যুগপৎ মানবসভ্যতা ও বিবেকের মৃত্যুঘণ্টা
Published: 3rd, August 2025 GMT
বধ্যভূমি হয়ে ওঠা গাজায় প্রতিদিন শিশুসহ নরহত্যা ‘উৎসব’ চলছে। এখন শুরু হয়েছে অপুষ্টি ও অনাহারে মৃত্যু। সঙ্গে গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে মাথা গোঁজার ঠাঁই। সব দেখে এখন বুঝতে পারি মানুষের বিবেক ও চেতনারও সীমাবদ্ধতা রয়েছে। গাজায় যাঁরা অবিরাম নিষ্ঠুরতার শিকার হচ্ছেন, তাঁদের তো এখন জৈবশক্তির জোরেই টিকে থাকতে হচ্ছে।
আক্রমণকারী শক্তি ইসরায়েল নির্দিষ্ট লক্ষ্য পূরণ না হওয়া পর্যন্ত রণাঙ্গন ছাড়বে বলে মনে হয় না। অতীতে দেখা যেত, সংঘাতের বাইরের দর্শক বাকি বিশ্বের নেতাদের চাপে এমন নিষ্ঠুরতা থামাতে হতো। হামাসের ৭ অক্টোবরের (২০২৩) হামলার প্রতিশোধ নেওয়া শুরু করেছিল ইসরায়েল নভেম্বর থেকে। তার মিত্রদের যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোভুক্ত পশ্চিম ইউরোপের পরামর্শে তারা ১৯ জানুয়ারি ২০২৫ একবার যুদ্ধবিরতি মেনে ছিল; কিন্তু তারপর মার্চ থেকে আবারও পূর্ণোদ্যমে গাজার নিরস্ত্র বেসামরিক জনগণের ওপর যে নৃশংস হামলা শুরু করেছে, তা আর বন্ধ করছে না।
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধবিরতির সব প্রস্তাব যুক্তরাষ্ট্র ভেটো দিয়ে ইসরায়েলের অবিরাম নিষ্ঠুরতার পক্ষে কাজ করে চলেছে, শান্তি প্রতিষ্ঠার পথ বন্ধ করে নিজেরাও সাম্প্রতিককালের এই গণহত্যার অংশীজন হয়ে গেল। মোটকথা তারা শান্তি আলোচনার সুযোগ রুদ্ধ করে রেখেছে। প্রায় ২১ মাসের একতরফা হামলার মধ্যে ইসরায়েল তার লক্ষ্য কয়েক দফায় বিস্তৃত করেছে। এটা তারা করেছে মুরব্বি যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিম ইউরোপীয় মিত্রদের নব্য ঔপনিবেশিক নীলনকশার পুরোভাগের বাহিনী হিসেবে।
পুরো বিশ্বের ওপর পশ্চিম ইউরোপীয় সাতটি দেশের আধিপত্যের শুরু মহাসাগরীয় অভিযাত্রার কালে (পঞ্চদশ–অষ্টাদশ শতাব্দী) দুই আমেরিকা ও সর্বশেষ অস্ট্রেলিয়ায় স্থানীয় ভূমিসন্তানদের নির্মম-নিষ্ঠুরতায় সম্পূর্ণ, কোথাও আংশিক বিনাশ করে ইউরোপীয় বসতি স্থাপনের মাধ্যমে। দীর্ঘ লাগাতার চক্রান্ত, মিথ্যা আশ্বাস এবং চরম নিষ্ঠুরতার পরও যারা বেঁচে গিয়েছিল, তাদের নিজস্ব ভাষা-কৃষ্টির ওপর ঔপনিবেশিক ইউরোপীয় ভাষা-সংস্কৃতির বাধ্যতা চাপানো হয়েছিল, যেমনটা ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষের উত্তরাধিকারের দায় আমাদেরও বইতে হয়েছে, হচ্ছে।
যে দুটি মহাদেশ পূর্ণাঙ্গ দখলের বাইরে ছিল, সেই এশিয়া ও আফ্রিকায় তারা উপনিবেশ স্থাপন করে অবিরাম লুণ্ঠন ও নিষ্পেষণ চালিয়ে গেছে। এভাবে শিল্পবিপ্লব-পরবর্তী ঊনবিংশ শতক নাগাদ বিশ্বের ভূমি এবং সম্পদ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির হাতেই পুঞ্জীভূত হয়ে যায়।
