বলশেভিকরা কেন দ্বিতীয় বিপ্লব বেছে নিয়েছিল
Published: 25th, October 2025 GMT
১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লব ছিল বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রভাব সৃষ্টিকারী রাজনৈতিক ঘটনা। এই রক্তক্ষয়ী বিপ্লবের শুরু হয়েছিল সে বছরের গোড়ার দিক থেকে। এর মধ্য দিয়ে ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিকরা দীর্ঘদিনের জার শাসনকে উচ্ছেদ করে নতুন শাসনব্যবস্থা গড়ে তোলে। লেনিনের অনুসারী বলশেভিকদের এই বিপ্লব খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন মার্কিন সাংবাদিক জন রিড। সেই অভিজ্ঞতা থেকে তিনি লিখেছিলেন, ‘দুনিয়া কাঁপানো দশ দিন’।
এই বিপ্লবের পর রাশিয়ায় গড়ে ওঠে বিশ্বের প্রথম সমাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা। ১৯২২ সালের ৩০ ডিসেম্বর গঠিত হয় সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রসমূহের ইউনিয়ন—সোভিয়েত ইউনিয়ন। এর মাধ্যমে তৈরি হয়েছিল দুই মেরুর আদর্শিক বিশ্বের পুঁজিবাদী শাসনব্যবস্থা আর সমাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা। সেই সময় থেকে ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন অবধি বলশেভিক বিপ্লবের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও মতাদর্শগত দাপট ছিল বিশ্বজুড়ে।
বিপ্লবের ক্ষেত্র তৈরি হয়েছিল যেভাবে
কৃষক অসন্তোষ: রুশ কৃষকেরা বিশ্বাস করতেন, জমি কেবল তাঁদেরই হওয়া উচিত, যাঁরা তা চাষ করেন। জার দ্বিতীয় আলেক্সান্দার কর্তৃক ১৮৬১ সালে যদিও ভূমি দাসপ্রথা থেকে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল, তবু গ্রামীণ কৃষকদের মধ্যে এক গভীর ক্ষোভ ছিল। কারণ, তাঁদের সামান্য যে জমি বরাদ্দ করা হয়েছিল, সে জন্য সরকারকে অর্থ পরিশোধ করতে বাধ্য করা হয়। কিন্তু তাঁরা যে জমিতে কাজ করতেন, সেটার মালিকানা দাবি করতে থাকেন। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে দুর্বল ভূমি সংস্কারের প্রচেষ্টা সত্ত্বেও ভূমির মালিকানার ক্ষেত্রে ছিল এক চরম বৈষম্য। দেশের মোট জমির ২৫ শতাংশ ছিল মাত্র ১ দশমিক ৫ শতাংশের দখলে।
শ্রমিক অসন্তোষ: উনিশ শতকের শেষের দিকে দারিদ্র্য থেকে বাঁচতে লাখো মানুষ গ্রাম ছেড়ে শহরাঞ্চলে চলে আসায় নতুন ‘প্রলেতারিয়েত’ বা ‘শ্রমিকশ্রেণি’ তৈরি হয়। শিল্পবিপ্লব রাশিয়ার শ্রমিকদের জন্য অনিরাপদ কাজের পরিবেশ, কম মজুরি এবং সীমিত শ্রমিক অধিকার নিয়ে এসেছিল। পশ্চিম ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমিকেরা শিল্পবিপ্লবের কারণে যে সম্পদ ও সমৃদ্ধি অর্জন করেছিলেন, রুশ শ্রমিকদের ভাগ্যে তা জোটেনি। এ নিয়ে তাঁদের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি হয়। কৃষকশ্রেণির তুলনায় এই নতুন শ্রমিকশ্রেণি ধর্মঘটে যাওয়া এবং প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করার প্রবণতা বেশি দেখায়। ১৯১৪ সালে যখন রাশিয়া প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে, তখন যুদ্ধসামগ্রী উৎপাদনের জন্য কলকারখানার ওপর পড়া বিশাল চাপ আরও বেশি শ্রমিক দাঙ্গা ও ধর্মঘটের জন্ম দেয়। যুদ্ধের প্রতি এমনিতেই রাশিয়ার বেশির ভাগ মানুষের বিরোধিতা ছিল। ফলে তারা এই শ্রমিকদের সমর্থন জানায়।
১৯০৫ সালেই লেনিন সোভিয়েতের বিপ্লবী সক্ষমতা আন্দাজ করতে পেরেছিলেন। মেনশেভিক ও সোশ্যাল রেভল্যুশনারিদের বিপরীতে বলশেভিকদের ‘রুটি, জমি, শান্তি’ এবং ‘সমস্ত ক্ষমতা বুর্জোয়া পার্লামেন্টের বদলে চাই সোভিয়েতের হাতে’ স্লোগান মানুষকে আকৃষ্ট করেছিল।অজনপ্রিয় সরকার: প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগেও রাশিয়ার বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ জার দ্বিতীয় নিকোলাসের স্বৈরাচারী শাসনের ওপর অসন্তুষ্ট হয়ে উঠেছিল। তাঁর স্লোগান ছিল, ‘এক জার, এক চার্চ, এক রাশিয়া।’ তাঁর বাবা তৃতীয় আলেক্সান্দারের মতোই দ্বিতীয় নিকোলাস একটি অপ্রিয় নীতি—‘রুশিফিকেশন’ বা রুশকরণ নীতি প্রয়োগ করেছিলেন। এই প্রক্রিয়ায় বেলারুশ ও ফিনল্যান্ডের মতো অজাতিগত রুশ সম্প্রদায়গুলোকে তাদের নিজ সংস্কৃতি ও ভাষা ত্যাগ করে রুশ সংস্কৃতি গ্রহণ করতে বাধ্য করা হয়েছিল।
গির্জা ও জারতন্ত্র সম্পর্ক: জার ছিলেন রুশ অর্থোডক্স চার্চেরও প্রধান। চার্চ স্বৈরাচারী শাসনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে কাজ করত। জারের কর্তৃত্বকে আরও সুদৃঢ় করতে চার্চ ঘোষণা করে, জার ঈশ্বর কর্তৃক নিযুক্ত। তাই ‘খুদে পিতা’র প্রতি যেকোনো চ্যালেঞ্জ ঈশ্বরের অবমাননা হিসেবে গণ্য করা হতো। ওই সময়ে রাশিয়ার অধিকাংশ মানুষ ছিল নিরক্ষর। তারা চার্চের বক্তব্য মেনে চলত। জারের পক্ষে প্রচার চালানোর জন্য প্রায়ই পাদরিদের আর্থিকভাবে পুরস্কৃত করা হতো। কিন্তু ধীরে ধীরে কৃষকেরা পাদরিদের প্রতি শ্রদ্ধা হারাতে শুরু করেন। কারণ, তাঁরা ক্রমেই পাদরিদের দুর্নীতিগ্রস্ত ও ভণ্ড হিসেবে দেখতে পান। সামগ্রিকভাবে দ্বিতীয় নিকোলাসের শাসনামলে চার্চ এবং এর শিক্ষা প্রত্যেক মানুষের শ্রদ্ধা হারাতে শুরু করে।
বিপ্লব শুরু হওয়ার এক দিন পর (১৯১৭ সালের ৮ নভেম্বর) পেত্রোগাদের উইন্টার প্যালেসের সামনে.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: শ সনব যবস থ অসন ত ষ প রথম
এছাড়াও পড়ুন:
বলশেভিকরা কেন দ্বিতীয় বিপ্লব বেছে নিয়েছিল
১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লব ছিল বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রভাব সৃষ্টিকারী রাজনৈতিক ঘটনা। এই রক্তক্ষয়ী বিপ্লবের শুরু হয়েছিল সে বছরের গোড়ার দিক থেকে। এর মধ্য দিয়ে ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিকরা দীর্ঘদিনের জার শাসনকে উচ্ছেদ করে নতুন শাসনব্যবস্থা গড়ে তোলে। লেনিনের অনুসারী বলশেভিকদের এই বিপ্লব খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন মার্কিন সাংবাদিক জন রিড। সেই অভিজ্ঞতা থেকে তিনি লিখেছিলেন, ‘দুনিয়া কাঁপানো দশ দিন’।
এই বিপ্লবের পর রাশিয়ায় গড়ে ওঠে বিশ্বের প্রথম সমাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা। ১৯২২ সালের ৩০ ডিসেম্বর গঠিত হয় সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রসমূহের ইউনিয়ন—সোভিয়েত ইউনিয়ন। এর মাধ্যমে তৈরি হয়েছিল দুই মেরুর আদর্শিক বিশ্বের পুঁজিবাদী শাসনব্যবস্থা আর সমাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা। সেই সময় থেকে ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন অবধি বলশেভিক বিপ্লবের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও মতাদর্শগত দাপট ছিল বিশ্বজুড়ে।
বিপ্লবের ক্ষেত্র তৈরি হয়েছিল যেভাবে
কৃষক অসন্তোষ: রুশ কৃষকেরা বিশ্বাস করতেন, জমি কেবল তাঁদেরই হওয়া উচিত, যাঁরা তা চাষ করেন। জার দ্বিতীয় আলেক্সান্দার কর্তৃক ১৮৬১ সালে যদিও ভূমি দাসপ্রথা থেকে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল, তবু গ্রামীণ কৃষকদের মধ্যে এক গভীর ক্ষোভ ছিল। কারণ, তাঁদের সামান্য যে জমি বরাদ্দ করা হয়েছিল, সে জন্য সরকারকে অর্থ পরিশোধ করতে বাধ্য করা হয়। কিন্তু তাঁরা যে জমিতে কাজ করতেন, সেটার মালিকানা দাবি করতে থাকেন। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে দুর্বল ভূমি সংস্কারের প্রচেষ্টা সত্ত্বেও ভূমির মালিকানার ক্ষেত্রে ছিল এক চরম বৈষম্য। দেশের মোট জমির ২৫ শতাংশ ছিল মাত্র ১ দশমিক ৫ শতাংশের দখলে।
শ্রমিক অসন্তোষ: উনিশ শতকের শেষের দিকে দারিদ্র্য থেকে বাঁচতে লাখো মানুষ গ্রাম ছেড়ে শহরাঞ্চলে চলে আসায় নতুন ‘প্রলেতারিয়েত’ বা ‘শ্রমিকশ্রেণি’ তৈরি হয়। শিল্পবিপ্লব রাশিয়ার শ্রমিকদের জন্য অনিরাপদ কাজের পরিবেশ, কম মজুরি এবং সীমিত শ্রমিক অধিকার নিয়ে এসেছিল। পশ্চিম ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমিকেরা শিল্পবিপ্লবের কারণে যে সম্পদ ও সমৃদ্ধি অর্জন করেছিলেন, রুশ শ্রমিকদের ভাগ্যে তা জোটেনি। এ নিয়ে তাঁদের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি হয়। কৃষকশ্রেণির তুলনায় এই নতুন শ্রমিকশ্রেণি ধর্মঘটে যাওয়া এবং প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করার প্রবণতা বেশি দেখায়। ১৯১৪ সালে যখন রাশিয়া প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে, তখন যুদ্ধসামগ্রী উৎপাদনের জন্য কলকারখানার ওপর পড়া বিশাল চাপ আরও বেশি শ্রমিক দাঙ্গা ও ধর্মঘটের জন্ম দেয়। যুদ্ধের প্রতি এমনিতেই রাশিয়ার বেশির ভাগ মানুষের বিরোধিতা ছিল। ফলে তারা এই শ্রমিকদের সমর্থন জানায়।
১৯০৫ সালেই লেনিন সোভিয়েতের বিপ্লবী সক্ষমতা আন্দাজ করতে পেরেছিলেন। মেনশেভিক ও সোশ্যাল রেভল্যুশনারিদের বিপরীতে বলশেভিকদের ‘রুটি, জমি, শান্তি’ এবং ‘সমস্ত ক্ষমতা বুর্জোয়া পার্লামেন্টের বদলে চাই সোভিয়েতের হাতে’ স্লোগান মানুষকে আকৃষ্ট করেছিল।অজনপ্রিয় সরকার: প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগেও রাশিয়ার বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ জার দ্বিতীয় নিকোলাসের স্বৈরাচারী শাসনের ওপর অসন্তুষ্ট হয়ে উঠেছিল। তাঁর স্লোগান ছিল, ‘এক জার, এক চার্চ, এক রাশিয়া।’ তাঁর বাবা তৃতীয় আলেক্সান্দারের মতোই দ্বিতীয় নিকোলাস একটি অপ্রিয় নীতি—‘রুশিফিকেশন’ বা রুশকরণ নীতি প্রয়োগ করেছিলেন। এই প্রক্রিয়ায় বেলারুশ ও ফিনল্যান্ডের মতো অজাতিগত রুশ সম্প্রদায়গুলোকে তাদের নিজ সংস্কৃতি ও ভাষা ত্যাগ করে রুশ সংস্কৃতি গ্রহণ করতে বাধ্য করা হয়েছিল।
গির্জা ও জারতন্ত্র সম্পর্ক: জার ছিলেন রুশ অর্থোডক্স চার্চেরও প্রধান। চার্চ স্বৈরাচারী শাসনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে কাজ করত। জারের কর্তৃত্বকে আরও সুদৃঢ় করতে চার্চ ঘোষণা করে, জার ঈশ্বর কর্তৃক নিযুক্ত। তাই ‘খুদে পিতা’র প্রতি যেকোনো চ্যালেঞ্জ ঈশ্বরের অবমাননা হিসেবে গণ্য করা হতো। ওই সময়ে রাশিয়ার অধিকাংশ মানুষ ছিল নিরক্ষর। তারা চার্চের বক্তব্য মেনে চলত। জারের পক্ষে প্রচার চালানোর জন্য প্রায়ই পাদরিদের আর্থিকভাবে পুরস্কৃত করা হতো। কিন্তু ধীরে ধীরে কৃষকেরা পাদরিদের প্রতি শ্রদ্ধা হারাতে শুরু করেন। কারণ, তাঁরা ক্রমেই পাদরিদের দুর্নীতিগ্রস্ত ও ভণ্ড হিসেবে দেখতে পান। সামগ্রিকভাবে দ্বিতীয় নিকোলাসের শাসনামলে চার্চ এবং এর শিক্ষা প্রত্যেক মানুষের শ্রদ্ধা হারাতে শুরু করে।
বিপ্লব শুরু হওয়ার এক দিন পর (১৯১৭ সালের ৮ নভেম্বর) পেত্রোগাদের উইন্টার প্যালেসের সামনে