ফরাসি উপকূলের কান শহর। নীল সমুদ্র আর আল্পস পর্বতের ছায়ায় গড়ে ওঠা এই ছবির মতো শহরটিই হয়ে ওঠে প্রতি বছর বিশ্ব চলচ্চিত্রের রাজধানী। ২০২৫ সালের ১৩ মে শুরু হয়েছে ৭৮তম কান চলচ্চিত্র উৎসব। শুরু থেকেই উৎসবে ছিল প্রতিদিন নতুন চমক, নতুন গল্প, আর তারার ঝলকানি।

এই উৎসব কেবল সিনেমার প্রদর্শনী নয়, এটি এক বিশাল সাংস্কৃতিক মিলনমেলা। যেখানে একই ফ্রেমে বন্দি হন হলিউডের সুপারস্টার, বলিউডের গ্ল্যামার আইকন, ইউরোপীয় সিনেমার দিকপাল, আর নতুন প্রজন্মের সাহসী নির্মাতারা। লালগালিচা হয়ে ওঠে শিল্প, ফ্যাশন আর রাজনীতির প্রতিচ্ছবি। চলুন ফিরে দেখা যাক গত আট দিনের আলোচিত মুহূর্তগুলো।

জাঁকজমকপূর্ণ সূচনা
১৩ মে উৎসবের সূচনা হয় ইতালীয় পরিচালক লুকা গুয়ার্দিনোর নতুন ছবি ‘Suspiria Reimagined’ দিয়ে, যেখানে অভিনয় করেছেন কেট ব্লানচেট ও জেমস ম্যাকঅ্যাভয়। উদ্বোধনী রাতেই লালগালিচা দাপিয়ে বেড়ান মেরিল স্ট্রিপ, লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিও, আর ফরাসি অভিনেত্রী লিয়া সিডু। উৎসবের প্রথম দিনেই পরিচালক ও বিচারকদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। এবারের প্রধান বিচারক হলেন প্রখ্যাত স্প্যানিশ নির্মাতা পেদ্রো আলমোদোভার, যিনি নারীকেন্দ্রিক গল্প বলার জন্য বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত।

লালগালিচায় বাংলাদেশি সিনেমার ঐতিহাসিক মুহূর্ত
২০২১ সালে কানের অফিসিয়াল সেকশন ‘আঁ সার্তে রিগা’-তে জায়গা করে নেয় আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ পরিচালিত ‘রেহানা মরিয়ম নূর’; যা ছিল বাংলাদেশের সিনেমার কানের মূল কাঠামোয় প্রথম প্রবেশ! তবে মূল প্রতিযোগিতা বিভাগে যেখানে স্বল্পদৈর্ঘ্য, পূর্ণদৈর্ঘ্য সব বিভাগের নির্ধারিত সংখ্যক সিনেমা আন্তর্জাতিক বিচারকের রায়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে– সেখানে প্রথমবার স্থান পেয়েছে বাংলাদেশি শর্টফিল্ম ‘আলী’। আদনান আল রাজীব পরিচালিত এটি কানের ৭৮তম আসরে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করছে। ‘আলী’ নিয়ে কানে যোগ দিয়েছেন নির্মাতা আদনান আল রাজীব, চিত্রগ্রাহক কামরুল হাসান খসরুসহ কয়েক সদস্যের দল। গেল শুক্রবার কানের লালগালিচায় হাঁটতে দেখা গেছে আদনান আল রাজীব ও কামরুল হাসান খসরুকে। লালগালিচায় তাদের হেঁটে যাওয়ার দৃশ্যটি ইতোমধ্যেই দেশীয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে গেছে।

