শামসুর রাহমানের অবদান ও অপরিহার্যতা
Published: 23rd, October 2025 GMT
কেন শামসুর রাহমান গুরুত্বপূর্ণ? এই প্রশ্ন অনেকের মধ্যে, বিশেষ করে তরুণ কবিদের মধ্যে প্রায়ই উচ্চারিত হয়। দ্বিধা নিয়ে বিতর্কে জড়িয়ে তাঁরা অনেকেই মনে করেন, শামসুর রাহমান তেমন গুরুত্বপূর্ণ নন। তাঁদের কাব্যধারা বিকাশে শামসুর রাহমানের কবিতা খুব একটা ভূমিকা রাখবে না।
কবিতার কাছে আমরা কী চাই? আর কবিতাকে আমরা কোন দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে বিচার করি—এই দুই প্রশ্নের সম্ভাব্য উত্তরগুলো বিশ্লেষণের মধ্যেই নিহিত রয়েছে শামসুর রাহমান–সংক্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গির যথার্থ উত্তর।
সেসব উত্তরের শুলুক সন্ধান করতে গেলে যেতে হবে বাংলা কবিতার হাজার বছরের ইতিহাসের কাছে। আমরা আপাতত অত বিস্তৃত সময়ের দিকে যাচ্ছি না। অন্তত গত শতাব্দীর ত্রিশের দশকের কাব্যপ্রবণতা আর কবিতা নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গির দিকে নজর দিলেও আমরা এর উত্তর পেয়ে যাব। আর বলার অপেক্ষা রাখে না, ওই সময়টা কিন্তু তার আগের হাজার বছরেরই কবিতার ধারাবাহিক দৃষ্টিভঙ্গির নির্যাস।
ওই সময়ে এসে কবিতা একাধিক ধারায় বিভক্ত হয়ে গেল। একদিকে রবীন্দ্রাধিপত্যের বিপরীতে ফ্যাশনেবল রবীন্দ্রবিরোধিতা বনাম রবীন্দ্রানুকরণ; অন্যদিকে পশ্চিমা কাব্যপ্রবণতার প্রভাবে বদলে যেতে থাকা আমাদের আবহমান বংলা কবিতা। একদিকে ঐতিহ্য ধরে রাখার শিকড়সংলগ্নতা, অন্যদিকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্তির স্পৃহা জাগ্রত করার উপাদান হিসেব কবিতার ব্যবহার। ইউরোপ–শাসিত এই পরাধীন ভূখণ্ডে তখন হেজেমনির মতো ইউরোপীয় কবিতার আধিপত্য বা আভিজাত্যের প্রভাব; অন্যদিকে এই উপাদান ব্যবহারের মাধ্যমে প্রতিবাদী স্পৃহাকে দমিয়ে রাখার জন্য আধুনিকতার নামে উচ্চকিত কবিতার বিরোধিতা ছিল জীবনানন্দের ‘কবিতা নানারকম’–নামীয় সংজ্ঞার বিস্তার।
শামসুর রাহমানের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’ ১৯৬০ সালে প্রকাশিত হওয়ার আগেই তিনি পত্রপত্রিকায় লিখে পরিচিতি পেয়ে যান; এবং এই নামকরণের মাধ্যমেই তিনি উজ্জ্বলতরভাবে নিজেকে আলাদা করিয়ে নেন ত্রিশোত্তর বাংলা কবিতা থেকে। এমনকি তাঁর সময় থেকেও। জীবন ও স্বপ্নের, বাস্তব ও অবাস্তবের মাঝে দাঁড়িয়ে তিনিই প্রথম দেখালেন মানসমৃত্যু আর শারীরিক মৃত্যুর পার্থক্য।এসব উপাদানের প্রভাবে বাংলা কবিতা তখন কয়েকটি ধারায় বিভক্ত হয়ে পড়ে। রবীন্দ্রানুকরণে অনেক কবিরই তখন সবার অজ্ঞাতে সমাধি হয়ে যায়। রবীন্দ্রবিরোধিতায় মগ্ন হয়ে বুদ্ধদেব বসুরা তখন নতুন কবিতার ইশতেহার নিয়ে বাংলা সাহিত্যে আবির্ভূত হন। সেখানে অন্তস্থ উপাদান আর বাহ্যিক কাঠামোর বিন্যাস ও বৈশিষ্ট্য উপস্থাপন করা হয়। ঔপনিবেশিক শাসক ইউরোপীয় আধুনিকতার নামে আধুনিক কবিতার বৈশিষ্ট্য হিসেবে ব্যক্তির একান্ত অনায়াস উপলব্ধিকে মুখ্য হিসেবে উপস্থাপন করে। জনমানুষের আকাঙ্ক্ষা ও উচ্চকিত কাব্যধারাকে অনাধুনিক বলে প্রচার করে। এতসব ডামাডোলের ভেতরে সবকিছু উপেক্ষা করে একাই একক বৈশিষ্ট্যে অনড় থেকে কাব্য রচনা