কেন শামসুর রাহমান গুরুত্বপূর্ণ? এই প্রশ্ন অনেকের মধ্যে, বিশেষ করে তরুণ কবিদের মধ্যে প্রায়ই উচ্চারিত হয়। দ্বিধা নিয়ে বিতর্কে জড়িয়ে তাঁরা অনেকেই মনে করেন, শামসুর রাহমান তেমন গুরুত্বপূর্ণ নন। তাঁদের কাব্যধারা বিকাশে শামসুর রাহমানের কবিতা খুব একটা ভূমিকা রাখবে না।

কবিতার কাছে আমরা কী চাই? আর কবিতাকে আমরা কোন দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে বিচার করি—এই দুই প্রশ্নের সম্ভাব্য উত্তরগুলো বিশ্লেষণের মধ্যেই নিহিত রয়েছে শামসুর রাহমান–সংক্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গির যথার্থ উত্তর।

সেসব উত্তরের শুলুক সন্ধান করতে গেলে যেতে হবে বাংলা কবিতার হাজার বছরের ইতিহাসের কাছে। আমরা আপাতত অত বিস্তৃত সময়ের দিকে যাচ্ছি না। অন্তত গত শতাব্দীর ত্রিশের দশকের কাব্যপ্রবণতা আর কবিতা নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গির দিকে নজর দিলেও আমরা এর উত্তর পেয়ে যাব। আর বলার অপেক্ষা রাখে না, ওই সময়টা কিন্তু তার আগের হাজার বছরেরই কবিতার ধারাবাহিক দৃষ্টিভঙ্গির নির্যাস।

ওই সময়ে এসে কবিতা একাধিক ধারায় বিভক্ত হয়ে গেল। একদিকে রবীন্দ্রাধিপত্যের বিপরীতে ফ্যাশনেবল রবীন্দ্রবিরোধিতা বনাম রবীন্দ্রানুকরণ; অন্যদিকে পশ্চিমা কাব্যপ্রবণতার প্রভাবে বদলে যেতে থাকা আমাদের আবহমান বংলা কবিতা। একদিকে ঐতিহ্য ধরে রাখার শিকড়সংলগ্নতা, অন্যদিকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্তির স্পৃহা জাগ্রত করার উপাদান হিসেব কবিতার ব্যবহার। ইউরোপ–শাসিত এই পরাধীন ভূখণ্ডে তখন হেজেমনির মতো ইউরোপীয় কবিতার আধিপত্য বা আভিজাত্যের প্রভাব; অন্যদিকে এই উপাদান ব্যবহারের মাধ্যমে প্রতিবাদী স্পৃহাকে দমিয়ে রাখার জন্য আধুনিকতার নামে উচ্চকিত কবিতার বিরোধিতা ছিল জীবনানন্দের ‘কবিতা নানারকম’–নামীয় সংজ্ঞার বিস্তার।

শামসুর রাহমানের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’ ১৯৬০ সালে প্রকাশিত হওয়ার আগেই তিনি পত্রপত্রিকায় লিখে পরিচিতি পেয়ে যান; এবং এই নামকরণের মাধ্যমেই তিনি উজ্জ্বলতরভাবে নিজেকে আলাদা করিয়ে নেন ত্রিশোত্তর বাংলা কবিতা থেকে। এমনকি তাঁর সময় থেকেও। জীবন ও স্বপ্নের, বাস্তব ও অবাস্তবের মাঝে দাঁড়িয়ে তিনিই প্রথম দেখালেন মানসমৃত্যু আর শারীরিক মৃত্যুর পার্থক্য।

