ইসলাম এক পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থার নাম, যা মানুষকে ইহকালীন শান্তি ও পরকালীন মুক্তির পথ বাতলে দিয়েছে। একজন মুসলমান মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত ও অন্যান্য আনুষ্ঠানিক ইবাদতের পাশাপাশি উত্তম নৈতিকতা, সদাচরণ এবং সামাজিক দায়িত্ব পালনের মাধ্যমেও তাঁর পূর্ণ ইমানের পরিচয় দেন।
আরবি ভাষায় সদাচরণকে বলা হয় ‘হুসনুল খুলুক’, অর্থাৎ সুন্দর চরিত্র বা উত্তম নৈতিকতা। মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে রাসুল (সা.
তিনি আরও বলেন, ‘আমি তো প্রেরিত হয়েছি মানবচরিত্রের উৎকর্ষ সাধনের জন্য’ (মুয়াত্তামালিক)।
সবার সঙ্গে মিলেমিশে থাকা ও ভালো ব্যবহার করা ইসলামের অন্যতম শিক্ষা। যারা মানুষের সঙ্গে ভালো আচরণ করেন, তাদের সবাই পছন্দ করেন। মানুষের সদাচরণ পাওয়ার সবচেয়ে বড় হকদার পিতা-মাতা। এর পর স্বামী-স্ত্রী, সন্তান-সন্ততিসহ আত্মীয়স্বজন, এতিম-অসহায়, প্রতিবেশী; এমনকি আল্লাহতায়ালার সব সৃষ্টিই সদাচরণ পাওয়ার হকদার।
পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন আয়াতে আল্লাহতায়ালা সদাচরণ করতে জোর তাগিদ দিয়েছেন। সুরা আন-নিসার ৩৬ আয়াতে মহান আল্লাহ এরশাদ করেন, ‘তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো এবং কাউকে তাঁর সঙ্গে শরিক করো না। বাবা-মা, আত্মীয়স্বজন, এতিম, নিকট-প্রতিবেশী, দূর-প্রতিবেশী, সঙ্গী-সাথী, মুসাফির ও তোমাদের অধিকারভুক্ত দাস-দাসিদের প্রতি সদাচরণ করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ দাম্ভিক-অহংকারীকে পছন্দ করেন না।’
সদাচরণ আত্মবিশ্বাস, ধৈর্য, বিনয়, শিষ্টাচার ও মানবিক বোধ জাগ্রত করে। একজন সদাচারী ব্যক্তি নিজের ভুল সহজেই বুঝতে পারে, ক্ষমা চাইতে জানে এবং অপরকে ক্ষমা করতেও জানে। এটি পরিবারে ভালোবাসা ও সহমর্মিতার আবহ তৈরি করে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘সর্বোত্তম ব্যক্তি সে-ই, যে তার পরিবার-পরিজনের সঙ্গে উত্তম আচরণ করে’ (তিরমিজি)।
সুরা আল ইমরানের ১৫৯ আয়াতে এরশাদ হয়েছে, ‘এটা আল্লাহতায়ালার অনুগ্রহ যে তুমি তাদের প্রতি কোমলচিত্ত। তুমি যদি কর্কশভাষী ও কঠোর হৃদয় হতে, তাহলে তারা তোমার সংসর্গ থেকে দূরে সরে যেত। তাই তুমি তাদের ক্ষমা করো, তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করো এবং কাজকর্মে তাদের সঙ্গে পরামর্শ করো।’
আরও অসংখ্য আয়াতে মহান আল্লাহ মানুষকে সদাচরণের নির্দেশ দিয়েছেন। এটা ইসলামের অন্যতম শিক্ষা। ইসলাম মনে করে, শুধু মানুষ নয়; যাবদীয় সৃষ্টিই ভালো আচরণ পাওয়ার অধিকার রাখে। অপ্রয়োজনে গাছের একটি পাতা ছেঁড়াও ইসলামের দৃষ্টিতে অন্যায়। এমনকি ভারবাহী পশুকে পর্যন্ত অতিরিক্ত বোঝা চাপিয়ে দেওয়া অপরাধ বলে গণ্য করেছে ইসলাম।
কোনো পশু-পাখিকে আটকে রেখে ক্ষুধায় কষ্ট দেওয়া ভয়াবহ গুনাহর কাজ। পশু-পাখির সঙ্গে আচরণই যদি এমন হয়ে থাকে, তাহলে সৃষ্টির সেরা ও আল্লাহর প্রতিনিধিদের সঙ্গে কেমন আচরণ ইসলাম দাবি করতে পারে– সহজেই অনুমেয়। ইসলাম মনে করে, মানুষের সঙ্গে দুর্ব্যবহার তো স্বয়ং আল্লাহর সঙ্গেই দুর্ব্যবহার।
আর তাই ধর্ম-বর্ণ, শ্রেণি-পেশা নির্বিশেষে প্রত্যেক মানুষের সঙ্গে সদাচরণ করা ইসলামের অন্যতম নির্দেশনা। শুধু তাই নয়, অন্যান্য সৃষ্টির সঙ্গেও সদাচরণ করার শিক্ষা ইসলাম আমাদের দিয়েছে।
