ময়মনসিংহের ত্রিশালে ৭০০ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি সুতার কারখানা করেছে লান্তাবুর গ্রুপ। কাজ শেষ হয়েছে ছয় মাস আগে। কিন্তু গ্যাস–সংযোগ না পাওয়ায় কারখানাটি এখনো চালু করা যায়নি। যদিও তারা গ্যাস–সংযোগের চাহিদাপত্র (ডিমান্ড নোট) পেয়েছে ২০২২ সালের নভেম্বরে।
লান্তাবুর অ্যাপারেলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ সালমান প্রথম আলোকে বলেন, কারখানাটি চালু হলে দেড় হাজার লোকের কর্মসংস্থান হবে। কিন্তু গ্যাসের অভাবে চালু করা যাচ্ছে না। ওদিকে ব্যাংকঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু হয়ে গেছে।
গ্যাস–সংযোগের অভাবে উৎপাদন শুরু করতে না পারা কারখানার উদাহরণ আরও আছে। পেট্রোবাংলা ও সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, তিতাসসহ ছয়টি গ্যাস বিতরণ কোম্পানির কাছে শিল্প সংযোগের এক হাজারের বেশি আবেদন জমা আছে। এর মধ্যে চার শর বেশি গ্রাহক সব প্রক্রিয়া শেষ করে সংযোগের (প্রতিশ্রুত সংযোগ) অপেক্ষায় রয়েছে। মানে হলো, তারা গ্যাস–সংযোগের জন্য টাকাও জমা দিয়েছে। বাকি ৬০০ কারখানা আবেদন করেছে। তবে প্রতিশ্রুতি পায়নি।
যে চার শর বেশি গ্রাহক সব প্রক্রিয়া শেষ করে সংযোগের (প্রতিশ্রুত সংযোগ) অপেক্ষায় রয়েছে, তাদের কেউ নতুন কারখানা, কেউ সম্প্রসারিত কারখানা, কেউ লোড বৃদ্ধির (সরবরাহের পরিমাণ) আবেদনকারী।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহের কথা বলে ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে শিল্পে ১৫০ থেকে ১৭৮ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয় শিল্পে গ্যাসের দাম। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে গত ১৩ এপ্রিল নতুন সংযোগ ও লোড বৃদ্ধির ক্ষেত্রে গ্যাসের দাম ৩৩ শতাংশ বাড়িয়ে দেয় বিইআরসি।সমস্যাটি তৈরি হয়েছে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সাড়ে ১৫ বছরে। বিগত সরকার দেশে গ্যাস উত্তোলনে নজর না দিয়ে আমদানির পথে হেঁটেছে। ২০২২ সালের দিকে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত কমতে থাকায় গ্যাস আমদানি কঠিন হয়ে পড়ে। বিশ্ববাজারে দামও ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। জ্বালানি খাতে আওয়ামী লীগ সরকার বিপুল দেনা তৈরি করেছিল, যা এখন অন্তর্বর্তী সরকার শোধ করছে। নতুন সরকার দেশে গ্যাস উত্তোলনে জোর দিয়েছে; কিন্তু সংকট দূর করা যায়নি। সব মিলিয়ে চলমান কারখানাগুলো যেমন সংকটে রয়েছে, তেমনি নতুন সংযোগ চাইলেই দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এতে ভুগছে শিল্পকারখানাগুলো।
কুমিল্লার মাটিয়ারা এলাকায় রপ্তানিমুখী একটি প্লাস্টিক কারখানা করেছে দেশের অন্যতম শীর্ষ শিল্পগোষ্ঠী প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ। কারখানাটি উৎপাদনে এলেও পুরো সক্ষমতা কাজে লাগানো যাচ্ছে না। ক্যাপটিভ গ্যাস–সংযোগের জন্য পাইপলাইন বসানো, দুটি জেনারেটর বসানো—সবই শেষ। তবে গ্যাস–সংযোগের জন্য অপেক্ষা শেষ হচ্ছে না। তাঁদের ভাষ্য, কারখানাটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে অন্তত পাঁচ হাজার নতুন কর্মসংস্থানের আশা। বাখরাবাদ গ্যাস কোম্পানি থেকে তারা চাহিদাপত্র পেয়েছে ২০২১ সালের ২৩ জুন। এর বাইরে তিতাসের অধীন তাদের আরও একটি প্যাকেজিং কারখানায় গ্যাস–সংযোগের চাহিদাপত্র পেয়েছে। সেটিও এখন পর্যন্ত সংযোগ পায়নি। ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে চাহিদাপত্র পেয়েছে তারা।
শিল্পগোষ্ঠীটির চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আহসান খান চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, শত শত কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে দুটি কারখানায়। অথচ শেষ মুহূর্তে সংযোগ আটকে গেছে।
