Prothomalo:
2025-11-10@12:18:04 GMT

বাড়ন্ত শহরে কোণঠাসা শৈশব-কৈশোর

Published: 10th, November 2025 GMT

শহরের একটি শান্ত সকাল। এমন সকালে প্রশস্ত, ছায়াঢাকা ফুটপাত ধরে হেঁটে হেঁটে স্কুলে যাচ্ছে দুই ভাইবোন। তারা হাঁটছে হাত–ধরাধরি করে। এমন একটা দৃশ্যের কথা ভাবুন তো। কী সুন্দর ছবি! প্রতিটি পরিবারে কিছু সুখের ছবি থাকে। ঠিক তেমনই এই ছবিও একটি নগরের সুখের ছবি।

শহরের এমন একটি ছবি তৈরি করতে অনেক নগরচিন্তক, নগরকারিগর ও প্রতিষ্ঠানকে চিন্তাশীল অবদান রাখতে হয়। শহরের দীর্ঘমেয়াদি সঠিক পরিকল্পনার চর্চা, সে অনুযায়ী অবকাঠামোর উন্নয়ন, নিরাপত্তা—সব মিলিয়ে এমন দৃশ্য তৈরি হয়। আর আমার কাছে শহরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে মানুষ এবং তার জন্য গণপরিসর সৃষ্টি ও সংরক্ষণ করা।

গণপরিসর ও স্বাস্থ্য অবকাঠামো নগরে শিশু–কিশোরদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য অপরিহার্য। খেলার মাঠ, উদ্যান, জলাশয়, নদী, নির্মল বাতাস, সবুজ বনানী, নিরাপদ ফুটপাত—একটি নগরের গণপরিসর ও স্বাস্থ্য অবকাঠামোর অংশ। এসবই নগরের প্রাণ।

সফল শহরের সার্থকতা নির্ভর করে এর গণপরিসর কতটা উন্মুক্ত, কতটা সুন্দর করে ব্যবহার করা হয় এবং শহর কর্তৃপক্ষ কতটা সুন্দরভাবে তা গুছিয়ে রাখতে পারে, তার ওপর। নগরজীবনে গণপরিসরকে এমনভাবে বিন্যাস করা উচিত, যাতে মানুষে মানুষে অর্থপূর্ণভাবে দেখা করা, কথা বলা এবং সামাজিক কাজে অংশগ্রহণের সুযোগ তৈরি করে দিতে পারে।

আমাদের দেশের নগরগুলোয় সঠিক পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়ন এবং সুশাসনের অভাবে শিশু–কিশোরদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করা যায়নি। দেশের গণপরিসর উন্নয়ন, ব্যবস্থাপনা ও ব্যবহারের ধরন খেয়াল করলে দেখা যাবে, এখানে নগরের প্রায় সব পরিসরেই ক্ষমতাবান, সক্ষম ও সামর্থ্যবান ব্যক্তির অভিপ্রায় প্রাধান্য পেয়েছে। 

নারী, শিশু, বৃদ্ধ ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষের উপযোগী শহর এ দেশে তৈরি হয়নি। এখানে মালিকানাবিহীন যৌথ পরিসর ব্যবহারের ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক দর্শন সংকুচিত হয়েছে। এ কারণে আমাদের শহরাঞ্চলে নগরজীবন কখনো আরামদায়ক হয়ে গড়ে ওঠেনি। নগরে বসবাসকারী মানুষের চাহিদার প্রতি সংবেদনশীল আচরণ না দেখালে সবার জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক নগর কোনো দিন নিশ্চিত করা যাবে না।  

নগর–পরিকল্পনার ভাষায় আমরা বলি, একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি ১৫ মিনিট হাঁটা দূরত্বে যেন একটি খেলার মাঠ অথবা পার্কের মতো একটি গণপরিসর পেয়ে যান।

স্বাস্থ্য অবকাঠামো

গণপরিসরের উপাদানগুলো সরাসরি জনস্বাস্থ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত, তাই এই উপাদানকে আমরা স্বাস্থ্য অবকাঠামো বলি। এর মধ্যে উদ্যান বা পার্ক, উন্মুক্ত স্থান, খেলার মাঠ যেমন আছে, তেমনি আছে নদী, লেকসহ বিভিন্ন জলাশয়, সবুজ বনানী ও রাস্তাঘাট। 

রাস্তা ও এর দুই পাশের ফুটপাত নগরজীবনে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত ও গুরুত্বপূর্ণ গণপরিসর। এ ছাড়া স্টেডিয়াম, ব্যায়ামাগার, কমিউনিটি স্পেস, স্পোর্টস কমপ্লেক্স, কমিউনিটি লাইব্রেরি, নদীর তীর, খোলা প্রান্তরকে গণপরিসরের অংশ হিসেবে ধরা হয়। 

