আইয়ুবি যুগে নারীরা যেভাবে ওয়াক্ফ প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন
Published: 10th, November 2025 GMT
ইসলামি সমাজে নারী কখনো পিছিয়ে থাকেনি। পুরুষের সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে নারী এগিয়েছে সব ক্ষেত্রে—আলেমা হিসেবে, মুহাদ্দিসা হিসেবে, কবি-সাহিত্যিক হিসেবেও তাঁরা ছিলেন উজ্জ্বল। আর সেবামূলক কাজে তো তাঁরা রীতিমতো প্রতিযোগিতাই করেছেন।
ওয়াক্ফ, অর্থাৎ সম্পদকে ব্যক্তিগত ব্যবহার থেকে আলাদা করে স্থায়ীভাবে সেবামূলক কাজে লাগানো, এতে নারীদের ভূমিকা ছিল অসাধারণ।
ইসলামি সভ্যতার উন্নয়ন, সমাজকল্যাণ, অর্থনীতি, ধর্মীয় জীবন—সবকিছুতে নারীর ওয়াক্ফের ভূমিকা রয়েছে। প্রথম যুগে এটা সীমিত ছিল, যদিও ফকিহরা নারীকে ওয়াক্ফকারী ও তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে পুরোপুরি অনুমোদন দিয়েছেন।
উম্মুল মুমিনিন হাফসা (রা.) প্রথম ওয়াক্ফ ব্যবস্থার সূচনা করেন। খলিফা ওমর (রা.) মৃত্যুর আগে তাঁকে কিছু ওয়াক্ফের দায়িত্ব দেন। আব্বাসি যুগে হারুন রশিদের স্ত্রী যুবাইদা ছিলেন এ ক্ষেত্রে বিখ্যাত।
উম্মুল মুমিনিন হাফসা (রা.) প্রথম ওয়াক্ফ ব্যবস্থার সূচনা করেন। খলিফা ওমর (রা.) মৃত্যুর আগে তাঁকে কিছু ওয়াক্ফের দায়িত্ব দেন। আব্বাসি যুগে হারুন রশিদের স্ত্রী যুবাইদা ছিলেন এ ক্ষেত্রে বিখ্যাত—হজপথে কূপ খনন, কাফেলার পথে সরাই নির্মাণ করে রাষ্ট্রের দায়িত্ব পালনে সাহায্য করেন।
কিন্তু আইয়ুবি যুগে (১১৭১-১২৬০ খ্রি.) সিরিয়ায় দেশে নারীর ওয়াক্ফে সত্যিকারের বিপ্লব ঘটে। সুলতান সালাহুদ্দিন আইয়ুবি ফাতিমি শিয়া রাষ্ট্রের বদলে সুন্নি জাগরণ তৈরি করেন। দামেস্ক ইসলামি দুনিয়ার হৃদয় হয়ে ওঠে।
সুলতান আইয়ুবির সময় সমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ, তাঁদের স্ত্রী-কন্যা, সম্ভ্রান্তরা ওয়াক্ফে প্রতিযোগিতা করেন। বিখ্যাত পর্যটক ইবনে জুবাইর দামেস্ক দেখে লিখেছেন, ‘শহরের সবকিছু যেন ওয়াক্ফে ডুবে আছে, ওয়াক্ফের ছোঁয়া ছাড়া কিছু নেই।’ (ইবনে জুবাইর, রিহলাতু ইবনে জুবাইর, ১/২৫৬, দার সাদির, বৈরুত, ২০০৫)
নারী ওয়াক্ফের উত্থানের পেছনেসালাহুদ্দিনের আমলে সিরিয়া অঞ্চলে ধর্মীয়-বৈজ্ঞানিক জিহাদি আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। শিয়া প্রভাব মোছা, সুন্নি মাজহাব ছড়ানো দরকার ছিল তাদের। আইয়ুবিরা কুর্দি বংশোদ্ভূত, মধ্য এশিয়া থেকে এসে আরব–অধ্যুষিত শাম (লেভান্ট) শাসন করছেন। আগে তারা সেলজুক ও জেঙ্গি সুলতানদের অধীনে তিনি সেনাপতি ছিলেন।
