লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলার মেঘনা নদীতে ড্রেজার (খননযন্ত্র) বসিয়ে অবাধে বালু তোলা হচ্ছে। স্থানীয় বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের কিছু নেতা-কর্মী অবৈধভাবে এসব ড্রেজার বসিয়েছেন বলে জানিয়েছেন বাসিন্দারা। অবাধে বালু তোলার কারণে নদীভাঙনের শঙ্কা দেখা দিয়েছে।

যোগাযোগ করা হলে অবৈধভাবে বালু তোলার বিষয়টির সত্যতা নিশ্চিত করেন রায়পুর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো.

ইমরান খান। তিনি বলেন, ‘অন্তত ৩০টি ড্রেজার দিয়ে নদী থেকে বালু ওঠানো হয়। ইতিমধ্যে অভিযান চালিয়ে ১০টি ড্রেজার নষ্ট করা হয়েছে, বাকিগুলোও পর্যায়ক্রমে ধ্বংস করা হবে।’

৩০টি ড্রেজার দিয়ে নদী থেকে বালু ওঠানো হয়। ইতিমধ্যে অভিযান চালিয়ে ১০টি ড্রেজার নষ্ট করা হয়েছে, বাকিগুলোও পর্যায়ক্রমে ধ্বংস করা হবে।মো. ইমরান খান, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও), রায়পুর

স্থানীয় বাসিন্দাদের সূত্রে জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে উপজেলার দক্ষিণ চরবংশী ইউনিয়নের মোল্লারহাট এলাকায় মেঘনা নদীর প্রায় চার কিলোমিটার এলাকাজুড়ে দিনরাত বালু তোলা হচ্ছে। বছর দেড়েক আগে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা বালু তুলতেন। তবে গত বছর আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে বিএনপির স্থানীয় কিছু নেতা-কর্মী ড্রেজার বসিয়ে বালু তোলা শুরু করেছেন। এর মধ্যে চরবংশী ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি কবির সরকার, ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক রাসেল ব্যাপারী, ইউনিয়ন যুবদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মহি উদ্দিন, ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ড যুবদলের সভাপতি আদম আলী এবং ৫ নম্বর ওয়ার্ড যুবদলের নেতা জালাল সরদার রয়েছেন। এ ছাড়া আনোয়ার হোসেন হাওলাদার, রতন গাজী, গফুর মোল্লা, মিন্টু মোল্লা নামের বিএনপির কয়েকজন কর্মীও জড়িত।

বাসিন্দারা জানান, বালু তোলার কারণে নদীপারের বাসিন্দারা ভাঙনের ঝুঁকিতে পড়েছেন। স্থানীয় বাসিন্দারা বিষয়টি বালু তোলায় জড়িত ব্যক্তিদের জানালেও তাঁরা উল্টো ভয়ভীতি দেখান।

সম্প্রতি সরেজমিনে দক্ষিণ চরবংশী ইউনিয়নের মিয়ার হাট, পানিরঘাট ও হাজীমারা এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, মেঘনা নদীতে ডজনখানেক ড্রেজার বসিয়ে বালু তোলা হচ্ছে। কয়েকজন যুবক বালু তোলার কাজ তদারক করছেন। মিয়ারহাট এলাকার বাসিন্দা মো. সামাদ আলী বলেন, নদীর পাড়ে তাঁর দুই বিঘা জমির এক বিঘা গত বছর নদীতে বিলীন হয়েছে। এখন যেটুকু জমি আছে, সেটুকুও বালু তোলার কারণে কবে নদীতে বিলীন হয়, সেই শঙ্কায় রয়েছেন।

সম্প্রতি সরেজমিনে দক্ষিণ চরবংশী ইউনিয়নের মিয়ারহাট, পানির ঘাট, হাজীমারা এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, মেঘনা নদীতে ডজনখানেক ড্রেজার বসিয়ে বালু তোলা হচ্ছে। কয়েক যুবক বালু তোলার কাজ তদারক করছেন।

