নারী সংস্কার কমিশনের সুপারিশ, প্রতিবাদ ও আকাঙ্ক্ষা
Published: 5th, May 2025 GMT
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর মোট ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন করে। এগুলোর মধ্যে ২০২৪ সালের ১৮ নভেম্বর নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের গেজেট প্রকাশিত হয়; শিরীন পারভীন হকের নেতৃত্বাধীন ১০ সদস্যের কমিশন ২ ডিসেম্বর থেকে কাজ শুরু করে। তারা ৪২৩টি সুপারিশসহ ৩১৮ পৃষ্ঠার বিস্তারিত প্রতিবেদন ১৯ এপ্রিল প্রধান উপদেষ্টা ড.
কমিশন তিন পর্যায়ে সুপারিশ বাস্তবায়নের প্রস্তাব করে। প্রথমত, অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদে বাস্তবায়নযোগ্য। দ্বিতীয়ত, পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের মেয়াদকালে পাঁচ বছরের মধ্যে বাস্তবায়নযোগ্য এবং তৃতীয়ত, দীর্ঘ মেয়াদে নারী আন্দোলনের স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়ন করা। প্রধান উপদেষ্টা সেদিন কমিশন সদস্যদের বলেন, যে প্রস্তাবগুলো দ্রুত কার্যকর করা সম্ভব, তা তাড়াতাড়ি করা হবে। অন্যদিকে সংস্কার কমিশনের কয়েকটি সুপারিশ নিয়ে প্রতিবাদ ওঠে। বিশেষত অভিন্ন পারিবারিক আইনের মাধ্যমে সব ধরনের নারীর সমান অধিকার, উত্তরাধিকার আইন ও শ্রম আইনে যৌনকর্মীদের স্বীকৃতি দেওয়ার সুপারিশের বিরুদ্ধে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল ও সংগঠনগুলো তীব্র আপত্তি জানায়।
কমিশনের পক্ষ থেকে স্পষ্ট বলা হয়– নারীর জন্য সমতা, সুরক্ষা, অর্থনীতিতে অংশগ্রহণ, সম্পদের অধিকার, নিরাপদ অভিবাসন ও জনপ্রশাসনে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করবার লক্ষ্যে এই সুপারিশগুলো দীর্ঘ মেয়াদে দেশের নারীর জীবনমান ও মর্যাদা নিশ্চিত করবে। এদিকে ৩ মে, ২০২৫ রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মহাসমাবেশে হেফাজতে ইসলাম অন্যান্য দাবির পাশাপাশি পুরো নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনই বাতিলের দাবি তুলেছে। সমাবেশে হেফাজত নেতৃবৃন্দ ঘোষণা করেন, নারীর ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে তিন মাসের মধ্যে বিভাগীয় সম্মেলন এবং আগামী ২৩ মে বাদ জুমা চার দফা আদায়ে বিক্ষোভ মিছিল করা হবে। নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের কয়েকটি সুপারিশের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে এরই মধ্যে রিটও হয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত মোট ১১টি সংস্কার কমিশনের অধিকাংশই প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। তবে আর কোনো কমিশনের সুপারিশ নিয়ে এমন প্রতিবাদ হয়নি কিংবা পুরো কমিশন বাতিলের দাবিও ওঠেনি। কমিশন সুপারিশ করেছে মাত্র; আলাপ-আলোচনা হতে পারে– যে কোনো যৌক্তিক মীমাংসা অবশ্যই সম্ভব; কিন্তু সবকিছুর আগেই আস্ত কমিশন বাতিলের দাবি থেকে বোঝা যায়, এর গোড়াতেই রয়েছে দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্য, সংশয়, অবিশ্বাস ও আশঙ্কা। হেফাজতে ইসলাম নেতৃবৃন্দ নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন বাতিল করে আলেমদের সমন্বয়ে নতুন কমিশন গঠনের দাবিও তুলেছেন।
২.