ক্ষমতা মজবুত করার পথে ওয়াক্ফ ব্যবস্থাপনা তাকে ব্যাপক জনপ্রিয়তা এনে দেয়। শিক্ষিত, ধার্মিক নেতৃত্ব তৈরি করেন, যারা তাঁদের সমর্থন করবে। ওয়াক্ফের মাধ্যমে সমাজে সহানুভূতি, ঐক্য, সহমর্মিতা ছড়ান, যা জিহাদ, ইলম ও আমলে প্রতিফলিত হয়। নারীরা এই রাষ্ট্রীয় নীতিতে সক্রিয় অংশ নেন। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, সমাজসেবা, খয়রাত—সব মিলিয়ে ওয়াক্ফের ঝড় ওঠে বলা যায়।
আরও পড়ুনমুসলিম নারী ক্যালিগ্রাফারদের গল্প১৫ জুন ২০২৫বিখ্যাত নারী ওয়াক্ফকারীরাআইয়ুবি সুলতান-আমিরদের স্ত্রী-কন্যারা ‘খাতুনিয়াত’ নামে পরিচিত ছিলেন। এই সকল খাতুন ছেলেদের জন্যও মাদ্রাসা, হাদিস-ফিকহ শেখানোর ব্যবস্থা করেন। দামেস্ক কেন্দ্র হলেও সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে তাদের ওয়াক্ফ প্রতিষ্ঠান। এই সব ‘খাতুন’র কয়েকজন হলেন:
আসমাতুদ্দিন খাতুন: তিনি সুলতান সালাহুদ্দিনের স্ত্রী। দামেস্কে খাতুনিয়া জুওয়ানিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। ইবনে তুলুন বলেন, ‘তিনি নারীদের মধ্যে সবচেয়ে উত্তম, দানশীলতা ও সৌন্দর্যে ছিলেন অতুলনীয়।’ (ইবনে তুলুন, আল-কালাইদুল জাওহারিয়া ফি তারিখিস সালিহিয়া, ১/১২৫, মাজমাউল লুগাতিল আরাবিয়া, দামেস্ক, ১৯৮০)
খাতুন সিত্তুশ শাম বিনতে আইয়ুব: তিনি সুলতান আইয়ুবের বোন এবং পরবর্তী বাদশাদের খালা। দানশীলতায় ছিলেন বিখ্যাত। তাঁকে ‘দরিদ্রদের মা’ বলা হতো। তিনি শাফেয়ি মাজহাবের অনুসারীদের জন্য ‘শামিয়া বারানিয়া মাদ্রাসা’ নির্মাণ করেন। এবং প্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য বাগান, খেত, আয়ের উৎস হিসেবে বিপুল জমি ওয়াক্ফ করেন। (আহমদ রিদা, মাদারিসুল খাতুনিয়াতি ওয়াল আমিরাতিল আইয়ুবিয়াতি ফি বিলাদিশ শাম ফিল আসরিল আইয়ুবি, ৭/৪, পৃষ্ঠা ৪৫, কুল্লিয়াতুত তারবিয়াতিল ইসলামিয়া, মোসুল, ২০০৮)
রাবিয়া খাতুন: সালাহুদ্দিনের বোন। তিনি হাম্বলি মাজহাবের অনুসারীদের জন্য ‘সাহিবিয়া মাদ্রাসা’ প্রতিষ্ঠা করেন। কয়েকটি গ্রামের জন্য নহর খনন করেন, বাগান নির্মাণ করেন এবং সর্বসাধারণের সুপেয় পানির ব্যবস্থা করেন।
তিনি দৈনিক ২ দিরহাম (রৌপ্যমুদ্রা) মাদ্রাসায়, ১ দিরহাম সহকারী শিক্ষককে দিতেন, ২০ জন ছাত্রের প্রত্যেককে দিতেন অর্ধ দিরহাম করে এবং তাদের সবার খাওয়া-থাকা সব ব্যবস্থা করতেন।তিনি দৈনিক ২ দিরহাম (রৌপ্যমুদ্রা) মাদ্রাসায়, ১ দিরহাম সহকারী শিক্ষককে দিতেন, ২০ জন ছাত্রের প্রত্যেককে দিতেন অর্ধ দিরহাম করে এবং তাদের সবার খাওয়া-থাকা সব ব্যবস্থা করতেন। (আব্দুল কাদির আদ-দিমাশকি, আদ-দারিস ফি তারিখিল মাদারিস, পৃষ্ঠা ১৮৭, আল-হাইয়াতুল আম্মাতুস সুরিয়া লিল কিতাব, দামেস্ক, ২০১৪)
