উপকূলে ঘরবাড়ি হারিয়ে শহরের বস্তিতে মোবারক, দুর্ভোগের শেষ নেই
Published: 10th, November 2025 GMT
সামাদ সানা ছিলেন সচ্ছল। বসতবাড়ি খুলনার কয়রার চরামুখা গ্রামে। নদীভাঙন আর ঘূর্ণিঝড়ের ধাক্কায় সব হারিয়ে এখন নদীর চরে অস্থায়ী ঘরে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন। তাঁর স্ত্রী আনজুয়ারা বেগম বলেন, ‘চার বিঘা জমি ছিল, এখন কিচ্ছু নেই। নদীর নোনাপানিতেই গোসল, রান্না—সব করতি হয়। খাবার পানি আনতি হয় দূর থেইকে। নদীর সঙ্গে যুদ্ধ কইরেই বাঁইচে আছি আমরা।’
এমন গল্প উপকূলের প্রায় প্রতিটি পরিবারেরই। শাকবাড়িয়া নদী–তীরের মোবারক হোসেন ২২ বিঘা চিংড়িঘের ও পাকা ঘর হারিয়ে শহরের বস্তিতে ঠাঁই নিয়েছেন। কয়রার বামিয়া গ্রামের কামরুল সরদার ঘূর্ণিঝড় আম্পানের পর সব হারিয়ে খুলনা শহরে দিনমজুর হিসেবে কাজ করছেন। কেউ রিকশা চালাচ্ছেন, কেউ ঠেলাগাড়ি, কেউবা ভ্যান—সবাই জীবিকার সন্ধানে গ্রাম ছেড়ে শহরমুখী।
খুলনা জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, গত ১৯ বছরে উপকূলে আঘাত হেনেছে ১৩টি ঘূর্ণিঝড়। সিডর, আইলা, ফণী, বুলবুল, আম্পান, ইয়াস—সবই রেখেছে গভীর ক্ষত। তবে বাস্তুচ্যুত মানুষের সঠিক সংখ্যা নেই সরকারের কাছে। নরওয়েভিত্তিক আইডিএমসির হিসাবে, শুধু ২০২৪ সালেই বাংলাদেশে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা ২৪ লাখের বেশি।
এমন বাস্তবতায় আজ সোমবার থেকে ব্রাজিলের বেলেম শহরে শুরু হচ্ছে বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন কপ-৩০। ১১ দিনব্যাপী এই সম্মেলনে বাংলাদেশ জোরালোভাবে দাবিগুলো তুলে ধরার প্রস্তুতি নিয়েছে।
দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ প্রতিনিয়ত জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহতার সঙ্গে যুদ্ধ করছে। খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটের বিস্তীর্ণ উপকূল এখন ঝড়, জলোচ্ছ্বাস এবং নদীভাঙনের চক্রে বিপর্যয়ের কেন্দ্রবিন্দু। স্থানীয় লোকজন জানাচ্ছেন, প্রতিবছর ক্ষতির পরিমাণ বেড়েই চলছে।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, ঘূর্ণিঝড় ও নদীভাঙনের কারণে উপকূলীয় মানুষের জীবনযাত্রা, কর্মসংস্থান ও স্বাস্থ্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রায় ৩০ শতাংশ মানুষ খাবারের পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছেন, অনেকেই পুষ্টিকর খাদ্য থেকে বঞ্চিত। নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশনের অভাবে নারী ও মেয়েদের মধ্যে জরায়ু ও প্রজননজনিত রোগ আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে।
গবেষণাটি পরিচালনা করেছেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘উপকূলে লবণাক্ততা ও কর্মসংস্থানের অভাবে মানুষ ঘরবাড়ি হারিয়ে শহরের বস্তিতে আশ্রয় নিচ্ছে। কিন্তু সেখানেও দারিদ্র্য, জলাবদ্ধতা ও নোংরা পরিবেশে তাদের দুর্ভোগের শেষ নেই।