হেফাজতে ইসলামের শনিবারের মহাসমাবেশের মঞ্চে যে ভাষায় ও ভঙ্গিতে বক্তব্য প্রদান করা হলো, তা যথেষ্ট উদ্বেগ ও বিতর্কের বিষয়। সংগঠনটির যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক বলেছেন, ‘নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেছে। আমরা তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা দেখতে চাই।’ আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমান বলেছেন, ‘নারী কমিশন করার জন্য জুলাই বিপ্লবে তরুণেরা জীবন দেননি। শুধু সেই সংস্কারগুলোই করা দরকার, যার মাধ্যমে দেশে ফ্যাসিবাদের পুনরুত্থানের পথ বন্ধ করা যাবে’ (প্রথম আলো, ৪ মে, ২০২৫)। সমাবেশে একাধিক নেতা নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের সদস্যদের সম্পর্কে আপত্তিকর শব্দ ও বাক্য ব্যবহার করেন। একই মঞ্চে বক্তব্য দেন গণঅভ্যুত্থানের ছাত্রনেতা ও এনসিপি নেতা হাসনাত আবদুল্লাহ। এনসিপিও কি তবে নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের সুপারিশের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে? তাদের নেতৃবৃন্দকে এ বিষয়ে স্পষ্ট অবস্থান জানাতে হবে।
যে অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থানে দেড় দশকের দোর্দণ্ড প্রতাপশালী একনায়ক শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী সরকারের পতন, তার অন্যতম কুশীলব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা। ১৪ জুলাই সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনার দাম্ভিক উক্তি– ‘চাকরি মুক্তিযোদ্ধার সন্তানরা পাবে, নাকি রাজাকারের সন্তানরা পাবে?’ এই কথার উত্তরে মধ্যরাতে বিশ্ববিদ্যালয় হল থেকে হাজার হাজার ছাত্রীর বজ্রকণ্ঠ উচ্চারণ স্বৈরাচারের ভিত কাঁপিয়ে তোলে– ‘তুমি কে আমি কে?/ রাজাকার, রাজাকার/ কে বলেছে? কে বলেছে?/ স্বৈরাচার/ স্বৈরাচার।’ সেই প্রথম দুঃশাসককে সরাসরি ‘স্বৈরাচার’ হিসেবে শনাক্ত করবার স্পর্ধা দেখায় এ দেশের ছাত্রীরা; তথা নারীরা। তারপর ৫ আগস্ট পর্যন্ত গণআন্দোলনে সম্মুখসারিতে ছিলেন সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা; তখন কারও মনে বা মাথায় আসেনি, কে হিজাব পরে মিছিলে আছে কিংবা কে টপস আর জিন্স পরে স্লোগান দিচ্ছে? নারী-পুরুষ নির্বিশেষে একাকার সেই মিছিলে সকলে সম্মিলিত প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর! কেবল ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থান নয়, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ থেকে এর আগের পরের সকল গণআন্দোলনে নারীর ভূমিকা সবসময় অগ্রগণ্যই শুধু নয়, ত্যাগ ও মহত্ত্বে বরাবর তা অতুলনীয়। দেশের আর্থসামাজিক অবকাঠামো নির্মাণে সব শ্রেণি-পেশার নারী শ্রম, সময় ও অংশগ্রহণের মাধ্যমে অসামান্য ভূমিকা রাখছেন।
সেই নারীদের জীবনমান উন্নয়ন ও পুরুষদের সমান্তরালে সমান অধিকার প্রসঙ্গে সুপারিশ করলে তা ধর্মদ্রোহী হয়ে ওঠে; তাদের পোশাক, তাদের কথা-বিবেচনা, তাদের সমান হিস্যার দাবি আক্রমণের বিষয় হয় কোন বিবেচনায়– তা বিস্ময়ের উদ্রেক করে। বলা হচ্ছে, নারীবিষয়ক সংস্কার কমিটিতে কেন কোনো আলেম রাখা হয়নি? কেন কোনো পুরুষ নেই? সংবিধান সংস্কার কমিটিতেও কোনো নারী নেই; সেটি নিয়ে কথা ওঠেনি। আর কোনো সংস্কার কমিটিতেই ধর্মীয় পণ্ডিত রাখা হয়নি। এই দেশ নিশ্চয়ই শরিয়া আইনে চলছে না; চলবেও না বলেই আমাদের প্রত্যাশা। যতক্ষণ পর্যন্ত দেশে একটি সংবিধান আছে, সেই অনুযায়ী সব আইনকানুন-সংস্কার হবে এবং হতে হবে। অভিন্ন পারিবারিক আইনের মাধ্যমে নারীর সমান অধিকার নিশ্চিত করবার সুপারিশ দেশের বর্তমান সংবিধানসম্মত। সব ধর্মের নারীই এক আইনে একই ধরনের সুবিধা পাবেন। অবশ্য কমিশন এ-ও সুপারিশ করেছে, যে বা যারা নিজ নিজ ধর্মীয় আইনে তাদের সম্পত্তি ও অধিকার বণ্টন করতে চাইবেন, অর্থাৎ ধর্মভিত্তিক আইন যারা চাইছেন, তারা সেই আইন অনুসরণ করবেন। আর যারা দেওয়ানি আইন অনুসরণ করতে চান, তাদের জন্য অভিন্ন পারিবারিক আইন। উত্তরাধিকার আইনের ক্ষেত্রেও একই। অর্থাৎ ধর্মভিত্তিক আইন ও দেওয়ানি আইন যুগপৎ কার্যকর থাকবে। যার যেটি পছন্দ, তিনি সেটি চর্চা করবেন। রাষ্ট্রীয়ভাবে কাউকে কোনো নির্দিষ্ট আইন মানতে বাধ্য করা হবে না।
৩.