সাফিয়া খাতুন: সালাহুদ্দিনের পুত্র গাজির স্ত্রী। তিনি ‘ফিরদাউস মাদ্রাসা’ প্রতিষ্ঠা করেন। এ ছাড়া মসজিদ, কবরস্থান, সামাজিক বৈঠকখানাসহ প্রথম বহুমুখী কমপ্লেক্স নির্মাণ করেন; যেখানে শিক্ষা, ইবাদত, সমাজসেবা এক ছাদের নিচে স্থান পায়।
এ ছাড়া সাধারণ ধনী ও আলেমা নারীদের মধ্যে ছিলেন উম্মুল লতিফ বিনতে নাসিহ আল-হাম্বলি, যিনি দামেস্কে আলেমা মাদ্রাসা ও বিশাল লাইব্রেরি করেন, যেখানে হাজার হাজার বই ছিল। সপ্তম হিজরি শতাব্দী তিনি মুসাফির, সুফি, দরিদ্রদের আশ্রয় দিতে সরাইখানা ও খানকা তৈরি করেন। তার মধ্যে অন্যতম ছিল ‘সাফিয়া কালইয়া’ ও ‘যাহরা রিবাত’। (উদা আশ-শারআ, আওকাফুল মারআ ফি দিমাশক ফিল আহদিল আইয়ুবি, পৃষ্ঠা ৯৮, প্রথম সংস্করণ, ২০১১)
আরও পড়ুনহিজরতে মহানবী (সা.)–কে সাহায্য করলেন দৃঢ়চেতা এক নারী২৯ জুন ২০২৫নারীদের ওয়াক্ফের প্রভাবআইয়ুবি যুগে নারীদের ওয়াক্ফ ব্যবস্থাপনা ছিল পূর্ববর্তী যুগ থেকে আলাদা। শুধু আমির-উমারা শ্রেণির নারী নয়, বরং সাধারণ ধনী, আলেমা সবাই এতে অংশ নেন। দামেস্ক কেন্দ্র হলেও গ্রাম-শহর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে এই ধারা। এর প্রভাব হয় গভীর:
১. সাংস্কৃতিক পরিচয় গড়া: প্রতি ওয়াক্ফে মসজিদ ছিল এবং ছিল মাদ্রাসাও। সেখানে ছাত্র-শিক্ষক একত্রে নামাজ পড়েন। ফলে তাদের ইসলামি পরিচয় মজবুত হয়। উমাইয়া মসজিদ, আকসা মসজিদ প্রভৃতি উসমানি যুগ পর্যন্ত ছিল ধর্মশিক্ষা কেন্দ্র।
২. সাংস্কৃতিক-ধর্মীয় উন্নয়ন: এই ওয়াক্ফ ব্যবস্থাপনার ফলে তখন শিক্ষায় বিপ্লব ঘটে যায়। মাদ্রাসা-খানকায় খাবার, থাকা, চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকায় ধর্মীয় সংস্কৃতি সমাজে ভিত্তি গেড়ে নেয়। স্বাধীন অর্থায়নের ফলে রাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীলতা কমে আসে। দামেস্কে শিক্ষার্থীরা ভিড় করে। আলেম ও জ্ঞানীদের সংখ্যা বাড়ে। মাদ্রাসা থেকে ইবনে তাইমিয়া, ইবনে জাওজির মতো বিচারক, আলেম, রাজনীতিবিদ বের হয়।
আইয়ুবি যুগে নারীদের ওয়াক্ফ ব্যবস্থাপনা ছিল পূর্ববর্তী যুগ থেকে আলাদা। শুধু আমির-উমারা শ্রেণির নারী নয়, বরং সাধারণ ধনী, আলেমা সবাই এতে অংশ নেন।৩. সচেতনতা বৃদ্ধি: বিদআত রোধ হয়, মাজহাবি বিভ্রান্তি দূর হয়। ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে জিহাদি প্রজন্ম তৈরি হয়।
