Samakal:
2025-07-11@18:15:33 GMT

বজ্রপাত

Published: 10th, July 2025 GMT

বজ্রপাত

শেষ কবে জিনাতপুরের লোকেরা কোনো বিষয়ে এমন হুড়মুড় করে একমত হয়েছিল, মনে পড়ে না পৃথিবীর, মনে পড়ে না আমাদেরও। প্রতিটি বিষয়ে শতধা বিভক্ত জিনাতপুরবাসীর হেকমত আলির শাস্তির দাবিতে একমত হওয়াটা তাই বিস্ময়কর এবং স্মরণীয় ঘটনা। যদিও শাস্তির ধরন নিয়ে তাদের মাঝে রয়েছে বিস্তর মতভেদ। কেউ বলছে হেকমত আলির গলায় জুতার মালা পরিয়ে গ্রামময় ঘোরানো হোক। কারও মতে, তাকে গ্রাম থেকে বের করে দেওয়া হোক। কেউ আবার পঞ্চাশ হাজার টাকা জরিমানার দাবি তুলছে এবং সেই টাকা জিনাতপুর শাহি মসজিদের উন্নয়ন খাতে ব্যয় করার প্রস্তাব দিচ্ছে। শাস্তির ধরন নিয়ে লোকেরা মতানৈক্য করলেও মূল শাস্তির বিষয়ে কারও কোনো মতভিন্নতা নেই। কারণ, জীবনের এই পড়ন্ত বেলায় এসে হেকমত আলি এমন এক গুরুতর অপরাধ করেছে, যার শাস্তি অনিবার্য।
প্রাইমারি স্কুলমাঠের প্রান্তে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা তালগাছের সাথে পিছমোড়া করে বাঁধা হয়েছে হেকমত আলিকে। তালগাছের ঠিক মাথার ওপর গনগনে সূর্য। হেকমত আলির খাটো ছায়া পায়ের কাছে নড়ছে। বাতাসে উড়ছে শিমুল তুলোর মতো ফুরফুরা শাদা দাড়ি। এত অপমান, এত গঞ্জনার পর সবাই ভেবেছিল হেকমত আলি ভেঙে পড়ব। কিন্তু সে ভেঙে পড়েনি। অন্যান্য সাধারণ দিনের মতোই স্বাভাবিক মানুষ সে। শুধু স্বাভাবিকই না, তার নির্লিপ্ত, নির্বিবাদী চেহারা বলছে, শুভ্র দাড়ির মতো তার মনটাও ফুরফুরা। কেবল প্রখর রৌদ্রতাপে মুখটা ঈষৎ তামাটে।
হেকমত আলির বিচার হবে বিকেলে। তার আগে সারাদিন তাকে বেঁধে রাখা হবে এখানে, একইভাবে। এটাও এক শাস্তি। শাস্তির আগে শাস্তি। বড়দের কেউ এখন স্কুলমাঠে নেই। তারা মাঠেঘাটে কাজেকর্মে ব্যস্ত। বিকেলের বিনোদনের জন্য আগেভাগে কাজ গুছিয়ে নিচ্ছে। বড়দের শূন্যস্থান পূরণ করছে শিশুরা। তারা হেকমত আলি নামে চমৎকার এক খেলনা পেয়েছে। ভোর থেকেই তাই স্কুলমাঠে শিশুদের হল্লা। পাশের গাঁ থেকে এক ফুচকার ভ্যানও চলে এসেছে সকাল সকাল। ভ্যানের কারণে শিশুদের আকর্ষণ দুইভাগে ভাগ হয়ে গেছে। হেকমত আলির দিকে এক ভাগ, ফুচকার ভ্যানের দিকে আরেক ভাগ। কেউ কেউ ফুচকা খাবে বলে বাড়িতে গিয়ে টাকার বায়না ধরছে। তাদের অধিকাংশই ব্যর্থ হচ্ছে। কারণ, সকাল বেলা সবাইকে পেট ভরে ভাত খাইয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। দুপুরে আবার তারা খাবে ভাত। এর মাঝে অন্য কিছু খাওয়ার বিলাসিত বারণ। 