বিশ্বের ভূমি ও সম্পদের ওপর দখল কায়েমের প্রকল্প ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর ঠান্ডা মাথার পরিকল্পনায় হয়েছিল। ১৮৮১ সালে প্রাশিয়ার জেনারেল অটো ফন বিসমার্ক বার্লিনে নিজেদের মধ্যে আফ্রিকার ভাগ–বাঁটোয়ারা নিয়ে সম্মেলন ডেকেছিলেন, ইতিহাসে এটি ‘স্ক্র্যাম্বল ফর আফ্রিকা’ বা আফ্রিকার জন্য কাড়াকাড়ি নামে আখ্যায়িত হয়েছে। পশ্চিম ইউরোপের সাতটি দেশ—যুক্তরাজ্য, নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম, ফ্রান্স, জার্মানি, স্পেন, পর্তুগাল নিজেদের মধ্যে মহাদেশটি ভাগাভাগি করে নিয়েছে। পরে তাতে ইতালি ও যুক্তরাষ্ট্র যোগ দিয়েছিল। বাদ ছিল শুধু দুটি দেশ—ইথিওপিয়া ও লাইবেরিয়া।
প্রথম মহাযুদ্ধের পর অটোমান সাম্রাজ্যের পতন ঘটলে তারা মুসলিম অধ্যুষিত মধ্যপ্রাচ্য, মিসর প্রভৃতি অঞ্চল পুনর্গঠনের মাধ্যমে তাদের আধিপত্য আরও বিস্তৃত ও দৃঢ় করার চেষ্টা চালিয়েছিল। ১৯২৯-৩০ সালের মহামন্দা ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ধকলে ইউরোপীয় শক্তি হ্রাস পাওয়ায় উপনিবেশগুলো ছেড়ে দেওয়ার বাস্তবতা তৈরি হয়। এর পেছনে স্থানীয় কারণ হলো দেশগুলোতে স্বদেশ ও স্বাধীনতা চেতনার বিকাশ এবং জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের তীব্রতা। এখন সময়ের ব্যবধানে বিচার করলে মনে হয়, যেসব দেশে প্রত্যক্ষ ঔপনিবেশিক শাসন চলেছে, সেখানে ঔপনিবেশিক শক্তি শাসনকাজে স্থানীয় সহায়ক শ্রেণি তৈরি করতে গিয়ে স্বদেশ ও স্বাধীনতা চেতনায় উজ্জীবিত কিছু মানুষের জন্ম দেয়।
এমন মানুষদের নেতৃত্বে উপনিবেশায়িত দেশে দেশে তীব্র জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে গত শতকের মধ্যভাগ থেকে এশিয়া-আফ্রিকায় নতুন স্বাধীন দেশের আবির্ভাব হতে থাকে। এই বাস্তবতা এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের উত্থানের প্রেক্ষাপটে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর সূচিত হয় স্নায়ুযুদ্ধ। যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউরোপ পুনর্গঠনের দায় এবং সাম্রাজ্যবাদী শক্তির নেতৃত্ব চলে আসে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে। শিল্পবিপ্লব যেমন সবার জন্য সুযোগ তৈরি করলেও এর আঁতুড় যুক্তরাজ্য ও আঙিনা পশ্চিম ইউরোপের ফসলের উত্তমর্ণ হিসেবে নিয়ন্তার ভূমিকায় ছিল, তেমনি আজকের নতুন প্রযুক্তির প্রভাব ও বিশ্বায়নের ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে। এতে শরিক হতে হচ্ছে সব দেশ ও জাতিকে এবং এর লভ্যাংশে সবার সুযোগ থাকলেও উত্তমর্ণের নিয়ন্তা-ভূমিকা পাল্টায়নি। মঞ্চ তাদের জন্যই সাজানো আছে।
নতুনভাবে ইরান এখন পশ্চিমের মাথাব্যথার কারণ।.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: য ক তর ষ ট র ঔপন ব শ ক ইউর প য় ইসর য় ল র ওপর
