আগর চাষ, পাহাড়ের সুগন্ধ ছড়াচ্ছে বিদেশে
Published: 10th, May 2025 GMT
গাছের কাণ্ড ও শিকড় ভেদ করে তেল আর নরম কাঠ খেতে ঢোকে এক প্রজাতির বিটল পোকা। পোকায় কাটা ক্ষত সারাতে গাছটি একজাতীয় রজন পদার্থ তৈরি করে। অনেকটা আমাদের শরীরের তৈরি হওয়া ক্ষতের ওপর যেমন কালচে লাল রঙের শক্ত আস্তরণ পড়ে, সে রকমই। গাছের গায়ের সেই প্রতিরক্ষা পদার্থের দাম কোটি টাকা! সারা পৃথিবীতে সুগন্ধিশিল্পের আরাধ্য বস্তু এই গাছের নাম আগর, যার চাষ হয় পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙামাটিতে।
আগরগাছের শরীরে যত বেশি পোকা আর ছত্রাকের আক্রমণ হয়, তত কালচে আর ঘন হয়ে ওঠে এর কাঠ। তত বেশি সুগন্ধিতে ভরে ওঠে গাছের শরীর। প্রাকৃতিক এ প্রক্রিয়ায় সময় লাগে ১৫ থেকে ২০ বছর। তবে বাণিজ্যিকভাবে আগরের সুগন্ধি উৎপাদনের জন্য কি আর পোকা আর ছত্রাকের মুখ চেয়ে বসে থাকলে চলে! তাই বাগানিরা গাছের শরীরজুড়ে পেরেক গাঁথেন। পেরেকের ক্ষতে ছত্রাকের আক্রমণ হয়। এর চারপাশে তখন জমতে থাকে প্রতিরক্ষাকারী রজন পদার্থ। পেরেকের আঘাতে আঘাতে দামি হয়ে ওঠে আগরগাছ। সেই গাছের কাঠ থেকে পাতন প্রক্রিয়ায় তৈরি হয় সুগন্ধি।
ছয় লাখ টাকা দিয়ে একটি বড় আগরগাছ বিক্রি করেছেন রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলা বাঘাইছড়ি ইউনিয়নের উগলছড়ি গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক অনন্ত সিং চাকমা। খেদারমারা ইউনিয়নের ঢেবাছড়ি গ্রামের আলোময় চাকমা নামের আরেক চাষি তিনটি আগরগাছ ২ লাখ ৯৫ হাজার টাকা দিয়ে বিক্রি করেছেন। বাঘাইছড়ি উপজেলা সদরের তালুকদার পাড়া ও তুলাবান গ্রামে স্থাপিত চুল্লি থেকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় সুগন্ধিও তৈরি হচ্ছে। এসব সুগন্ধি সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব, দুবাইসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয় বলে জানান বাগানিরা।
উগলছড়ি গ্রামের অনন্ত সিং চাকমা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি ৩৬টি আগরগাছ ১৩ লাখ টাকায় বিক্রি করেছি। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় গাছটির মূল্য ৬ লাখ টাকা। অন্য গাছগুলো ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকায় বিক্রি করেছি। আমাদের গ্রামে অনেকে আগরগাছ বিক্রি করছেন।’
আরেক ব্যবসায়ী সন্তোষ প্রিয় চাকমা বলেন, ‘আগরগাছের আতরের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। আমাদের দেওয়া আতর মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে নেওয়া হচ্ছে। আমরা এখন পর্যন্ত আগরগাছ থেকে প্রাকৃতিকভাবে ও পেরেক ঢুকিয়ে তৈরি হওয়া সুগন্ধি সিলেট, ঢাকা ও চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের দিচ্ছি। পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঘাইছড়ি উপজেলায় সবচেয়ে বেশি প্রাকৃতিকভাবে আগরের সুগন্ধি পাওয়া যাচ্ছে। এ ছাড়া খাগড়াছড়ির পানছড়ি ও দীঘিনালায় কিছু পাওয়া যায়।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা ২০২৩ সালে একটি সমিতি করেছি। সেটি রেজিস্ট্রেশনের প্রক্রিয়ায় রয়েছে। সমিতিটি রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন হলে কয়টা গাছ বিক্রি করা হলো, কত টাকার ব্যবসা হলো, লাভ-ক্ষতি—এসবের হিসাব থাকবে। এখন ব্যক্তি উদ্যোগে বিক্ষিপ্ত ও বিচ্ছিন্নভাবে আগরগাছ বিক্রি হচ্ছে। তাই সঠিক হিসাব কেউ দিতে পারবেন না।’