হেকমত আলির ঘর্মাক্ত মুখ মায়ায় ফেলে দেয় ভিনগাঁয়ের ফুচকাওয়ালাকে। সে এক গ্লাস পানি হাতে এগিয়ে যায় হেকমত আলির দিকে। সঙ্গে সঙ্গে কোত্থেকে হাজির হয় এক প্রৌঢ়। ফুচকাওয়ালাকে চড় শাসিয়ে বলে, ওরে পানি খাওয়ানোর পারমিশন দিছে কিডা! তুই জানিস, কতবড় শয়তান সে! বুড়ো খাটাশ!
ভয় পেয়ে পিছিয়ে আসে ফুচকাওয়ালা। আসলেই সে জানে না হেকমত আলির বৃত্তান্ত। জমায়েত দেখে পাশের গাঁ থেকে ছুটে এসেছে ফুচকা নিয়ে। ব্যবসা বন্ধ হওয়ার শঙ্কায় সে পানির গ্লাসটা বাড়িয়ে ধরে প্রৌঢ়ের দিকে। হাসি হাসি মুখে বলে, পানিটা আপনে খান। ওই শয়তানকে আমি পানি দেব না। কক্ষনো না। বুড়ো খাটাশ!
তৃষ্ণা সত্ত্বেও বাধার মুখে পানি খাওয়া হয় না হেকমত আলির। সে বরং একটু পরপর ঘাড় বাঁকা করে বিশালদেহী তালগাছটার পাতাভরা মাথার দিকে তাকায়। তার ছানি পড়া চোখ দুটো কি সজল হয়ে ওঠে? হয়তো ওঠে। ওঠারই কথা। আজ হতে পঁয়তাল্লিশ বছর আগে, যখন তার প্রথম যৌবন, তালগাছটা সে যে নিজ হাতে লাগিয়েছিল এই মাটিতে। তখন আজকের এই বিল্ডিংওয়ালা স্কুলঘর ছিল কাচারি ঘরের মতো শীর্ণ। কে ভেবেছিল, নিজের হাতে লাগানো এই গাছটা একদা হয়ে উঠবে তার শাস্তি মঞ্চ! শুধু এই তালগাছই নয়, জিনাতপুরের পথে পথে, খালের পাড়ে, নদীর কূলে অন্তত চার হাজার তালগাছ আছে, সবগুলোর জন্ম হেকমত আলির হাতে। আহা, বছরের পর বছর কত যত্ন করে সে গাছগুলো লাগিয়েছে! অমন যত্ন নিজের সন্তান, নাতিপুতিদেরও করেছে বলে মনে পড়ে না। বিনিময়ে গাছগুলোও তাকে অকৃত্রিম ভালোবাসা দিয়েছে। যখনই সে তালের ছায়ায় দাঁড়িয়েছে, গাছগুলোর শান্ত হৃৎস্পন্দন সে অনুভব করেছে। গ্রীষ্ম-বর্ষা-শরতের কত সন্ধ্যা সে গাছগুলোর সাথে কথা বলে কাটিয়েছে! মাঝে কয়েকবার সাংবাদিক এসেছিল জিনাতপুরে। তালগাছের ভিডিও করার ফাঁকে হেকমত আলির দিকে তাক করেছিল বুম– কেন তার এই তালগাছ প্রেম?
সাংবাদিকদের কথার জবাব দিতে গিয়ে জিনাতপুরের শীর্ণ নদীর মতোই বেঁকেচুরে গিয়েছিল হেকমত আলির কণ্ঠ। সজল হয়েছিল চোখ। স্মৃতির ভারে নত হয়েছিল কাঁধ। তারপরও বলেছিল তাল রোপণের ইতিবৃত্ত। কৈশোরে বাপ হারিয়েছিল সে। যদিও বহু মানুষই কিশোরবেলায় বাপকে হারায়। কিন্তু হেকমত আলির বাপ হারানোর ঘটনা ছিল আলাদা। আকাশের আগুনে পুড়ে মরেছিল বাপ, হেকমত আলির চোখের সামনে। বাপের সঙ্গে ক্ষেতে পটোল তুলতে গিয়েছিল হেকমত আলি। তখন বৈশাখ মাস। খালের