মেট্রোরেলের ভায়াডাক্টের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ‘বিয়ারিং প্যাড’–সম্পর্কিত দ্বিতীয় দুর্ঘটনায় এক যুবক প্রাণ হারিয়েছেন। এটি মেট্রোরেল অবকাঠামো নির্মাণের গুণমান, তদারকি ও দীর্ঘমেয়াদি নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তুলেছে।

রাজধানীর উত্তরা থেকে মতিঝিল পথে মেট্রোরেল ২০২২ সালের ডিসেম্বর থেকে দুই ধাপে চালু হয়। এখনো তিন বছরও হয়নি। অথচ বিয়ারিং প্যাডের নকশাগত আয়ুষ্কাল থাকে ২০-৩০ বছর। এমন দুর্ঘটনা বিয়ারিং প্যাডের বার্ধক্যের কারণে নয়; বরং গভীরতর ও মৌলিক ত্রুটির ইঙ্গিত বহন করে।

বিয়ারিং প্যাড হলো যেকোনো রেল বা সড়ক অবকাঠামোর অত্যাবশ্যক অংশ। ইলাস্টোমেরিক রাবার-স্টিল কম্পোজিট উপাদানে তৈরি এই প্যাডগুলো কংক্রিট ডেক (যার ওপর দিয়ে ট্রেন চলে) ও পিয়ারের মাঝখানে বসানো থাকে। এর মূল কাজ হলো ট্রেনের ওজন সমানভাবে বণ্টন করা, কম্পন শোষণ করা এবং তাপমাত্রা বা চলাচলের কারণে সৃষ্ট ক্ষুদ্র গতিবিধি সামলানো।

রাজধানীর ফার্মগেট স্টেশন এলাকায় প্রাণঘাতী দুর্ঘটনাটিতে একটি বিয়ারিং প্যাড খুলে নিচে পড়ে যায়, যা ইঙ্গিত করে যে এটি আর পিয়ার ও ডেকের মধ্যে সংযোগ অবস্থায় ছিল না। এখানে কয়েক বছরে অকালক্ষয় বা রক্ষণাবেক্ষণের অভাবজনিত অবনতি হওয়ার আশঙ্কা খুবই কম।

বরং সম্ভাব্য কারণগুলো হলো—

১.

নকশাগত ত্রুটি বা স্থাপনজনিত ভুল: সবচেয়ে সম্ভাব্য কারণ এটি। পিয়ারপৃষ্ঠের ভুল লেভেলিং, অসম প্যাড পুরুত্ব, সঠিকভাবে স্থাপন না করা বা পর্যাপ্ত পার্শ্বনিয়ন্ত্রণের অভাবের ফলে বিয়ারিং শুরু থেকেই সঠিকভাবে কাজ করেনি।

২. নির্মাণ পর্যায়ে তদারকির অভাব: মেট্রোরেলের নির্মাণ চলাকালে অভিজ্ঞ প্রযুক্তিগত জনবলের ঘাটতি ছিল স্পষ্ট। প্রকল্প বাস্তবায়ন বা প্রজেক্ট ইমপ্লিমেন্টেশন ইউনিট ছিল দুর্বল, যা সড়ক ও রেলওয়ে বিভাগের কয়েকজন প্রকৌশলীর ওপর নির্ভরশীল ছিল। তাঁরা প্রেষণে এসেছিলেন। তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক নতুন প্রযুক্তিগত জনবল নিয়োগে অনাগ্রহ দেখিয়ে পরামর্শকদের ওপর নির্ভর করেছিলেন, যাঁদের বাণিজ্যিক স্বার্থের কারণে কঠোর সাইট তদারকি ব্যাহত হতে পারে। এমন ঘটনা বহু প্রকল্পে দেখা যায়।

নির্মাণকাজে যুক্ত শ্রমিকেরা মধ্যপ্রাচ্য ও সিঙ্গাপুরে কাজের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন এবং কঠোর নিরাপত্তা মানদণ্ডে অভ্যস্ত ছিলেন। তাঁরা তদারকির অভাব ও নিরাপত্তা প্রটোকল (নিয়মকানুন) লঙ্ঘন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। কেউ কেউ সরাসরি অভিযোগও জানিয়েছিলেন যে যথাযথ তদারকি ছাড়াই কাজ চলছিল।