নিরাপদ ও প্রশস্ত খেলার মাঠ ও উন্মুক্ত স্থান শিশু–কিশোরদের সুস্থভাবে বেড়ে ওঠার জন্য অত্যন্ত জরুরি। তেমনই নারী ও বয়স্ক মানুষসহ সবার জন্য পার্ক বা উদ্যান প্রয়োজন। 

আমাদের ছোটবেলায় মাঠ ছাড়া একটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও কল্পনা করা যেত না। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, পাড়া, মহল্লা বা ওয়ার্ডে পর্যাপ্ত খেলার মাঠ থাকা দরকার। নগরে খোলা আকাশের নিচে দৌড়ানো, সাইকেল চালানো, খেলাধুলার জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা থাকা দরকার। খেলাধুলা, বিতর্ক, বিজ্ঞান মেলা, স্কাউটিং ইত্যাদি সহশিক্ষা কার্যক্রম স্কুলের পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত থাকতে হবে। 

শহরে পর্যাপ্ত সবুজ পরিবেশ ও জলাশয়ের ব্যবস্থা প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সংযোগ ঘটায়। লাইব্রেরি, শিশু–কিশোর ক্লাব, সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, আর্ট ও ক্র্যাফট কর্মশালা, সিনেমা, থিয়েটার ইত্যাদি বিনোদন ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রম শিশু–কিশোরদের পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলে। 

রাজধানীর লক্ষ্মীবাজারের এই ছবি প্রথম আলোয় ছাপা হয় ২০২২ সালে। পরে বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমারের সামনে থেকে শিশুদের খেলাধুলার স্থাপনা সরানো হয়েছে.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: স ব স থ য অবক ঠ ম ব যবস থ র জন য ব যবহ শহর র নগর র

এছাড়াও পড়ুন:

এম এন লারমার জীবন: আত্মত্যাগের এক অনন্য দলিল

পার্বত্য চট্টগ্রামের জাতিসত্তাগুলোর স্বীকৃতি ও আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের এক কেন্দ্রবিন্দু। এই সংগ্রামের কেন্দ্রস্থলে ছিলেন মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা (এম এন লারমা) ও তাঁরই অনুজ জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা)। তাঁদের সংগ্রাম, নেতৃত্ব ও আত্মত্যাগ এখানকার আদিবাসী জাতিসত্তাগুলোর জীবন ও চেতনাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে।

শৈশব ও জাগরণ

রাঙামাটির মহাপুরম গ্রামে এম এন লারমা জন্মগ্রহণ করেন ১৯৩৯ সালে, আর তাঁর ছোট ভাই সন্তু লারমা ১৯৪৪ সালে। এম এন লারমা ১৯৫৬ সাল থেকে ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে রাজনৈতিক জীবনে পা দেন। ১৯৫৭ সালে অনুষ্ঠিত প্রথম পাহাড়ি ছাত্র সম্মেলনে তিনি অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন। ১৯৫৮ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নে যোগ দেন।

কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের কারণে হাজারও মানুষের বাস্তুচ্যুতি তাঁকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছিল। তিনি ১৯৬১ সালে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলেন এবং ১৯৬৩ সালে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের কারণে নিবর্তনমূলক আইনে তিনি গ্রেপ্তার হন। ১৯৬৫ সালে তিনি আবার কারাগার থেকে মুক্ত হন। সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তিনি এক দূরদৃষ্টিসম্পন্ন রাজনৈতিক নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।

রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও প্রতিরোধ সংগ্রাম

১৯৬০ ও ৭০-এর দশকে লারমা ভ্রাতৃদ্বয়ের আন্দোলন তাঁদের রাজনৈতিক নেতৃত্বে পরিণত করে। এম এন লারমা ১৯৭০ সালে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে চার দফাসংবলিত আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবিনামা পেশ করেন।

১৯৭২ সালে যখন সংবিধান সব নাগরিককে ‘বাঙালি’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করে, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য অস্বীকার করে, তখন এম এন লারমা এর প্রতিবাদস্বরূপ গণপরিষদ থেকে ওয়াকআউট করেন। বাংলাদেশ গণপরিষদ বিতর্কের সময় তিনি বলেছিলেন, ‘আমি যে অঞ্চল থেকে এসেছি, সেই পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীরা যুগ যুগ ধরে বাংলাদেশে বাস করে আসছে। বাংলাদেশের বাংলা ভাষায় বাঙালিদের সঙ্গে লেখাপড়া শিখে আসছি। বাংলাদেশের সঙ্গে আমরা ওতপ্রোতভাবে জড়িত।...কিন্তু আমি একজন চাকমা। আমার বাপ, দাদা চৌদ্দপুরুষ—কেউ বলে নাই, আমি বাঙালি।’

তিনি আরও বলেছিলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে আমরা দশটি ছোট ছোট জাতি বাস করি। চাকমা, মগ (মারমা), ত্রিপুরা, লুসাই, বোম, পাংখো, খুমি, খিয়াং, মুরং ও চাক—এই দশ ছোট ছোট জাতি সবাই মিলে আমরা নিজেদের “পাহাড়ি” বা “জুম্ম জাতি” বলি।’