এসব উপাদানের প্রভাবে বাংলা কবিতা তখন কয়েকটি ধারায় বিভক্ত হয়ে পড়ে। রবীন্দ্রানুকরণে অনেক কবিরই তখন সবার অজ্ঞাতে সমাধি হয়ে যায়। রবীন্দ্রবিরোধিতায় মগ্ন হয়ে বুদ্ধদেব বসুরা তখন নতুন কবিতার ইশতেহার নিয়ে বাংলা সাহিত্যে আবির্ভূত হন। সেখানে অন্তস্থ উপাদান আর বাহ্যিক কাঠামোর বিন্যাস ও বৈশিষ্ট্য উপস্থাপন করা হয়। ঔপনিবেশিক শাসক ইউরোপীয় আধুনিকতার নামে আধুনিক কবিতার বৈশিষ্ট্য হিসেবে ব্যক্তির একান্ত অনায়াস উপলব্ধিকে মুখ্য হিসেবে উপস্থাপন করে। জনমানুষের আকাঙ্ক্ষা ও উচ্চকিত কাব্যধারাকে অনাধুনিক বলে প্রচার করে। এতসব ডামাডোলের ভেতরে সবকিছু উপেক্ষা করে একাই একক বৈশিষ্ট্যে অনড় থেকে কাব্য রচনা করতে থাকেন কাজী নজরুল ইসলাম। আর ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত একদল তরুণ কবি ইউরোপের ওই ভাবধারাকে বাংলা কবিতায় নিয়ে এলেন। তাঁরা ভাবলেন, এভাবে বাংলা কবিতা আধুনিকীকরণের শুদ্ধতায় পরিশুদ্ধ হবে। নজরুল কারও কথা শুনলেন না। রবীন্দ্রনাথ প্রমাণ করলেন, তিনি চির আধুনিক। এসবের বাইরে পঞ্চপাণ্ডব বলে খ্যাত কবিরা বাংলা কবিতায় অনায়াস–নমনীয় ভাষা তৈরি করলেন বটে; কিন্তু এমন সব আন্তর্জাতিকতা ঢুকে পড়ল, এত সব আড়াল ঢুকে পড়ল, যা বাংলা কবিতাকে নিয়ে গেল সাধারণ্য থেকে দূরে।

বলার অপেক্ষা রাখে না পরবর্তী সময়ে এই ধারা চলতে থাকল চল্লিশের দশক থেকেই। শামসুর রাহমান তো সেই ধারারই এক সংযোজন এবং কবিতাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার একজন আমৃত্য সারথি।

সেই পুরোনো প্রশ্ন—শামসুর রাহমানের এখানে বিশিষ্টতা কী, যেখানে ব্যক্তির আবেগকে প্রাধান্য দিয়ে বৃহত্তর জীবনের প্রতিধ্বনিকে অনুপস্থিত রাখার কৌশল নিয়ে পুরো বাংলা কবিতাকে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছে এই ভূখণ্ডে? এককথায় যদি উত্তর দিই, তাহলে বলতে হবে, অন্যরা যেখানে অন্য অনেক উপাদানের সঙ্গে (এবং বিচ্ছিন্নভাবে) আবেগের মিশ্রণ ঘটিয়েছেন, শামসুর রাহমান সেখানে বৃহত্তর জীবন ও স্বদেশের প্রতিধ্বনির সঙ্গে নিজের পুরো কাব্যযাত্রাকে মিশিয়েছেন। এককথার উত্তরের পরে এই কথার ব্যাখ্যার জন্য বহুকথা বলার দরকার। আমরা এখন সেদিকেই যাব।

তিরিশি আধুনিকতা যেখানে ভিখারির মতো হাত পেতেছে কিটসের কাছে, ইয়েটসের কাছে, গ্রিক ও পাশ্চাত্য পুরাণের দ্বারে দ্বারে, মালার্মের পরাবাস্তব বৈঠকিতে; বোদলেয়ারের বিকল্প জগতে, র‍্যাবোর অপরাধী নরকে। শামসুর রাহমান সেখানে হেঁটেছেন আপন নগরীতে। এ নগরীর বাতাসে সেরেছেন ‘রুপালি স্নান’। ঢাকাকে ঢাকা হয়ে উঠতে দেখে তাকে আপন করে নিয়েছেন। কখনো তাঁর মনে হয়নি নরক বা বিকল্প জগৎ।