৩. হুড়োহুড়ি করে নির্মাণ: তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক পরামর্শকদের সুপারিশ উপেক্ষা করে ২০১৯ সালের মধ্যেই মেট্রোর উদ্বোধনের জোর দাবি জানান (সুপারিশ ছিল ২০২২ সালে করার)। নির্বাচনী তাড়নায় তৈরি এই অবাস্তব সময়সূচির ফলে মাঠপর্যায়ে কাজ দ্রুত শেষ করতে গিয়ে সাইট তদারকি মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হয়। এর সঙ্গে ইনহাউস (নিজস্ব) প্রযুক্তিগত জনবলের অভাব ও পরামর্শক তদারকির দুর্বলতা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে। এর ফলে মেট্রোর ট্রানজিট-অরিয়েন্টেড ডেভেলপমেন্ট এবং অ-অপারেশনাল রাজস্ব বৃদ্ধির সম্ভাবনাও উপেক্ষিত হয়, প্রথম ও শেষ মাইল সংযোগব্যবস্থা অবহেলিত থাকে এবং জনসাধারণের ব্যবহারের আগে আবশ্যিক নিরাপত্তা মূল্যায়নও সম্পন্ন করা হয়নি।

এক বছরের মধ্যে দ্বিতীয় এমন ঘটনা প্রমাণ করে যে প্রথম দুর্ঘটনার মূল কারণ সঠিকভাবে শনাক্ত বা সমাধান করা হয়নি। এটি বর্তমান নিরাপত্তা নিরীক্ষা ও দায়বদ্ধতা ব্যবস্থার মারাত্মক দুর্বলতা প্রকাশ করে। বর্তমান মেট্রো ব্যবস্থা এখনো পূর্ণ সক্ষমতায় পরিচালিত হচ্ছে না। সেবা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে গতিশীল চাপ ও কম্পনও বাড়বে, যা এই দুর্বল উপাদানগুলোর ওপর আরও চাপ সৃষ্টি করবে।

পুনরাবৃত্তি রোধে কিছু পদক্ষেপ অবিলম্বে নেওয়া প্রয়োজন। এর মধ্যে রয়েছে—

১. স্বাধীন বিশেষজ্ঞ নেতৃত্বাধীন নিরাপত্তা নিরীক্ষা: প্রকৃত কারণ চিহ্নিত করতে একটি স্বাধীন, দক্ষ ও প্রযুক্তিগতভাবে সক্ষম সংস্থার মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত জরুরি। এটি কোনো অভ্যন্তরীণ তদন্ত হওয়া উচিত নয়।

২. তাৎক্ষণিক কাঠামোগত ব্যবস্থা: সব গুরুত্বপূর্ণ ভায়াডাক্ট অংশে অতিরিক্ত পার্শ্বনিয়ন্ত্রণ, যেমন শিয়ার কি বা গাইড বার সংযোজন করে স্থানচ্যুতি রোধ করতে হবে।

৩. প্রযুক্তিগতভাবে সক্ষম রক্ষণাবেক্ষণ ইউনিট গঠন: ডিএমটিসিএলের (মেট্রোরেল পরিচালনাকারী সংস্থা) অভ্যন্তরে একটি শক্তিশালী, প্রকৌশলী নেতৃত্বাধীন রক্ষণাবেক্ষণ ইউনিট গঠন করতে হবে, যারা প্রতি ছয় মাসে দৃশ্যমান পরিদর্শন ও প্রতিবছর লোড টেস্ট পরিচালনা করবে এবং তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিস্থাপনের ব্যবস্থা নিতে পারবে।

৪. ডিএমটিসিএলের কাঠামোগত সংস্কার: এই বহু টাকার অবকাঠামো পরিচালনাকারী সংস্থাটিকে জ্ঞানভিত্তিক ও সেবাকেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করতে হবে, যা প্রযুক্তিগতভাবে দক্ষ পেশাদারদের দ্বারা পরিচালিত হবে। বর্তমানে প্রেষিত বা অবসরপ্রাপ্ত সাধারণ আমলাদের প্রাধান্য নিরাপত্তা ও স্থায়িত্বের জন্য বড় ঝুঁকি।

যদি মূল কারণ শনাক্ত না হয় এবং দায়বদ্ধতা নিশ্চিত না করা হয়, তাহলে ভবিষ্যতে আরও প্রাণঘাতী দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।

 সামছুল হক: অধ্যাপক, বুয়েট; সাবেক পরিচালক, ডিএমটিসিএল এবং পরিচালক, দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট (এআরআই)

[মতামত লেখকের নিজস্ব]