আগরগাছ থেকে তিন প্রক্রিয়ায় সুগন্ধি পাওয়া যায়—পোকার আক্রমণে প্রাকৃতিকভাবে, গাছে পেরেক ঢুকিয়ে ও কাঠের নির্যাস থেকে। প্রাকৃতিকভাবে পাওয়া সুগন্ধি বিশেষ এলাকায় আগরগাছে হয়ে থাকে। বাঘাইছড়ি উপজেলার সারোয়াতলী ইউনিয়নের বাঘাইছড়ি, উগলছড়ি, তালুকদার পাড়া, মহিষপয্যা, শিজক, তুলাবানসহ ১০ থেকে ১২টি গ্রামে ও খেদারমারা ইউনিয়নে শিলকাটাছড়া, ঢেবাছড়ি, নলবনিয়া, উলুছড়িসহ ৮ থেকে ১০টি গ্রামে প্রাকৃতিকভাবে সুগন্ধি পাওয়া যাচ্ছে। প্রাকৃতিকভাবে তৈরি হওয়া সুগন্ধির তুলনায় পেরেক দেওয়া সুগন্ধির মান ও দাম অনেক কম। পেরেক ঢুকিয়ে পাওয়া সুগন্ধি প্রতি তোলা ছয় হাজার টাকায় বিক্রি হয়। অন্য দিকে যেসব আগরগাছে প্রাকৃতিকভাবে এবং পেরেক ঢুকিয়েও সুগন্ধি পাওয়া যায়নি, সেসব গাছের কাঠের নির্যাস থেকে সুগন্ধি বের করা হয়। তবে এর মান সবচেয়ে কম।
২০১২ সালে বাঘাইছড়ি পৌরসভার তালুকদার পাড়া ও মারিশ্যা ইউনিয়নের তুলাবান গ্রামে সুগন্ধি তৈরির জন্য দুটি চুল্লি স্থাপন করা হয়। তালুকদার পাড়া গ্রামের চুল্লিতে ছয়টি ও তুলাবান গ্রামের চুল্লিতে তিনটি পাত্র বসানোর জায়গা রয়েছে। প্রতিবছর এই দুই চুল্লির অন্তত তিন কোটি টাকার আতর উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে। তবে কাঁচামাল পর্যাপ্ত না থাকায় মাত্র ৮ থেকে ৯ মাস চুল্লি চালু রাখা হয় বলে জানান ব্যবসায়ীরা। বর্তমানে যেসব আগরবাগান রয়েছে, সেগুলোর গাছ পরিপক্ব হতে আরও পাঁচ থেকে ছয় বছর সময় লাগবে। বর্তমানে প্রতিবছর বাঘাইছড়ির দুটি চুল্লি থেকে অন্তত দুই কোটি টাকার সুগন্ধি বিক্রি করা হয়। প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্টি হওয়া বেশির ভাগ সুগন্ধিযুক্ত আগরগাছ ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটে নেওয়া হচ্ছে। সেখানে বিশেষ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সুগন্ধি বের করে বিদেশে নেওয়া হয় বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
সিলেটের আগর ব্যবসায়ী মো.
পেরেক ঢোকানো কিংবা প্রাকৃতিকভাবে তৈরি হওয়া আগরগাছগুলো বাগান থেকে কেটে নিয়ে আসা হয়। পরে শ্রমিক দিয়ে ছোট ছোট টুকরা করে ১০ থেকে ৩০ দিন পর্যন্ত পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হয়। এরপর আগরগাছের ভিজিয়ে রাখা টুকরাগুলো একটি বড় পাত্রে ঢুকিয়ে চুলার আগুনে সেদ্ধ করতে হয়। পাত্রের ঢাকনার একটি ছিদ্রের সাহায্যে বাইরে অপর একটি পাত্রে সুগন্ধি তেল এসে জমা হয়।
বাঘাইছড়ি উপজেলার মধ্যম বাঘাইছড়ি গ্রামের একটি আগর বাগান। আজ সকালে তোলাউৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ব ঘ ইছড় ব যবস য় উপজ ল
এছাড়াও পড়ুন:
জুলাই ঘোষণাপত্র ও সনদ নিয়ে টালবাহানা চলছে
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, ‘যে আকাঙ্ক্ষা নিয়ে আমরা জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নেমেছিলাম, যে পরিবর্তন দেখতে চেয়েছিলাম, সেই পরিবর্তন এখনও দেখতে পাচ্ছি না। বরং আমাদের সামান্য যে চাওয়া ছিল, জুলাই ঘোষণাপত্র এবং জুলাই সনদ– সেটি নিয়েও টালবাহানা করা হচ্ছে।’
সিরাজগঞ্জ শহরে পথসভা: ‘দেশ গড়তে জুলাই পদযাত্রা’র সপ্তম দিন সোমবার বিকেলে সিরাজগঞ্জ শহরের বাজার স্টেশন এলাকার স্বাধীনতা স্কয়ারে পথসভায় এসব কথা বলেন তিনি। প্রশাসনের নিরপেক্ষ ভূমিকা পালনের আহ্বান জানিয়ে নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘আমরা বলেছিলাম গণঅভ্যুত্থানের পর নিরপেক্ষ প্রশাসন চাই, বিচার ব্যবস্থা চাই। আমরা আগে দেখতাম, তারা একটা দলের হয়ে কাজ করত। আমরা চাই না এখনও তারা সেটা করুক। আমরা দেখেছি, আয়নাঘর থেকে শুরু করে কত কিছু করা হয়েছে। তাহলে আমরা বিচার ও সংস্কার ছাড়া কীভাবে নির্বাচনের দিকে যাবো? বিচার না হলে কীভাবে আমরা শহীদ ভাইবোনদের পরিবারের সামনে গিয়ে দাঁড়াব?
