বিএনপি-জামায়াত দুই দলকেই কথায় বিদ্ধ করলেন নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী
Published: 24th, October 2025 GMT
বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে নিজেদের পার্থক্য বোঝাতে গিয়ে দুই দলকেই কথায় বিঁধিয়েছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী।
নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী অভিযোগ করেছেন, গত ৫২ বছরে বিএনপি গণতন্ত্রের কথা বলে বাংলাদেশে ‘জিয়াতন্ত্র’ কায়েম এবং জামায়াতে ইসলামী ইসলামের কথা বলে ‘মওদুদিতন্ত্র’ কায়েমের চেষ্টা চালিয়েছে।
আজ শুক্রবার রাজধানীর শাহবাগে শহীদ আবু সাঈদ ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সেন্টারে এনসিপির এক সভায় বক্তব্যে এই অভিযোগ তুলে নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেন, ‘বাংলাদেশে নতুন করে আমরা যখন মুজিববাদের গর্ত থেকে উঠে দাঁড়াচ্ছি, নতুন করে মওদুদিবাদ ও জিয়াবাদের গর্ত আমাদের সামনে আবির্ভূত হয়েছে। আমাদের মঞ্জিলে মকসুদ হলো বাংলাবাদ।’
তবে বিএনপি ও জামায়াতের সঙ্গে নির্বাচনী জোট গঠনের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী। তবে তা হবে কি না, তা দল দুটির ভূমিকার ওপর নির্ভর করবে বলে তিনি জানান।
নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেন, ‘জুলাই সনদের আইনি ভিত্তিতে বাংলাদেশে নতুন একটি সংস্কার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যারা যাবে, আমাদের আগামীর জোট তাদের সঙ্গেই হবে। এ ক্ষেত্রে যদি জামায়াতে ইসলামী এগিয়ে আসে, তাহলে আমরা দুই পা এগিয়ে যাব। যদি বিএনপি এগিয়ে আসে, তাহলেও আমরা দুই পা এগিয়ে যাব।’
ভবিষ্যতে কারা সরকার গঠন করবে, এনসিপি তার নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করবে বলে মন্তব্য করে নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেন, ‘আগামীর সংসদে আমরা জাতীয় পার্টি এবং আওয়ামী লীগের কোনো প্রতিনিধি দেখতে চাই না, জাতীয় পার্টি এবং আওয়ামী লীগমুক্ত একটি সংসদ চাই। এটার জন্যই এই ভোট ব্যাংকে এনসিপি কাজ করে যাবে।’
নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেন, ‘বাংলাদেশে বর্তমানে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আওয়ামী লীগের বাহাত্তরের সংবিধান রয়েছে, সেটার প্রতি তাদের “পিরিত” জেগে উঠেছে। আপনাদের জাতির পিতা মুজিব হতে পারে, আমাদের জাতির পিতা মুজিব নয়। বাংলাদেশে গণ-অভ্যুত্থানের সৈনিকেরা এখানে এখনো জেগে আছে। মুজিববাদী কায়দাকানুন যারা বাংলাদেশে নতুন করে কায়েম করার চেষ্টা চালাবে, তাদের পরিণতি হাসিনার মতোই হবে।’
রাষ্ট্রপতি মো.