উপকূলীয় কয়রা উপজেলার ঘোড়িলাল গ্রামের অহিদুল ইসলাম বলেন, ‘একসময় ধানভরা মাঠ ছিল, এখন সব ঘেরের নিচে। লবণাক্ততার কারণে জমি মরে গেছে। এখন আমরাই অন্য জেলায় ধান কাটতে যাই।’
হড্ডা গ্রামের আমেনা বেগমের কথায় উঠে আসে লবণাক্ততার নির্মমতা। তিনি বলেন, ঘেরের নোনাপানিতে গাছপালা মরে যাচ্ছে, মানুষ পেটের সমস্যা আর চর্মরোগে ভুগছেন। যদি এমনই চলে, এলাকা বসবাসের অযোগ্য হয়ে যাবে।
১৯৭৩ সালে দেশে ৮ লাখ ৩৩ হাজার হেক্টর লবণাক্ত জমি থাকলেও ২০২২ সালের জরিপে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১১ লাখ হেক্টরে। গত ৫০ বছরে লবণাক্ত জমি বেড়েছে প্রায় ২৬ শতাংশ।মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের (এসআরডিআই) সর্বশেষ জরিপে দেখা গেছে, খুলনার মাটির লবণাক্ততা ৫ দশমিক ৯৭ থেকে ১২ দশমিক ০২ ডিএস/মিটার পর্যন্ত পৌঁছেছে। ১৯৭৩ সালে দেশে ৮ লাখ ৩৩ হাজার হেক্টর লবণাক্ত জমি থাকলেও ২০২২ সালের জরিপে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১১ লাখ হেক্টরে। গত ৫০ বছরে লবণাক্ত জমি বেড়েছে প্রায় ২৬ শতাংশ।
সাতক্ষীরার সোনাখালীর কবির গাজী বলেন, ‘চার বছর ধরে বাড়ির উঠানে একটা আমগাছ লাগানোর চেষ্টা করছি, কিন্তু প্রতিবছরই শুকিয়ে মরে যায়। চিনি মিশিয়ে মাটিকে মিষ্টি করার চেষ্টা করছিলাম, তাতেও লাভ হলো না।’
কয়রার মহেশ্বরীপুর, মঠবাড়ি ও সোনাপাড়া এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, নারীরা নদীর নোনাপানিতে গোসল ও গৃহস্থালির কাজ করছেন। মহেশ্বরীপুর গ্রামের আম্বিয়া বেগম বলেন, ‘নোনাপানির কারণে মেয়েদের ছোট বয়সেই বিয়ে দিতে হয়, না হলে চেহারা কালো হয়ে যায়। দূরের আত্মীয়স্বজন আসতেও চান না।’
কয়রার মহেশ্বরীপুরের কমিউনিটি ক্লিনিকের স্বাস্থ্যকর্মী সুলতা মণ্ডল বলেন, লবণাক্ততার কারণে এখানে চর্মরোগ, পেটের পীড়া ও উচ্চ রক্তচাপ সাধারণ সমস্যা। সবচেয়ে বেশি ভোগেন গর্ভবতী মায়েরা—অপরিণত সন্তানপ্রসব ও ভ্রূণ নষ্ট হওয়ার ঘটনা বেড়েছে।
বাঁধের বাইরে আশ্রয় নেওয়া লোকজনের আবাসস্থল পানিতে ডুবে গেছে। সম্প্রতি খুলনার কয়রার সুন্দরবনসংলগ্ন শাকবাড়িয়া নদীর তীর থেকে.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ঘ র ণ ঝড় উপক ল কয়র র
এছাড়াও পড়ুন:
শেখ হাসিনার মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ, আত্মপক্ষ সমর্থন ১৭ নভেম্বর
পূর্বাচলে প্লট বরাদ্দে দুর্নীতির অভিযোগে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ১২ জনের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়েছে। একই সঙ্গে এই মামলায় আসামিদের আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য ১৭ নভেম্বর তারিখ ধার্য করা হয়েছে। ঢাকার বিশেষ জজ-৫–এর বিচারক মোহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মামুনের আদালত আজ সোমবার এই তারিখ ধার্য করেন।