জাহ্নবী-ইশানের ‘হোমবাউন্ড’ জাদু
কান ২০২৫-এ বলিউডের উপস্থিতি বরাবরের মতোই নজর কেড়েছে। ‘হোমবাউন্ড’ ছবির প্রিমিয়ারে জাহ্নবী কাপুর, ইশান খাট্টার এবং বিশাল জেঠওয়ার আবির্ভাব ছিল অনন্য। ছবিটি ‘আঁ সারতাঁ রেগার’ বিভাগে নির্বাচিত হয়েছে, আর এর নির্বাহী প্রযোজক ছিলেন স্বয়ং মার্টিন স্করসেসি। ভাইরাল হয়েছে এক মুহূর্ত– যেখানে ইশান খাট্টার সাবেক প্রেমিকা জাহ্নবীর গাউন ঠিক করে দিচ্ছেন লালগালিচায়। এই ভদ্রতা সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রশংসিত হয়েছে আন্তর্জাতিকভাবেও।

স্কারলেট জোহানসনের পরিচালনায় আবেগের ছোঁয়া 
এই বছর কান উৎসবে স্কারলেট জোহানসনের ‘Eleanor the Great’ সিনেমাটি ব্যাপক প্রশংসা কুড়িয়েছে। তাঁর পরিচালনায় এটি প্রথম ফিচার ফিল্ম, যেখানে ৯৪ বছর বয়সী জুন স্কুইবের পারফরম্যান্স দর্শকদের মুগ্ধ করেছে। ছবিটি প্রদর্শনের পর ৫ মিনিটের করতালি এবং আবেগঘন আলিঙ্গনের মধ্য দিয়ে উৎসবের এক আবেগপূর্ণ মুহূর্ত রচিত হয়। জোহানসন বলেছিলেন, “এটি বন্ধুত্ব, দুঃখ আর ক্ষমার গল্প– যা আমাদের সময়ের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় বার্তাগুলোর একটি।”

ডেনজেল ওয়াশিংটনের সম্মাননা ও বিতর্ক 
স্পাইক লি পরিচালিত ‘Highest 2 Lowest’ ছবির প্রিমিয়ারে অংশ নিতে এসে লালগালিচায় এক মুহূর্তে উত্তেজিত হয়ে ওঠেন ডেনজেল ওয়াশিংটন। এক ফটোগ্রাফারের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণে তিনি চিৎকার করে বলেন, “স্টপ!” তবে ছবির প্রদর্শনের পর তাঁকে দেওয়া হয় অনারারি পাম দ’অর, আর সেই সঙ্গে হয় তাঁর ক্যারিয়ারের স্মরণীয় সম্মাননা।

ফ্যাশনে বহুমাত্রিকতা 
কানের লালগালিচা মানেই বিশ্ব ফ্যাশনের প্রদর্শনী। এই বছর সেটি আরও বৈচিত্র্যময় হয়েছে। বলিউড থেকে জাহ্নবী কাপুরের নীল গাউন, ঐশ্বরিয়া রাইয়ের সাদা-সোনালি কাস্টম ড্রেস, হলিউড থেকে জেনিফার লরেন্সের মিনিমালিস্ট শৈলী,  কোরিয়ান অভিনেত্রী জিউন হো-র হ্যান্ড-পেইন্টেড কিমোনো–সব মিলিয়ে এটি ছিল ফ্যাশনের সেরা সপ্তাহ।

বিশ্ব সিনেমায় নতুন ধারা
এবারের উৎসবে আন্তর্জাতিকভাবে যেসব চলচ্চিত্র আলোড়ন তুলেছে, তার মধ্যে রয়েছে আফগান চলচ্চিত্র ‘The Other Side of Silence’, পোলিশ ছবি ‘Borderline’, আর ব্রাজিলের পরিবেশকেন্দ্রিক ডকু-ড্রামা ‘Amazonia Bleeds’। এসব ছবিতে উঠে এসেছে যুদ্ধ, রাজনৈতিক দমন, পরিবেশ বিপর্যয় আর আত্মপরিচয়ের সংকট– সব মিলিয়ে মানবিকতার বড় চিত্র।
আগামীর অপেক্ষা