করতে থাকেন কাজী নজরুল ইসলাম। আর ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত একদল তরুণ কবি ইউরোপের ওই ভাবধারাকে বাংলা কবিতায় নিয়ে এলেন। তাঁরা ভাবলেন, এভাবে বাংলা কবিতা আধুনিকীকরণের শুদ্ধতায় পরিশুদ্ধ হবে। নজরুল কারও কথা শুনলেন না। রবীন্দ্রনাথ প্রমাণ করলেন, তিনি চির আধুনিক। এসবের বাইরে পঞ্চপাণ্ডব বলে খ্যাত কবিরা বাংলা কবিতায় অনায়াস–নমনীয় ভাষা তৈরি করলেন বটে; কিন্তু এমন সব আন্তর্জাতিকতা ঢুকে পড়ল, এত সব আড়াল ঢুকে পড়ল, যা বাংলা কবিতাকে নিয়ে গেল সাধারণ্য থেকে দূরে।
বলার অপেক্ষা রাখে না পরবর্তী সময়ে এই ধারা চলতে থাকল চল্লিশের দশক থেকেই। শামসুর রাহমান তো সেই ধারারই এক সংযোজন এবং কবিতাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার একজন আমৃত্য সারথি।
সেই পুরোনো প্রশ্ন—শামসুর রাহমানের এখানে বিশিষ্টতা কী, যেখানে ব্যক্তির আবেগকে প্রাধান্য দিয়ে বৃহত্তর জীবনের প্রতিধ্বনিকে অনুপস্থিত রাখার কৌশল নিয়ে পুরো বাংলা কবিতাকে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছে এই ভূখণ্ডে? এককথায় যদি উত্তর দিই, তাহলে বলতে হবে, অন্যরা যেখানে অন্য অনেক উপাদানের সঙ্গে (এবং বিচ্ছিন্নভাবে) আবেগের মিশ্রণ ঘটিয়েছেন, শামসুর রাহমান সেখানে বৃহত্তর জীবন ও স্বদেশের প্রতিধ্বনির সঙ্গে নিজের পুরো কাব্যযাত্রাকে মিশিয়েছেন। এককথার উত্তরের পরে এই কথার ব্যাখ্যার জন্য বহুকথা বলার দরকার। আমরা এখন সেদিকেই যাব।
তিরিশি আধুনিকতা যেখানে ভিখারির মতো হাত পেতেছে কিটসের কাছে, ইয়েটসের কাছে, গ্রিক ও পাশ্চাত্য পুরাণের দ্বারে দ্বারে, মালার্মের পরাবাস্তব বৈঠকিতে; বোদলেয়ারের বিকল্প জগতে, র্যাবোর অপরাধী নরকে। শামসুর রাহমান সেখানে হেঁটেছেন আপন নগরীতে। এ নগরীর বাতাসে সেরেছেন ‘রুপালি স্নান’। ঢাকাকে ঢাকা হয়ে উঠতে দেখে তাকে আপন করে নিয়েছেন। কখনো তাঁর মনে হয়নি নরক বা বিকল্প জগৎ।শামসুর রাহমানের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’ ১৯৬০ সালে প্রকাশিত হওয়ার আগেই তিনি পত্রপত্রিকায় লিখে পরিচিতি পেয়ে যান; এবং এই নামকরণের মাধ্যমেই তিনি উজ্জ্বলতরভাবে নিজেকে আলাদা করিয়ে নেন ত্রিশোত্তর বাংলা কবিতা থেকে। এমনকি তাঁর সময় থেকেও। জীবন ও স্বপ্নের, বাস্তব ও অবাস্তবের মাঝে দাঁড়িয়ে তিনিই প্রথম দেখালেন মানসমৃত্যু আর শারীরিক মৃত্যুর পার্থক্য। বিংশ শতাব্দীতে ত্রিশের আলোড়নের পর এমন ভাবধারা ছিল একেবারেই নতুন। ‘রৌদ্র করোটিতে’ তিনি উজ্জ্বলতর করলেন সবকিছু। আঁধার ও অবগুণ্ঠন বিদায় করলেন। তাঁর চেতনাকে খোলাসা করলেন। বুদ্ধদেব বসুর ‘প্রান্তরে কিছুই নেই: জানালার পর্দা টেনে দে’র বিপরীতে তিনি রোদের আলোকে নিয়ে এলেন তাঁর কবিতার করোটি। বুদ্ধদেব বসুর ওই চরণ নিছক তাঁর চরণ নয়, তাঁর নিজস্ব কাব্যচেতনা, এমনকি তিরিশি কাব্যপ্রবণতারও কেন্দ্র। শামসুর রাহমান ‘প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’তে যে নানা ধরনের মৃত্যুর মধ্যে রেখা টেনে টেনে দেখিয়েছেন, দ্বিতীয় কাব্য ‘রৌদ্র করোটিতে’ এসে স্পষ্ট হয়ে দাঁড়িয়েছেন তিরিশির বিপরীতে স্বতন্ত্র হয়ে। এই স্বাতন্ত্র্য উজ্জ্বলতর হয়েছে ‘বিধ্বস্ত নীলিমা’য় তারপর ‘নিরালোকে দিব্যরথ’, এরপর ‘নিজ বাসভূমে’।