আমাদের সমাজে প্রবীণরা বড় অসহায় ও অবহেলার পাত্র। যার পরিপ্রেক্ষিতে বৃদ্ধাশ্রমের ধারণা সমাজে চালু হয়েছে। একজন বৃদ্ধ-বৃদ্ধা তাঁর আত্মীয়স্বজন পরিবেষ্টিত হয়ে জীবনের শেষ দিনগুলো কাটাবেন, এটাই স্বাভাবিক। এর ব্যতিক্রমী আচরণ যে কতটা কষ্টের, তা বলে বোঝানো মুশকিল। আমাদের সবার উচিত যারা প্রবীণ, আমাদের বয়োজ্যেষ্ঠ; তারা যেন যথাযথ শ্রদ্ধা ও সম্মান পান। আমাদের বুঝতে হবে, যে দয়া করে না, সে দয়া পায় না।
ড. মো. শাহজাহান কবীর: বিভাগীয় প্রধান, ইসলামিক স্টাডিজ, ফারইস্ট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ঢাকা
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: আম দ র
এছাড়াও পড়ুন:
গোমস্তাপুরে ২ শিশুর অস্বাভাবিক মৃত্যু নিয়ে গুঞ্জন
চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুরে একটি মহিলা হাফেজিয়া মাদ্রাসার দুজন আবাসিক শিক্ষার্থীর অস্বাভাবিক মৃত্যু নিয়ে গুঞ্জন শুরু হয়েছে। শুক্রবার (১৫ আগস্ট) দিবাগত রাতে শিশু দুটির মৃত্যু হয়। তারা দুজনই উপজেলার রাধানগর ইউনিয়নের ‘ডুবার মোড় শেফালী বেগম মহিলা নূরানী ও হাফিজিয়া মাদ্রাসা’র শিক্ষার্থী।
এ ঘটনায় পুলিশ কোনো মন্তব্য না করলেও প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক ও নিহতের পরিবারের দাবি, বিষাক্ত পোকামাকড় বা সাপের কামড়ে তাদের মৃত্যু হয়েছে। শনিবার (১৬ আগস্ট) বিকেলে ওই দুজন মাদ্রাসা শিক্ষার্থীর ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়। তবে রিপোর্ট এখনো পাওয়া যায়নি।
নিহতরা গোমস্তাপুর উপজেলার রাধানগর ইউনিয়নের লেবুডাঙ্গার তরিকুল ইসলামের মেয়ে তানিয়া খাতুন (১২) এবং ওই ইউনিয়নেরই বেগপুর গ্রামের সৈবুর রহমানের মেয়ে মোসা. জামিলা খাতুন (১০)। এ দুজনেরই বাবা কর্মসূত্রে ঢাকায় থাকেন।
মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষের বরাতে পুলিশ জানায়, প্রতিদিনের মতো শুক্রবার দিবাগত রাতে ওই মাদ্রাসার আসাবিকের শিক্ষার্থীরা ঘুমিয়ে যায়। গভীর রাতে আকস্মিকভাবে তানিয়া ও জামিলা অসুস্থ অনুভব করলে কান্নাকাটি শুরু করে। তাদের সহপাঠীরা সেখানে থাকা প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষিকা সাহিদা খাতুনকে জানান।
সাহিদা খাতুন ওই দুজন শিক্ষার্থীর কাছে গিয়ে দেখতে পান তারা বমি করছে। তাদের একজনের বমির সঙ্গে রক্তও আসছিল। তড়িঘড়ি করে ওই শিক্ষিকা মাদ্রাসার পরিচালককে বিষয়টি জানান। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে দ্রুত ছুটে আসেন পরিচালক আশরাফ আলী। অবস্থা আরও খারাপ হলে ওই দুজন শিক্ষার্থীর পরিবারকে ডেকে পাঠানো হয়। এরইমধ্যে ওই দুজন শিক্ষার্থীকে গোমস্তাপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়া হয়। পথিমধ্যে মারা যায় জামিলা আর হাসপাতালে নেওয়ার পর তানিয়ার মৃত্যু হয়।
তানিয়া ও জামিলার মৃত্যু নিয়ে পুলিশ এখনো খোলাসা করে কিছু বলছে না। তাদের দাবি, মৃত্যুর আসল কারণ জানতে ময়নাতদন্তের রিপোর্ট খুবই জরুরি। শিশু দুটির মৃত্যু নিয়ে কোনো অভিযোগ না থাকায় ময়নাতদন্তে নারাজ ওই শিক্ষার্থীদের পরিবার। তবে মৃত্যুর আসল রহস্য উদঘাটনে ইতিমধ্যে তদন্ত শুরু করেছে বলে দাবি করছে পুলিশ।
সংশ্লিষ্টরা জানান, মাদ্রাসা শিক্ষার্থী তানিয়ার ডান পায়ের গোড়ালিতে পোকার কামড়ের দাগের চিহ্ন দেখতে পাওয়া গেছে কিন্তু জামিলার শরীরে কোন দাগই ছিল না। অথচ জামিলাও মারা গেছে হাসপাতালে নেওয়ার পথে।
