মেট্রোরেলের বিয়ারিং প্যাড পড়ে মৃত্যু: কারণ শনাক্ত ও দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা জরুরি
Published: 28th, October 2025 GMT
মেট্রোরেলের ভায়াডাক্টের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ‘বিয়ারিং প্যাড’–সম্পর্কিত দ্বিতীয় দুর্ঘটনায় এক যুবক প্রাণ হারিয়েছেন। এটি মেট্রোরেল অবকাঠামো নির্মাণের গুণমান, তদারকি ও দীর্ঘমেয়াদি নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তুলেছে।
রাজধানীর উত্তরা থেকে মতিঝিল পথে মেট্রোরেল ২০২২ সালের ডিসেম্বর থেকে দুই ধাপে চালু হয়। এখনো তিন বছরও হয়নি। অথচ বিয়ারিং প্যাডের নকশাগত আয়ুষ্কাল থাকে ২০-৩০ বছর। এমন দুর্ঘটনা বিয়ারিং প্যাডের বার্ধক্যের কারণে নয়; বরং গভীরতর ও মৌলিক ত্রুটির ইঙ্গিত বহন করে।
বিয়ারিং প্যাড হলো যেকোনো রেল বা সড়ক অবকাঠামোর অত্যাবশ্যক অংশ। ইলাস্টোমেরিক রাবার-স্টিল কম্পোজিট উপাদানে তৈরি এই প্যাডগুলো কংক্রিট ডেক (যার ওপর দিয়ে ট্রেন চলে) ও পিয়ারের মাঝখানে বসানো থাকে। এর মূল কাজ হলো ট্রেনের ওজন সমানভাবে বণ্টন করা, কম্পন শোষণ করা এবং তাপমাত্রা বা চলাচলের কারণে সৃষ্ট ক্ষুদ্র গতিবিধি সামলানো।
রাজধানীর ফার্মগেট স্টেশন এলাকায় প্রাণঘাতী দুর্ঘটনাটিতে একটি বিয়ারিং প্যাড খুলে নিচে পড়ে যায়, যা ইঙ্গিত করে যে এটি আর পিয়ার ও ডেকের মধ্যে সংযোগ অবস্থায় ছিল না। এখানে কয়েক বছরে অকালক্ষয় বা রক্ষণাবেক্ষণের অভাবজনিত অবনতি হওয়ার আশঙ্কা খুবই কম।
বরং সম্ভাব্য কারণগুলো হলো—
১.
২. নির্মাণ পর্যায়ে তদারকির অভাব: মেট্রোরেলের নির্মাণ চলাকালে অভিজ্ঞ প্রযুক্তিগত জনবলের ঘাটতি ছিল স্পষ্ট। প্রকল্প বাস্তবায়ন বা প্রজেক্ট ইমপ্লিমেন্টেশন ইউনিট ছিল দুর্বল, যা সড়ক ও রেলওয়ে বিভাগের কয়েকজন প্রকৌশলীর ওপর নির্ভরশীল ছিল। তাঁরা প্রেষণে এসেছিলেন। তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক নতুন প্রযুক্তিগত জনবল নিয়োগে অনাগ্রহ দেখিয়ে পরামর্শকদের ওপর নির্ভর করেছিলেন, যাঁদের বাণিজ্যিক স্বার্থের কারণে কঠোর সাইট তদারকি ব্যাহত হতে পারে। এমন ঘটনা বহু প্রকল্পে দেখা যায়।
নির্মাণকাজে যুক্ত শ্রমিকেরা মধ্যপ্রাচ্য ও সিঙ্গাপুরে কাজের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন এবং কঠোর নিরাপত্তা মানদণ্ডে অভ্যস্ত ছিলেন। তাঁরা তদারকির অভাব ও নিরাপত্তা প্রটোকল (নিয়মকানুন) লঙ্ঘন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। কেউ কেউ সরাসরি অভিযোগও জানিয়েছিলেন যে যথাযথ তদারকি ছাড়াই কাজ চলছিল।
৩. হুড়োহুড়ি করে নির্মাণ: তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক পরামর্শকদের সুপারিশ উপেক্ষা করে ২০১৯ সালের মধ্যেই মেট্রোর উদ্বোধনের জোর দাবি জানান (সুপারিশ ছিল ২০২২ সালে করার)। নির্বাচনী তাড়নায় তৈরি এই অবাস্তব সময়সূচির ফলে মাঠপর্যায়ে কাজ দ্রুত শেষ করতে গিয়ে সাইট তদারকি মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হয়। এর সঙ্গে ইনহাউস (নিজস্ব) প্রযুক্তিগত জনবলের অভাব ও পরামর্শক তদারকির দুর্বলতা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে। এর ফলে মেট্রোর ট্রানজিট-অরিয়েন্টেড ডেভেলপমেন্ট এবং অ-অপারেশনাল রাজস্ব বৃদ্ধির সম্ভাবনাও উপেক্ষিত হয়, প্রথম ও শেষ মাইল সংযোগব্যবস্থা অবহেলিত থাকে এবং জনসাধারণের ব্যবহারের আগে আবশ্যিক নিরাপত্তা মূল্যায়নও সম্পন্ন করা হয়নি।