প্রধান উপদেষ্টার উদ্দেশে নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেন, ‘জনগণ আপনাকে ক্ষমতায় বসিয়েছে, জনগণ আপনাকে সম্মান দিয়েছে। আপনি জনগণের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করুন। জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দিন। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে হত্যার বিচার করুন। সেই ক্ষেত্রে আপনি যদি পিছপা হন, জনগণ যেভাবে আপনাকে সম্মান জানিয়েছে, তেমনিভাবে আপনাকে আবার অসম্মানও জানাতে পারবে। আমরা কোনো ব্যক্তিপূজা করি না।’
এনসিপির জুলাই সনদ স্বাক্ষর না করা নিয়ে দলটির মুখ্য সমন্বয়ক বলেন, ‘স্বাক্ষর আমরা তখনই করব, যখন জনগণের অধিকার আমরা আইনিভাবে বুঝে পাব। কারণ, নব্বইয়ে জনগণকে কলা দেখানো হয়েছে, চব্বিশে তাদের কলা দেখানো যাবে না।’
নির্বাচন কমিশনে সেনাবাহিনী, জামায়াত ও বিএনপি থেকে একজন করে দেওয়া হয়েছে বলে দাবি করেন এনসিপির এই নেতা। তিনি বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনে কোনো গ্যাংবাজি, দলবাজি চলবে না, কোনো পরিবারতন্ত্র চলবে না। নির্বাচন কমিশনকে মিলিটারিমুক্ত করতে হবে, সিভিল ফর্মে ফিরিয়ে আনতে হবে। এটাকে জিয়াবাদ মুক্ত করতে হবে, জামায়াতে ইসলামী মুক্ত করতে হবে।’
ডাকসু নির্বাচনে জয়ী ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতাদের উদ্দেশে নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেন, ‘ছাত্ররা আপনাদের যে কারণে ভোট দিয়েছে, আপনারা এ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যা সমাধানকল্পে কোনো প্রকল্প হাজির করতে পারেননি; বরং জামায়াতের কার্যক্রম হিসেবে আপনারা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে অস্থিতিশীল করার জন্য নতুন করে পাঁয়তারা চালাচ্ছেন। আমরা আপনাদের হুঁশিয়ার করে দিতে চাই। আপনারা গণতন্ত্রের জন্য কাজ করুন, দেশের শিক্ষাব্যবস্থার জন্য কাজ করুন। যদি আপনারা মনে করেন, ডাকসুতে আপনাদের নিয়োগকর্তা জামায়াত বা আপনাদের অর্থের জোগানদাতা ইবনে সিনা, তাহলে ছাত্ররা যেভাবে আপনাদের ডাকসু ভবনে বসিয়েছে, আবার আপনাদের ডাকসু ভবন থেকে টেনেহিঁচড়ে জনতার কাতারে নিয়ে আসবে।’
গুমের বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে এনসিপির এই নেতা বলেন, ‘যারা গুমের সঙ্গে জড়িত ছিল, তাদের আলাদা সাব-জেলে রাখা হয়েছে। আমরা রাষ্ট্রে কোনো বৈষম্য চাই না। বিচারালয়ে আপনাদের দাঁড়াতে হবে।...আমরা সেনাবাহিনীকে আহ্বান জানাব, সেনাবাহিনীকে কলঙ্কমুক্ত করার জন্য বাংলাদেশে একটি সুযোগ এসেছে। এই সুযোগকে আমাদের কাজে লাগাতে হবে। দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর প্রত্যেকটি পদক্ষেপের সঙ্গে ইনশা আল্লাহ আমরা থাকব, যাতে আপনারা এদের বিচার নিশ্চিত করতে পারেন। আপনারা যে উদ্যোগ নিয়েছেন, আমরা সেটাকে সাধুবাদ জানাই। প্রসিকিউশনে যে মামলা হয়েছে, সেখানে অন্য যারা কয়েদি রয়েছে, তাদের যেভাবে হাজিরা দিতে হয়, আপনাদের সেভাবে হাজিরা ফেস করতে হবে।’