৪. সামাজিক স্থিতিশীলতা: তালাকপ্রাপ্তা, বিধবা, এতিম, মুক্ত দাস, দরিদ্ররা যুদ্ধের কঠিন আঘাত থেকে রক্ষা পায়। ধনী-দরিদ্র সবাই সুবিধা পাওয়ার ফলে বৈষম্য কমে আসে। সমাজে ভ্রাতৃত্ব বাড়ে।
৫. গ্রামীণ অর্থনৈতিক উন্নয়ন: এর আগে শহরকেন্দ্রিক ওয়াক্ফ ব্যবস্থাপনা থাকায় গ্রাম থেকে লোক শহরে আসতেন, জনসংখ্যা সংকট তৈরি করত। কিন্তু গ্রামে বাগান, তেলের মিল, সুপেয় পানির ব্যবস্থা হওয়ায় গ্রাম জেগে ওঠে, কৃষকেরা গ্রামে স্থায়ী হন এবং ফসলের ব্যাপক উন্নয়ন হয়। ফলে সারা দেশে খাদ্যে জোগান স্বাভাবিক থাকে।
আজকের নারী কীভাবে এ ভূমিকা পুনরুদ্ধার করবেআজ আরব-মুসলিম সমাজে নারীর অধিকার নিয়ে অনেক কথা হয়। সংসদে আইন, সংবিধানে ধারা—কিন্তু ওয়াক্ফসহ সেবামূলক কাজে অংশগ্রহণ খুব কম। আইয়ুবি যুগে নারী ওয়াক্ফ সমাজকে নতুন রূপ দিয়েছে। উসমানি যুগে তা চূড়ান্ত হয়।
দামেস্ক হয়ে ওঠে জ্ঞান-ধর্ম-ব্যবসা-স্থাপত্যের কেন্দ্র। আলেম, ছাত্র, দরিদ্র, ধনী, ব্যবসায়ী, স্থপতি—সবাই ছুটে আসে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকলেও প্রভাব ছিল গভীর।
আরও পড়ুনফকিহদের দৃষ্টিতে নারী-পুরুষের মধ্যকার প্রেম–ভালোবাসা২৬ জুলাই ২০২৫উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ন র ম ণ কর র ব যবস থ র জন য দর দ র দ রহ ম ইসল ম আইয় ব মসজ দ প রথম
এছাড়াও পড়ুন:
রাতে বিএনপির জরুরি বৈঠক
দেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে দলের স্থায়ী কমিটির জরুরি বৈঠক ডেকেছেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
সোমবার (১০ নভেম্বর) রাত সাড়ে আটটায় বিএনপি চেয়ারপার্সনের গুলশান কার্যালয়ে বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হবে।
আরো পড়ুন:
কিশোরগঞ্জ-২ আসনে বিএনপির প্রার্থীর মনোনয়ন বাতিলের দাবি
শেখ হাসিনাকে জিয়াউর রহমানের অর্ধাঙ্গিনী বলা সেই বিএনপি নেতাকে শোকজ
বৈঠকে লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হবেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
এ বিষয়টি সাংবাদিকদের নিশ্চিত করেছেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন।
তিনি জানান, আজকের বৈঠকে কোনো নির্দিষ্ট এজেন্ডা থাকছে না। খোলামেলা আলোচনা। তবে বৈঠকটি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ।
কী বিষয়ে এই বৈঠক ডাকা হয়েছে তা সুনির্দিষ্টভাবে জানা যায়নি। তবে স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য বলেন, “জরুরি কোনো বিষয়ে আলাপ করতেই বৈঠক ডাকা হয়েছে।”
ঢাকা/নঈমুদ্দীন/সাইফ