প্রথমত যে বিষয়টিতে আমি গুরুত্ব দিতে চাই, সেটি হলো ঐকমত্য কমিশন কিছু সংস্কার প্রস্তাব ‘নোট অব ডিসেন্ট’সহ (ভিন্নমত) গ্রহণ করছে। আমি এটি সমর্থন করি না। এ প্রসঙ্গে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস দ্য ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহ্ফুজ আনামকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে (গত নভেম্বরে) বলেছিলেন, তাঁরা মূলত ফ্যাসিলিটেটরের (এগিয়ে নিতে সহায়তাকারী) ভূমিকা পালন করছেন। তাঁর ভাষায়, যতটুকু সংস্কারে সবাই একমত হবেন, ততটুকুই বাস্তবায়নের জন্য বিবেচনায় নেওয়া হবে। তিনি সংখ্যার উদাহরণ দিয়ে বলেছিলেন, যদি ১০০টি প্রস্তাব আসে, আর সব দলের সম্মতি মেলে মাত্র ১০টির ক্ষেত্রে, তাহলে কেবল সেই ১০টি বাস্তবায়নের জন্য বিবেচনায় নেওয়া হবে, বাকিগুলো নয়।

আমি মনে করি, ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দেওয়া সংস্কার প্রস্তাবগুলো অন্তর্ভুক্ত করে জুলাই সনদ চূড়ান্ত করা উচিত নয়; বরং যেসব বিষয়ে সব রাজনৈতিক দলের ঐকমত্য রয়েছে, কেবল সেগুলো নিয়েই জুলাই সনদ চূড়ান্ত হওয়া উচিত।

উদাহরণ হিসেবে ধরা যাক, বিএনপি যেসব প্রস্তাবের ব্যাপারে নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়নের বিষয়ে তারা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ নয়। ফলে ভবিষ্যতে তারা যদি ক্ষমতায় যায়, তাহলে সেসব প্রস্তাব বাস্তবায়নের সম্ভাবনা নেই। কারণ, তারা আগেভাগেই আনুষ্ঠানিকভাবে আপত্তি জানিয়েছে। সুতরাং এই প্রক্রিয়ায় জুলাই সনদ হওয়ার মানে, আমার কাছে মনে হয় সরকার কোনো একটি পক্ষকে খুশি করার কৌশল হিসেবে এই পদক্ষেপ নিয়েছে।

গণতন্ত্রে সংখ্যার কথা বলা হয়। কিন্তু রাজনৈতিক প্রভাবও বিবেচনায় রাখা উচিত। শুধু বিএনপি নয়, জামায়াতে ইসলামী বা জাতীয় নাগরিক পার্টিও (এনসিপি) যদি কোনো প্রস্তাবের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট অবস্থান নেয়, তবে সেগুলো জুলাই সনদে অন্তর্ভুক্ত না করাই শ্রেয়। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, নোট অব ডিসেন্টসহ জুলাই সনদ প্রকাশ করা উচিত নয়।

যে উদ্দেশ্যে উচ্চকক্ষ গঠনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল, আমি সেটির সঙ্গে সহমত। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে (পিআর) উচ্চকক্ষ গঠনের যে ভাবনা, তাতে ভারসাম্য রক্ষার সুযোগ ছিল। আমি সেই প্রস্তাবের পক্ষে। তবে আমি নিম্নকক্ষে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির ঘোরতর বিরোধী।

অবশ্য সবকিছু ছাপিয়ে ঐকমত্য কমিশনের কার্যক্রমে কিছু বিষয় আমাকে যথেষ্ট সন্তুষ্ট করেছে। প্রথমত, কমিশনের সদস্যদের উপস্থিতিতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অকল্পনীয় মাত্রায় খোলামেলা বিতর্ক হয়েছে। তাঁরা একসঙ্গে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দেশ পরিচালনার কাঠামো নিয়ে আলোচনা করেছেন, এটা বড় অগ্রগতি। দ্বিতীয়ত, বিএনপির অবস্থানও এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। তারা যেসব প্রস্তাব মানেনি, তা স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে। সমালোচনা হবে জেনেও তারা যেটা করবে না, সে বিষয়ে কথা দেয়নি। বিএনপি উচ্চকক্ষে পিআর পদ্ধতি, সংবিধান ও কমিশনসংক্রান্ত কিছু বিষয়ে একমত হয়নি এবং তা স্পষ্টভাবে জানিয়েছে। আমি এটিকে সৎ অবস্থান মনে করি। অতীতে কোনো প্রস্তাবে সম্মতি দিলেও পরবর্তী সময়ে ক্ষমতায় গিয়ে তা পালন না করার প্রবণতা দেখা গেছে।

এ ছাড়া বিচার বিভাগ সম্পূর্ণভাবে পৃথক্‌করণের বিষয়ে সব দল রাজি হয়েছে। এটা একটা অসাধারণ অর্জন। সরকারের সম্পূর্ণ প্রভাবমুক্ত পৃথক সচিবালয় হবে, হাইকোর্টের বেঞ্চ বিভাগীয় পর্যায়ে যাবে, নিম্ন আদালত উপজেলায় যাবে—এগুলোতে সবাই একমত হয়েছে, এগুলো অবিশ্বাস্য অর্জন।

সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়েও মোটামুটি সবাই একটি জায়গায় পৌঁছেছে। নির্বাচন কমিশন সরকারের হাত থেকে সম্পূর্ণভাবে সরিয়ে ফেলার বিষয়ে রাজি হওয়া, কেউ ১০ বছরের বেশি প্রধানমন্ত্রী পদে থাকতে না পারার সিদ্ধান্ত—এগুলো খুবই মৌলিক সংস্কার। সব মিলিয়ে যতটুকু একমত হওয়া গেছে তা যথেষ্ট।

জাহেদ উর রহমান: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

(মতামত লেখকের নিজস্ব)

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ন ট অব ড স ন ট জ ল ই সনদ প রস ত ব র জন ত ক ব এনপ

এছাড়াও পড়ুন:

জুলাই সনদের বাস্তবায়নে দেরি হলে জনগণ আবারও রাস্তায় নামবে: জামায়াত নেতা রফিকুল

জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি এখন দেশের ১৮ কোটি মানুষের দাবি বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল রফিকুল ইসলাম খান। তিনি বলেন, ‘এই সনদ নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে জারি করা হোক এবং প্রয়োজনে গণভোটের আয়োজন করা হোক। তবে এই গণভোট অবশ্যই জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই হতে হবে, নির্বাচনের পরে নয়।’

আজ বুধবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে জুলাই সনদের বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে তৃতীয় ধাপে তৃতীয় দিনের আলোচনা শেষে সাংবাদিকদের এ কথা বলেন রফিকুল ইসলাম খান। এ সময় উপস্থিত ছিলে জামায়াতের আরেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ।

জুলাই সনদের বাস্তবায়নে দেরি হলে জনগণ স্বাভাবিকভাবেই আবারও রাস্তায় নেমে আসবে বলে মন্তব্য করেন রফিকুল ইসলাম খান। তিনি বলেন, ১৯৯০ সালের গণ-অভ্যুত্থানের পর সে সময়কার দলগুলোর ঐকমত্য থাকা সত্ত্বেও ক্ষমতায় থাকা দলগুলো সেটি (তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা) যথাসময়ে বাস্তবায়ন করেনি। পরে আন্দোলনের মাধ্যমেই তা সংবিধানে যুক্ত হয়।

জামায়াতের এই নেতা আরও বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল হয়েছিল বিচারপতি খায়রুল হকের রায়ের মাধ্যমে। আদালতের ওপর প্রভাব বিস্তার করে এ রায় দেওয়ানো হয়েছিল। তাই বিচার বিভাগকে আবার বিতর্কের মুখে না ফেলে সংবিধানিক আদেশের মাধ্যমে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পক্ষে জামায়াত।

জামায়াতের আরেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, ঐকমত্য কমিশন একটি বিশেষজ্ঞ কমিটির মাধ্যমে চারটি বিকল্প নিয়ে কাজ করেছে, যার মধ্যে কমিশন সংবিধানিক আদেশের প্রস্তাবটি সমর্থন করেছে। এই আদেশের মাধ্যমে জুলাই সনদের ২২টি আর্টিকেল বাস্তবায়িত হতে পারে। এটি আইনিভাবে সবচেয়ে শক্তিশালী ভিত্তি।

এক প্রশ্নের জবাবে হামিদুর রহমান বলেন, সংবিধানের মৌলিক কাঠামো পরিবর্তন করার এখতিয়ার সংসদের নেই, এবং এ ধরনের পরিবর্তন করতে হলে অবশ্যই গণভোটের প্রয়োজন হয়।

জামায়াতে ইসলামী জনগণের অভিপ্রায়কে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয় উল্লেখ করে জামায়াতের এ সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল বলেন, জনগণের ইচ্ছা ও আকাঙ্ক্ষাই হচ্ছে দেশের সর্বোচ্চ আইন।

জুলাই সনদের যে আদর্শ ও চেতনা, তা বাস্তবায়ন হওয়া উচিত এবং যারা এই আদর্শের পথে হাঁটবে না, জনগণ তাদের ব্যাপারে সঠিক সিদ্ধান্ত নেবে বলে মনে করেন হামিদুর রহমান আযাদ। উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, ডাকসু নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়লাভ এটি প্রমাণ করে যে এ দেশের তরুণসমাজ ও জনগণ নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থা চায় এবং জুলাই বিপ্লবের যোদ্ধাদের পক্ষেই রয়েছে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • সাংবিধানিক আদেশ ও গণভোটের সুপারিশ, একমত নয় দলগুলো
  • ‘সংবিধান আদেশ’ জারির সুপারিশ করতে পারে কমিশন: আলী রীয়াজ
  • জুলাই সনদের বাস্তবায়নে দেরি হলে জনগণ আবারও রাস্তায় নামবে: জামায়াত নেতা রফিকুল
  • কমিটি গঠন, প্রতিবেদন না আসা পর্যন্ত আন্দোলন স্থগিত 
  • বর্ধিত মেয়াদের আগেই জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি চূড়ান্ত করতে চায় কমিশন: আলী রীয়াজ
  • বিএনপি নির্বাচনমুখী কর্মসূচিতে যাবে
  • দলগুলোর সঙ্গে বুধবার আবার আলোচনায় বসছে ঐকমত্য কমিশন
  • ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধেই নির্বাচন হতে হবে
  • জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের মেয়াদ ফের এক মাস বাড়ল
  • সব দলের সম্মতিতে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পক্ষে এবি পার্টি