প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থায় সংস্কার আনার আহ্বান জানিয়ে নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেন, ‘আমরা আওয়াজ তুলেছিলাম, বাংলাদেশে ডিজিএফআইকে সংস্কার করতে হবে। কিন্তু আপনাদের থেকে এখনো কোনো উদ্যোগ আমরা দেখিনি। এটা আমাদের জন্য দুঃখজনক। এ জন্য আগামী নির্বাচনে অতীতের নির্বাচনের মতো ডিজিএফআই যদি কোনো ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং করতে চায়, তাহলে রাজপথে লড়াই হবে।’
এনসিপির ঢাকা মহানগর (উত্তর ও দক্ষিণ) এবং ঢাকা জেলার এই সমন্বয় সভায় দলের সদস্যসচিব আখতার হোসেন, মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলম, মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) হাসনাত আবদুল্লাহ, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আবদুল হান্নান মাসউদসহ জ্যেষ্ঠ নেতারা বক্তব্য দেন।
আরও পড়ুনএনসিপি ক্ষমতায় না গেলেও ‘পোষা’ বিরোধী দল হবে না: সারজিস আলম১ ঘণ্টা আগেউৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ন স র দ দ ন প টওয় র জ ল ই সনদ আপন দ র এনস প র র জন য আম দ র ক ত কর আপন র ত করত আপন ক ব এনপ ইসল ম
এছাড়াও পড়ুন:
অদ্ভুত চেয়ার
শাসক যখন চেয়ারে বসেন, তার চোখ মাছের চোখের মতো জ্বলজ্বলে হয়ে যায়। চেয়ারটি স্থির থাকে। শাসক কথা বলার সময় হাত নেড়ে নেড়ে কথা বলেন। যেন এই জগৎ–সংসারে তার পূর্ববর্তী শাসকেরা যেসব ভুল করে গেছেন, তিনি তা শোধরাতে এসেছেন। শাসকের কথা শুনলে মনে হয়, তিনি কোনো ভুল করতে পারেন না। তার বর্ণনায় যেকোনো শাসক বড় দুর্বল প্রমাণিত হয়। কিন্তু আমার ভালো লাগে তার চেয়ার। একদিন চেয়ারটি খালি পেয়ে বসে পড়লাম। সঙ্গে সঙ্গে চেয়ারটি ঘুরতে শুরু করল। দেখলাম জগৎ ঘুরছে। আমার চিৎকার শুনে ধীরে–স্থিরে শাসক ঘরে প্রবেশ করলেন।
‘চেয়ারটি কেমন?’
‘আগে ঘূর্ণন থামান, তারপর বলছি।’
‘আমি আগেই জানতাম, তুই এই চেয়ারে বসতে চাস। শাসক হতে চাস। আমি যখন কথা বলি, তুই আমার কথা না শুনে চেয়ারের দিকে তাকিয়ে থাকিস, তখনই বুঝতে পারি।’
‘আপনি ভুল জানেন, আমি এই চেয়ারে বসতে চেয়েছি ঠিকই, শাসক হতে চাইনি।’
‘এই চেয়ারে কেবল একজন শাসক বসতে পারেন।’
‘কিন্তু এর আগে আমি আপনার ছেলেকে বসতে দেখেছি, মেয়েকে বসতে দেখেছি। তাদের তো কোনো সমস্যা হয়নি।’
‘ওদের নিয়ে প্রশ্ন তোলার সাহস তোকে কে দিল? এটা নিয়ে প্রশ্ন তুললে জনগণ প্রশ্ন তুলবে?’
‘আমিও তো জনগণ।’
‘না, তুই জনগণ না, আমার কর্মচারী।’
‘আপনার চেয়ারের দোহাই লাগে চেয়ারের ঘূর্ণন থামান।’
‘তোর চোখমুখ দিয়ে যখন রক্ত উঠবে, তখন চেয়ার থেমে যাবে। এক ফোঁটা রক্ত চেয়ারে পড়তে দে। চিৎকার কর। কেউ তোর চিৎকার শুনবে না। দরজা-জানালা সব বন্ধ করে দিয়েছি, যাতে বাইরে থেকে আর কেউ তোর চিৎকার শুনতে না পায়। চিৎকার মানুষের হৃদয়ে খুব সহজে পৌঁছে যায়। এটা তো হতে দেওয়া যাবে না।’
‘শাসক, আমার কথা বোঝার চেষ্টা করুন। আমি খুব বেশি সময় কাঁদতে পারি না। আমার শরীর থেকে সহজে রক্তও বের হয় না।’
‘ও তা–ই। তাহলে তো তোকে বাঁচার একটা উপায় খুঁজে দিতেই হয়। নে, এবার হাসতে থাক। পারবি না?’
