিয় মৌলবাদী ইহুদি রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। এমন রাষ্ট্র আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি। এরা বিধ্বংসী শক্তি হিসেবে কাজ করবে।

এই প্রেক্ষাপটে উপসাগরীয় দেশগুলোকে কৌশলগত ক্ষেত্রেও নিজেদের প্রভাব কাজে লাগাতে হবে। উচিত হবে ওয়াশিংটনে নতুনভাবে লবি গড়ে তোলা। ট্রাম্প প্রশাসনের ওপর চাপ সৃষ্টি করা, যেন তারা সংঘাত নয়, কূটনীতি বেছে নেয়।

কাতার-ওমান এরই মধ্যে একধরনের সেতু গড়ছে তেহরান আর ট্রাম্পের মধ্যে। তাদের বহুমুখী অংশীদারত্বকেও কাজে লাগাতে হবে। বিশ্ব এখন বহু মেরু। ফলে যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক সংযুক্তি, রাশিয়ার সঙ্গে নিরাপত্তা সংলাপ—সবই যুক্তরাষ্ট্রকে আরও চাপে ফেলবে। সবশেষে উপসাগরীয় দেশগুলোকে বুঝতে হবে, তাদের কোনো বিকল্প নেই। তাদের আছে শক্তি, আছে ক্ষমতা। এখন দরকার সেই ক্ষমতা ব্যবহারের সাহস। 

ড. আন্দ্রেয়াস ক্রিগ কিংস কলেজ লন্ডনের ডিফেন্স স্টাডিজ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক

মিডল ইস্ট আই থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত

সম্পর্কিত নিবন্ধ