গাজায় হাজার হাজার আহত ও অসুস্থ মানুষ জরুরি চিকিৎসার জন্য বিদেশে সরিয়ে নেওয়ার অপেক্ষায় রয়েছেন। কিন্তু ইসরায়েলের কড়াকড়ি সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ ও সীমিত অনুমতির কারণে তাদের জীবন বিপন্ন হয়ে উঠেছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) জানিয়েছে, গাজার হাসপাতালগুলো এখনও রোগীদের জন্য নিরাপদ আশ্রয়স্থল নয়। চিকিৎসার অভাব, জরুরি ওষুধ ও যন্ত্রপাতির ঘাটতি এবং সীমিত লোকবল, সব মিলিয়ে হাসপাতালগুলো এখন বাঁচানোর জায়গা না হয়ে যেন মৃত্যুর করিডরে পরিণত হয়েছে। অসংখ্য রোগী জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে রয়েছেন। 

নাসের হাসপাতালে ভিন্ন ভিন্ন ওয়ার্ডে শুয়ে আছে দুটি ১০ বছর বয়সী ছেলে—একজন ইসরায়েলি গুলিতে গলা থেকে নিচ পর্যন্ত পক্ষাঘাতে আক্রান্ত, আরেকজনের মস্তিষ্কে টিউমার।

নাজুক যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলেও তারা দুজন সেই প্রায় ১৫ হাজার রোগীর মধ্যে আছেন, যাদের জরুরি চিকিৎসার জন্য বিদেশে সরিয়ে নেওয়া প্রয়োজন বলে জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। খবর বিবিসির। 
হাসপাতালে আবু সাঈদ আলতোভাবে তার ছেলে আমিরের চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। পরিবারের সদস্যদের ভাষ্য, দক্ষিণ গাজার একটি তাঁবুতে থাকার সময় ইসরায়েলি ড্রোন থেকে ছোড়া একটি গুলি আমিরের গায়ে লাগে। গুলিটি তার মেরুদণ্ডের মাঝখানে আটকে আছে, ফলে সে এখন সম্পূর্ণ পক্ষাঘাতে আক্রান্ত।

আমিরের বাবা বলেন, “তার জরুরি অস্ত্রোপচার দরকার। কিন্তু বিষয়টি জটিল। চিকিৎসকেরা বলেছেন, অপারেশন করলে তার মৃত্যু, স্ট্রোক বা মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের ঝুঁকি আছে। তাকে এমন জায়গায় অস্ত্রোপচার করতে হবে, যেখানে যথাযথ চিকিৎসা সুবিধা রয়েছে। কিন্তু বর্তমানে গাজা সেই অবস্থায় নেই।” টানা দুই বছর যুদ্ধের পর এখানকার হাসপাতালগুলো এখন ভীষণ সংকটাপন্ন অবস্থায় রয়েছে।

নিজের ছোট ভাই আহমেদ আল-জাদের শয্যার পাশে বসে তার বোন সাহদ বলেন, “দুই বছরের যুদ্ধ আর বাস্তুচ্যুত জীবনের পুরো সময়টাতেই ভাইটি ছিল তার একমাত্র সান্ত্বনা। তার বয়স মাত্র ১০ বছর। যখন আমাদের অবস্থা খুব খারাপ হয়ে যেত, তখন সে বাইরে গিয়ে পানি বিক্রি করত, যাতে কিছু টাকা ঘরে আনতে পারে। কয়েক মাস আগে আহমেদের শরীরে অসুস্থতার লক্ষণ দেখা দিতে শুরু করে।
আহমেদের মুখ একপাশে বেঁকে যেত।”

তিনি বলেন, “একদিন সে আমাকে বারবার বলছিল, আমার মাথা ব্যথা করছে। আমরা ভেবেছিলাম সামান্যই, তাই শুধু প্যারাসিটামল দিয়েছিলাম। কিন্তু কিছুদিন পর তার ডান হাতটা কাজ করা বন্ধ করে দেয়।”

আহমেদকে বিদেশে নিয়ে চিকিৎসা করাতে চান সাহদ। 

তিনি বলেন, “তাকে হারাতে পারব না। আমরা ইতিমধ্যেই আমাদের বাবা, আমাদের ঘর আর আমাদের স্বপ্ন হারিয়েছি। যুদ্ধবিরতি ঘোষণার পর একফোঁটা আশা পেয়েছিলাম—হয়তো এক শতাংশ সম্ভাবনাও আছে, আহমেদ বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা নিতে পারবে।”

বুধবার (২২ অক্টোবর) যুদ্ধবিরতি শুরুর পর প্রথমবারের মতো গাজা থেকে চিকিৎসার জন্য রোগীদের সরিয়ে নেওয়ার অভিযান পরিচালনা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। 

এই অভিযানে ৪১ জন রোগী ও তাদের সঙ্গে থাকা ১৪৫ জন অভিভাবক বা সহযাত্রীকে ইসরায়েলের কেরেম শালোম সীমান্ত দিয়ে বাইরে নেওয়া হয়। সেখান থেকে অ্যাম্বুলেন্স ও বাসে করে তাদের জর্ডানে পাঠানো হয়। তাদের মধ্যে কয়েকজন জর্ডানেই চিকিৎসা নিচ্ছেন।

জাতিসংঘের এই সংস্থা জানিয়েছে, গাজায় হাজার হাজার অসুস্থ ও আহত মানুষের চিকিৎসা নিশ্চিত করতে দ্রুত বড় পরিসরে চিকিৎসা সরিয়ে নেওয়ার কার্যক্রম বাড়ানো প্রয়োজন। ডব্লিউএইচও চায়, পূর্বের মতো গাজার রাফাহ সীমান্ত দিয়েও রোগীদের মিশরে পাঠানোর অনুমতি দেওয়া হোক।

তবে ইসরায়েল জানিয়েছে, হামাস যুদ্ধবিরতি চুক্তির শর্ত পূরণ না করা পর্যন্ত—বিশেষ করে নিহত ইসরায়েলি জিম্মিদের মরদেহ ফেরত না দেওয়া পর্যন্ত রাফাহ সীমান্ত খুলে দেওয়া হবে না। ২০২৪ সালের মে মাসে যুদ্ধের সময় গাজার মিশরীয় সীমান্ত নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার পর থেকেই ইসরায়েল এই পথটি বন্ধ রেখেছে।

বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক টেড্রোস আধানম গেব্রেয়াসুস বলেন, “সবচেয়ে কার্যকর পদক্ষেপ হবে যদি ইসরায়েল গাজার রোগীদের দখলকৃত পশ্চিম তীরের হাসপাতালে বিশেষ করে পূর্ব জেরুজালেমে, চিকিৎসা নেওয়ার সুযোগ দেয়—যেমনটা যুদ্ধের আগে করা হতো।”

ইউরোপীয় ইউনিয়নের শীর্ষ কর্মকর্তারা ও ২০টিরও বেশি দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা আগেই এই আহ্বান জানিয়েছেন। তারা চিকিৎসা সরঞ্জাম, অর্থায়ন ও চিকিৎসাকর্মী পাঠানোর প্রস্তাবও দিয়েছেন। 

মাউন্ট অব অলিভসের অগাস্টা ভিক্টোরিয়া হাসপাতালের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ডা.

ফাদি আতরাশ বলেন, “যদি পূর্ব জেরুজালেম ও পশ্চিম তীরের হাসপাতালগুলোর সঙ্গে চিকিৎসা রুটটি পুনরায় চালু করা যায়, তাহলে অল্প সময়েই শত শত রোগীকে সহজে ও দক্ষতার সঙ্গে চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব।” 
ডা. ফাদির ভাষায়, “পূর্ব জেরুজালেমে রোগী পাঠানোই সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত ও কার্যকর উপায়, কারণ এখানে আমাদের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা রয়েছে।” 

বিবিসি ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনীর বিশেষ ইউনিট কো অর্ডিনেটর অব গভর্নমেন্ট অ্যাক্টিভিটিজ ইন দ্য টেরিটোরিজ (কোগাট) কাছে জানতে চায়, কেন এই চিকিৎসা রুট পুনরায় অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে না। কোগাট জানায়, এটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, তাই বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে—যেখান থেকে কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি।

গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, ২০২৫ সালের আগস্ট পর্যন্ত এক বছরে ১৪০ শিশুসহ অন্তত ৭৪০ জন রোগী, চিকিৎসার অপেক্ষায় থেকে মারা গেছে।

নাসের হাসপাতালের শিশু ও মাতৃ বিভাগের প্রধান ডা. আহমেদ আল-ফাররা বলেন, “একজন চিকিৎসকের জন্য সবচেয়ে কষ্টের মুহূর্ত হলো—রোগ নির্ণয় করতে পারা সত্ত্বেও প্রয়োজনীয় পরীক্ষা বা চিকিৎসা দিতে না পারা। এমন ঘটনা বহুবার ঘটেছে, আর দুঃখজনকভাবে আমাদের সীমিত সক্ষমতার কারণে প্রতিদিনই প্রাণহানি ঘটছে।”

যুদ্ধবিরতির পরও অনেক রোগী চিকিৎসার অভাবে মারা গেছে এবং এখনও অনেকের অবস্থা গুরুতর বলেও তিনি জানান।

ঢাকা/ইভা 

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ইসর য় ল র আম দ র র জন য অবস থ আহম দ

এছাড়াও পড়ুন:

তহবিলসংকটে ঝুঁকিতে পড়তে পারে পোলিও নির্মূল কার্যক্রম: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সতর্কতা

