প্রতি বছরের মতো এবারেও বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশে ও পালিত হচ্ছে বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস। এবারের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে–‘ন্যায্য ও সম্ভাবনাময় বিশ্বে পছন্দের পরিবার গড়তে প্রয়োজন তারুণ্যের ক্ষমতায়ন’। এই প্রতিপাদ্য বিষয় আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছে তরুণ ও নারীদের প্রজনন স্বাস্থ্যসেবায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও অভিগম্যতা এই সময়ের জরুরি দাবি। 

বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর এক-তৃতীয়াংশই হচ্ছে তরুণ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০২২ সালের তথ্য অনুসারে: দেশের মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ৪.

৯ কোটি তরুণ। ২৯ বছরের কম বয়সীদের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫৭ শতাংশ। এই বিশাল তরুণ জনগোষ্ঠী আমাদের উন্নয়নের মূল চালিকাশক্তি। কিন্তু এই তরুণ জনগোষ্ঠী যদি প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা, বিশেষ করে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবায় অভিগম্যতা না থাকে তাহলে তার নীতিবাচক প্রভাব পড়বে স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান এবং দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের ওপর। অথচ বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে প্রজনন স্বাস্থ্য নিয়ে আলাপ-আলোচনা এখনও ট্যাবু। বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এখনও যৌন প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয নিয়ে যে অধ্যায় আছে তা পড়ানো হয় না অথবা দায়সারাভাবে আলোচনাগুলো করা হয় বা কার্যকরভাবে শেখানো হয় না।

ফলে উপযুক্ত তথ্য ও জ্ঞান না থাকার কারণে বেশির ভাগ তরুণরাই যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কে প্রয়োজনীয় ও বৈজ্ঞানিক তথ্য জানে না। অথচ কৈশোরকালীন সময় থেকেই তারা একটা শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায়। মাসিক ব্যবস্থাপনা, স্বপ্নদোষ, যৌনতা এসব বিষয় তাদের এই পরিবর্তিত জীরনের অপরিহার্য অংশ। বিশেষ করে কিশোরীরা মাসিক সম্পর্কে সঠিক তথ্য ও পরিচ্ছন্নতা ব্যবস্থার অভাবে সংক্রমণ, অপুষ্টি এবং আত্মবিশ্বাসের অভাবে ভোগে। অপরদিকে, কিশোর ছেলেরা যৌন স্বাস্থ্য সম্পর্কে ভুল তথ্য পায় বা একে উপেক্ষা করে, যার ফলে ভবিষ্যতে ঝুঁকিপূর্ণ আচরণে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকে।

আমরা মানতে না চাইলেও এটা প্রমাণিত অনেক ক্ষেত্রেই এ দেশের কিশোর কিশোরী, তরুণ-তরুণীরা যৌন জীবনে জড়িয়ে পড়ে। কিন্তু সামাজিকভাবে অবিবাহিত তরুণ-তরুণীদের পরিবার পরিকল্পনা  বা যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা নেওয়া এখনও নেতিবাচকভাবে দেখা হয়। ফলে তারা গোপনে অথবা ঝুঁকিপূর্ণ পদ্ধতির দিকে ঝুঁকে পড়ে। কখনও কখনও মেয়েদের অনিরাপদ গর্ভপাতের ঝুঁকি নিতে হয় যা মৃত্যুর ঝুঁকিও ডেকে আনে। 

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে বাল্যবিয়ে এখনও আমাদের দেশের বড় এক সমস্যা। অনেক প্রচেষ্টা থাকা সত্ত্বেও আমরা বাল্যবিয়েকে এখনও পর্যন্ত কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে কমিয়ে আনতে পারিনি। ফলে অনেক কিশোরী অপ্রাপ্ত বয়সে গর্ভধারণ করে, যা তাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে। বাল্যবিয়ে কেবল স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়িয়ে দেয় না,  পাশাপাশি তারা পারিবারিক নির্যাতন ও সহিংসতার শিকার হয়।

দুঃখের সঙ্গে বলতে হয় যথেষ্ট আইন ও নীতিমালা থাকা সত্ত্বেও আমরা কৈশোর ও তরুণ জনগোষ্ঠীর চাহিদা মোতাবেক শিক্ষা, স্বাস্থ্যও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারিনি। স্বাস্থ্যসেবা প্রসঙ্গে আমাদের অভিজ্ঞতা বলে স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোর বেশির ভাগই এখনও কৈশোর ও তরুণবান্ধব নয়। তরুণরা সেখানে গেলে হেয় করে দেখা হয়, নয় তো উপযুক্ত পরামর্শ পায় না। এ কারণে তারা অনেক সময় সেবা গ্রহণ থেকে বিরত থাকে। 