এত সরল নয় নারী-পুরুষের সমান অধিকারের বিষয়; সামাজিক মূল্যবোধ ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নানা পরম্পরা আঁকড়ে ধরে রাখে। যারা দায়িত্বে থাকেন, সংস্কার বাস্তবায়ন করতে চান; তাদের উচিত এগুলোকে সংবেদনশীলনতার সঙ্গে বুঝে সকলের মধ্যে সম্মিলিত ‘স্পেস’ বা ‘নিঃশ্বাস নেবার জায়গা’ বের করা। চাপিয়ে না দিয়ে বরং আলোচনা ও যুক্তির মাধ্যমে বিরোধ মীমাংসা করতে হবে।
এ দেশের নব্বই ভাগের বেশি মানুষ ধর্মপ্রাণ মুসলমান, জন্ম থেকেই তারা মুসলিম; সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষদের জন্য তাই আর বাড়তি ‘রাষ্ট্রীয়’ ইসলামের পৃষ্ঠপোষকতার প্রয়োজন পড়ে না। বরং সকলে যাতে সমান অধিকার পায়– ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ নির্বিশেষে, সেই দিকেই রাষ্ট্রের দৃষ্টি রাখা সংগত। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার যেহেতু রাজনৈতিক সরকারের মতো ভোটের রাজনীতি করে না, তাই আমজনতাকে নিয়ে রাজনীতি করবার চেয়ে বিবেক-যুক্তি ও সময়ের প্রয়োজনকে তারা বেশি গুরুত্ব দেবে বলে প্রত্যাশা করি। আর ড. মুহাম্মদ ইউনূস– তাঁর দীর্ঘ ও সফল জীবনের বেশির ভাগ সময় দেশের তৃণমূলের নারীর জীবনমান উন্নয়নে কাজ করেছেন, বিশ্বজুড়ে খ্যাতি অর্জন করেছেন। নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে তাঁর ইতিবাচক ভূমিকা দেখবার অপেক্ষায় তাই সমগ্র জাতি।
মাহবুব আজীজ: উপসম্পাদক, সমকাল; সাহিত্যিক
mahbubaziz01@gmail.com
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: সরক র র র জন য র জন ত ত করব করব র ক আইন ইসল ম
এছাড়াও পড়ুন:
বিএনপির নেতৃত্ব, গণতন্ত্র ও নির্বাচন
প্রায় চার মাস লন্ডনে অবস্থানের পর বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার দেশের উদ্দেশে রওনা হওয়ার ঘটনা বিশেষভাবে আলোচিত হচ্ছে। এর আগে সামাজিক মাধ্যমে কেউ কেউ ছড়াচ্ছিলেন– তিনি আর ফিরবেন না। ‘মাইনাস টু’ ফর্মুলায় যারা এখনও উৎসাহী, তারাই এসব বলে থাকেন। বাস্তবতা দেখা যাচ্ছে ভিন্ন। খালেদা জিয়া কাতারের আমিরের দেওয়া বিশেষ বিমানে তাঁর পুত্র, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কাছে গিয়েছিলেন। সেখানে তাঁকে টানা ক’দিন ক্লিনিকে থাকতে হয়। তারপর বাসায়ও ছিলেন চিকিৎসাধীন। বিগত শাসনামলে বারবার অনুরোধ সত্ত্বেও উন্নত চিকিৎসা গ্রহণের এ সুযোগ তিনি পাননি। বিএনপি চেয়ারপারসন এখন কতটা সুস্থ, তা স্পষ্ট জানা না গেলেও তাঁর অবস্থার উন্নতি হয়েছে বলে মনে হয়।
শারীরিক অবস্থার উন্নতি হলেও খালেদা জিয়া আর আগের মতো বিএনপির নেতৃত্ব দিতে পারবেন কি? বুদ্ধি-পরামর্শ দিয়ে দলকে সহায়তা করতে পারবেন নিশ্চয়ই। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর মুক্ত হয়ে এ পর্যন্ত সরব না হলেও তারেক রহমানের মাধ্যমে যে কিছুটা হলেও ভূমিকা তিনি রাখছেন, তা ধরেই নেওয়া যায়। এটাও ঠিক, তিনি কারাগারে থাকার সময় পুত্র তারেক রহমানই বিএনপিকে রক্ষা ও পরিচালনা করেছেন। বিদেশে অবস্থান করে কাজটা করা কঠিন। তাঁর নেতৃত্বে সরকার পতনের আন্দোলন বেগবান না হলেও একটি স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থায় দলের ঐক্য ধরে রাখাও ছিল গুরুত্বপূর্ণ। দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছর দমন-পীড়নের শিকার হয়ে বিএনপি নেতাকর্মীও দলকে রক্ষা করেছেন।