‘পারব।’
শাসকের কথা শুনলে মনে হয়, তিনি কোনো ভুল করতে পারেন না। তার বর্ণনায় যেকোনো শাসক বড় দুর্বল প্রমাণিত হয়। কিন্তু আমার ভালো লাগে তার চেয়ার। একদিন চেয়ারটি খালি পেয়ে বসে পড়লাম। সঙ্গে সঙ্গে চেয়ারটি ঘুরতে শুরু করল। দেখলাম জগৎ ঘুরছে। আমার চিৎকার শুনে ধীরে–স্থিরে শাসক ঘরে প্রবেশ করলেন। ‘চেয়ারটি কেমন?’আমি হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়লাম। মনে হলো আমার মা একটি ঘুঙুর বাজাচ্ছেন। আমি হাসছি। বাবা বাজার থেকে আষাঢ় মাসের আম নিয়ে ফিরছেন। মা সেই আম কাটছেন। তার চোখ চিকচিক করছে। আমি ভাবলাম আর হাসলাম। আমার শাসক দরজা-জানালা সব খুলে দিলেন। অনেক মানুষ জড়ো হলো ঘরের ভেতর। আমাকে চেয়ারে বসা দেখে তারা শাসকের মহানুভবতা নিয়ে কথা বলতে শুরু করল। হাততালির শব্দ পড়ল। শাসকের চেয়ারে আমি তখনো ঘুরছি। আমার ছবি তোলা হলো। ভিডিও করা হলো। আমি তখনো ঘুরছি। আমার আর হাসি আসছিল না। এবার আমি এক গ্লাস রক্ত চাইলাম। শাসকের আগের শর্তে ফিরে যেতে চাইলাম। আমার পূর্বনারীদের মতো, পূর্বপুরুষদের মতো। মনে হলো শাসকের আগের শর্তই ভালো ছিল। এক গ্লাস রক্ত চাইলাম, যাতে চেয়ারে ঢেলে দিতে পারি। কিন্তু তারা ভাবল, আমি পানি চাচ্ছি। শাসক বলল ফলের রস দিতে। কালো জামের রস আনা হলো আমার জন্য। ভাবলাম, চেয়ারের ঘূর্ণন থামিয়ে আমাকে নামিয়ে নেওয়া হবে। কিন্তু কেউ আমাকে নামাল না। তারা ঘূর্ণন থামার জন্য অপেক্ষা করতে থাকল। মনো হলো আমি একাই দুটি মোরগে পরিণত হলাম। একটি মোরগ আরেকটি মোরগকে ঠোকর দিয়ে যেমন রক্তাক্ত করে, এবার নিজেই নিজেকে সেভাবে রক্তাক্ত করার পালা। নিজেকে ঠোকরাতে থাকলাম, রক্ত বের হয়ে শরীরেই শুকিয়ে গেল, চেয়ারে পড়ল না। আমি চোখ বন্ধ করে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার জন্য প্রস্তুতি নিলাম। কিছু সময়ের মধ্যেই অচেতন হলাম। মানুষের হাসি কিংবা হাততালির শব্দ আমার কানে পৌঁছাতে পারল না। এরপর নিজেকে আবিষ্কার করলাম একটি ধবধবে পরিষ্কার বিছানায়। শাসকের হাতে কালো জামের রসভর্তি গ্লাস। তিনি আমাকে এক গ্লাস জামের রস পান করালেন। এ জন্য আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলাম।
শাসক একা আমার সঙ্গে কথা বলতে চাইলেন। বলে চললেন, ‘বাইরে ঝড় হয়েছে। ঝড়ের পর আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেছে। কিন্তু এই ঝড়ে অনেক পাখির ডানা ভেঙে গেছে। অনেক পাখি পালক হারিয়েছে। কোনো কোনো পাখির বাসা ভেঙে পড়েছে। মৃত ছানাদের জন্য ছটফট করছে মা পাখি। স্কুলগামী ছেলেটা জুতার ফিতাটা আরও ভালোভাবে গিঁট দিয়ে নিচ্ছে। কিন্তু ঝড় হলে আয়নাগুলো আরও স্বচ্ছ হয়। হয়েছেও তা–ই।’
‘আপনার চোখও স্বচ্ছ হয়েছে।’
‘বলছিস?’