অধিকন্তু বাংলাদেশ কেবল শহর এবং গ্রাম এই দু’ভাবে দেখলে সবার কাছে সেবা পৌঁছানোর প্রতিশ্রুতি কাগজ-কলমে রয়ে যাবে। কেননা ভৌগোলিক বৈচিত্র্য, জাতি, গোষ্ঠী, শ্রেণি, বয়স, লিঙ্গ বিশেষে চাহিদা ভিন্ন থাকবে– এটাই স্বাভাবিক। সমতলের তরুণ-তরুণী বা নারীদের স্বাস্থ্যসেবা চাহিদা প্রদানের কৌশল  অথবা পাহাড়ি এলাকার কর্মসূচি বাস্তবায়নের কৌশল কখনই এক হবে না। কারণ আর্থিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট ভিন্ন। বাংলাদেশের গ্রামীণ ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের কিশোর-কিশোরীরা আজও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে নানা ধরনের বৈষম্যের সম্মুখীন হচ্ছে। এই বৈষম্য কেবল স্বাস্থ্যসেবার সীমিত প্রাপ্যতা নয়, বরং সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং কাঠামোগত প্রতিবন্ধকতার এক জটিল চক্রের অংশ। অধিকন্তু প্রায় এক বছর মাঠ পর্যায়ে গর্ভনিরোধক, নিরাপদ মাসিক নিয়মিতকরণের সামগ্রী না থাকার ফলে গ্রামীণ এবং প্রত্যন্ত এলাকার নারীরা সীমাহীন স্বাস্থ্যঝুঁকির সম্মুখীন। এই সমস্যা সমাধান অত্যন্ত জরুরি।

১৯৯৪ সালে কায়রোতে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক জনসংখ্যা ও উন্নয়ন সম্মেলন একটি যুগান্তকারী মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত। এই সম্মেলনে বিশ্ব নেতৃবৃন্দ প্রথমবারের মতো স্বীকার করেন যে, জনসংখ্যা ও উন্নয়ন বিষয়ে টেকসই অগ্রগতির জন্য ব্যক্তির প্রজনন স্বাস্থ্য ও অধিকার নিশ্চিত করা অত্যাবশ্যক। আইসিডিপি কর্মপরিকল্পনার অন্যতম প্রধান প্রতিশ্রুতি ছিল ‘সর্বজনীন প্রজনন স্বাস্থ্যসেবায় প্রবেশাধিকার’ নিশ্চিত করা, বিশেষ করে যুব জনগোষ্ঠী, কিশোর-কিশোরী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য।

এই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের জন্য আমাদের জরুরিভিত্তিতে তরুণদের জন্য বয়সোপযোগী তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যশিক্ষা নিশ্চিত করা দরকার। স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে নারী ও কিশোরীদের জন্য পৃথক এবং নিরাপদ সেবা ব্যবস্থা গড়ে তোলা প্রয়োজন। জীবনঘনিষ্ঠ শিক্ষা পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে। বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে সামাজিক সচেতনতা ও আইন প্রয়োগ জোরদার করতে হবে। যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা বিষয়ে অভিভাবক ও শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে যেন তারা তরুণদের পাশে দাঁড়াতে পারে। দুর্গম অঞ্চলে মোবাইল ক্লিনিক, রোভিং টিম ও ডিজিটাল সেবা জোরদার করা জরুরি। বাজেট ও কর্মপরিকল্পনায় নারী ও যুব অধিকারকে অগ্রাধিকার দেওয়া। প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা যেন তথ্য ও খরচজনিত কারণে কারও জন্য অপ্রাপ্য না হয়।

পরিশেষে বলা যায়, তরুণ ও নারীর প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা শুধু একটি স্বাস্থ্যগত বিষয় নয়। এটি মানবাধিকার, লিঙ্গ সমতা এবং টেকসই উন্নয়নের ভিত্তি। আন্তর্জাতিক জনসংখ্যা দিবস ২০২৫ আমাদের সুযোগ করে দিচ্ছে এই বার্তা নতুন করে ছড়িয়ে দেওয়ার। আজকের বিনিয়োগই আগামীর সুস্থ, দক্ষ ও সমতাভিত্তিক সমাজ গঠনের মূল ভিত্তি।


মনজুন নাহার:  প্রধান, ফান্ড রাইজিং ও পার্টনারশিপ, মেরী স্টোপস বাংলাদেশ

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: জনস খ য প রজনন স ব স থ য য ন ও প রজনন স ব স থ য ন শ চ ত কর জনগ ষ ঠ র জনস খ য র জন য আম দ র

এছাড়াও পড়ুন:

বাংলাদেশের সরাসরি বিশ্বকাপ খেলা নিয়ে সুখবর দিল বিসিবি

আইসিসির শর্ত পূরণ করে ২০১৫, ২০১৯ এমনকি ২০২৩ বিশ্বকাপে বাংলাদেশ সরাসরি কোয়ালিফাই করেছে। ২০১৫ থেকে লম্বা সময় ধরে ওডিআই র‌্যাংকিংয়ে বাংলাদেশ ৭ নম্বরে। সেখান থেকে অবনমন হতে হতে এখন ১০ নম্বরে। তাইতো প্রশ্ন উঠছে ২০২৭ বিশ্বকাপে সরসরি খেলতে পারবে তো বাংলাদেশ?

আফগানিস্তানের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজ হারের পর এই স্বপ্নও ধীরে ধীরে ফিকে হচ্ছে। তবে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড জানিয়েছে, এখনও পর্যাপ্ত ম্যাচ আছে বাংলাদেশের। যেগুলোতে ভালো করলে রাংকিংয়ে অবস্থান ভালো হবে। তাতে বাংলাদেশ সরাসরি বিশ্বকাপ খেলতে পারবে বলে আশাবাদী বিসিবি।

আরো পড়ুন:

শারমনি-শর্নার ফিফটিতে ২৩৩ রানের টার্গেট দিল বাংলাদেশ

টস জিতে ব্যাটিংয়ে বাংলাদেশ, একাদশে দুই পরিবর্তন

২০২৭ বিশ্বকাপে সরাসরি কোয়ালিফাই করতে হলে র‌্যাংকিংয়ে সেরা আট দলের মধ্যে থাকতে হবে। ১৪ দলের টুর্নামেন্টে বাকি দলগুলোকে বাছাইপর্বের বাধা পেরোতে হবে। ২০২৭ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত দক্ষিণ আফ্রিকা এবং জিম্বাবুয়ে ছাড়া ওডিআই র‍্যাংকিংয়ের সেরা আটে থাকা দলই বিশ্বকাপে সরাসরি খেলবে। অর্থাৎ দক্ষিণ আফ্রিকা ও জিম্বাবুয়ে সেরা আটের মধ্যে থাকলে র‍্যাংকিংয়ে দশ নম্বর পর্যন্ত থাকা দলগুলো সরাসরি অংশগ্রহণ করবে।

এই সময়কালের মধ্যে ওয়ানডে র‍্যাংকিংয়ে সেরা অবস্থানের মধ্যে না থাকতে পারলে তখন ১০ দলের বাছাইপর্ব খেলতে হবে। যা গত বিশ্বকাপে পেরোতে পারেনি ওয়েস্ট ইন্ডিজের মতো দুবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নরা।

এই মুহূর্তে আফগানিস্তান ৯৪ রেটিং নিয়ে আছে সপ্তমে। ৮৮ রেটিংয়ে আটে অবস্থান ইংল্যান্ডের। ৮০ রেটিংয়ে নয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। আর এর পরেই দশম অবস্থানে বাংলাদেশ, রেটিং ৭৫।

বিশ্বকাপে সরাসরি খেলার যোগ্যতা অর্জনের পথটা বাংলাদেশের জন্য এখন বেশ জটিল। প্রতিটি সিরিজ, প্রতিটি ম্যাচই গুরুত্বপূর্ণ। তবে পর্যাপ্ত সুযোগও আছে।

বিসিবি জানিয়েছে ২০২৫-২৬ সময়কালে বাংলাদেশ আরও ২৪টি ওয়ানডে খেলবে। ফলে র‍্যাংকিংয়ে উন্নতি করে এখনও সরাসরি বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ রয়েছে।

বাংলাদেশের বাকি থাকা ম্যাচগুলো- আফগানিস্তান – ১ ওয়ানডে (চলমান সিরিজ), ওয়েস্ট ইন্ডিজ – ৩ ওয়ানডে (হোম), পাকিস্তান – ৩ ওয়ানডে (হোম), নিউ জিল্যান্ড – ৩ ওয়ানডে (হোম), অস্ট্রেলিয়া – ৩ ওয়ানডে (হোম), জিম্বাবুয়ে – ৫ ওয়ানডে (অ্যাওয়ে), আয়ারল্যান্ড – ৩ ওয়ানডে (অ্যাওয়ে) ও ভারত – ৩ ওয়ানডে (হোম)।

এই ম্যাচগুলি আইসিসি এফটিপি’র অধীনে দ্বিপাক্ষিক সিরিজের অংশ এবং ওয়ানডে র‍্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের অবস্থান নির্ধারণে সরাসরি ভূমিকা পালন করবে।

ঢাকা/ইয়াসিন/আমিনুল

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • যে দেশে বিড়ালের সংখ্যা মানুষের চেয়ে বেশি
  • আড়াইহাজারে মেঘনা নদী থেকে ২ লাখ মিটার কারেন্ট জাল জব্দ
  • বাংলাদেশের সরাসরি বিশ্বকাপ খেলা নিয়ে সুখবর দিল বিসিবি
  • মৃত ইসরায়েলি জিম্মিদের মরদেহ হস্তান্তর নিয়ে ধোঁয়াশা