মাঠে থাকা প্রধান রাজনৈতিক দল এখন বিএনপি। চিকিৎসা শেষে দলটির চেয়ারপারসনের দেশে ফেরার ঘটনা তাই দলীয় নেতাকর্মীর জন্য বড় সুখবর। তিনি আবার ফিরছেন দুই পুত্রবধূকে সঙ্গে নিয়ে। এ অবস্থায় তারেক রহমানের স্ত্রী জোবাইদা রহমানের দেশে ফেরার ঘটনা বিশেষ আলোচনার জন্ম দিয়েছে। প্রায় ১৭ বছর পর তিনি ফিরছেন। এক-এগারো সরকারের আমলে তাঁর বিরুদ্ধেও মামলা দেওয়া হয়েছিল। হাসিনা সরকারের আমলে তা বহাল থাকে। বর্তমানে তিনি সেসব জটিলতা থেকে মুক্ত। তবে দেশে তাঁর নিরাপত্তা ঝুঁকি রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। জোবাইদার জন্য বিশেষ নিরাপত্তা চেয়ে আইজিপির কাছে চিঠি দিয়েছে বিএনপি।
এ অবস্থায় এমন জল্পনাও হচ্ছে, জোবাইদা রহমান কি বিএনপিতে কোনো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে যাচ্ছেন? এর আগে সম্ভবত ২০১৮ সালে নির্বাচনের আগে রটেছিল, খালেদা জিয়া কারান্তরীণ এবং তারেক রহমান বিদেশে অবস্থানে বাধ্য হওয়ায় জোবাইদা দলের নেতৃত্ব দিতে আসবেন! মামলা থাকায় কিংবা যে কারণেই হোক, সেটি ঘটেনি। তারেক রহমানকেই বরং আরও নিবিড়ভাবে বিএনপির নেতৃত্ব দিতে দেখা গেছে।
২০১৮ সালে নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ কার্যত ঢুকে গিয়েছিল সরকারের মধ্যে। আর সরকার প্রবেশ করেছিল প্রশাসনে। এ অবস্থায় চরম মূর্তি ধারণ করা স্বৈরতন্ত্র থেকে বিএনপিকে আগলে রাখাই ছিল বড় কাজ। তারেক রহমান এতে ব্যর্থ হননি। এর ভেতর দিয়ে দলে তাঁর অবস্থান হয়েছে আরও সংহত। এ অবস্থায় তারেক রহমানের জায়গায় জোবাইদা কিংবা অন্য কাউকে গ্রহণের কথা উঠবে কেন? এমনও হতে পারে, তারেক রহমানের স্ত্রী বলেই তাঁর নিরাপত্তায় বিশেষ জোর দেওয়া হচ্ছে।
তারেক রহমানের নামে বিচারিক আদালতে আর কোনো মামলা নেই। বলা হচ্ছে, খালেদা জিয়া দুই পুত্রবধূ নিয়ে দেশে ফেরার কিছুদিন পর তারেক রহমানও ফিরবেন। এক-এগারো সরকারের সময় তাঁকে আর রাজনীতি না করার বিষয়ে মুচলেকা দিয়ে দেশ ছাড়তে হয়েছিল। এর আগে বিভিন্ন অভিযোগ ঘিরে জিজ্ঞাসাবাদের সময় তাঁর ওপর চালানো হয় অমানুষিক নির্যাতন। তাঁকে বিদেশে দীর্ঘদিন চিকিৎসা নিতে হয়। কালক্রমে তিনি দলের নেতৃত্ব গ্রহণ এবং চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে দলীয় নেতাকর্মীর নিবিড় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করেন তিনি। গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তীকালে জাতীয় রাজনীতিতে তাঁর দায়িত্বপূর্ণ ভূমিকাও সবার নজর কেড়েছে। দলকে গতানুগতিক অভিযোগ থেকে মুক্ত রাখতেও সচেষ্ট দেখা যাচ্ছে তাঁকে।
