প্রজনন স্বাস্থ্যসেবায় বিনিয়োগের এখনই সময়
Published: 11th, July 2025 GMT
প্রতি বছরের মতো এবারেও বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশে ও পালিত হচ্ছে বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস। এবারের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে–‘ন্যায্য ও সম্ভাবনাময় বিশ্বে পছন্দের পরিবার গড়তে প্রয়োজন তারুণ্যের ক্ষমতায়ন’। এই প্রতিপাদ্য বিষয় আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছে তরুণ ও নারীদের প্রজনন স্বাস্থ্যসেবায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও অভিগম্যতা এই সময়ের জরুরি দাবি।
বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর এক-তৃতীয়াংশই হচ্ছে তরুণ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০২২ সালের তথ্য অনুসারে: দেশের মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ৪.
ফলে উপযুক্ত তথ্য ও জ্ঞান না থাকার কারণে বেশির ভাগ তরুণরাই যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কে প্রয়োজনীয় ও বৈজ্ঞানিক তথ্য জানে না। অথচ কৈশোরকালীন সময় থেকেই তারা একটা শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায়। মাসিক ব্যবস্থাপনা, স্বপ্নদোষ, যৌনতা এসব বিষয় তাদের এই পরিবর্তিত জীরনের অপরিহার্য অংশ। বিশেষ করে কিশোরীরা মাসিক সম্পর্কে সঠিক তথ্য ও পরিচ্ছন্নতা ব্যবস্থার অভাবে সংক্রমণ, অপুষ্টি এবং আত্মবিশ্বাসের অভাবে ভোগে। অপরদিকে, কিশোর ছেলেরা যৌন স্বাস্থ্য সম্পর্কে ভুল তথ্য পায় বা একে উপেক্ষা করে, যার ফলে ভবিষ্যতে ঝুঁকিপূর্ণ আচরণে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকে।
আমরা মানতে না চাইলেও এটা প্রমাণিত অনেক ক্ষেত্রেই এ দেশের কিশোর কিশোরী, তরুণ-তরুণীরা যৌন জীবনে জড়িয়ে পড়ে। কিন্তু সামাজিকভাবে অবিবাহিত তরুণ-তরুণীদের পরিবার পরিকল্পনা বা যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা নেওয়া এখনও নেতিবাচকভাবে দেখা হয়। ফলে তারা গোপনে অথবা ঝুঁকিপূর্ণ পদ্ধতির দিকে ঝুঁকে পড়ে। কখনও কখনও মেয়েদের অনিরাপদ গর্ভপাতের ঝুঁকি নিতে হয় যা মৃত্যুর ঝুঁকিও ডেকে আনে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে বাল্যবিয়ে এখনও আমাদের দেশের বড় এক সমস্যা। অনেক প্রচেষ্টা থাকা সত্ত্বেও আমরা বাল্যবিয়েকে এখনও পর্যন্ত কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে কমিয়ে আনতে পারিনি। ফলে অনেক কিশোরী অপ্রাপ্ত বয়সে গর্ভধারণ করে, যা তাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে। বাল্যবিয়ে কেবল স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়িয়ে দেয় না, পাশাপাশি তারা পারিবারিক নির্যাতন ও সহিংসতার শিকার হয়।
দুঃখের সঙ্গে বলতে হয় যথেষ্ট আইন ও নীতিমালা থাকা সত্ত্বেও আমরা কৈশোর ও তরুণ জনগোষ্ঠীর চাহিদা মোতাবেক শিক্ষা, স্বাস্থ্যও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারিনি। স্বাস্থ্যসেবা প্রসঙ্গে আমাদের অভিজ্ঞতা বলে স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোর বেশির ভাগই এখনও কৈশোর ও তরুণবান্ধব নয়। তরুণরা সেখানে গেলে হেয় করে দেখা হয়, নয় তো উপযুক্ত পরামর্শ পায় না। এ কারণে তারা অনেক সময় সেবা গ্রহণ থেকে বিরত থাকে।
