গণমাধ্যম সূচকে অগ্রগতি এবং সাংবাদিকের নিজস্ব লড়াই
Published: 3rd, May 2025 GMT
আজ ৩ মে বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস। আনন্দের বার্তা হলো, বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে বাংলাদেশে গত ১৫ বছর পর প্রথমবারের মতো ইতিবাচক অগ্রগতি ঘটেছে! বিষয়টি অন্যভাবে বলা যাক। মূলত গত দেড় দশক আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ভয়াবহভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে। এই অর্জনের বার্তা হলো, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর দেশে সংবাদমাধ্যমের ওপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। এটি বিশেষত বাংলাদেশের মতো নিয়ন্ত্রিত সংবাদমাধ্যমের জন্য অনেক বড় একটি খবর।
সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার সঙ্গে প্রধানত তিনটি পক্ষ যুক্ত থাকে। রাষ্ট্র ব্যবস্থা, মালিকপক্ষ ও সাংবাদিক। আঠারো শতকের শেষে নিখিল ভারতবর্ষে সংবাদপত্রের সূচনা ঘটেছিল। ইংরেজ সরকার বিভিন্ন সময় সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ করেছে। দেশভাগের পরেও সংবাদমাধ্যমের ওপর পাকিস্তান সরকারের নিয়ন্ত্রণের বহু চেষ্টা আমরা দেখেছি। সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার কায়েমের লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটেছিল, সেখানেও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। বরং স্বাধীনতার পরে গঠিত শেখ মুজিব সরকারও জাতীয়করণের নামে সংবাদমাধ্যমের ওপর নজিরবিহীন নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। বস্তুত পাঁচ দশক ধরেই ক্ষমতাসীন দলগুলো দেশে বারবার সংবাদমাধ্যমের ওপর হস্তক্ষেপ করেছে।
প্রশ্ন হলো, হস্তক্ষেপের নেপথ্যে কি শুধু ক্ষমতাসীন দলগুলোই দায়ী? বিষয়টি পুরোপুরি তেমন নয়। ২০২৪ সালের জুলাই গণঅভ্যুত্থান চলাকালে আমরা দেখেছি কীভাবে শেখ হাসিনার প্রেস কনফারেন্সে দেশের অনেক জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক তোষামোদ করেছিল! এতে এটাই স্পষ্ট হয়, দেশে ক্ষমতাসীন দল সংবাদমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করার পেছনে কোনো কোনো সাংবাদিক ও কতিপয় সংবাদমাধ্যম কর্তৃপক্ষও দায়ী।
এ পরিস্থিতিতে সাংবাদিক হিসেবে আমাদেরও আত্মসমালোচনা জরুরি হয়ে পড়েছে। ইতিহাসের পরতে পরতে দেখা গেছে, ক্ষমতাসীন দল নাগরিকদের কণ্ঠরোধের চেষ্টা করে। পুঁজিবাদী বলয়ে যুক্ত হওয়ার পর থেকে ধীরে ধীরে সংবাদমাধ্যমের নাগরিক অধিকার, চিন্তা ও কথা বলার স্বাধীনতার মতো মৌলিক বিষয়গুলো উপেক্ষিত হতে থাকে। এতে চেক অ্যান্ড ব্যালান্সের অবনতি ঘটে। ফলে সাংবাদিক, লেখক ও সিভিল সোসাইটির চিন্তার স্বাধীনতা সংকুচিত হয়ে এসেছে। অনেকটা জর্জ ফ্লয়েডের সেই ঐতিহাসিক বার্তার মতো– আমি শ্বাস নিতে পারছি না।
স্বাধীনতার পর থেকে যে লুটেরা অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, তার পাটাতনে দাঁড়িয়ে বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক ও নাগরিক সমাজের বিকাশ ঘটেছে। সুতরাং আমাদের চিন্তার পাটাতনই সুষ্ঠু ও স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় চালিত হয়নি। একটা সমাজের বিবেক নিয়ে যে জনগোষ্ঠী কাজ করে– যাদের আমরা বলি লেখকসমাজ– তারা একটি ভয়াবহ শৃঙ্খলে আবদ্ধ থেকে চিন্তা করতে বাধ্য হয়। মস্তিষ্ক নিয়ন্ত্রণের এই প্রক্রিয়া যে কোনো মানুষের মধ্যে মনোবিকার ঘটায়। এ কারণে বাংলাদেশে বুদ্ধিবৃত্তিক বলয়ের কোনো স্বাধীন সত্তা গড়ে ওঠেনি। এর দায় যতটা রাষ্ট্র ব্যবস্থা ও ক্ষমতাসীন দলের, তেমনি এই বন্দোবস্ত ফলবান হতে পুষ্টি জুগিয়েছে নাগরিক সমাজ, লেখক ও সাংবাদিক মহলের একটি অংশ।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সমুন্নত করার দুর্দান্ত সুযোগ তৈরি হয়েছে। এই সম্ভাবনা জাগিয়ে রাখতে সবার আগে দরকার সাংবাদিক মহলের যৌথ তৎপরতা। সাংবাদিকরা নীতি ও নৈতিকতার ভিত্তিতে নিজেদের কণ্ঠ ও কলম জোরদার করলেই সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা শক্তিশালী হবে। এর জন্য সরকার ও মালিকপক্ষের সহযোগিতা প্রক্রিয়াটি আরও সহজ করে তুলবে। নিজের অধিকার ও স্বাধীনতার লড়াই নিজেকে করতে হবে– এই বোধোদয় যতদিন সাংবাদিক মহলের হবে না, ততদিন তারা “দু’পয়সার সাংবাদিক” হিসেবেই কোনো রকম বেঁচে থাকবে।
ইফতেখারুল ইসলাম: সহসম্পাদক, সমকাল
 iftekarulbd@gmail.                