শামসুর রাহমানের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’ ১৯৬০ সালে প্রকাশিত হওয়ার আগেই তিনি পত্রপত্রিকায় লিখে পরিচিতি পেয়ে যান; এবং এই নামকরণের মাধ্যমেই তিনি উজ্জ্বলতরভাবে নিজেকে আলাদা করিয়ে নেন ত্রিশোত্তর বাংলা কবিতা থেকে। এমনকি তাঁর সময় থেকেও। জীবন ও স্বপ্নের, বাস্তব ও অবাস্তবের মাঝে দাঁড়িয়ে তিনিই প্রথম দেখালেন মানসমৃত্যু আর শারীরিক মৃত্যুর পার্থক্য। বিংশ শতাব্দীতে ত্রিশের আলোড়নের পর এমন ভাবধারা ছিল একেবারেই নতুন। ‘রৌদ্র করোটিতে’ তিনি উজ্জ্বলতর করলেন সবকিছু। আঁধার ও অবগুণ্ঠন বিদায় করলেন। তাঁর চেতনাকে খোলাসা করলেন। বুদ্ধদেব বসুর ‘প্রান্তরে কিছুই নেই: জানালার পর্দা টেনে দে’র বিপরীতে তিনি রোদের আলোকে নিয়ে এলেন তাঁর কবিতার করোটি। বুদ্ধদেব বসুর ওই চরণ নিছক তাঁর চরণ নয়, তাঁর নিজস্ব কাব্যচেতনা, এমনকি তিরিশি কাব্যপ্রবণতারও কেন্দ্র। শামসুর রাহমান ‘প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’তে যে নানা ধরনের মৃত্যুর মধ্যে রেখা টেনে টেনে দেখিয়েছেন, দ্বিতীয় কাব্য ‘রৌদ্র করোটিতে’ এসে স্পষ্ট হয়ে দাঁড়িয়েছেন তিরিশির বিপরীতে স্বতন্ত্র হয়ে। এই স্বাতন্ত্র্য উজ্জ্বলতর হয়েছে ‘বিধ্বস্ত নীলিমা’য় তারপর ‘নিরালোকে দিব্যরথ’, এরপর ‘নিজ বাসভূমে’।

শামসুর রাহমান (২৩ অক্টোবর ১৯২৯—১৮ আগস্ট ২০০৬).

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: রব ন দ র উপ দ ন করল ন প রথম ইউর প

এছাড়াও পড়ুন:

সাভার–ধামরাইয়ের কৃষক রক্ষায় পদক্ষেপ নিন

ঢাকার সাভার ও ধামরাই—এ দুই গুরুত্বপূর্ণ উপজেলায় কৃষিজমি দ্রুত কমে যাওয়ার যে প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, তার মূলে রয়েছে অপরিকল্পিত শিল্পায়ন এবং শিল্পবর্জ্যের ভয়াবহ দূষণ। প্রথম আলোর প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত দশকে এ অঞ্চলে শিল্পকারখানার সংখ্যা প্রায় ১ হাজার ৯৪ থেকে বেড়ে ১ হাজার ৮৩২–এ দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে কৃষিজমির পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে, সাভারে যা ২ হাজার ৫১০ হেক্টর ও ধামরাইয়ে ১ হাজার ১২৭ হেক্টর। শিল্প ও কৃষির মধ্যকার অসম লড়াইয়ে এভাবে কৃষিজমি বিলীন হয়ে যাওয়াটা খুবই উদ্বেগজনক।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের সহায়তায় করা নমুনা পরীক্ষায় এ বিপর্যয়ের বৈজ্ঞানিক প্রমাণ মিলেছে। এর থেকে জানা যাচ্ছে, কারখানার নালা এবং কৃষিজমির জমা পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ (ডিও) এত কম যে জলজ জীবন প্রায় ‘প্রাণঘাতী পর্যায়ে’ চলে গেছে। পানিতে অ্যামোনিয়া, ফসফেট ও নাইট্রেটের মাত্রাতিরিক্ত উপস্থিতি লক্ষ করা গেছে। বিশেষ করে ট্যানারিশিল্পের ক্রোমিয়াম ও ক্যাডমিয়াম এবং ডাইং ও ওষুধ কারখানার নিকেল ও সিসা মাটিতে মিশে মাটিকে বিষাক্ত করছে। 