এক বছরের মধ্যে দ্বিতীয় এমন ঘটনা প্রমাণ করে যে প্রথম দুর্ঘটনার মূল কারণ সঠিকভাবে শনাক্ত বা সমাধান করা হয়নি। এটি বর্তমান নিরাপত্তা নিরীক্ষা ও দায়বদ্ধতা ব্যবস্থার মারাত্মক দুর্বলতা প্রকাশ করে। বর্তমান মেট্রো ব্যবস্থা এখনো পূর্ণ সক্ষমতায় পরিচালিত হচ্ছে না। সেবা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে গতিশীল চাপ ও কম্পনও বাড়বে, যা এই দুর্বল উপাদানগুলোর ওপর আরও চাপ সৃষ্টি করবে।
পুনরাবৃত্তি রোধে কিছু পদক্ষেপ অবিলম্বে নেওয়া প্রয়োজন। এর মধ্যে রয়েছে—
১. স্বাধীন বিশেষজ্ঞ নেতৃত্বাধীন নিরাপত্তা নিরীক্ষা: প্রকৃত কারণ চিহ্নিত করতে একটি স্বাধীন, দক্ষ ও প্রযুক্তিগতভাবে সক্ষম সংস্থার মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত জরুরি। এটি কোনো অভ্যন্তরীণ তদন্ত হওয়া উচিত নয়।
২. তাৎক্ষণিক কাঠামোগত ব্যবস্থা: সব গুরুত্বপূর্ণ ভায়াডাক্ট অংশে অতিরিক্ত পার্শ্বনিয়ন্ত্রণ, যেমন শিয়ার কি বা গাইড বার সংযোজন করে স্থানচ্যুতি রোধ করতে হবে।
৩. প্রযুক্তিগতভাবে সক্ষম রক্ষণাবেক্ষণ ইউনিট গঠন: ডিএমটিসিএলের (মেট্রোরেল পরিচালনাকারী সংস্থা) অভ্যন্তরে একটি শক্তিশালী, প্রকৌশলী নেতৃত্বাধীন রক্ষণাবেক্ষণ ইউনিট গঠন করতে হবে, যারা প্রতি ছয় মাসে দৃশ্যমান পরিদর্শন ও প্রতিবছর লোড টেস্ট পরিচালনা করবে এবং তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিস্থাপনের ব্যবস্থা নিতে পারবে।
৪. ডিএমটিসিএলের কাঠামোগত সংস্কার: এই বহু টাকার অবকাঠামো পরিচালনাকারী সংস্থাটিকে জ্ঞানভিত্তিক ও সেবাকেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করতে হবে, যা প্রযুক্তিগতভাবে দক্ষ পেশাদারদের দ্বারা পরিচালিত হবে। বর্তমানে প্রেষিত বা অবসরপ্রাপ্ত সাধারণ আমলাদের প্রাধান্য নিরাপত্তা ও স্থায়িত্বের জন্য বড় ঝুঁকি।
যদি মূল কারণ শনাক্ত না হয় এবং দায়বদ্ধতা নিশ্চিত না করা হয়, তাহলে ভবিষ্যতে আরও প্রাণঘাতী দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
সামছুল হক: অধ্যাপক, বুয়েট; সাবেক পরিচালক, ডিএমটিসিএল এবং পরিচালক, দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট (এআরআই)
[মতামত লেখকের নিজস্ব]
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ব যবস থ দ র ঘটন প রক শ পর চ ল র ওপর
এছাড়াও পড়ুন:
একীভূত ব্যাংকের নাম হবে সম্মিলিত ইসলামী ব্যাংক
দেশের শরিয়াহভিত্তিক পাঁচ ব্যাংক একীভূত করার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে কাজ শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এরই অংশ হিসেবে ব্যাংক পাঁচটি থেকে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহের কাজ শুরু করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা। ব্যাংকটি একীভূত হলে জনবল ও শাখা নেটওয়ার্কের ব্যবস্থাপনা কীভাবে করা যাবে, তা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। পাশাপাশি আমানতকারীদের চাপ কীভাবে মোকাবিলা করা হবে, সেটি নিয়েও ব্যাংকগুলোর সঙ্গে আলোচনা করছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা।