পানি শুকিয়ে গেছে। তীব্র রোদে ফেটে নকশা হয়েছে পায়ের তলার মাটি। এমনই এক তীব্র ঝাঁঝালো বিকেলে, বলা নেই কওয়া নেই, পশ্চিমাকাশে মেঘ। মায়ের চুলের মতো তার বরণ। মাঝে মাঝে মরা গাছের ডালপালার মতো আঁকাবাঁকা বিদ্যুচ্চমক ওই মেঘের দেয়ালকে খণ্ডবিখণ্ড করে দিচ্ছে। আসমানি আলোর অলৌকিক ঝলক যখন নৃত্য করে কিশোর হেকমত আলির সামনে, চমকে চমকে ওঠে সে। তবে আশার কথা– বজ্রপাতের শব্দ হচ্ছিল দূরে, চরপাড়ার ওইদিকে। বাপ নির্ভয় দিচ্ছিল– ভয় নাই ভয় নাই। এডা জিনাতপুরির ঠাডা না, এডা চরপাড়ার ঠাডা। 
হেকমত আলি পটোল তোলায় ক্ষান্ত দিয়ে ভয়ার্ত চোখে চারপাশ দেখছিল। একফোঁটা বাতাস নেই মাঠে। গাছের পাতারা নিশ্চুপ। দ্রুত ঘরে ফিরতে ডানা ঝাপটাচ্ছিল পাখিরা। হেকমত আলি দূর থেকেও টের পাচ্ছিল, পাখিদের চোখে ভয়। অজানা ঝড়ের ভয়। পাখিদের ঘরে ফেরা হয় না, তার আগেই শুরু হয় উথালপাথাল দমকা বাতাস। পাখিরা শুকনো পাতার মতো আকাশের রাস্তায় এলোমেলো উড়তে থাকে। দিকশূন্য হতবাক পাখিদের জন্য কোমল মায়া অনুভব করে হেকমত আলি। নিঃশ্বাস বন্ধ করে অদৃশ্য হাতে সে আপন ঠিকানার দিকে ঠেলতে থাকে পাখিদের। আকাশে পাখিদের এই এলোমেলো ওড়াউড়ির ভেতরই প্রকৃতিতে শুরু হয় ভিন্ন আয়োজন। সবুজ চকচকা পটোলে ঝুড়ি ভরে ওঠার আগেই চরপাড়া ভ্রমণ শেষে জিনাতপুরে ঢুকে পড়ে আসমানি আগুন। বুক কাঁপানো শব্দ ক্রমে নিকটতর হয়। তখন টনক নড়ে বাপের। যে কোনো মুহূর্তে বজ্রপাত শুরু হবে এখানে, এই জিনাতপুরের মাঠে। হেকমতকে সে দ্রুত বাড়ি চলে যেতে বলে। দিশাহীন হেকমত আধভরা পটোলের ঝুড়ি মাথায় নিয়ে বাতাসের স্রোত ঠেলে বাড়ির দিকে হাঁটা ধরে। হারেস কাকার কলার ভুঁইয়ে পা রাখতেই তীব্র এক আলোর ঝলকানি তার চোখ ধাঁধিয়ে যায়। আলোর বন্যাও যে কখনও কখনও ভীষণ অন্ধকার ডেকে আনে, এই দিনটি না এলে জানা হতো না হেকমতের। নিজের অজান্তেই দুই হাতের দুই শাহাদত আঙুল ঢুকে পড়ে দুই কানের গহ্বরে। আর তখন আপনা-আপনি মাথা থেকে পড়ে যায় পটোলের ঝুড়ি। হতবিহ্বল হেকমত এই তীব্র আলোয় বাপকে দেখতে ঘুরে দাঁড়ায় পটোলের ক্ষেতের দিকে। তীব্র শব্দের সাথে বাপকে সে আগুনের গোলক হয়ে উঠতে দেখে। তারপর মাংস পোড়া গন্ধ। পটোল তুলতে এসে বাপ জীবনের পটল তুলে বসে।
কিন্তু এই ঘটনার সাথে তালগাছ রোপণের কী সম্পর্ক? সংবেদহীন, পেশাদার কণ্ঠে প্রশ্ন করে সাংবাদিক।