পানির ঘাট এলাকার জলিল মিয়া নামের এক বাসিন্দা বলেন, ‘আমাদের গ্রামের সব জমি দু-তিন ফসলি। কিছু জমি আছে, তাতে বর্ষাতেও পানি ওঠে না। জমিগুলোও খুব উর্বর। আমাদের গ্রামের মানুষের মূল পেশা কৃষিকাজ। এখন জমি ঘেঁষে নদী থেকে বালু লুট করে নেওয়া হচ্ছে। আমরা বাধা দিলে উল্টো আমাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়।’

বালু তোলায় অভিযুক্ত জালাল সরদার দক্ষিণ চরবংশী ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ড যুবদলের সভাপতি পদপ্রার্থী হিসেবে নিজেকে পরিচয় দেন। এলাকায় তাঁর এই পরিচয়সংবলিত ব্যানারও ঝোলানো হয়েছে। জানতে চাইলে জালাল সরদার বলেন, ‘আমার একটি ড্রেজার মেশিন আছে। প্রশাসন অভিযান চালানোর পর কয়েক দিন ধরে নদী থেকে বালু ওঠানো বন্ধ করেছি।’

চরবংশী ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি কবির সরকার অবৈধভাবে বালু তোলার সঙ্গে নিজের সংশ্লিষ্টতা স্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘এলাকায় রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি তৈরি—সবকিছুর জন্য বালু দরকার। আমরা চেষ্টা করি নদী ও নদীপারের বাসিন্দাদের ক্ষতি না করে বালু তুলতে।’

এখন জমি ঘেঁষে নদী থেকে বালু লুট করে নেওয়া হচ্ছে। আমরা বাধা দিলে উল্টো আমাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়।জলিল মিয়া, বাসিন্দা, পানির ঘাট এলাকা

ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক রাসেল ব্যাপারী, ইউনিয়ন যুবদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মহি উদ্দিন বলেন, কারও জমি বা বসতভিটা ধ্বংস করতে তাঁরা চান না। যেখানে নদী গভীর, সেখান থেকেই বালু তুলছেন। এলাকার মানুষের প্রয়োজনেই বালু তোলা হচ্ছে। এলাকার উন্নয়নের কাজে এসব বালু ব্যবহৃত হয়।

অভিযুক্ত আনোয়ার হোসেন হাওলাদার চরবংশী ইউনিয়ন বিএনপির সাবেক সহসভাপতি। বালু তোলার সঙ্গে নিজের সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করে তিনি বলেন, ‘এ অঞ্চলে নদী থেকে বালু তোলার জন্য সরকারের কোনো অনুমোদন নেই। তারপরও অনেকে অবৈধভাবে ড্রেজার দিয়ে বালু তোলেন। দীর্ঘদিন ধরে আমাদের দলের নেতা-কর্মীরা মামলা–হামলার কারণে এলাকাছাড়া ছিলেন। এলাকায় ফিরে এখন তাঁদের অনেকে বালু তোলায় জড়িত হয়ে পড়েছেন।’

জানতে চাইলে রায়পুর উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক জেড এম নাজমুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘নদী থেকে বালু তোলার বিষয়টি আমরাও শুনেছি। বিএনপি কখনোই দলের নাম ব্যবহার করে কোনো ধরনের অপকর্মকে প্রশ্রয় দেয় না। দলের কোনো নেতা এ কাজে জড়িত থাকলে তাঁদের বিরুদ্ধে দলীয়ভাবে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমরা স্থানীয় প্রশাসনকেও অনুরোধ জানিয়েছি এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নিতে।’

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ড র জ র বস য় য বদল র স ব এনপ র স ইউন য ন এল ক র আম দ র ট এল ক এল ক য় সরক র উপজ ল

এছাড়াও পড়ুন:

সাড়ে ১১ বছরেও বিএনপির পূর্ণাঙ্গ কমিটি হয়নি, বেড়েছে কোন্দল

সাড়ে ১১ বছরেও চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করা যায়নি। কমিটি না থাকায় সাংগঠনিক কার্যক্রম চলেছে ঢিমেতালে। জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরে চট্টগ্রাম উত্তরের সাতটি আসনে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে বিএনপি নেতাদের বিরোধ আরও চাঙা হয়ে উঠেছে। কেউ কাউকে ছাড় দিতে নারাজ।

সর্বশেষ গোলাম আকবর খন্দকার ও গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরীর অনুসারীদের মধ্যে গত মঙ্গলবার বিকেলে সংঘর্ষ ও গোলাগুলির পর রাতে উত্তর জেলা কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করেন কেন্দ্রীয় নেতারা। তৃণমূল পর্যায়ের নেতা–কর্মীদের প্রত্যাশা, সংঘাত থামিয়ে বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকা নেতৃত্বকে দায়িত্ব দেবে দল; যাতে উত্তরের সাতটি সংসদীয় আসন বিএনপির থাকে।

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ২০২০ সালের ২২ ডিসেম্বর গোলাম আকবর খন্দকারকে আহ্বায়ক করে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির ৪৪ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করেন। এই কমিটিতে সদস্যসচিব ও যুগ্ম আহ্বায়ক রাখা হয়নি। কমিটিতে সদস্য হিসেবে থাকা ৯ জনকে পরে যুগ্ম আহ্বায়ক হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে কেন্দ্রীয় বিএনপি। এই কমিটি কোন্দল থামাতে পারেনি, উল্টো বেড়ে যায়। সর্বশেষ কোন্দল নিরসনে নবগঠিত আহ্বায়ক কমিটিকে চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবের রহমানের সঙ্গে পরামর্শ ও মতামতের ভিত্তিতে কাজ করার নির্দেশনা দেওয়া হয় কেন্দ্র থেকে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি।

রাউজানে আওয়ামী লীগের কিছু নেতা–কর্মী বিএনপির এক নেতার প্রশ্রয়ে রয়েছেন। তাঁরাই বিএনপির অনেক সভা–সমাবেশে হামলা করেছেন। আমি কোনো সন্ত্রাসীকে প্রশ্রয় দিইনি।গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী, সাবেক সভাপতি, চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপি

এর আগে ২০১৪ সালের মার্চ পর্যন্ত উত্তর জেলা বিএনপির পূর্ণাঙ্গ কমিটি ছিল। ওই কমিটির সভাপতি ছিলেন গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী আর সাধারণ সম্পাদক ছিলেন আসলাম চৌধুরী। এরপর আর পূর্ণাঙ্গ কমিটি হয়নি। সীতাকুণ্ড, মিরসরাই, সন্দ্বীপ, ফটিকছড়ি, রাঙ্গুনিয়া ও হাটহাজারী উপজেলায় পূর্ণাঙ্গ কমিটি করা যায়নি। শুধু চলতি বছরের শুরুতে রাউজানে সভাপতি–সম্পাদক দুজনের কমিটি হয়। তবে গিয়াস উদ্দিন কাদেরের অনুসারীরা এটির বিরোধিতা করেন। গোলাম আকবরের অনুসারীদের দিয়ে কমিটি গঠনের অভিযোগ ওঠে।

আওয়ামী লীগের সময়ে গত ১৬ বছর রাউজানে বিএনপি মিছিল–সমাবেশ করতে পারেনি। গত বছরের ৫ আগস্টের পর সেখানে মিছিল করে বিএনপি। এরপর গিয়াস ও গোলাম আকবর এলাকায় আধিপত্য বিস্তারে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন। গত ১৯ মার্চ ইফতার মাহফিলে দুই পক্ষের সংঘর্ষে ১৫ জন আহত হন। মঙ্গলবার বিকেলে চট্টগ্রাম–রাঙামাটি সড়কের রাউজানে সত্তারহাট এলাকায় তাঁদের দুজনের অনুসারীদের মধ্যে সংঘর্ষে অন্তত ২০ জন আহত হন। এতে ছররা গুলিতে আহত হন গোলাম আকবর খন্দকার নিজেও। তিনি দাবি করেছেন, তাঁর গাড়িবহরে হামলা করা হয়েছে।