এদিকে একীভূত কার্যক্রম বাস্তবায়নে সরকার গঠিত কমিটি নতুন ব্যাংক গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করেছে। আইন মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদনের পর ব্যাংকটির নাম নিবন্ধন সম্পন্ন হবে। নতুন ব্যাংকটির নাম চূড়ান্ত হয়েছে ‘সম্মিলিত ইসলামী ব্যাংক’। অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে সংকটে পড়া ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ও এক্সিম ব্যাংক একীভূত করা হচ্ছে। একীভূত ব্যাংকটি অধিগ্রহণ করবে সম্মিলিত ইসলামী ব্যাংক। এই ব্যাংকে ২০ হাজার কোটি টাকার মূলধন জোগান দেবে সরকার। ফলে শুরুতে এটি হবে সরকারি খাতের একটি ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংক এক বছর ধরে এই পাঁচ ব্যাংককে একীভূত করার বিষয়ে কাজ করছে। এ নিয়ে আইন ও নীতিমালা প্রণয়ন, সংকটে পড়া ব্যাংকগুলোর সম্পদ ও দায় পর্যালোচনা, ব্যাংক পাঁচটিকে কারণ দর্শানোর নোটিশ প্রদান ও সময় দেওয়ার পাশাপাশি আরও বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়। ৯ অক্টোবর পাঁচ ব্যাংক একীভূত করার প্রস্তাব অনুমোদন করে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ। এতে সিদ্ধান্ত হয়, নতুন ব্যাংকের অনুমোদিত মূলধন হবে ৪০ হাজার কোটি টাকা, যার মধ্যে পরিশোধিত মূলধন ৩৫ হাজার কোটি। পরিশোধিত মূলধনের ২০ হাজার কোটি টাকা দেবে সরকার। যার ১০ হাজার কোটি টাকা নগদে এবং বাকি ১০ হাজার কোটি সুকুক বন্ড ইস্যুর মাধ্যমে পরিশোধ করা হবে। শেয়ার রূপান্তরের মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিক আমানতকারীদের ১৫ হাজার কোটি টাকা মূলধনে রূপান্তর করা হবে। এ প্রক্রিয়ায় ব্যাংকের গ্রাহক ও অন্যান্য পাওনাদারের ঋণের একাংশ শেয়ারে রূপান্তর হবে। পরে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় এই শেয়ারের অর্থ নগদায়ন করা হবে।
একীভূত কার্যক্রম বাস্তবায়নে সরকার গঠিত কমিটি সূত্র জানায়, নতুন ব্যাংকের জন্য সংঘবিধি ও সংঘস্মারক চূড়ান্ত করার প্রক্রিয়া চলছে এখন। আগামীকাল মঙ্গলবারের মধ্যে তা আইন মন্ত্রণালয়ে পরীক্ষা–নিরীক্ষার জন্য পাঠানো হবে। সেখানে অনাপত্তি পেলে তা অনুমোদনের জন্য পাঠানো হবে বাংলাদেশ ব্যাংকে। এরপর নিবন্ধনের জন্য পাঠানো হবে যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তরে (আরজেএসসি)। এরপর সরকার মূলধনের টাকা দিলে ব্যাংক পাঁচটির দায়িত্ব নেবে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, পাঁচ ব্যাংকের আমানত, ঋণ ও ট্রেজারি ব্যবস্থাপনা নতুন করে নিরীক্ষা করতে হবে। পাশাপাশি ব্যাংক পাঁচটির জনবল, প্রযুক্তি বিভাগ ও নেটওয়ার্কের হিসাব–নিকাশ চলছে।
একীভূত প্রক্রিয়ার সঙ্গে থাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, অনেক জেলা শহরে পাঁচ ব্যাংকের শাখা আছে। ওই শহরে একটি বা দুটি শাখা রেখে অন্যগুলোকে অন্য উপজেলায় স্থানান্তর করা হবে। এ জন্য শাখাগুলো কোথায় স্থানান্তর করা যায়, তার সম্ভাব্য তালিকা করা হচ্ছে। এ ছাড়া এসব শাখা পরিচালনা করতে কত জনবল প্রয়োজন, তা–ও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। চলতি বছরের মধ্যে ব্যাংক পাঁচটির নতুন নামে নামকরণ হয়ে যাবে।
জানতে চাইলে গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ নূরুল আমিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘ব্যাংক একীভূত বিষয়ে লিখিত সিদ্ধান্তের জন্য আমরা অপেক্ষা করছি। তবে একীভূত করতে যে প্রক্রিয়া মেনে চলা হবে, তা অনানুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়েছে। ব্যাংকের আমানত, ঋণ, জনবল, শাখা ও এটিএম নেটওয়ার্কের হিসাব-নিকাশ চলছে। আশা করছি শিগগিরই আনুষ্ঠানিকভাবে এই প্রক্রিয়া শুরু হবে।’