সিরাজগঞ্জের সম্ভাবনাময় তাঁতশিল্পকে অবজ্ঞা করা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আগামীতে এগুলোকে তুলে ধরা হবে, নতুন কর্মসংস্থান তৈরি করা হবে।’
আমরা কোনো আপস করব না: পাবনায় পথসভায় নাহিদ ইসলাম: সোমবার রাত ১১টায় পাবনা শহরের ট্রাফিক মোড়ে আয়োজিত পথসভায় নাহিদ ইসলাম বলেন, দেশের স্বার্থে আসুন ঐক্যবদ্ধ হই। দেশের উন্নয়ন সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আমরা কোনো আপস করব না। জনগণকে সাথে নিয়ে রাজপথে থাকবো যৌক্তিক দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত। পাবনা, নাটোর, সিরাজগঞ্জ এনসিপির পদযাত্রা উপলক্ষে এ সভার আয়োজন করা হয়।
নাহিদ ইসলাম বলেন, ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে জনগণকে সাথে নিয়ে ফ্যাসিবাদী ও স্বৈরাচার শেখ হাসিনার সরকারের পতন ঘটিয়েছিলাম। সেই আন্দোলনে আমরা কারও সঙ্গে আপস করিনি, ভবিষ্যতেও করব না।
গণঅভ্যুত্থানে শহীদদের স্মরণ করে তিনি বলেন, আমার ভাই-বোনেরা শহীদ হয়েছেন। তাদের শহীদি মর্যাদা ও সাংবিধানিক স্বীকৃতি থাকতে হবে। এজন্য প্রয়োজন জুলাই সনদ। এই দাবিতে আমরা অনড় অবস্থানে।
সভায় আরও উপস্থিত ছিলেন, উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম, দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহ, সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন, ডা. তাসলিমা জারা, মুখ্য সমন্বয়ক নাসিরুদ্দিন পাটোয়ারী, নাটোর জেলা যুগ্ম সমন্বয়কারী আব্দুর মান্নাফসহ কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতাকর্মীরা। পথসভা শেষে নেতাকর্মীরা কুষ্টিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হন।
এর আগে দুপুরে নাটোর শহরের মাদ্রাসা মোড়ের স্বাধীনতা চত্বরে পথসভায় নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘ফ্যাসিবাদের পতন হলেই হবে না, দেশের মৌলিক সংস্কার প্রয়োজন। সে জন্য জুলাই ঘোষণাপত্র দিতে হবে, গণঅভ্যুত্থানের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিতে হবে। গণঅভ্যুত্থানে যে ভাইবোনেরা নেমে এসেছিল, যেসব মানুষ শহীদ হয়েছিল, তাদের সেই শহীদি মর্যাদা রাষ্ট্রকে দিতে হবে। সংবিধানে স্বীকৃতি থাকতে হবে। এর জন্য আমাদের প্রয়োজন জুলাই ঘোষণাপত্র এবং জুলাই সনদ।’
নাটোরে এনসিপির কর্মসূচিতে বাধা দেওয়া হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের ব্যানার ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে। হুঁশিয়ারি দিতে চাই। মাত্র এক বছর আগে কর্মসূচিতে বাধা দিয়ে যারা ক্ষমতায় দীর্ঘায়িত হতে চেয়েছিল, তাদের আজকের বাংলাদেশে ঠাঁই হয়নি। যদি এখনও আমরা সেই স্বৈরাচারী ফ্যাসিবাদী সরকারের পতন থেকে শিক্ষা না নিই, তবে তাদের পরিণতিও সেই দিকেই যাবে।’
এ সময় এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী, উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম, দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্য সচিব ডা. তাসনিম জারা প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
এর আগে রোববার পদযাত্রার ষষ্ঠ দিনে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে যান নাহিদ ইসলামসহ এনসিপির অন্য নেতারা। এ ছাড়া এদিন তারা নওগাঁর রাণীনগর উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকার কুজাইল বাজার সফর করেন। রোববার নওগাঁ শহরে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন।
(প্রতিবেদনে তথ্য দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট প্রতিনিধি)