শামসুর রাহমান (২৩ অক্টোবর ১৯২৯—১৮ আগস্ট ২০০৬).উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: রব ন দ র উপ দ ন করল ন প রথম ইউর প
এছাড়াও পড়ুন:
সি চিন পিংয়ের কাছে লড়াইয়ে পরিষ্কারভাবে হেরে যাচ্ছেন ট্রাম্প
গত সপ্তাহে মিসরের শার্ম আল-শেখ শহরে ক্যামেরার সামনে বসে নিজের সাফল্যের বড়াই করছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি নিজেকে গাজার ত্রাণকর্তা হিসেবে জাহির করতে চাইছিলেন। তাঁর পাশে ছিলেন মিসরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাতাহ আল–সিসির মতো আরও কয়েকজন স্বৈরশাসক। এই স্বৈরশাসকেরাই ট্রাম্পকে ইসরায়েল-হামাসের নাটকীয় যুদ্ধবিরতির মঞ্চ সাজাতে সাহায্য করেছেন।
কিন্তু এ মাসের শেষ দিকে অসীম ক্ষমতাধর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সহজে বশ না মানার পাত্র চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের মুখোমুখি হতে যাচ্ছেন। একুশ শতকে প্রভাব বিস্তারের দৌড়ে সি অনেকটাই এগিয়ে, আর সেটা সম্ভব হচ্ছে প্রতি পদে ট্রাম্পের ভুলের কারণে।
সম্প্রসারণবাদী চীনের কমিউনিস্ট সরকারের চরিত্র ও উদ্দেশ্য কী, তা নিয়ে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে বিতর্ক চলছে দেখে অবাক হতে হয়। বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা; হংকং, জিনজিয়াং ও তিব্বতে মানুষের মৌলিক অধিকার দমন; প্রতিবেশী দেশগুলোকে যুদ্ধের হুমকি দেওয়া আর দুনিয়াজুড়ে সাইবার গুপ্তচরবৃত্তি চালানো— চীন সম্পর্কে এমন একটা উপসংহারে পৌঁছনো যায়।
আরও পড়ুনট্রাম্প কেন সি চিন পিংয়ের চেয়ে অনেক বেশি ‘মাওবাদী’১৭ মে ২০২৫সম্প্রতি চীন বিরল খনিজ ও চুম্বকের ওপর কড়া রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ জারি করেছে। এ খাতে চীনের প্রায় একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তির উদ্দেশ্যে এটা খুব ইচ্ছাকৃতভাবে নেওয়া ক্ষতিকর পদক্ষেপ।
বিরল খনিজ এ চুম্বকের মতো উপকরণ মোবাইল ফোন, গাড়িসহ আধুনিক ইলেকট্রনিক পণ্য তৈরির অপরিহার্য উপাদান। নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও এর প্রভাব গুরুতর। বিরল খনিজ ও চুম্বক ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র, যুদ্ধবিমান, পারমাণবিক সাবমেরিন, ড্রোন এবং অন্যান্য আধুনিক অস্ত্র তৈরিতেও ব্যবহৃত হয়। চীনের নতুন নিয়ম অনুযায়ী, এগুলো কোনো সামরিক কাজে ব্যবহার করা যাবে না। বিভিন্ন দেশ এখন গুরুত্বপূর্ণ এই ধাতুর বিকল্প উৎস খুঁজতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। আগামী মাসে যদি এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হয়, তাহলে ইউক্রেনে পশ্চিমাদের অস্ত্র সরবরাহ এবং রাশিয়ার বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ঝুঁকিতে ফেলতে পারে।