এদিকে শিশু দুটির মৃত্যু নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টির হয়েছে। সেখানকার একাংশ বলছেন, শুক্রবার রাতের খাবার খেয়ে বিষক্রিয়ায় মারা যেতে পারে তারা। কিন্তু মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ বলছে, একই খাবার খেয়েছে আবাসিকে থাকা আরও ১১জন শিক্ষার্থী। তাদের শরীরে বিষক্রিয়ার কোনো লক্ষণ কিংবা উপসর্গ টের পাওয়া যায়নি।
আরেক পক্ষ দাবি করছেন, হয়তো ওই দুজন শিক্ষার্থী মাদ্রাসার খাবার খাওয়ার আগে বাইরের খাবার খেয়েছিল। সেখান থেকেই বিষক্রিয়া হতে পারে। কিন্তু ওই দুজন শিক্ষার্থীর পরিবারের দাবি, মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের বাইরের দোকানে গিয়ে কিনে কোন খাবার খাওয়ার নিয়ম নেই।
‘ডুবার মোড় শেফালী বেগম মহিলা নূরানী ও হাফিজিয়া মাদ্রাসা’টি প্রতিষ্ঠা হয় ২০২৩ সালে। শুক্রবার রাতে ওই প্রতিষ্ঠানটির আবাসিকে ১৩জন শিক্ষার্থী ছিল উল্লেখ করে পরিচালক আশরাফ আলী বলেন, “শুক্রবার রাতে খাবার খেয়ে ছাত্রীরা সবাই ঘুমিয়ে যায়। গভীর রাতে তানিয়া ও জামিলা অসুস্থ হয়। তাদের দুজনকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়ার পথে জামিলা ও সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তানিয়ার মৃত্যু হয়।”
তিনি আরো বলেন, “আমরা ধারণা করছি বিষাক্ত পোকামাকড়েরর কামড়ে তাদের মৃত্যু হয়েছে। একজনের পায়ে দাগও দেখেছি। কিন্তু আরেক জনের শরীরে কোনো চিহ্ন পাওয়া যায়নি।”
নিহত তানিয়ার চাচা মশিউর রহমান বলেন, “খবর পেয়ে আমরা মাদ্রাসার পৌঁছার আগেই শিক্ষকরা তাদের দুজনকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। একজন রাস্তায় মারা যায়। আমার ভাতিজি তানিয়ার পায়ের গোড়ালির কাছে ক্ষত চিহ্ন দেখতে পেয়েছি। পরে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।”
তিনি আরো বলেন, “মাদ্রাসাটির আশপাশে বাগান ও ঝোপঝাড় রয়েছে। সাপ আসার মতোই জায়গা। শিশুদের নিরাপত্তার বিষয়ে নজর দেওয়া উচিত ছিল প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের।” তবে এসব বলার পরেও তানিয়ার চাচা বলেন, “আমরা কোন আইনি ব্যবস্থা নিব না।”
নিহত জামিলার চাচা রুবেল বলেন, “আমরা নিশ্চিত, সাপের কামড়েই মারা গেছে তারা দুজন। আমাদের কোন অভিযোগ নাই।”
গোমস্তাপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক আবদুল আলিম বলেন, “নিহতদের মধ্যে একজনকে মৃত অবস্থায় পেয়েছি। অপরজন হাসপাতালে নেওয়ার কিছুক্ষণ পর মারা গেছে। প্রাথমিকভাবে মৃত্যুর কারণ নিশ্চিত হওয়া যায়নি। ময়নাতদন্তের রিপোর্টে মৃত্যুর আসল কারণ জানা যাবে।”
চাঁপাইনবাবগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এএনএম ওয়াসিম ফিরোজ বলেন, “মাদ্রাসার দুজন বাচ্চা একসঙ্গে মারা গেছে, বিষয়টি খুবই গুরুত্ব সহকারে দেখছে পুলিশ। আমরা এখনো নিশ্চিত নই বাচ্চাগুলো কীভাবে মারা গেলো। সেজন্য মরদেহ দুটি ময়নাতদন্তে পাঠানো হয়েছে।”
তিনি বলেন, “একজনের পায়ে বিষাক্ত কিছুর কামড়ের ক্ষত চিহ্ন রয়েছে। তবে আরেক জনের শরীরে কোন চিহ্ন নেই। এটি সন্দেহজনক। পোস্টমর্টেম রিপোর্ট ছাড়া কোনো মন্তব্য করা যাবে না। আমরা সরাসরি সাপের কামড় বলতেও চাচ্ছি না। কারণ এ ঘটনায় কেউ জড়িত থাকলে সে সুবিধা পেয়ে যাবে। আমরা এ বিষয়টি আমলে নিয়ে তদন্ত শুরু করেছি।”
ঢাকা/শিয়াম/এস