‘জি।’
‘তাহলে এবার আমি তোকে আমার চেয়ারে বসতে দেব। অল্প সময়ের জন্য বসলেই দেখবি অসংখ্য চোখ। চোখগুলো ঘৃণায় ভরা, অথচ তারা ভালোবাসার গল্প বলছে।’
‘না, না, আমি আর ওই চেয়ারে বসতে চাই না।’
‘বোকা, চেয়ারে বসে সামনে হেলে পড়েছিলি কেন?’
‘আপনিও তো হেলে বসেন। তাতে তো কোনো সমস্যা হয় না।’
‘শোন, আমি এমন এক শহরে বড় হয়েছি, যে শহরটি অনেক পুরোনো স্থাপনা বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। একটা স্থাপনা আরেকটা থেকে খুব বেশি দূরে ছিল না। তাই কখনো কোনো স্থাপনা ভেঙে পড়লে পুরোপুরি ভেঙে পড়তে পারত না। একবার ভূমিকম্প হলো। পুরো শহর কেঁপে উঠল। স্থাপনাগুলো ভেঙে গেল। মানুষগুলো সেই সব স্থাপনার ভেতর থেকে বের হয়ে এল কাটা হাত, পা, মাথা, কপাল নিয়ে, আর মৃতরা পড়ে রইল ধ্বংসস্তূপের ভেতর। শহরের বুকের এক পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীটিতে তখন স্রোত আরও বেগবান হলো। তবু লাশগুলো পড়ে রইল। আমার পিতা তখন ওই শহরের শাসক ছিলেন। সেই লাশ উদ্ধার না করে শহরটি ত্যাগের সিদ্ধান্ত নিলেন। বললেন, “শহরে আপাতত কোনো মানুষের প্রবেশাধিকার নেই। এটি এখন থেকে জাদুঘর হিসেবে বেবেচিত হবে।” আমরা বিশ্বাস করলাম। জাদুঘর দেখাশোনার জন্য লোক নিয়োগ দেওয়া হলো। তারা দিনরাত পরিশ্রম করে সেই পরিত্যক্ত শহরে ফুল ফোটাল। আমরা ভুলে গেলাম, ধ্বংসস্তূপের নিচে শুধু লাশ ছিল না, অনেক জীবিত মানুষও ছিল।
‘শহরটি যেদিন ধসে পড়েছিল, আমি সেদিন শহরে ছিলাম না, পিতার সঙ্গে দূরে ভ্রমণে গিয়েছিলাম। এসে দেখি, আমাদের প্রাসাদ দাঁড়িয়ে আছে। ভেতরে মা নেই। মায়ের পায়ের জুতা জোড়া একটা জায়গায় পড়ে আছে। মাকে টেনেহিঁচড়ে হয়তো কোনো ধ্বংসস্তূপের ভেতর ফেলে দেওয়া হয়েছে। মাকে হত্যা করে জনগণ তাদের দুঃখ ভোলার চেষ্টা করেছে।‘শহরটি যেদিন ধসে পড়েছিল, আমি সেদিন শহরে ছিলাম না, পিতার সঙ্গে দূরে ভ্রমণে গিয়েছিলাম। এসে দেখি, আমাদের প্রাসাদ দাঁড়িয়ে আছে। ভেতরে মা নেই। মায়ের পায়ের জুতা জোড়া একটা জায়গায় পড়ে আছে। মাকে টেনেহিঁচড়ে হয়তো কোনো ধ্বংসস্তূপের ভেতর ফেলে দেওয়া হয়েছে। নয়তো এই ধ্বংসের দায় আমার পিতার ওপর চাপিয়ে মাকে হত্যা করে জনগণ তাদের দুঃখ ভোলার চেষ্টা করেছে। আমার পিতা আমাকে বললেন, “শাসকের চেয়ার সব সময় ঘূর্ণনশীল। এটাকে আয়ত্তে রাখতে না পারলে