চীন বিদেশি কোম্পানি ও বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খলের ওপরও একই ধরনের নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে চায়। যুক্তরাষ্ট্র ১৯৫৯ সাল থেকে একই ধরনের এখতিয়ার দাবি করে আসছে। এখন বেইজিং ওয়াশিংটনের সঙ্গে তার নিজের কৌশলে খেলছে। এর মানে হচ্ছে, রাজনৈতিক স্বার্থে বাণিজ্যকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে।
এক দশকের বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থাকা সি চিন পিং এতটা সাহসী ও আত্মবিশ্বাসী পদক্ষেপ নিচ্ছেন যে তাঁকে শুধু এই তত্ত্বের খাপে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না। বর্তমান প্রবণতা হচ্ছে, চীন ও আমেরিকার মধ্যে প্রাধান্যের লড়াই অনিবার্যভাবে আরও তীব্র হবে। ট্রাম্প ধন্যবাদ পেতেই পারেন। কেননা, তিনি যতটা শক্তিশালী, তার থেকে অনেক বেশি পতিত ব্যক্তি। চীনের সঙ্গে লড়াইয়ে যুক্তরাষ্ট্রের হারের সম্ভাবনা বেশি।নতুন পদক্ষেপের ঘোষণা শুনে ট্রাম্প প্রথমে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। তিনি চীনের ওপর শতভাগ শুল্ক আরোপের হুমকি দেন এবং সি চিন পিংয়ের সঙ্গে পরিকল্পিত বৈঠক বাতিলের কথাও বলেন। কিন্তু বাজারে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লে শেষ পর্যন্ত তিনি পিছু হটেন। তবু দুপক্ষের পাল্টাপাল্টি শুল্ক আরোপ চলছেই, যা বৈশ্বিক অর্থনীতির মন্দার শঙ্কা বাড়াচ্ছে।
যথারীতি এ ক্ষেত্রেও ট্রাম্পের কোনো পরিকল্পনা নেই। ট্রাম্প নিজেই জানেন না তিনি কী করছেন। সি চিন পিং কিন্তু এমন নেতা নন। তিনি প্রমাণ করছেন যে ট্রাম্প যদি পূর্ণমাত্রার বাণিজ্যযুদ্ধের পথে হাঁটেন, তবু তিনি হোয়াইট হাউসের হামবড়া ভাবের মানুষদের সঙ্গে চোখে চোখ রেখে মোকাবিলা করতে পারেন।
আরও পড়ুনচীনকে চোখ রাঙাবে না—শোডাউনে সি চিন পিং কি এটাই বললেন০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫বিরল খনিজ ও চুম্বকের ওপর চীনের কঠোর বিধিনিষেধ হতে পারে দর–কষাকষির ক্ষেত্রে একটি কৌশল, অথবা চীনা কমিউনিস্ট পার্টির রাজনৈতিক কৌশলের ফসল। তবে এটি সম্ভবত কল্পনাজনিত আশাবাদ। বিশ্লেষকেরা চিহ্নিত করছেন যে চীনের ক্ষেত্রে একটি মৌলিক পরিবর্তনের আভাস দেখা যাচ্ছে। প্রাথমিকভাবে ধৈর্য ধরার পর সি চিন পিং এখন আক্রমণাত্মক অবস্থানে যাচ্ছেন।
এই পরিবর্তনের কারণ কী? বেইজিংয়ের শাসকেরা এই উপলব্ধি করছেন যে ট্রাম্পের বেপরোয়া ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি পুরোনো ও নতুন সব বন্ধুদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের দূরত্ব তৈরি করেছে। ট্রাম্পের নীতি বিশ্বে একটি শূন্যস্থান সৃষ্টি করছে, যেটা চীন পূরণ করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক প্রভাব ও প্রাধান্য দ্রুত কমছে। ইউরোপ ও এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের জোটে সমস্যা সৃষ্টি হওয়া, রাশিয়া ও ইসরায়েলের মতো কর্তৃত্ববাদী দেশগুলোর বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিতে না পারা, অন্য দেশে যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য ও সফট পাওয়ারের ক্ষমতা কমে যাওয়া, জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক নিয়মকানুনকে অবজ্ঞা করা—এসবই সেই পতনের প্রতিফলন।