সম্পর্ক আছে। নয়তো মিতভাষী হেকমত আলির এই গল্প বলার কথা না। চোখের সামনে বাপকে বজ্রপাতে পুড়তে দেখে বহু রাত ঘুমাতে পারেনি হেকমত। মরিচ মাখানো ভাত কিংবা আলু ভর্তার ভেতর থেকে ডুব দিয়ে বের হয়েছে মাংস পোড়া গন্ধ। আকাশে মেঘ জমলেই ভয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছে সে। বাপের অগ্নিদগ্ধ শরীর তার কোমল কৈশোরকে করে তুলেছে নরকতুল্য। একটু বড় হওয়ার পর সে যখন জানতে পারে, বজ্রপাত রোধে প্রকৃতির সবচেয়ে মজবুত প্রতিরোধ ব্যবস্থা হলো তালগাছ, সে অকাতরে তালগাছ লাগানো শুরু করে। মূলত তালগাছ রোপণ ছিল হেকমত আলির এক ধরনের জেদ, অসময়ে বাপকে হারানোর জেদ। তারপর দিনে দিনে গাছগুলোর প্রতি পিতৃস্নেহ জন্মে যায় হেকমতের। গাছগুলো এখন আর শুধু বজ্রপাত নিরোধক ছাতা নয়, গাছগুলো এখন হেকমতের সন্তান। 
সে নাহয় বোঝা গেল। কিন্তু আজ কেন হেকমতকে পিছমোড়া করে সন্তানতুল্য গাছের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে? কী তার অপরাধ? হেকমতের অপরাধ গুরুতর। সে মসজিদ ভেঙেছে। একে তো নিজে নামাজ-কালামের ধার ধারে না, তার ওপর সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর পবিত্র ইবাদতগাহে আঘাত হেনেছে। যে মসজিদের রয়েছে আবার বিশেষ ঐতিহ্যমূল্য। মৃত্যুদণ্ডও এই অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করতে পারে না। অন্তত উত্তেজিত জনতার মুখাবয়বে ফুটে ওঠা ক্রোধ সেই কথারই সাক্ষ্য দেয়।   
সকাল থেকে তালগাছের সাথে বাঁধা হেকমত। এখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চলেছে। বাদ আসর এই স্কুলমাঠেই তার বিচার হবে। হেকমত মসজিদ ভাঙতে বেরিয়েছিল তাহাজ্জুদের ওয়াক্তে, সবাই যখন ঘুমিয়ে। তারপরও তোরাব চোরা তাকে দেখে ফেলে এবং নালিশ ঠুকে দেয় মাতব্বরদের কাছে। তোরাব চোর হতে পারে, তাই বলে সে বেইমান না। আজ তার পেশা চুরি বলেই এতবড় অধর্ম সে ধরতে পেরেছে। এই নিয়ে তোরাব চোরার গর্বের শেষ নেই। সেই আনন্দে সে জিনাতপুরের শাহি মসজিদের বারান্দায় দুই রাকাত নফল নামাজ পড়ে। মসজিদটির এমনই ঐতিহ্য, এর নামে প্রচলিত আছে নানা মিথ ও জনশ্রুতি। কয়েকশ বছর আগে একদল জিন নাকি এক রাতে তৈরি করেছিল এই মসজিদ। এবং এ কারণেই মসজিদটির প্রতি জনসাধারণের তীব্র আবেগ, ভালোবাসা ও শ্রদ্ধামিশ্রিত ভীতি রয়েছে। এই আবেগ, ভালোবাসা ও শ্রদ্ধামিশ্রিত ভীতির কারণে মসজিদটি দিনে দিনে হয়ে উঠেছে এক দর্গা, মনোবাসনা পূরণের জন্য লোকেরা এখানে সকাল-সন্ধ্যা মানত দেয়। সন্তান লাভের বাসনায় কিংবা রোগমুক্তির