      
				
                    
    
				com 
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র স ব ধ নত র ক ষমত স ন সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
বিদেশি বিনিয়োগ বেড়েছে
বাংলাদেশে বৈদেশিক প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ (এফডিআই) গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী এক বছরে ১৯ দশমিক ১৩ শতাংশ বেড়েছে। এর মধ্যে দিয়ে দেশে বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশের প্রতি আন্তর্জাতিক আস্থার প্রতিফলন দেখা গেছে।
বিশ্বব্যাংকের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, সম্প্রতি যেসব দেশে গণঅভ্যুত্থান ঘটেছে, সেসব দেশে পরবর্তী এক বছরে এফডিআই উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। এর মধ্যে শ্রীলঙ্কায় ২০২২ সালের পর এফডিআই কমেছে ১৯.৪৯ শতাংশ, চিলিতে ২০১৯ সালের পর কমেছে ১৫.৬৮ শতাংশ, সুদানে ২০২১ সালের পর ২৭.৬০ শতাংশ, ইউক্রেনে ২০১৪ সালের পর ৮১.২১ শতাংশ, মিশরে ২০১১ সালের পর ১০৭.৫৫ শতাংশ এবং ইন্দোনেশিয়ায় ১৯৯৮ সালের পর ১৫১.৪৯ শতাংশ কমেছে। এই ধারাবাহিক হ্রাসের মধ্যে বাংলাদেশে এফডিআইর ১৯.১৩ শতাংশ বৃদ্ধির চিত্র বিশেষভাবে নজরকাড়া।
বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী বলেছেন, “বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় গুণ হলো—শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও অর্থনীতিকে পুনরায় চালু করার অদ্ভুত ক্ষমতা। এই পরিসংখ্যান তার দারুন একটা প্রতিফলন। সাধারণত, গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে বিদেশি বিনিয়োগ কমে যায়, কিন্তু আমরা উল্টা দেখছি। সঠিক নীতি নির্ধারণ, বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআরসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থার আন্তরিকতা এবং প্রাইভেট সেক্টরের অদম্য স্পৃহা কারণে এটি সম্ভব হয়েছে। আমরা সব সময় বিনিয়োগকারীদের সাহায্য করার চেষ্টা করেছি। সব সমস্যার সমাধান হয়নি, তবে সদিচ্ছার কোনো ত্রুটি ছিল না। শিগগিই সারা বছরের একটি আমলনামা (রিপোর্ট কার্ড) প্রকাশ করা হবে।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে বিদেশি বিনিয়োগ ছিল ৪৮৮ দশমিক ৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, ২০২২ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৬৭০ দশমিক ৭ মিলিয়ন ডলারে। ২০২৩ সালে বিনিয়োগের পরিমাণ হয় ৯২৪ দশমিক ৪ মিলিয়ন ডলার, তবে ২০২৪ সালে কিছুটা কমে দাঁড়ায় ৬৭৬ দশমিক ৬ মিলিয়ন ডলারে। ২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসে বিদেশি বিনিয়োগ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৯২ দশমিক ৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে এই ধারা বজায় থাকা অত্যন্ত ইতিবাচক। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, দীর্ঘমেয়াদি নীতি সহায়তা ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ ভবিষ্যতে আরো বড় পরিসরে বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে পারবে বলে মনে করছেন তারা।
ঢাকা/নাজমুল/রফিক