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ব যবস থ দ র ঘটন প রক শ পর চ ল র ওপর

এছাড়াও পড়ুন:

গুলি ছুড়ে প্রহরীদের ভয় দেখিয়ে বনের গাছ কেটে নিল দুর্বৃত্তরা

হবিগঞ্জে বনে ঢুকে ফাঁকা গুলি ছুড়ে ও বনপ্রহরীদের ভয় দেখিয়ে ২০ থেকে ২৫টি গাছ কেটে নিয়ে গেছে একদল দুর্বৃত্ত। গতকাল বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত সাড়ে তিনটায় জেলার চুনারুঘাট উপজেলায় অবস্থিত দেশের অন্যতম বনাঞ্চল রেমা–কালেঙ্গায় এ ঘটনাটি ঘটে।

বন বিভাগের হবিগঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক মো. জয়নাল আবেদীন ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের জনবল কম। যে কারণে ৫০ থেকে ৬০ জনের বনদস্যু দল বনের ভেতরে ঢুকে আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে ফাঁকা গুলি ছুড়ে আতঙ্ক তৈরি করে এ ঘটনাটি ঘটিয়েছে। এ বিষয়ে তদন্ত চলছে।’

১ হাজার ৮০০ একর আয়তনের এই সংরক্ষিত বনের ভেতরে সেগুনগাছসহ নানা প্রজাতির গাছগাছালি রয়েছে। সম্প্রতি এ বনের গাছ কেটে নেওয়াসহ নানা অপরাধের ঘটনা ঘটছে।

বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, গতকাল দিবাগত রাত সাড়ে তিনটার দিকে বনের হিমানিয়া বাজারসংলগ্ন এলাকা দিয়ে ৫০ থেকে ৬০ দুর্বৃত্ত প্রবেশ করে। তারা বনে ঢুকে প্রথমে ফাঁকা গুলি ছোড়ে। গুলির আওয়াজ শুনে বনপ্রহরীরা এগিয়ে গেলে তাঁদের লক্ষ্য করেও গুলি চালায় দুর্বৃত্তরা। এ সময় প্রহরীরা পাল্টা গুলি চালান। একপর্যায়ে বনদুস্যদের তাড়া খেয়ে বনপ্রহরীরা ঘটনাস্থল থেকে চলে যান। এ সময় দুর্বৃত্তরা বনের ভেতর থেকে একে একে ২০ থেকে ২২টি সেগুনগাছ কেটে ট্রাক্টরে নিয়ে পালিয়ে যায়। বিষয়টি জানাজানি হলে আজ শুক্রবার সকালে বন বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।

রেমা–কালেঙ্গা বন কর্মকর্তা (রেঞ্জার) আবদুল খালেক বলেন, প্রহরীদের লক্ষ্য করে দুর্বৃত্তরা গুলি ছুড়লে তাঁরা পিছু হটেন। কারণ, এ সময় মাত্র তিন প্রহরী দায়িত্বরত ছিলেন। এর বিপরীতে দুর্বৃত্তরা ছিল বেশ সংঘবদ্ধ। বন কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘বনদস্যুরা বেশি গাছ নিতে পারেনি। সেগুন ও আকাশমণি জাতের ২০ থেকে ২২টি গাছ নিয়ে গেছে। আমরা কিছু উদ্ধার করতে পেরেছি। দুর্বৃত্তরা আধুনিক করাত ব্যবহার করে। এই করাত দিয়ে তিন থেকে চার মিনিটে একটি কাছ কাটা যায়।’

হবিগঞ্জ বন বিভাগের সহকারী বন সংরক্ষক মো. জয়নাল আবেদীন জানান, এত বড় বন কমসংখ্যক জনবল দিয়ে সংরক্ষণ করা কঠিন। এ ছাড়া বনের কর্মকর্তা ও বনপ্রহরী সবাই এ বনে নতুন যোগদান করেছেন। যে কারণে তাঁরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই এ ঘটনাটি ঘটে। তিনি বলেন, কী পরিমাণ গাছ কেটে নিয়ে গেছে দুর্বৃত্তরা, তা নির্ণয় ও তদন্তকাজ চলছে। পাশাপাশি এ বিষয়ে আইনগত পদক্ষেপ প্রক্রিয়াধীন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • গুলি ছুড়ে প্রহরীদের ভয় দেখিয়ে বনের গাছ কেটে নিল দুর্বৃত্তরা