দাম বাড়ানোর আগে সরবরাহ নিশ্চিত করতে হয়। সংযোগের প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিনিয়োগ করানো—এটা প্রতারণা। নিজের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে তিনি বলেন, সংযোগের অনুমোদন নিয়ে জটিলতা বাড়লে ঘুষ, দুর্নীতি বা বৈষম্য সৃষ্টির সুযোগ থাকে।ভোক্তা অধিকার সংগঠন ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলমদাম বেড়েছে, সংকট যায়নি
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গ্যাসের দাম বারবার বেড়েছে। কিন্তু সংকট কখনোই যায়নি। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহের কথা বলে ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে শিল্পে ১৫০ থেকে ১৭৮ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয় শিল্পে গ্যাসের দাম। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে গত ১৩ এপ্রিল নতুন সংযোগ ও লোড বৃদ্ধির ক্ষেত্রে গ্যাসের দাম ৩৩ শতাংশ বাড়িয়ে দেয় বিইআরসি।
এদিকে গত জানুয়ারি থেকে নতুন সংযোগ দেওয়া পুরোপুরি বন্ধ আছে। তবে সরকারের অগ্রাধিকারে আছে প্রতিশ্রুত সংযোগ। এসব গ্রাহক আবেদন করে গ্যাস কোম্পানির বোর্ড থেকে অনুমোদন পেয়েছেন। এরপর জামানতের টাকা জমা দিয়ে ডিমান্ড নোট (চাহিদাপত্র) নিয়েছেন। গত ১৩ এপ্রিল পর্যন্ত যারা চাহিদাপত্র পেয়েছে, তাদের প্রতিশ্রুত গ্রাহকের তালিকায় রাখা হয়েছে।
গত ১৬ এপ্রিল জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ নির্দেশনা দেয়, গ্যাস–সংযোগের আবেদনগুলো তিন ভাগে ভাগ করতে—নতুন সংযোগ, লোড বৃদ্ধি ও প্রতিশ্রুত সংযোগ। ১৮ জুন পাঁচ সদস্যের একটি যাচাই কমিটি গঠিত হয় অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে। কমিটির কাজ আবেদন যাচাই করে অগ্রাধিকার তালিকা তৈরি করা; শিল্প স্থাপনের প্রস্তুতি পর্যালোচনা এবং মাঠপর্যায়ে পরিদর্শন।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, কোম্পানি আইন অনুসারে সর্বোচ্চ ক্ষমতা বোর্ডের হাতে। তাই গ্যাস–সংযোগ দিতে মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের প্রয়োজন হয় না। প্রয়োজনে গ্যাস–সংযোগ নিয়ে আলাদা বিধিমালা বা নীতিমালা করে দিতে পারে সরকার। যেসব কারখানা গ্যাস পেলেই সঙ্গে সঙ্গে কারখানা চালু করতে পারবে, তাদের অগ্রাধিকার দেওয়া যেতে পারে। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান প্রথম আলোকে বলেন, সংযোগের অনুমোদন মন্ত্রণালয় দেবে না, কোম্পানির বোর্ড থেকেই হবে। তবে টাকার বিনিময়ে সংযোগ দেওয়ার অভিযোগ আছে কোম্পানির বিরুদ্ধে। তাই সংযোগের যৌক্তিকতা ও অগ্রাধিকার বিবেচনা করে তালিকা তৈরিতে কাজ করছে কমিটি।
‘সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে’
বর্তমানে দেশে গড়ে ২৮০ থেকে ২৯০ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে, যেখানে চাহিদা ৩৮০ কোটি ঘনফুট। শিল্প খাতে যাচ্ছে ১২০ কোটির কিছু বেশি। এক হিসাবে দেখা গেছে, প্রতিশ্রুত সংযোগগুলো দেওয়া হলে আরও ১০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের সরবরাহ বাড়াতে হবে।
ভোক্তা অধিকার সংগঠন ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, দাম বাড়ানোর আগে সরবরাহ নিশ্চিত করতে হয়। সংযোগের প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিনিয়োগ করানো—এটা প্রতারণা। নিজের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে তিনি বলেন, সংযোগের অনুমোদন নিয়ে জটিলতা বাড়লে ঘুষ, দুর্নীতি বা বৈষম্য সৃষ্টির সুযোগ থাকে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: সরক র র আমল ল গ সরক র র প রথম আল ক নত ন স য গ সরবর হ গ র হক আওয় ম
এছাড়াও পড়ুন:
থাইল্যান্ডে চালের দাম ১৫ বছরে সর্বনিম্ন, বিশ্ববাজারে এ বছর কমেছে ১৪%