অধিকন্তু বাংলাদেশ কেবল শহর এবং গ্রাম এই দু’ভাবে দেখলে সবার কাছে সেবা পৌঁছানোর প্রতিশ্রুতি কাগজ-কলমে রয়ে যাবে। কেননা ভৌগোলিক বৈচিত্র্য, জাতি, গোষ্ঠী, শ্রেণি, বয়স, লিঙ্গ বিশেষে চাহিদা ভিন্ন থাকবে– এটাই স্বাভাবিক। সমতলের তরুণ-তরুণী বা নারীদের স্বাস্থ্যসেবা চাহিদা প্রদানের কৌশল অথবা পাহাড়ি এলাকার কর্মসূচি বাস্তবায়নের কৌশল কখনই এক হবে না। কারণ আর্থিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট ভিন্ন। বাংলাদেশের গ্রামীণ ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের কিশোর-কিশোরীরা আজও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে নানা ধরনের বৈষম্যের সম্মুখীন হচ্ছে। এই বৈষম্য কেবল স্বাস্থ্যসেবার সীমিত প্রাপ্যতা নয়, বরং সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং কাঠামোগত প্রতিবন্ধকতার এক জটিল চক্রের অংশ। অধিকন্তু প্রায় এক বছর মাঠ পর্যায়ে গর্ভনিরোধক, নিরাপদ মাসিক নিয়মিতকরণের সামগ্রী না থাকার ফলে গ্রামীণ এবং প্রত্যন্ত এলাকার নারীরা সীমাহীন স্বাস্থ্যঝুঁকির সম্মুখীন। এই সমস্যা সমাধান অত্যন্ত জরুরি।
১৯৯৪ সালে কায়রোতে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক জনসংখ্যা ও উন্নয়ন সম্মেলন একটি যুগান্তকারী মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত। এই সম্মেলনে বিশ্ব নেতৃবৃন্দ প্রথমবারের মতো স্বীকার করেন যে, জনসংখ্যা ও উন্নয়ন বিষয়ে টেকসই অগ্রগতির জন্য ব্যক্তির প্রজনন স্বাস্থ্য ও অধিকার নিশ্চিত করা অত্যাবশ্যক। আইসিডিপি কর্মপরিকল্পনার অন্যতম প্রধান প্রতিশ্রুতি ছিল ‘সর্বজনীন প্রজনন স্বাস্থ্যসেবায় প্রবেশাধিকার’ নিশ্চিত করা, বিশেষ করে যুব জনগোষ্ঠী, কিশোর-কিশোরী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য।
এই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের জন্য আমাদের জরুরিভিত্তিতে তরুণদের জন্য বয়সোপযোগী তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যশিক্ষা নিশ্চিত করা দরকার। স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে নারী ও কিশোরীদের জন্য পৃথক এবং নিরাপদ সেবা ব্যবস্থা গড়ে তোলা প্রয়োজন। জীবনঘনিষ্ঠ শিক্ষা পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে। বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে সামাজিক সচেতনতা ও আইন প্রয়োগ জোরদার করতে হবে। যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা বিষয়ে অভিভাবক ও শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে যেন তারা তরুণদের পাশে দাঁড়াতে পারে। দুর্গম অঞ্চলে মোবাইল ক্লিনিক, রোভিং টিম ও ডিজিটাল সেবা জোরদার করা জরুরি। বাজেট ও কর্মপরিকল্পনায় নারী ও যুব অধিকারকে অগ্রাধিকার দেওয়া। প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা যেন তথ্য ও খরচজনিত কারণে কারও জন্য অপ্রাপ্য না হয়।
পরিশেষে বলা যায়, তরুণ ও নারীর প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা শুধু একটি স্বাস্থ্যগত বিষয় নয়। এটি মানবাধিকার, লিঙ্গ সমতা এবং টেকসই উন্নয়নের ভিত্তি। আন্তর্জাতিক জনসংখ্যা দিবস ২০২৫ আমাদের সুযোগ করে দিচ্ছে এই বার্তা নতুন করে ছড়িয়ে দেওয়ার। আজকের বিনিয়োগই আগামীর সুস্থ, দক্ষ ও সমতাভিত্তিক সমাজ গঠনের মূল ভিত্তি।
মনজুন নাহার: প্রধান, ফান্ড রাইজিং ও পার্টনারশিপ, মেরী স্টোপস বাংলাদেশ
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: জনস খ য প রজনন স ব স থ য য ন ও প রজনন স ব স থ য ন শ চ ত কর জনগ ষ ঠ র জনস খ য র জন য আম দ র
এছাড়াও পড়ুন:
ইরানের কাছে এখনও অস্ত্র তৈরির উপযোগী ইউরেনিয়াম আছে, দাবি ইসরায়েলের