আরও পড়ুনপুতিন-সি চিন পিং পশ্চিমা চাপকে যেভাবে বুড়ো আঙুল দেখালেন২২ মে ২০২৪চীন যেন একেবারে ফাঁকা গোলপোস্টের সামনে দাঁড়িয়ে। দৃঢ়প্রতিজ্ঞ সি চিন পিং, বেসামাল ট্রাম্পের মধ্যকার একটি বিব্রতকর অসম ম্যাচ এটি। ওয়াশিংটনের নীতিনির্ধারক, যাঁদের মস্তিষ্ক ধীরে চলে, তাঁরা এখন পর্যন্ত বিষয়টি বুঝতে পারছেন না। গত সপ্তাহে ভাইস প্রেসিডেন্ট জে ডি ভ্যান্স বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের হাতে চীনের চেয়ে অনেক বেশি কার্ড আছে।
কিন্তু ভ্যান্স কি বাস্তবতাটা বোঝেন? উদাহরণস্বরূপ, স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ সেন্টারের তথ্য বলছে, ‘চীন (দেশটির কাছে সীমাহীন বিরল খনিজ আছে) দ্রুত যুদ্ধাস্ত্র উৎপাদনক্ষমতা বৃদ্ধি করছে এবং আধুনিক অস্ত্র তৈরি করছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের গতির চেয়ে পাঁচ থেকে ছয় গুণ দ্রুত?’ ভ্যান্স কি বোঝেন যে যুক্তরাষ্ট্রই এই শুল্কযুদ্ধে হেরে যাচ্ছে, যেটা তারা শুরু করেছে? ফরেন পলিসিতে জেমস পামেলা লিখেছেন, ‘এ বছর ট্রাম্প বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু করার পর চীনা রপ্তানিকারকেরা নতুন বাজার খুঁজে নিতে যথেষ্ট সফল হয়েছেন। গত মাসে চীনের যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি গত বছরের তুলনায় ২৭ শতাংশ কমেছে, কিন্তু মোট রপ্তানি ৮ দশমিক ৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।’
আরও পড়ুনসি–পুতিনের মধ্যে শত্রুতা বাধাতে গিয়ে উল্টো বিপদে ট্রাম্প!২৬ মার্চ ২০২৫এর বিপরীতে, যুক্তরাষ্ট্রের কৃষকেরা তাঁদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ চীনের সয়াবিন বাজার হারিয়েছেন। সম্ভবত এটি স্থায়ীভাবে। চীনের সয়াবিন বাজার এখন ব্রাজিলিয়ান উৎপাদকদের হাতে চলে গেছে। উৎসবের মৌসুম আসার আগে এবার আমেরিকান ভোক্তাদের বাড়তি মূল্য গুনতে হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রে বিক্রি হওয়া অধিকাংশ খেলনা এবং ক্রিসমাস পণ্যের প্রায় ৯০ শতাংশ চীনের তৈরি।
কিছু বিশ্লেষক মনে করেন, সি চিন পিং আসলে বিশ্ব শাসন করতে চান না এবং বিশ্বও তাঁর কর্তৃত্ববাদী শাসন চায় না। তাঁরা বলছেন, সি চিন পিংয়ের অগ্রাধিকার ও চীনের মৌলিক স্বার্থে কোনো পরিবর্তন আসেনি। সেগুলো হলো দেশের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা, জাতীয় সার্বভৌমত্ব, কমিউনিস্ট পার্টির নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন।
কিন্তু এক দশকের বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থাকা সি চিন পিং এতটা সাহসী ও আত্মবিশ্বাসী পদক্ষেপ নিচ্ছেন যে তাঁকে শুধু এই তত্ত্বের খাপে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না। বর্তমান প্রবণতা হচ্ছে, চীন ও আমেরিকার মধ্যে প্রাধান্যের লড়াই অনিবার্যভাবে আরও তীব্র হবে। ট্রাম্প ধন্যবাদ পেতেই পারেন। কেননা, তিনি যতটা শক্তিশালী, তার থেকে অনেক বেশি পতিত ব্যক্তি। চীনের সঙ্গে লড়াইয়ে যুক্তরাষ্ট্রের হারের সম্ভাবনা বেশি।
সাইমন টিসডাল দ্য গার্ডিয়ানের কলাম লেখক
দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত