ইউক্রেন নিয়ে ট্রাম্পের সুর বদল, পাল্টা জবাব মস্কোর
Published: 24th, September 2025 GMT
রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে হঠাৎ করেই সুর বদলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি বলেছেন, ইউক্রেনে রাশিয়ার দখল করা অঞ্চলগুলো আবার কিয়েভ ফিরে পেতে পারে বলে বিশ্বাস তাঁর। কিছুদিন আগেও যুদ্ধ বন্ধে ইউক্রেনকে কিছু অঞ্চল ছাড় দেওয়া লাগতে পারে বলে মন্তব্য করেছিলেন তিনি। ট্রাম্পের এই মন্তব্যের পর ক্রেমলিন বলেছে, ইউক্রেনে অভিযান চালিয়ে যাবে তারা।
যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ফাঁকে গত মঙ্গলবার ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে বৈঠক করেন ট্রাম্প। সেখানেই কথাগুলো বলেন তিনি। বর্তমানে ইউক্রেনের প্রায় ২০ শতাংশ ভূখণ্ড রাশিয়ার দখলে রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ক্রিমিয়াও। ২০১৪ সালে ইউক্রেনে রুশপন্থী সরকারের পতনের পর উপদ্বীপটি দখল করে নিয়েছিল রুশ বাহিনী।
জেলেনস্কির সঙ্গে বৈঠকের পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে ট্রাম্প লেখেন, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও রাশিয়া এখন বড় অর্থনৈতিক সমস্যার মধ্যে রয়েছে। ইউক্রেনের পদক্ষেপ নেওয়ার এখনই সময়। তিনি মনে করেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সমর্থনে বর্তমানে লড়াই করার এবং নিজেদের প্রকৃত মানচিত্রের পুরো অংশ ফিরিয়ে আনার অবস্থানে রয়েছে ইউক্রেন।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধের শুরু থেকেই তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের এককাট্টা সমর্থন পেয়ে আসছিল ইউক্রেন। গত জানুয়ারিতে ট্রাম্প ক্ষমতায় বসার পর সেই সমর্থন অনেকটাই কমে। পাশাপাশি যুদ্ধ বন্ধের চেষ্টাও চালিয়ে যাচ্ছেন ট্রাম্প। এ লক্ষ্যে একাধিকবার ইউক্রেনের ও রাশিয়ার নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা।
এরই ধারাবাহিকতায় গত মাসে যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কা অঙ্গরাজ্যে পুতিনের সঙ্গে বৈঠক করেন ট্রাম্প। সে সময় দুজনের মধ্যে বেশ সখ্য দেখা গিয়েছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে ইউক্রেনসহ ইউরোপীয় নেতাদের শঙ্কা ছিল, আড়ালে হয়তো ইউক্রেনের দখল হওয়া ভূখণ্ডগুলো রাশিয়ার অংশ হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হতে পারে। শান্তিচুক্তির জন্য ইউক্রেনকে অঞ্চল ছাড় দেওয়ার কথা বলেছিলেন ট্রাম্পও।
এখন ট্রাম্পের অবস্থান বদলের পর সমালোচনা করে ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বুধবার বলেছেন, ইউক্রেন নিয়ে প্রেসিডেন্ট পুতিন যে লক্ষ্য নির্ধারণ করেছেন, তা অর্জন করতে এবং নিজেদের স্বার্থ রক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত করতে বিশেষ সামরিক অভিযান চালিয়ে যাবে রাশিয়া। রাশিয়ার বর্তমান ও ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে এটি করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
জেলেনস্কির সঙ্গে বৈঠকের পর রাশিয়াকে ‘কাগুজে বাঘ’ বলে উল্লেখ করেছিলেন ট্রাম্প। এমন মন্তব্যের বিরোধিতা করেন পেসকভ। যদিও নিজেদের অর্থনৈতিক সমস্যার কথা স্বীকার করেন তিনি। পেসকভ বলেন, রাশিয়া নিজেদের সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখছে। তবে এটি সত্যি যে অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে নানা সমস্যা ও উদ্বেগ রয়েছে।