এশিয়াসহ বিশ্বের চালের বাজারে নিম্নমুখী প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এশিয়ায় চালের অন্যতম বৃহৎ সরবরাহকারী থাইল্যান্ডে চালের দাম ১৫ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে। মূলত বাজারে চালের সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।
থাইল্যান্ডসহ চালের অন্যান্য বড় উৎপাদনকারী দেশ ভারত ও মিয়ানমারে উৎপাদন বেড়ে যাওয়ায় বিশ্ববাজারেও চালের দাম কমছে। বিশ্ব খাদ্য সংস্থার খাদ্যসূচক অনুযায়ী, চলতি বছর চালের দাম কমেছে ১৩ দশমিক ৪০ শতাংশ। এমনকি বিশ্ববাজার চালের দাম আগস্ট মাসে আট বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে আসে। খবর দ্য নেশনের
থাইল্যান্ডে চালের দামের এই নিম্নমুখী প্রবণতা একদম নতুন কিছু নয়, বেশ কয়েক মাস ধরেই এ প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে দেশটির কৃষিবিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, দীর্ঘ সময় ধরে চালের দাম কম থাকায় দেশটির কৃষকেরা ধানের আবাদ কমিয়ে দিতে পারেন।
থাইল্যান্ডে গত বৃহস্পতিবার ৫ শতাংশ খুদযুক্ত চালের দাম দাঁড়ায় টনপ্রতি ৩৩৫ ডলার। আগের সপ্তাহে যা ছিল ৩৩৮ ডলার। থাইল্যান্ডের কৃষি খাত–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, গত ১৪ বছরে থাই সরকারের জনতুষ্টিমূলক নীতির কারণে এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। সরকার কৃষকদের সন্তুষ্ট করতে বিভিন্ন ধরনের নিশ্চয়তা দিয়েছে। এসব কর্মসূচিতে প্রায় ৪০ বিালিয়ন বা ৪ হাজার কোটি ডলার ব্যয় হলেও একধরনের নীতিগত ফাঁদ তৈরি হয়েছে। ফলে কৃষকেরা প্রযুক্তি উন্নয়ন, দক্ষতা বাড়ানো কিংবা বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার সঙ্গে খাপ খাওয়ানো থেকে নিরুৎসাহিত হয়েছেন।
সেই সঙ্গে থাইল্যান্ডের ব্যবসায়ীরা জানান, বর্ষা মৌসুমের শেষ দিকে বাজারে নতুন চালের সরবরাহ এসেছে। এটাও দাম কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ। অন্যদিকে ভারত ও মিয়ানমারের মতো প্রতিযোগী দেশগুলো চালের গুণগত মানের উন্নতি করেছে। আধুনিকতা এনেছে উৎপাদনব্যবস্থায়। ফলে তারা কম খরচে ভালো মানের চাল রপ্তানি করতে পারছে। কিন্তু থাইল্যান্ড এখনো ভর্তুকিনির্ভর ব্যবস্থায় আটকে আছে। এ পরিস্থিতিতে দেশটির কৃষকেরা ক্ষতির মুখে পড়ছেন বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
এফএওর সূচক কমেছেপ্রতি মাসেই খাদ্যমূল্যসূচক করে থাকে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও)। তাতে দেখা যাচ্ছে, চলতি বছর বিশ্ববাজারে চালের দাম কেমেছে ১৩ দশমিক ৪০ শতাংশ। গত অক্টোবর মাসে চালের মূল্যসূচক নেমে এসেছে ৯৮ দশমিক ৪–এ। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে তা ছিল ১১৩ দশমিক ৬। সেই সঙ্গে ২০২৪ সালের অক্টোবর মাসে চালের মূল্যসূচক ছিল ১২৫ দশমিক ৭। সেই হিসাবে এক বছরে চালের দাম কমেছে ২১ দশমিক ৭ শতাংশ।
চালের দামের এই পতন শুরু হয় ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে। বিশ্বের সর্ববৃহৎ চাল রপ্তানিকারক দেশ ভারত ধাপে ধাপে রপ্তানি–নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে শুরু করে তখন। এ ঘটনা চালের বাজারে বড় প্রভাব ফেলে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, এ বছর সব ধরনের চালের মূল্যসূচক ১৩ শতাংশ কমেছে। খবর ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসের
অথচ ২০২৪ সালের শুরুতে এর উল্টো চিত্র দেখা গেছে। তখন ভারত একের পর এক রপ্তানি সীমাবদ্ধতা জারি করলে ২০০৮ সালের পর চালের দাম সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায়। বিশ্বজুড়ে ভোক্তাদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। মানুষের মধ্যে মজুতের প্রবণতা তৈরি হয়। অন্যান্য উৎপাদক দেশেও সুরক্ষাবাদী পদক্ষেপ নেওয়া হয়। এর পর থেকে চালের দাম কমতে শুরু করে।