এছাড়াও পড়ুন:
যুগপৎ মানবসভ্যতা ও বিবেকের মৃত্যুঘণ্টা
বধ্যভূমি হয়ে ওঠা গাজায় প্রতিদিন শিশুসহ নরহত্যা ‘উৎসব’ চলছে। এখন শুরু হয়েছে অপুষ্টি ও অনাহারে মৃত্যু। সঙ্গে গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে মাথা গোঁজার ঠাঁই। সব দেখে এখন বুঝতে পারি মানুষের বিবেক ও চেতনারও সীমাবদ্ধতা রয়েছে। গাজায় যাঁরা অবিরাম নিষ্ঠুরতার শিকার হচ্ছেন, তাঁদের তো এখন জৈবশক্তির জোরেই টিকে থাকতে হচ্ছে।
আক্রমণকারী শক্তি ইসরায়েল নির্দিষ্ট লক্ষ্য পূরণ না হওয়া পর্যন্ত রণাঙ্গন ছাড়বে বলে মনে হয় না। অতীতে দেখা যেত, সংঘাতের বাইরের দর্শক বাকি বিশ্বের নেতাদের চাপে এমন নিষ্ঠুরতা থামাতে হতো। হামাসের ৭ অক্টোবরের (২০২৩) হামলার প্রতিশোধ নেওয়া শুরু করেছিল ইসরায়েল নভেম্বর থেকে। তার মিত্রদের যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোভুক্ত পশ্চিম ইউরোপের পরামর্শে তারা ১৯ জানুয়ারি ২০২৫ একবার যুদ্ধবিরতি মেনে ছিল; কিন্তু তারপর মার্চ থেকে আবারও পূর্ণোদ্যমে গাজার নিরস্ত্র বেসামরিক জনগণের ওপর যে নৃশংস হামলা শুরু করেছে, তা আর বন্ধ করছে না।
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধবিরতির সব প্রস্তাব যুক্তরাষ্ট্র ভেটো দিয়ে ইসরায়েলের অবিরাম নিষ্ঠুরতার পক্ষে কাজ করে চলেছে, শান্তি প্রতিষ্ঠার পথ বন্ধ করে নিজেরাও সাম্প্রতিককালের এই গণহত্যার অংশীজন হয়ে গেল। মোটকথা তারা শান্তি আলোচনার সুযোগ রুদ্ধ করে রেখেছে। প্রায় ২১ মাসের একতরফা হামলার মধ্যে ইসরায়েল তার লক্ষ্য কয়েক দফায় বিস্তৃত করেছে। এটা তারা করেছে মুরব্বি যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিম ইউরোপীয় মিত্রদের নব্য ঔপনিবেশিক নীলনকশার পুরোভাগের বাহিনী হিসেবে।
পুরো বিশ্বের ওপর পশ্চিম ইউরোপীয় সাতটি দেশের আধিপত্যের শুরু মহাসাগরীয় অভিযাত্রার কালে (পঞ্চদশ–অষ্টাদশ শতাব্দী) দুই আমেরিকা ও সর্বশেষ অস্ট্রেলিয়ায় স্থানীয় ভূমিসন্তানদের নির্মম-নিষ্ঠুরতায় সম্পূর্ণ, কোথাও আংশিক বিনাশ করে ইউরোপীয় বসতি স্থাপনের মাধ্যমে। দীর্ঘ লাগাতার চক্রান্ত, মিথ্যা আশ্বাস এবং চরম নিষ্ঠুরতার পরও যারা বেঁচে গিয়েছিল, তাদের নিজস্ব ভাষা-কৃষ্টির ওপর ঔপনিবেশিক ইউরোপীয় ভাষা-সংস্কৃতির বাধ্যতা চাপানো হয়েছিল, যেমনটা ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষের উত্তরাধিকারের দায় আমাদেরও বইতে হয়েছে, হচ্ছে।
যে দুটি মহাদেশ পূর্ণাঙ্গ দখলের বাইরে ছিল, সেই এশিয়া ও আফ্রিকায় তারা উপনিবেশ স্থাপন করে অবিরাম লুণ্ঠন ও নিষ্পেষণ চালিয়ে গেছে। এভাবে শিল্পবিপ্লব-পরবর্তী ঊনবিংশ শতক নাগাদ বিশ্বের ভূমি এবং সম্পদ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির হাতেই পুঞ্জীভূত হয়ে যায়।