চেয়ারই শাসকের হাড়, মাংসসহ খেয়ে ফেলে।” আমাকে তিনি একটি ঘূর্ণনশীল চেয়ারে বসতে অভ্যস্ত করে তুললেন। প্রথমে মাথা ঘুরত, বমি হত। রক্তবমি হলে দেখতাম চেয়ারটি থেমে যাচ্ছে। পিতা বললেন, “হাসতে শেখো।” আমি হাসতে শিখলাম। ধীরে ধীরে চেয়ারটি আমার বশে এল। কিন্তু সেই ধ্বংসস্তূপ তৈরি হওয়ার পেছনে পিতার দায় ছিল কি না, বলতে পারলাম না। আমি ঘুমিয়ে পড়লেই আমার পিতা কোথায় যেন চলে যেতেন। ফিরে এসে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতেন। মায়ের কোনো একটি শাড়ির আঁচল নিজের মাথায় টেনে বলতেন, “তোমাকে আজও পেলাম না।” শাসকের দুঃখ বড় গোপন। যে নিজের দুঃখ গোপন করে সে–ই শাসক।
‘আর ইতিহাস? সে তো সব সময় কমপক্ষে তিনটি রাস্তা দিয়ে অগ্রসর হয়। জনগণ বেশি হলেও দুটি রাস্তা ব্যবহার করে। আর শাসক ইতিহাস মুছে দেওয়ার আয়োজন সম্পন্ন করে। মানুষ ইতিহাস ভুলে না থাকলে তাকে শাসন করা গেলেও শোষণ করা যায় না।’
‘সেই শহর এখন কোথায়?’
‘আমার পিতা তার লাল ডায়েরিতে নিজ হাতে লিখেছিলেন, “ধ্বংসস্তূপের ওপর আরেকটি শহর গড়ে তুলতেই হবে। ইতিহাস থেকে মানুষের দূরত্ব তৈরি করার জন্য এটা প্রয়োজন।”’
এ কথা শোনার পর আমার পা শিরশির করে উঠল। আমি সেই পুনর্নির্মিত শহরে বসবাস করছি, যে শহরের নিচে একটি ধ্বংসস্তূপ রয়েছে। আর ভাবতে পারছিলাম না।
শাসক বললেন, ‘ওই শহরে প্রবেশের একটা পথ রয়েছে। আজ তোকে সেই শহরে নিয়ে যাব।’
‘না, আপনি আমাকে আর ফিরতে দেবেন না।’
‘এমনও তো হতে পারে, তুই নিজেই আর ফিরতে চাইবি না।’
এদিকে শাসক নিজ হাতে আমাকে কালো জামের রস পান করাচ্ছেন, সেই ছবি পত্রিকায় ছাপা হলো। ভিডিও টিভিতে দেখানো হলো। মানুষ আমাকে বলল, ‘আরে তুই তো সৌভাগ্যবান।’
আমি সেই ধ্বংসস্তূপ দেখতে চাই কি না, সেই বিষয়ে শাসক আমাকে আগামী জন্মদিন পর্যন্ত ভেবে সিদ্ধান্ত জানাতে বললেন। শাসকের পিতার লেখা ডায়েরিটা পড়তে চাইলাম। তিনি নিরাশ করলেন না। হাতে পেয়ে পড়লাম। এমন এক পিচ্ছিল রাস্তার বর্ণনা সেখানে আছে, যেই রাস্তায় চলার সময় তিনি তার ছেলের হাত ধরেছিলেন। এরপর সিদ্ধান্ত নিলাম, যাব। তারপর সিদ্ধান্ত নিলাম যাব না। এভাবে একেকবার একেক ভাবনা এসে আমাকে উলট-পালট করে দিয়ে যাচ্ছিল। একদিন ঘরে এসে শুনি, মেঝের মাটি ধসে আমার স্ত্রী, সন্তান মাটির গর্তে ঢুকে গেছে। এবার আর আমার না বলার উপায় থাকল না।