আকাঙ্ক্ষায় মসজিদের গ্রিলে বাঁধে সুতা। কেউ কেউ ছাগল জবাই করে বিতরণ করে মাংস। কী কুক্ষণে যে বেছে বেছে এই মসজিদটাই ভাঙতে গিয়েছিল হেকমত আলি, কে জানে? মানুষের ভয় তাকে প্রতীজ্ঞা থেকে টলাতে করতে পারেনি, এমনকি মসজিদটির নির্মাতা অদৃশ্য জিনদের ভয়ও তাকে নিরত করেনি। মূলত চক্ষুকর্ণহীন গোঁয়ার এক জেদ চেপে বসেছিল হেকমতের মনে, কৈশোরে যে জেদের বশবর্তী হয়ে হাজার হাজার তালগাছ লাগানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সে। উত্তরপাড়ার সবচেয়ে পুরোনো তালগাছটা যেদিন একদল মুসল্লি হল্লা করতে করতে কেটে দেয়, সেদিন থেকেই ভাতের বলক ওঠার মতো গোঁয়ার জেদ ও ক্রোধ বুকের ভেতর সঞ্চিত হচ্ছিল তার। পুঞ্জীভূত সেই ক্রোধের উদ্‌গিরণ ঘটেছে গেল রাতে, শাহি মসজিদের পাঁজরে শাবল হানার মাধ্যমে।
বিকেলে শুরু হয় সালিশ। এই মুহূর্তটির জন্যই হেকমত আলিকে দিনভর স্কুলমাঠে বেঁধে রাখা হয়েছে। এতক্ষণ ছেলেপুলে তাকে উত্ত্যক্ত করছিল। বিকেল হতেই ছেলের বাপেরা হাজির হয় স্কুলমাঠে। উপস্থিত হয় জিনাতপুরের মাতব্বরবর্গ ও মুসল্লিবৃন্দ। যেহেতু ঘটনার সাথে মসজিদ জড়িত তাই এই সালিশে মুসল্লিদের অধিকার বেশি। অল্পক্ষণে শত শত মানুষের ভিড়ে অন্যরকম এক উৎসব রচিত হয় মাঠটিতে। কিন্তু হেকমত আলি তখনও নির্বিকার, ভাবলেশহীন, নির্বাক। একটু পরপর, আগের মতোই সে, তালগাছটার মাথার দিকে তাকায়। এই গাছের মাঝে কি সে খুঁজে ফিরছে সেই গাছ, ক’দিন আগে মুসল্লিরা যে গাছটি উল্লাস করতে করতে কেটে দিয়েছিল? হেকমত আলির চোখ অশ্রুসজল হয়। নিহত সেই গাছটির জন্য বুকের ভেতর কেমন করে। সেই গাছটির নিহত হওয়ার পেছনে রয়েছে এক গল্প। সেই গল্প না জানলে হেকমত আলির আজকের গল্প বোঝা যাবে না। মূলত জিনাতপুর এমন এক গ্রাম, আজগুবি সব কারবার ঘটানোর জন্য এই গ্রামকেই বেছে নেয় প্রকৃতি। তাই তো এক সকালে তারা আবিষ্কার করে, উত্তরপাড়ার সবচেয়ে লম্বা তালগাছের মাথায় অদ্ভুত এক ফুল, তালের দুই শাখার ভেতর থেকে বেরিয়েছে ফুলটি। বেগুনি রঙের এমন ফুল কেউ কোনোদিন দেখেনি, গল্পও শোনেনি। লোকেরা বলতে থাকে, কী এক কলিকাল আইলো, তালগাছও ফুল দেয়। ক্রমে ক্রমে সাত গাঁয়ে ছড়িয়ে পড়ে তালফুলের খবর। তালফুল দেখতে মানুষের ঢল নামে জিনাতপুরে। আর এটা তো জানা কথা– যেখানে মানুষ সেখানে ব্যবসা। মানুষ ব্যবসার প্রধান উপাদান। তাই তো তালতলায় বসে যায় হরেক রকম খাবার ও মনোহারী দোকান। নবদম্পতি তালফুল দেখতে এসে খেয়ে