রাউজানে গত বছরের ৫ আগস্টের পর সহিংসতায় মোট ১৩টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে ১০টি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড। বিএনপির দুই পক্ষে সংঘর্ষ হয় শতাধিকবার। তিন শতাধিক মানুষ এসব ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হন।

জানতে চাইলে পদ স্থগিত হওয়া বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাউজানে আওয়ামী লীগের কিছু নেতা–কর্মী বিএনপির এক নেতার প্রশ্রয়ে রয়েছেন। তাঁরাই বিএনপির অনেক সভা–সমাবেশে হামলা করেছেন। আমি কোনো সন্ত্রাসীকে প্রশ্রয় দিইনি।’

সীতাকুণ্ড, মিরসরাই, সন্দ্বীপ, ফটিকছড়ি, রাঙ্গুনিয়া ও হাটহাজারী উপজেলায় পূর্ণাঙ্গ কমিটি করা যায়নি। শুধু চলতি বছরের শুরুতে রাউজানে সভাপতি–সম্পাদক দুজনের কমিটি হয়। তবে গিয়াস উদ্দিন কাদেরের অনুসারীরা এটির বিরোধিতা করেন। গোলাম আকবরের অনুসারীদের দিয়ে কমিটি গঠনের অভিযোগ ওঠে।

চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির বিলুপ্ত কমিটির আহ্বায়ক গোলাম আকবর খন্দকার বলেন, হামলার পেছনে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীদের প্রশ্রয় দেওয়ার জন্য দলের প্রতিপক্ষ দায়ী। তিনি পরিচ্ছন্ন রাজনীতি করেন বলে দাবি করেন।

একই অবস্থা মিরসরাই উপজেলায়। ২৪ মার্চ মিরসরাই উপজেলা, বারইয়ারহাট ও মিরসরাই পৌরসভা বিএনপির নতুন আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা হয়। উপজেলা বিএনপির কমিটিতে আহ্বায়ক করা হয় আবদুল আওয়াল চৌধুরীকে। সদস্যসচিব হন আজিজুর রহমান চৌধুরী। ৮৩ সদস্যের নতুন কমিটির নেতৃত্বে থাকা এই দুজনই উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি নুরুল আমিনের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। কমিটিতে নিজেদের পক্ষের প্রতিনিধিত্ব কম থাকায় সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান নুরুল আমিনের অনুসারীরা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। কমিটি গঠনের প্রতিবাদে ২৫ মার্চ দলের এই অংশের নেতা–কর্মীরা মিরসরাইয়ে ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়ক বন্ধ করে ঝাড়ুমিছিল ও বিক্ষোভ সমাবেশ করেন। ২৬ মার্চ ১৪৪ ধারা ভেঙে মিছিল করে শহীদ মিনারে ফুল দিতে যান সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান নুরুল আমিনের অনুসারীরা। উপজেলার বারইয়ারহাট পৌরসভার জামালপুর এলাকায় দলের দুই পক্ষের সংঘর্ষে মোহাম্মদ জাবেদ নামের এক যুবক নিহত হন। সংঘর্ষে গুরুতর আহত হন বিএনপির অন্তত ১৩ নেতা–কর্মী। পরে কমিটির কার্যক্রম স্থগিত করেন নেতারা।

চট্টগ্রামের রাউজানে গত মঙ্গলবার বিএনপির দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের সময় ভাঙচুর করা গাড়ি

সম্পর্কিত নিবন্ধ