ট্রাম্পের মন্তব্যে রাশিয়া নাখোশ হলেও এতে বেশ খুশি হয়েছেন জেলেনস্কি। মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠকের পর সাংবাদিকদের তিনি বলেন, আলোচনা ‘ভালো ও গঠনমূলক’ হয়েছে। ট্রুথ সোশ্যালে ট্রাম্পের মন্তব্যকে ‘বড় পরিবর্তন’ বলে উল্লেখ করেন তিনি। পরে ফক্স নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জেলেনস্কি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র–ইউক্রেন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে কাছাকাছি রয়েছে।
ট্রাম্পের মন্তব্যের প্রশংসা করেছেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্র নীতিবিষয়ক প্রধান কাজা কালাস। বুধবার তিনি বলেন, ‘এটি খুবই জোরালো বক্তব্য। এমনটা আমরা আগে এ ধরনের পরিসরে শুনিনি। তাই এখন আমরা একই ধরনের বোঝাপড়ায় পৌঁছেছি। বিষয়টি সত্যিই ভালো।’
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: য ক তর ষ ট র র ইউক র ন র র পর স
এছাড়াও পড়ুন:
রাজনৈতিক দলগুলোকে শান্তিপূর্ণ উপায়ে সংস্কারের প্রতি প্রতিশ্রুতি দেখাতে হবে
বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্রের অবনতির পর্বে, গণতান্ত্রিক উত্তরণের পথে হাঁটছে বাংলাদেশ। এ জন্য সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। গণতন্ত্রের পথে উত্তরণে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে সংস্কারের প্রতি শান্তিপূর্ণ উপায়ে প্রতিশ্রুতি দেখাতে হবে।
চলতি মাসে বাংলাদেশ ঘুরে যাওয়া ইউরোপীয় পার্লামেন্টের মানবাধিকারবিষয়ক উপকমিটির প্রতিবেদনে এ মন্তব্য করা হয়েছে।
গতকাল বুধবার ফ্রান্সের স্ত্রাসবুর্গে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের দপ্তরে প্রতিবেদনটি পেশ করা হয়েছে। প্রতিবেদন উপস্থাপনের বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ সফরে আসা প্রতিনিধিদলের প্রধান মুনির সাতোরি।
মুনির সাতোরি বলেন, ‘আমাদের সফরের দুটি উদ্দেশ্য ছিল। একটি হচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার কার্যক্রম পর্যালোচনা করা ও গণতান্ত্রিক উত্তরণে মানবাধিকারের গুরুত্ব তুলে ধরা। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, প্রায় বিস্মৃত হতে যাওয়া রোহিঙ্গাদের পাশে থাকা। রোহিঙ্গা সংকট যাতে হারিয়ে না যায়, সে জন্য এটি ইইউর রাজনৈতিক এজেন্ডায় আবারও অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।’
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কারকাজ নিয়ে মুনির সাতোরি বলেন, ‘এখনো কিছু চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। এ ক্ষেত্রে আমরা সহযোগিতার প্রস্তাব করেছি।’
প্রতিনিধিদলের সদস্য ইজাবেল উইসেলার-লিমা বলেন, যখন বিশ্বে নাটকীয়ভাবে গণতন্ত্র অবনতির পথে, তখন বাংলাদেশ পথ পরিবর্তন করে দেখিয়েছে যে গণতন্ত্রের পথে যাওয়া যায়। তারা চেষ্টা করছে গণতন্ত্রের দিকে যাওয়ার। আর এ জন্য সংস্কার কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। এটা আশা করা জরুরি যে সামনে নির্বাচন হবে এবং তা প্রতিযোগিতামূলক হবে, যা হওয়া উচিত। অন্তর্বর্তী সরকার এ জন্য চেষ্টা করছে।
রোহিঙ্গাদের প্রসঙ্গে ইজাবেল বলেন, ‘কক্সবাজার বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবির। সম্প্রতি ইউক্রেন যুদ্ধ এবং গাজা সংকটের কারণে রোহিঙ্গা সংকটের বিষয়টি মানুষ ভুলে যাচ্ছে। এ সংকট আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত নয়। রোহিঙ্গা পরিস্থিতি কঠিন হয়ে উঠেছে। কারণ, মিয়ানমার তাদের দায়িত্ব নিচ্ছে না। আর বাংলাদেশও দরিদ্র দেশ। বাংলাদেশের নিজেরই বিশাল জনসংখ্যা রয়েছে। ফলে রোহিঙ্গাদের জনগোষ্ঠীর মধ্যে নিয়ে নেওয়া তাদের জন্য সম্ভব নয়। রোহিঙ্গা সংকটের এখনকার চ্যালেঞ্জ হচ্ছে বাংলাদেশ বর্তমানে গণতন্ত্রের পথে উত্তরণে অবস্থায় রয়েছে।’