যায় ফুচকা-চটপটি। বাচ্চারা খেলনা কেনার বায়নায় বাবার হাত ধরে ঝোলে। স্কুলের মেয়েরা কেনে চুলের ক্লিপ, ঠোঁটের লিপস্টিক। এ যেন রীতিমতো এক তালতলার মেলা। দিনে দিনে যখন ফুলের আকর্ষণ কমে যেতে থাকে এবং এর ফলে মেলার মহিমা ম্লান হতে থাকে, তখন শুরু হয় প্রকৃতির নতুন খেলা। লোকেরা, বিশেষ করে মহিলারা, নানারকম ইচ্ছা পূরণের ইচ্ছায় অলৌকিক ফুলওয়ালা তালগাছের গোড়ায় মানত দিতে শুরু করে। মোরগ-মুরগি-ছাগল জবাই হতে থাকে তালতলায়। পূর্ণিমা রাতে বন্ধ্যা নারীরা তালতলার মাটি পরম বিশ্বাসে পেটে মাখে। কেউবা তালগাছের সঙ্গে কপাল ঠেকিয়ে রোগমুক্তি চায়। মানতকে ঘিরে আবার জমে ওঠে বাজার। আবার শুরু হয় কেনাবেচা। কিন্তু জিনাতপুরের এই আনন্দ বেশিদিন স্থায়ী হয় না। এক সকালে জিনাতপুরের মুসল্লিরা শিরকের অভিযোগ তুলে তালগাছটি কাটতে আসে। সন্তান রক্ষার সাহস নিয়ে হেকমত আলি তালগাছের সামনে দু’হাত প্রসারিত করে দাঁড়ায়। কিন্তু ক্ষিপ্ত জনতা তার শীর্ণ বাহুর দেয়াল পাটকাঠির বেড়ার মতো পটপট করে ভেঙে দেয়। ফলে দুপুরের আগেই, সন্তানসম তালগাছটি চোখের সামনে টুকরো টুকরো হয়ে লুটিয়ে পড়তে দেখে বাকরুদ্ধ হেকমত আলি। 
তাই বলে তালগাছ কাটার প্রতিশোধ নিতে তুমি মসজিদ ভাঙবা? তুমার খুদার ভয় নি? হেকমত আলির দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দেয় জিনাতপুরের মেম্বর। 
 বাঁধন খুলে হেকমত আলিকে এখন সভার মাঝখানে দাঁড় করানো হয়েছে। মেম্বারের প্রশ্নের প্রেক্ষিতে হেকমত আলির ঠোঁট নড়ে ওঠে। সে কিছু বলতে চায়। 
কথা বলো! পাশ থেকে চিৎকার করে ওঠে আরেক মাতব্বর। 
হেকমত আলি বিড়বিড় করে বলে, পোতিশোধ না, শেরেক দূর।
জোরে বলো। তুমার গলায় কি জোর নি! 
শেরেক দূর করার জন্নি আমি মসজিদ ভাঙতি গিছিলাম। হেকমত আলি চিৎকার করে ওঠে।
জনতা এবার হা হয়ে যায় বিস্ময়ে। শিরক দূর করতে মসজিদ ভাঙা– এমন আচানক কথা তারা আগে কখনও শোনেনি। হেকমত আলি বলতেই থাকে, মান্নত দিয়া যদি শেরেক হয় এবং সেই শেরেক দূর করার জন্নি যদি তালগাছ কাটা হয়, তাহলি শাহি মসজিদ কেন ভাঙা হবি না! ওই মসজিদিও তো মান্নত দিয়া হয়। ওই মসজিদও তো শেরেকের কারখানা। এই জন্নিই আমি মসজিদ ভাঙতি গিসলাম। 
হেকমত আলির কথায় বজ্রপাত হয় মজলিশে। এক মুহূর্তে নির্বাক হয়ে যায় তারা। বহু বছর আগে, পটোলের ক্ষেতে, বজ্রপাত যেভাবে হেকমতের বাপকে স্তব্ধ করেছিল, আজ, হেকমত আলির কথা, একই রকম স্তব্ধ করে উপস্থিত জনতাকে। v