তারেক রহমান যথাসময়ে দেশে ফিরে দল পরিচালনা করবেন, সেটাই স্বাভাবিক। তবে গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তীকালে কিছু ‘ষড়যন্ত্রতত্ত্ব’ সব সময় উড়ে বেড়াচ্ছে। তারেক রহমান ঘিরেও এটা রয়েছে। মামলাগুলোর নিষ্পত্তি তাঁর পক্ষে গেলেও মহলবিশেষ নাকি তাঁকে দেশে ফিরতে দিতে নারাজ। দলের ক’জন সিনিয়র নেতার মধ্যে নেতৃত্ব নিয়ে বিরোধের কথাও শোনা যায়। এ পরিস্থিতিতেই খালেদা জিয়া পুত্রবধূ জোবাইদা রহমানকে নিয়ে দেশে ফিরছেন। তিনিই নাকি দেশে থেকে আগামী নির্বাচন পর্যন্ত এক ধরনের নেতৃত্ব দেবেন বিএনপিকে।
জল্পনা-কল্পনা ঘিরে আলোচনা চালিয়ে যাওয়া কঠিন। আপাতত আমাদের অপেক্ষা করতে হবে খালেদা জিয়ার দেশে ফেরার জন্য। জানুয়ারির শুরুতে লন্ডন যাত্রার সময় দলের নেতাকর্মী, সমর্থকরা বিমানবন্দর পর্যন্ত তাঁকে যে সংবর্ধনা দিয়েছিলেন, সেটা সবার মনে আছে। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে কখনোই পরাস্ত হননি তিনি। গণতন্ত্রে উত্তরণে রাখা ভূমিকার জন্য তাঁকে ‘আপসহীন নেত্রী’ বলা হয়। সংযত রাজনৈতিক বক্তব্যের জন্যও তিনি প্রশংসা পেয়েছেন। গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী পরিস্থিতিতে তাঁকে অনুসরণ করেই তারেক রহমান দায়িত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে যাচ্ছেন বলে অনেকের অভিমত। মায়ের মতো আরেক জটিল সময়ে দল পরিচালনায় সফল হয়ে তারেকও নিশ্চয় আছেন দেশে ফেরার অপেক্ষায়।
সম্প্রতি একটি ভারতীয় সাময়িকী তারেক রহমানকে ‘বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী’ বলে প্রতিবেদন বের করেছে। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে মাঠে থাকা দলগুলোর মধ্যে বিএনপিই সবচেয়ে ভালো করবে– এমন ধারণা রয়েছে বৈ কি! তারেক রহমান দেশে ফিরলে সে সম্ভাবনা আরও বাড়বে। উল্লিখিত জল্পনা সত্য হলে অবশ্য ভিন্ন কথা। সে ক্ষেত্রে নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পরই তাঁকে ফিরতে হবে।
আমরা আশা করব, নিয়মতান্ত্রিকভাবেই সবকিছু এগোবে। রাজনীতিকে স্বাভাবিক ধারায় বইতে দিতে হবে। এক-এগারোর পরও রাজনীতিকে লাইনচ্যুত করার চেষ্টা চালানো হয়েছিল। সেটা কতখানি ব্যর্থ হয়, তা সবারই জানা। ব্যর্থ হয়েছে ‘মাইনাস টু’ ফর্মুলাও। মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার আশা করা যায়, নিয়মনীতি রক্ষা করেই পথ চলবে। দলের নেতৃত্ব কে দেবেন, তা নির্ধারণ
করবে দল। আর দেশের নেতৃত্ব কে দেবেন, সেটা নির্ধারণ করবে জনগণ। সে ক্ষেত্রে নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই।
গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তীকালে রাষ্ট্র সংস্কার অবশ্য এক বড় এজেন্ডা। তার বিরোধিতা কেউ করছে না। নির্ধারিত সময়ে এ-সংক্রান্ত কাজ সম্পন্ন করে নির্বাচনে যাওয়াই সরকারের কর্তব্য। এতে কে বা কারা ক্ষমতায় আসবেন– সে প্রশ্নটি গণতন্ত্রে মুখ্য নয়। আর তারেক রহমান দেশে ফিরলে গণতন্ত্রে উত্তরণ প্রক্রিয়াটি আরও জোরদার হবে বলে ধারণা। এ ঘটনা প্রবাহের দিকে তাই দৃষ্টি থাকবে সবার।
হাসান মামুন : সাংবাদিক, কলাম লেখক