বিশ্বের ভূমি ও সম্পদের ওপর দখল কায়েমের প্রকল্প ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর ঠান্ডা মাথার পরিকল্পনায় হয়েছিল। ১৮৮১ সালে প্রাশিয়ার জেনারেল অটো ফন বিসমার্ক বার্লিনে নিজেদের মধ্যে আফ্রিকার ভাগ–বাঁটোয়ারা নিয়ে সম্মেলন ডেকেছিলেন, ইতিহাসে এটি ‘স্ক্র্যাম্বল ফর আফ্রিকা’ বা আফ্রিকার জন্য কাড়াকাড়ি নামে আখ্যায়িত হয়েছে। পশ্চিম ইউরোপের সাতটি দেশ—যুক্তরাজ্য, নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম, ফ্রান্স, জার্মানি, স্পেন, পর্তুগাল নিজেদের মধ্যে মহাদেশটি ভাগাভাগি করে নিয়েছে। পরে তাতে ইতালি ও যুক্তরাষ্ট্র যোগ দিয়েছিল। বাদ ছিল শুধু দুটি দেশ—ইথিওপিয়া ও লাইবেরিয়া।
প্রথম মহাযুদ্ধের পর অটোমান সাম্রাজ্যের পতন ঘটলে তারা মুসলিম অধ্যুষিত মধ্যপ্রাচ্য, মিসর প্রভৃতি অঞ্চল পুনর্গঠনের মাধ্যমে তাদের আধিপত্য আরও বিস্তৃত ও দৃঢ় করার চেষ্টা চালিয়েছিল। ১৯২৯-৩০ সালের মহামন্দা ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ধকলে ইউরোপীয় শক্তি হ্রাস পাওয়ায় উপনিবেশগুলো ছেড়ে দেওয়ার বাস্তবতা তৈরি হয়। এর পেছনে স্থানীয় কারণ হলো দেশগুলোতে স্বদেশ ও স্বাধীনতা চেতনার বিকাশ এবং জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের তীব্রতা। এখন সময়ের ব্যবধানে বিচার করলে মনে হয়, যেসব দেশে প্রত্যক্ষ ঔপনিবেশিক শাসন চলেছে, সেখানে ঔপনিবেশিক শক্তি শাসনকাজে স্থানীয় সহায়ক শ্রেণি তৈরি করতে গিয়ে স্বদেশ ও স্বাধীনতা চেতনায় উজ্জীবিত কিছু মানুষের জন্ম দেয়।
এমন মানুষদের নেতৃত্বে উপনিবেশায়িত দেশে দেশে তীব্র জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে গত শতকের মধ্যভাগ থেকে এশিয়া-আফ্রিকায় নতুন স্বাধীন দেশের আবির্ভাব হতে থাকে। এই বাস্তবতা এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের উত্থানের প্রেক্ষাপটে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর সূচিত হয় স্নায়ুযুদ্ধ। যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউরোপ পুনর্গঠনের দায় এবং সাম্রাজ্যবাদী শক্তির নেতৃত্ব চলে আসে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে। শিল্পবিপ্লব যেমন সবার জন্য সুযোগ তৈরি করলেও এর আঁতুড় যুক্তরাজ্য ও আঙিনা পশ্চিম ইউরোপের ফসলের উত্তমর্ণ হিসেবে নিয়ন্তার ভূমিকায় ছিল, তেমনি আজকের নতুন প্রযুক্তির প্রভাব ও বিশ্বায়নের ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে। এতে শরিক হতে হচ্ছে সব দেশ ও জাতিকে এবং এর লভ্যাংশে সবার সুযোগ থাকলেও উত্তমর্ণের নিয়ন্তা-ভূমিকা পাল্টায়নি। মঞ্চ তাদের জন্যই সাজানো আছে।
নতুনভাবে ইরান এখন পশ্চিমের মাথাব্যথার কারণ।