ইরানে যুক্তরাষ্ট্রের বাঙ্কার বিধ্বংসী বোমা হামলার পরও তেহরানের কাছে কিছু সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম রয়ে গেছে বলে মনে করে ইসরায়েল। তেল আবিবের আশঙ্কা, এসব ইউরেনিয়াম পরমাণু অস্ত্র তৈরিতে ব্যবহৃত হতে পারে।
গতকাল বৃহস্পতিবার ইসরায়েলের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার বরাত দিয়ে দ্য নিউইয়র্ক টাইমস এ খবর জানায়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্যরা শুরু থেকেই দাবি করে আসছেন, যুক্তরাষ্ট্রের হামলায় ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনাই ‘পুরোপুরি ধ্বংস’ হয়ে গেছে। গত ২২ জুন ৩০ হাজার পাউন্ড ওজনের বিশেষ বাঙ্কার বিধ্বংসী বোমার মাধ্যমে ইরানে এ হামলা চালানো হয়।
গত সপ্তাহে মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তরের মুখপাত্র শন পারনেল সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে অন্তত এক থেকে দুই বছর পেছনে ঠেলে দিয়েছি। অন্তত প্রতিরক্ষা দপ্তরের গোয়েন্দা বিভাগের পর্যালোচনায় এমনটাই মনে করা হচ্ছে। যদিও শন পারনেল তাঁর এ দাবি প্রমাণে কোনো তথ্য উপস্থাপন করেননি। পারনেল বলেন, গোয়েন্দা বিশ্লেষকদের হিসাব অনুযায়ী, আসল সময়টা সম্ভবত দুই বছরের কাছাকাছি।
ইসরায়েলের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, ইরানের পারমাণবিক কেন্দ্রে থাকা ১৮ হাজার সেন্ট্রিফিউজের বেশির ভাগই ধ্বংস হয়ে গেছে। তবে ৬০ শতাংশ মাত্রায় সমৃদ্ধ সব ইউরেনিয়াম নষ্ট হয়নি। কিছু ইউরেনিয়াম বিশেষ পাত্রে আলাদা করে সংরক্ষণ করা ছিল, যা এখনও ইরানি বিজ্ঞানীরা ব্যবহার করতে পারেন। তবে ওই ইসরায়েলি কর্মকর্তা হুঁশিয়ার করে বলেন, কেউ যদি সে ইউরেনিয়াম সংগ্রহের চেষ্টা করে, তবে ইসরায়েল তা ধরে ফেলবে এবং আবার হামলা চালাবে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই কর্মকর্তা বলেন, ইসরায়েলের বিশ্বাস, ১০ মাস আগে হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরাল্লাহ নিহত হওয়ার পর ইরান যে জোরেশোরে পরমাণু বোমা বানানোর চেষ্টা চালাচ্ছে, তার যথেষ্ট প্রমাণ ইসরায়েলের হাতে আছে। নাসরাল্লাহ ছিলেন ইরানের গুরুত্বপূর্ণ মিত্র।
তবে আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার (আইএইএ) মহাসচিব রাফায়েল গ্রোসি বলেন, হামলার আগেই ইরান তাদের অনেক ইউরেনিয়াম মজুত সরিয়ে ফেলেছিল। তবে ইসরায়েলের ওই কর্মকর্তা বলেন, এটা সম্ভব নয়। কারণ, এমনটা করা খুবই কঠিন।
ইরানের পরমাণু সমৃদ্ধকরণের উদ্দেশ্য নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রেই ভিন্ন ভিন্ন মত দেখা গেছে। দেশটির গোয়েন্দা প্রধান তুলসী গ্যাবার্ড বলেছিলেন, ইরান কোনো পরমাণু বোমা বানাচ্ছে না। কিন্তু ইসরায়েল বারবার দাবি করে ইরান বোমা বানানোর কাছাকাছি রয়েছে। গত তিন দশকে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু একাধিকবার ইরানের বিরুদ্ধে এ দাবি করেন। তাঁর বিরুদ্ধে ইরানের সঙ্গে যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রকে টেনে আনার অভিযোগ রয়েছে।
গত ১৩ জুন থেকে ইরানের ওপর হামলা শুরু করে ইসরায়েল। ইরানের সামরিক ঘাঁটি ও পারমাণবিক স্থাপনাগুলোকে লক্ষ্য করে একের পর এক হামলা চালায় তারা। জবাবে ইসরায়েলের হাইফা, তেল আবিবসহ বিভিন্ন বড় শহরের দিকে ইরান টানা ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে। এগুলোর কিছু কিছু স্পর্শকাতর এলাকায় আঘাত হানে।