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: গল প মসজ দ ভ ঙ মসজ দ র হ কমত র র স মন আল র ব র জন য র ভ তর প রক ত ত লতল ই মসজ ব যবস অপর ধ

এছাড়াও পড়ুন:

ব্যবসায়ীকে ইট-পাথর মেরে হত্যা: যুবদলের ২ নেতাকে আজীবন বহিষ্কার

পুরান ঢাকায় ভাঙাড়ি ব্যবসায়ী লাল চাঁদ ওরফে সোহাগ (৪৩) হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় যুবদলের দুই নেতাকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হয়েছে।

তারা হলেন- যুবদলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সাবেক সহ-জলবায়ু বিষয়ক সম্পাদক রজ্জব আলী পিন্টু ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক সাবাহ করিম লাকি। তাদের বিরুদ্ধে সোহাগের পরিবারের পক্ষ থেকে মামলা করা হয়েছে।

শুক্রবার রাতে যুবদলের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-দপ্তর সম্পাদক মিনহাজুল ইসলাম ভূইয়ার সই করা গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, গত ৯ জুলাই রাজধানীর মিটফোর্ড হাসপাতালের মূল ফটকে সোহাগ নামে এক ব্যবসায়ী যুবককে প্রকাশ্যে দিবালোকে কুপিয়ে ও পিটিয়ে নৃশংসভাবে হত্যার ঘটনায় তার পরিবারের পক্ষে থেকে মামলা করা হয়। আসামিরা হলেন- যুবদলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সাবেক সহ-জলবায়ু বিষয়ক সম্পদাক রজ্জব আলী পন্টু ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক সাবাহ করিম লাকি। তাদের প্রাথমিক সদস্য পদসহ দল থেকে আজীবন জন্য বহিষ্কার করা হয়েছে। যুবদলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সভাপতি আবদুল মোনায়েন মুন্না ও সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ নূরুল ইসলাম নয়ন ইতোমধ্যে এ সিদ্ধান্ত কার্যকর করেছেন। 

এতে আরও বলা হয়েছে, বহিষ্কৃত নেতাদের কোনো ধরনের অপকর্মের দায়-দায়িত্ব দল নেবে না। যুবদলের সব পর্যায়ের নেতাকর্মীদের তাদের সঙ্গে সাংগঠনিক সম্পর্ক না রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ওই বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কোনোরূপ শৈথিল্য না দেখিয়ে প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থা নেয়ার উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছে যুবদল।

এদিকে এ ঘটনায় অভিযুক্তদের আজীবনের জন্য বিএনপি বহিষ্কার করেছে জানিয়ে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ।

এদিকে ভাঙাড়ি ব্যবসায়ীকে ইট-পাথর দিয়ে আঘাত করে নির্মমভাবে হত্যার ঘটনায় পৃথক দুই মামলায় দুইজনকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার অনুমতি দিয়েছেন আদালত। এর মধ্যে গ্রেপ্তার মাহমুদুল হাসান মহিনের ৫ দিন ও তারেক রহমান রবিনের ২ দিন রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়।

গত বুধবার সন্ধ্যা ৬টার দিকে মিটফোর্ড হাসপাতালের ৩ নম্বর গেট সংলগ্ন রজনী ঘোষ লেনে এই মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে।

নিহত মো. সোহাগ কেরানীগঞ্জ মডেল থানার পূর্ব নামাবাড়ি গ্রামের ইউসুফ আলী হাওলাদারের ছেলে। তিনি দীর্ঘদিন ধরে মিটফোর্ড এলাকার ৪ নম্বর রজনী ঘোষ লেনে ভাঙাড়ির ব্যবসা করতেন। ঘটনার পর পুলিশ মাহমুদুল হাসান মহিন ও তারেক রহমান রবিনকে আটক করে। পরে কোতোয়ালি থানায় একটি হত্যা ও একটি অস্ত্র মামলা দায়ের হয়।

সম্পর্কিত নিবন্ধ