আজ উৎসবের নবম দিন। আর মাত্র কয়েক দিন পরেই ঘোষণা হবে স্বর্ণপাম (Palme d'Or) বিজয়ীর নাম। বিচারকদের পছন্দের তালিকায় রয়েছে আফগান পরিচালক লায়লা হাশেমির ‘Dust Will Sing’, জোহানসনের ‘Eleanor the Great’, দক্ষিণ কোরিয়ার নতুন থ্রিলার ‘Echoes from Nowhere’।

কান শুধু চলচ্চিত্রের উৎসব নয়– এটি মানবিকতার, শিল্পের, সহানুভূতির এক উজ্জ্বল প্রকাশ। এই নবম দিনে দাঁড়িয়ে ফিরে তাকালে দেখা যায়, কত গল্প, কত আবেগ, কত ভিন্ন সংস্কৃতির সম্মিলন। বিশ্ব সিনেমা আজ যেন এক হয়ে উঠেছে ফ্রান্সের ছোট্ট এক শহরের সমুদ্রে তীরে– চলচ্চিত্রের মন্দিরে। আগামী দিনে কী অপেক্ষা করছে এই রঙিন উৎসবে? সেটা দেখার জন্য চোখ রাখতে হবে কানের পর্দা নামা পর্যন্ত। এ কথা নিশ্চিত– এ উৎসবের প্রতিটি দিনই ইতিহাস হয়ে থাকবে বিশ্ব চলচ্চিত্রের পাতায়।

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ক ন চলচ চ ত র উৎসব চলচ চ ত র র জ হ নসন উৎসব র ন র পর পর চ ল

এছাড়াও পড়ুন:

তুলশীগঙ্গার তীরে সন্ন্যাসতলীর শতবর্ষী ঘুড়ির মেলা

জয়পুরহাটের ক্ষেতলাল উপজেলার মামুদপুর ইউনিয়নের মহব্বতপুর গ্রাম ঘেঁষে তুলশীগঙ্গা নদীর অদূরে সন্ন্যাসতলীর বটতলা। জায়গাটিতে প্রায় একশ বছর আগে থেকে বাংলা জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষ শুক্রবার আয়োজন হয় ঘুড়ির মেলা। এবারও এর ব্যতিক্রম হয়নি। অন্তত ৫০ গ্রামের হাজারো মানুষের উপস্থিতিতে শুক্রবার সন্ন্যাসতলী ঘুড়ি উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছে। 

মেলার দিনক্ষণ মনে রেখে সময়মতো দোকানিদের পাশাপাশি দর্শনার্থীরা ভিড় জমান নিভৃত পল্লীতে। আগে মেলার দিন বৃষ্টি হওয়া যেন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু এবার ব্যতিক্রম ঘটনা ঘটেছে। প্রচণ্ড গরম ও তাপপ্রবাহের মধ্যেই চলে এ আয়োজন। বৈরী পরিবেশের কারণে উৎসবের স্বাভাবিক কর্মকাণ্ডে কিছুটা ব্যাঘাত ঘটেছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

স্থানীয় প্রবীণ বাসিন্দারা বলছেন, সন্ন্যাসতলীর এ ঘুড়ি উৎসব শুরুর দিন বিকেলে বটতলায় স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায় সন্ন্যাস পূজা পালন করেন। তাদের এ পূজা-অর্চনা ঘিরেই মূলত এ মেলার উৎপত্তি। তবে শুরুর কথা কেউ বলতে পারেননি। প্রবীণরা শুধু জানেন, একশ বছরের বেশি সময় ধরে তারা এ মেলার আয়োজন দেখে আসছেন।

মেলার নিজস্ব জায়গা না থাকলেও এর ব্যাপ্তি প্রায় দুই কিলোমিটার এলাকাজুড়ে। প্রচণ্ড গরমের মধ্যেই এক দিনের এ মেলা ঘিরেই জেলার জামালগঞ্জ চারমাথা থেকে ঐতিহাসিক আছরাঙ্গাদীঘি পর্যন্ত রকমারি পণ্যের দোকান বসে। এখান থেকে সংসারের প্রয়োজনীয় বিভিন্ন আসবাব থেকে শুরু করে ছোট মাছ ধরার বাঁশের তৈরি পণ্য খলসানি, টোপা, ডালা, চালুন কিনে নেন অনেকে।