গবেষকেরা বলছেন, ভারী ধাতুগুলো মাটি থেকে শস্যে চলে যাচ্ছে। এর ফলে ফসলের গুণাগুণ পরিবর্তিত হচ্ছে, উৎপাদন কমছে এবং এই ধাতুগুলো খাদ্যের মাধ্যমে মানুষের শরীরে প্রবেশ করছে। এই দূষণের মূল কারণ হলো শিল্পকারখানার মালিকদের আইন না মানার প্রবণতা এবং প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর কার্যকর উদ্যোগের অভাব।

নগরবিদদের মতে, আইন ও নীতি অনুযায়ী শিল্পকারখানা নির্দিষ্ট এলাকায় হওয়ার কথা থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। কারখানাগুলো কৃষিজমির ভিত উঁচু করে গড়ে উঠছে এবং তরল বর্জ্য পরিশোধনাগার (ইটিপি) স্থাপন না করেই অবাধে সেগুলো নালা, খাল এবং নদীনালার মধ্য দিয়ে কৃষিজমিতে ফেলছে। স্থানীয় খালগুলো দখল ও ভরাট হয়ে সরু হয়ে যাওয়ায় কারখানার বর্জ্য উপচে কৃষিজমিতে জমা হচ্ছে। ফলে দেখা যাচ্ছে, একসময় যে জমি থেকে ২৫ মণ ধান পাওয়া যেত, এখন সেখানে চাষ করাই সম্ভব হচ্ছে না। তখন কম দামে জমি বিক্রি করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন কৃষকেরা। তাঁদের বক্তব্য, ‘কারখানার পচা পানির কারণে ফসল হয় না, হুদাই খাজনা দিতে হয়।’

স্থানীয় প্রশাসনকে অভিযোগ জানিয়েও কোনো স্থায়ী সমাধান পাওয়া যাচ্ছে না। ‘গায়ের জোরে’ শিল্পমালিক নিজ স্বার্থে পরিবেশ ধ্বংস করছেন আর প্রশাসন যেন নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে। পরিবেশ রক্ষার আইন থাকা সত্ত্বেও কৃষিজমি সুরক্ষা আইনের উদ্যোগ নেওয়া সত্ত্বেও যখন তা প্রয়োগ হয় না, তখন বোঝা যায় মুনাফার কাছে পরিবেশ ও জীবনের মূল্য কত তুচ্ছ।

এ পরিস্থিতি কেবল পরিবেশদূষণ বা কৃষিজমি কমার সমস্যা নয়; এটি খাদ্যনিরাপত্তা, জনস্বাস্থ্য এবং সুশাসনের ওপর একটি বড় আঘাত। রাষ্ট্রের উচিত অবিলম্বে কার্যকর তদারকি এবং আইন প্রয়োগের মাধ্যমে দূষণকারী শিল্পকারখানাগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া। নিয়মিত মাটি ও পানি পরীক্ষা করে ক্ষতিকর রাসায়নিকের প্রবেশ বন্ধ করা আবশ্যক।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • সিকদার আমিনুল হকের কবিতায় প্রেম ও নারী
  • সাভার–ধামরাইয়ের কৃষক রক্ষায় পদক্ষেপ নিন