বৈশ্বিক পোলিও নির্মূল উদ্যোগ বড় ধরনের তহবিলসংকটে পড়তে চলেছে বলে সতর্ক করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। দ্য গ্লোবাল পোলিও ইরাডিকেশন ইনিশিয়েটিভ (জিপিইআই) নামে একটি যৌথ উদ্যোগে বিশ্বজুড়ে শিশুদের বিনা মূল্যে পোলিও টিকা খাওয়ানো হয়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, ২০২৬ সাল নাগাদ জিপিইআইকে ৩০ শতাংশ বাজেট কমাতে হবে। আর ২০২৯ সাল নাগাদ এ উদ্যোগ ১৭০ কোটি মার্কিন ডলার তহবিলসংকটে পড়বে। এই তহবিলসংকট বিশ্বজুড়ে চলা পোলিও নির্মূল কার্যক্রমের জন্য বড় ঝুঁকি তৈরি করছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, দ্য গেটস ফাউন্ডেশনসহ আরও কয়েকজন অংশীদারের উদ্যোগে পোলিও নির্মূল কার্যক্রম পরিচালিত হয়।

ডব্লিউএইচওর পোলিও নির্মূল কার্যক্রমের পরিচালক জামাল আহমেদ গতকাল মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, তহবিল উল্লেখযোগ্য হারে কমার অর্থ...নির্দিষ্ট কিছু কার্যক্রম আর চালিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে না।

সংকট মোকাবিলায় বৈশ্বিক পোলিও নির্মূলকরণ উদ্যোগ (জিপিইআই) নিজেদের সামর্থ্যকে উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় নজরদারি এবং টিকাদান কর্মসূচিতে কেন্দ্রীভূত করার পরিকল্পনা করছে।

কর্মকর্তারা বলেন, তহবিলের এই ঘাটতি মূলত বৈদেশিক সাহায্য হ্রাসের কারণে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র থেকে তহবিলের জোগান অনেক কমে যাওয়ায়। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার ডব্লিউএইচও থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নেন তিনি।

তহবিলের উল্লেখযোগ্য হ্রাসের অর্থ....সহজভাবে বললে, নির্দিষ্ট কিছু কার্যক্রম আর চালিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে না।...জামাল আহমেদ, ডব্লিউএইচওর পোলিও নির্মূল কার্যক্রমের পরিচালক

জার্মানি ও যুক্তরাজ্যের মতো কয়েকটি বড় দাতা দেশও তাদের বরাদ্দ কমিয়েছে। আহমেদ বলেন, ‘পোলিও নির্মূল কার্যক্রম এখনো চলছে এবং এটি চালিয়ে নেওয়া সম্ভব। এ জন্য আমাদের সবাইকে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ থাকতে হবে এবং এটা নিশ্চিত করতে হবে যে একটি শিশুও যেন পেছনে পড়ে না থাকে।’

আরও পড়ুনপোলিও শনাক্তের নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন২১ আগস্ট ২০২৩

সংকট মোকাবিলায় বৈশ্বিক পোলিও নির্মূল উদ্যোগ নিজেদের সামর্থ্যকে উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় নজরদারি ও টিকাদান কর্মসূচিতে গুরুত্ব দেওয়ার পরিকল্পনা করছে।

এ উদ্যোগটি অন্যান্য স্বাস্থ্য কর্মসূচির সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার কৌশলও গ্রহণ করবে।

খরচ কমাতে নিম্ন-ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলে সংক্রমণের প্রাদুর্ভাব না ঘটলে কার্যক্রম হ্রাসের পরিকল্পনাও করা হয়েছে।

এ ছাড়া খরচ কমাতে নিম্ন-ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলে সংক্রমণের প্রাদুর্ভাব না ঘটলে কার্যক্রম হ্রাসের পরিকল্পনাও করা হয়েছে।

বিশ্ব থেকে পোলিওকে নির্মূল করতে কয়েক দশক ধরে কাজ চলছে। ১৯৮৮ সাল থেকে ব্যাপক টিকাদানের ফলে সংক্রমণের সংখ্যা নাটকীয়ভাবে অনেক কমে গেছে। তবে এ ভাইরাস এখনো নির্মূল হয়নি। বিশ্বের কয়েকটি অঞ্চলে এখনো এর উপস্থিতি রয়ে গেছে।

আফগানিস্তানের জালালাবাদে একটি শিশুকে পোলিও টিকা খাওয়ানো হচ্ছে। দেশটির প্রত্যন্ত অঞ্চলে টিকাদান কর্মসূচি চালাতে গিয়ে প্রায়ই স্বাস্থ্যকর্মীদের হামলার শিকার হতে হয়।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • তহবিলসংকটে ঝুঁকিতে পড়তে পারে পোলিও নির্মূল কার্যক্রম: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সতর্কতা