সুতার তৈরি তৌরা জাল, গৃহস্থালি কাজে ব্যবহৃত দ্রব্যাদি, বিভিন্ন ধরনের খেলনা, মিষ্টান্ন, প্রসাধনী, মাটির তৈজসপত্রসহ বিভিন্ন সামগ্রী বিক্রি হয়। শিশুদের বিনোদনের জন্য ছিল নাগরদোলার ব্যবস্থাও। আর মেলার বড় আকর্ষণ ঘুড়ি ওড়ানো ও বিক্রি। পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন জেলা থেকে ব্যবসায়ীরা এসেছিলেন ঘুড়ি বিক্রি করতে।

প্রচণ্ড গরমের পাশাপাশি তেমন হাওয়া-বাতাস না থাকায় এবার ঘুড়ি ওড়ানোর প্রতিযোগিতা সেভাবে জমে ওঠেনি। তবে ঘুড়ি বেচাকেনা ও শিশু-কিশোরদের উচ্ছ্বাস ছিল চোখে পড়ার মতো। এ উপলক্ষে আসা হাজার হাজার দর্শনার্থীর নিরাপত্তার জন্য মেলায় সার্বক্ষণিক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের টহল ছিল।

আদমদীঘির শিববাটি গ্রামের ঘুড়ি ব্যবসায়ী সালাম হোসেনের ভাষ্য, সন্ন্যাসতলীর মেলা বড় হওয়ায় তিনি এসেছেন ঘুড়ি বিক্রির জন্য। মেলায় প্রত্যাশা অনুযায়ী ঘুড়ি বিক্রি করতে পেরে তিনি খুশি। জয়পুরহাটের পার্বতীপুর এলাকার ঘুড়ি ব্যবসায়ী মফিজ উদ্দিন ও মজনু সরদার বলেন, পূর্বপুরুষের আমল থেকে এ মেলার কথা শুনে আসছেন তারা।

মেলা উদযাপন ও পূজা কমিটির সদস্য মহব্বতপুর গ্রামের মন্টু মণ্ডল বলেন, মেলাটি হিন্দু সম্প্রদায়ের হলেও এটি আসলে সব ধর্মালম্বীর মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে। 

মামুদপুর ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান মিলন হোসেনের ভাষ্য, এক দিনের আয়োজনে যে এত লোকের সমাগম হতে পারে, তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। মেলায় যেন অনৈতিক কর্মকাণ্ড না হয়, সে ব্যাপারে ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

ক্ষেতলাল থানার ওসি মোহাম্মদ ফরিদ হোসেন বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে এবং মেলায় আসা দর্শনার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পুলিশ প্রশাসন সতর্ক আছে। মেলায় অনৈতিক আচরণ লক্ষ্য করা গেলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। 

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • বকুলতলায় বৃষ্টির সুর
  • কলকাতায় নতুন সিনেমার শুটিং শুরু করলেন জয়া
  • বর্ষা উৎসবে বন ও পরিবেশ ধ্বংসের প্রতিবাদ, পান্থকুঞ্জ পার্ক রক্ষাসহ কয়েকটি দাবি
  • নাচ-গান-আবৃত্তিতে চারুকলায় বর্ষাবরণ
  • মেঘ-রোদের লুকোচুরির সকালে নাচে-গানে বর্ষাবরণ 
  • মেঘ-রোদের লুকোচুরি সকালে নাচে-গানে বর্ষাবরণ 
  • আষাঢ়ের প্রথম দিন আজ
  • কলিজা ঠান্ডা করে দেওয়া ছবি ‘উৎসব’
  • তুলশীগঙ্গার তীরে সন্ন্যাসতলীর শতবর্ষী ঘুড়ির মেলা
  • ভালোবাসার ফ্রেমে মেহজাবীন-রাজীব, পেছনে আইফেল টাওয়ার