প্রতিনিধিদলের আরেক সদস্য আরকাদিউজ মুলারজিক বলেন, ‘রোহিঙ্গা শিবিরে সবচেয়ে বেশি মানবিক অনুদান আসে ইউরোপের রাষ্ট্রগুলো থেকে, যদিও আগে যুক্তরাষ্ট্র সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা দিত। মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর পক্ষ থেকে রোহিঙ্গাদের প্রতি প্রতিশ্রুতি খুবই নগণ্য, এটি আশ্চর্যজনক এবং গ্রহণযোগ্য নয়। মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর বদলে অনেক দূরে থাকা ইউরোপের রাষ্ট্রগুলোকে এর দায়িত্ব নিতে হচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে রোহিঙ্গা মুসলিমদের জন্য মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর বড় অংশগ্রহণকারী হওয়া উচিত ছিল। বিষয়টি নিয়ে ভারতের সঙ্গেও কথা বলা উচিত। কারণ, বর্তমানে আমরা ভারতের সঙ্গে একটি চুক্তি নিয়ে দর–কষাকষি করছি।’
বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিনিধিদলের সদস্য ক্যাটারিনা ভিয়েরা বলেন, এটি পরিষ্কার যে বাংলাদেশ ইতিহাসে দেশটি বর্তমানে একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এটি একটি সুযোগ সত্যিকারের অগ্রগতির। শিগগিরই হয়তো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। বাংলাদেশের ভেতরে গ্রহণযোগ্য গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সবাই নির্বাচনটি স্বচ্ছ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক দেখতে চায়। এ বিষয়গুলো শুধু রাজনৈতিক নেতৃত্বের থেকে আসেনি, এসেছে নাগরিক সমাজ, ছাত্র ও যুব আন্দোলনের পক্ষ থেকেও, যাদের সঙ্গে আমরা আলোচনা করেছি। তারা নিজেদের মধ্যে সংলাপের মধ্যে রয়েছে। যদিও অনুতাপের বিষয় হচ্ছে ধর্মীয়, লিঙ্গ ও নৃতাত্ত্বিক সংখ্যালঘু এবং নারীদের এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অংশগ্রহণ নেই। ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের সমাজ গঠনে এখানে উন্নয়নের সুযোগ রয়েছে।
আরকাদিউজ আরও বলেন, ‘বাংলাদেশে সংস্কারে উৎসাহ, যারা সংস্কারে কাজ করছেন, তাঁদের প্রতি সংহতি প্রকাশ ও গণতান্ত্রিক কাঠামোয় গঠনমূলক সহযোগিতা করে ইইউ ভূমিকা রাখতে পারে। বিশ্ব যখন গণতন্ত্রের উল্টো পথে যাত্রা করছে, তখন বাংলাদেশ নিয়ে আমাদের আশা করার অবকাশ রয়েছে। গণতন্ত্রের পথে আরও অনেক কাজ করতে হবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহায়তায় বাংলাদেশ সামনে দিকে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নেবে বলে মনে করি। এটি এখন নির্ভর করছে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর, বিশেষ করে রাজনৈতিক দলগুলোকে সংস্কারের প্রতি শান্তিপূর্ণ উপায়ে প্রতিশ্রুতি দেখাতে হবে।’
১৬ থেকে ১৮ সেপ্টেম্বর ইউরোপীয় পার্লামেন্টের মানবাধিকার উপকমিটির পাঁচ সদস্যের প্রতিনিধিদলটি বাংলাদেশ সফর করে। এ সময়ে তারা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতিনিধি, রাজনৈতিক দল, বেসরকারি সংস্থা, নাগরিক সমাজ সংগঠন, শ্রমিক প্রতিনিধি এবং মাঠপর্যায়ে কর্মরত বহুপক্ষীয় সংস্থার প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করে।
এ ছাড়া প্রতিনিধিদলটি কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থীশিবিরও পরিদর্শন করে।