এম এন লারমা শুধু পার্বত্য অঞ্চলের বিভিন্ন জাতিসত্তার অধিকারের কথাই বলেননি। গণপরিষদ বিতর্কের সময় তিনি দেশের মাঝিমাল্লা, জেলে, প্রান্তিক কৃষক, রিকশাচালক, কলকারখানার শ্রমিক, নারী থেকে শুরু করে সব প্রান্তিকের মানুষের অধিকারের কথা তুলে ধরেছিলেন এবং সংবিধানে তাঁদের অধিকার নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছিলেন।

১৯৭২ সালে তিনি পাহাড়ের রাজনৈতিক সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তী সময় তিনি ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রতিনিধি নির্বাচিত হন। একই বছর তিনি জনসংহতি সমিতির সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি পাহাড়ের জাতিসত্তাগুলোর আন্দোলনে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের ধারণা যুক্ত করেন, যা ছিল বিশ্বব্যাপী খেটে খাওয়া মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সংগ্রামের একটি দার্শনিক ভিত্তি।

তিনি পাহাড়ে আদিবাসী সমাজে শ্রেণি বিশ্লেষণের দ্বারা রাজনৈতিক রণনীতি ও রণকৌশল নির্ধারণ করেছিলেন, যাতে অধিকার আদায়ের আন্দোলনে শত্রু–মিত্র চিহ্নিত করা যায়। ১৯৭৫ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর তাঁকে আত্মগোপনে চলে যেতে হয়। ১৯৭৭ ও ১৯৮২ সালের জাতীয় সম্মেলনে তিনি জনসংহতি সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৮৩ সালের ১০ নভেম্বর তিনি বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়ে নিহত হন, কিন্তু মৃত্যু হলেও তাঁর রাজনৈতিক আদর্শ অমরত্ব পেয়ে যায়।

সংগ্রামের উত্তরাধিকার: আগামী প্রজন্মের জন্য শিক্ষা

জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার মৃত্যুর পর সন্তু লারমা জনসংহতি সমিতির নেতৃত্ব গ্রহণ করেন এবং শান্তিবাহিনীকে পুনর্গঠিত করেন। অবশেষে তাঁর নেতৃত্বে ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যার দ্বারা পার্বত্য চট্টগ্রামের জাতিসত্তাগুলোর ন্যূনতম রাজনৈতিক অধিকার স্বীকৃত হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ গঠনের দ্বারা পাহাড়ে একটি বিশেষ শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছে। পরবর্তী সময় তিনি বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম প্রতিষ্ঠা করেন এবং সংগঠনের সভাপতি হিসেবে সারা দেশের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন।

এম এন লারমা ও সন্তু লারমা ভ্রাতৃদ্বয়ের গল্প যেন এক আধুনিক উপকথা, যা বৌদ্ধ জাতক কাহিনির মহানন্দিক ও চুল্লনন্দিকের কথা মনে করিয়ে দেয়। এই উপকথা আমাদের শেখায়—নীতি-নৈতিকতা, আদর্শ, সংগ্রাম ও আত্মত্যাগ একটি জনগোষ্ঠীর অস্তিত্ব রক্ষার আন্দোলনে দিকনির্দেশনা দিতে পারে, তৈরি করতে পারে ইতিহাস।

এম এন লারমার আত্মত্যাগ এই আন্দোলনকে দিয়েছে নৈতিক, দার্শনিক ও রাজনৈতিক দিকনির্দেশনা, আর সন্তু লারমার নেতৃত্বে সেই আন্দোলন পেয়েছে সূত্রবদ্ধ কাঠামো, গতি ও ধারাবাহিকতা।

এম এন লারমার সংগ্রামী জীবনের আখ্যান কেবল পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসের একটি অধ্যায় নয়; এটি আত্মত্যাগ, দূরদর্শিতারও দলিল। তাঁর জীবন প্রমাণ করে যে সত্যিকারের নেতৃত্ব কেবল ক্ষমতার অনুসন্ধান নয়—এটি গণমানুষের প্রতি অবিচল আনুগত্য ও প্রতিশ্রুতি। যেখানে নিপীড়ন ও অস্বীকৃতির রাজনীতি প্রায়ই ন্যায় ও মানবতাকে ম্লান করে দেয়, সেখানে লারমার জীবন ও সংগ্রাম পাহাড়ে হয়ে উঠেছে অধিকার, স্বীকৃতি ও মর্যাদার জন্য সংগ্রামরত মানুষের কাছে এক দীপ্ত আলোকবর্তিকা।

মিলিন্দ মারমা: লেখক ও অধিকারকর্মী

Email: [email protected]

(মতামত লেখকের নিজস্ব)

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • এম এন লারমার জীবন: আত্মত্যাগের এক অনন্য দলিল