আদালতে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সহকারী পরিচালক আফনান জান্নাতকে আসামি খুরশীদ আলমের আইনজীবী শাহিন উর রহমান জেরা করেন। তদন্তকারী কর্মকর্তার জেরা শেষ হওয়ায় আইনানুযায়ী আদালত আসামির আত্মপক্ষ সমর্থনের তারিখ ধার্য করেন।
দুদকের পাবলিক প্রসিকিউটর শামসুদ্দিন মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ জানান, শেখ হাসিনা ছাড়াও তাঁর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের মামলায় তদন্ত কর্মকর্তার জেরা শেষ হয়েছে। আর মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার সাক্ষ্য গ্রহণ শেষে আংশিক জেরা হয়েছে।
এই তিন মামলায় গ্রেপ্তার একমাত্র আসামি খুরশীদ আলমের পক্ষে আইনজীবী শাহিন উর রহমান জেরা করেন। অন্য আসামিরা পলাতক থাকায় নিয়ম অনুযায়ী তাঁদের পক্ষে জেরার সুযোগ নেই। ১৭ নভেম্বর জয়ের মামলায় বাদীর সাক্ষ্য ও জেরার দিন, আর পুতুলের মামলার তদন্ত কর্মকর্তার জেরার তারিখ ধার্য করেন আদালত।
আদালতের বেঞ্চ সহকারী আরিফুল ইসলাম জানান, জয়ের মামলায় ২৮ ও পুতুলের মামলায় ২২ জন সাক্ষ্য দিয়েছেন।
গত বছরের ২৬ ডিসেম্বর শেখ হাসিনা ও তাঁর পরিবারের নামে বরাদ্দ নেওয়া প্লটের বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। সেদিন দুদকের মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) আক্তার হোসেন জানিয়েছিলেন, পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পের ২৭ নম্বর সেক্টরের কূটনৈতিক জোনের ২০৩ নম্বর সড়কের আশপাশের এলাকায় শেখ হাসিনা, সজীব ওয়াজেদ, সায়মা ওয়াজেদ, শেখ রেহানা ও তাঁর ছেলে-মেয়ের নামে ১০ কাঠা করে ৬০ কাঠার ছয়টি প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
প্লট বরাদ্দের দুর্নীতির অভিযোগে গত জানুয়ারিতে আলাদা ছয়টি মামলা করে দুদক। এসব মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ (পুতুল), বোন শেখ রেহানা, রেহানার মেয়ে ও ব্রিটিশ এমপি টিউলিপ রিজওয়ানা সিদ্দিক, ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ও অন্য মেয়ে আজমিনা সিদ্দিকসহ আরও অনেককে আসামি করা হয়। সব কটি মামলায় গত ১০ মার্চ অভিযোগপত্রের অনুমোদন দেয় দুদক।
মামলার অভিযোগপত্রে বলা হয়, সরকারের সর্বোচ্চ পদে থাকার সময় শেখ হাসিনা ও তাঁর পরিবার ক্ষমতার অপব্যবহার করেন। তাঁরা বরাদ্দ পাওয়ার যোগ্য না হলেও অসৎ উদ্দেশ্যে পূর্বাচল আবাসন প্রকল্পের ২৭ নম্বর সেক্টরের ২০৩ নম্বর রাস্তার ছয়টি প্লট তাঁদের বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
গত ৩১ জুলাই এই তিন মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরু হয়। এর পর থেকে শেখ রেহানা ও তাঁর তিন ছেলে-মেয়ের বিরুদ্ধে করা আলাদা তিন মামলায় এখন পর্যন্ত ৩৬ জন সাক্ষ্য দিয়েছেন। এসব মামলায় ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও আসামি।