পঙ্কজ ভট্টাচার্য আজন্ম নিবেদিতপ্রাণ সংগ্রামী
Published: 10th, January 2025 GMT
‘আমি তোমাদেরই লোক’—এই পরিচয়ই চেয়েছিলেন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রাজনীতিক পঙ্কজ ভট্টাচার্য কথাটা এভাবে বলেননি, কিন্তু সারা জীবন গণমানুষের পাশে থেকে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য নিরন্তর সংগ্রাম করে গেছেন। তিনি ছিলেন আজন্ম নিবেদিতপ্রাণ সংগ্রামী। তাই কবির কথাটি ঘুরিয়ে তাঁকে স্মরণ করলেন অনুরাগীরা ‘আমাদেরই লোক’ বলে।
আজ শুক্রবার ছুটির দিন বিকেলে মোড়ক উন্মোচন হলো ‘আমাদেরই লোক’ নামে জননেতা পঙ্কজ ভট্টাচার্য স্মারকগ্রন্থের। রাজধানীতে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ইসফেন্দিয়ার জাহেদ মিলনায়তনে প্রকাশনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল পঙ্কজ ভট্টাচার্য স্মারকগ্রন্থ সম্পাদনা পরিষদ। গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে প্রকাশনা সংস্থা বাংলা ধরিত্রী।
বয়োজ্যেষ্ঠ রাজনীতিক থেকে শুরু করে তরুণ প্রজন্মের রাজনীতিক, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, সমাজকর্মী, অধিকার আন্দোলনকারী, পরিবেশবিদ, নারীনেত্রী, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর নেতাসহ সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার ১৩২ জনের লেখা রয়েছে এই গ্রন্থে। তাঁরা পঙ্কজ ভট্টাচার্যের রাজনৈতিক ভূমিকার মূল্যায়ন, ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণা, নির্যাতিত মানুষের পাশে দাঁড়ানো, সাহিত্য–সংস্কৃতিতে তাঁর অবদানসহ বিভিন্ন বিষয় নানা কৌণিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তুলে এনেছেন প্রায় ৬০০ পাতার গ্রন্থটিতে। এর সঙ্গে পঙ্কজ ভট্টাচার্যের বেশ কয়েকটি নির্বাচিত লেখা, পত্রিকায় দেওয়া সাক্ষাৎকার ও তাঁর কর্মময় জীবনের আলোকচিত্রের সংযুক্তি গ্রন্থটিকে ভিন্নমাত্রা দিয়েছে। এতে বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের পক্ষে এই নিবেদিতপ্রাণ রাজনীতিককে জানতে সহায়ক হবে।
আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়েছিল আনন্দম শিল্পীগোষ্ঠীর শিল্পীদের গাওয়া পঙ্কজ ভট্টাচার্যের প্রিয় দুটি গান ‘আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে’ ও ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’ পরিবেশনা দিয়ে। এরপর তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। সভাপতিত্ব করেন স্মারকগ্রন্থ সম্পাদনা পরিষদের প্রধান নাট্যব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার। পঙ্কজ ভট্টাচার্যের জীবনকে কেন্দ্র করে গত শতকের ষাট দশকের আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, দেশের বাম আন্দোলন, শোষণমুক্ত গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম থেকে সামাজিক–সাংস্কৃতিক কর্মোদ্যোগের বিবিধ বিষয় উঠে আসে বক্তাদের আলোচনা ও স্মৃতিচারণায়।
অনুষ্ঠানে বিভিন্ন সময় যাঁরা দেশের প্রগতিশীল আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন, নানাভাবে পঙ্কজ ভট্টাচার্যের সাহচর্য লাভ করেছেন, তাঁদের বিপুল সমাগম ঘটেছিল। তাঁদের মধ্যে অনেকেরই পারস্পরিক সাক্ষাৎ হলো অনেক দিন পর। ফলে অনেকটা মিলনমেলার মতো পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল আনুষ্ঠানিক আলোচনা ও তার পরের চা পান পর্বে। প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছিল পরিবেশ। আয়োজকেরা জানালেন, স্মরকগ্রন্থটি পঙ্কজ ভট্টচার্যের প্রথম মৃতুব্যার্ষিকী গত বছরের ২৩ এপ্রিল প্রকাশের পরিকল্পনা থাকলেও বিশেষ কারণে তা সম্ভব হয়নি (তিনি ২০২৩ সালের ২৩ এপ্রিল প্রয়াত হন)।
পঙ্কজ ভট্টাচার্যের স্মরণে অনুষ্ঠানে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। ঢাকা, ১০ জানুয়ারি.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
‘৫৪ বছর ধরে ভাত খাই না, চোখের সামনে বীভৎস সেই দৃশ্য ভেসে ওঠে’
‘চারদিকে রাস্তায় কুকুর-শিয়াল আর শকুন লাশ নিয়ে টানাটানি করছে। গর্ত খুঁড়ে কোনোরকমে লাশগুলো মাটিচাপা দিয়েছি। ধর্মীয় রীতি মেনে সৎকারের সুযোগও পাইনি। সেদিন সেই ভয়ংকর দৃশ্য দেখার পর আর কখনো ভাত খেতে পারিনি। এরপর ৫৪ বছর ধরে ভাত খাই না, ভাত খেতে গেলে বমি আসে, চোখের সামনে বীভৎস সেই দৃশ্য ভেসে ওঠে। কলা-রুটি–বিস্কুট খেয়ে বেঁচে আছি।’
১৯৭১ সালের ২১ মে চট্টগ্রামের আনোয়ারায় পাকিস্তানি হানাদারদের গুলিতে ১৭৬ জন নিহত হওয়ার ঘটনা স্মরণ করে কথাগুলো বলছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা সুরজিৎ দাশ (৭১)। চট্টগ্রাম নগরে তিনি পরিচিত ‘শুনু মামা’ নামে।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আনোয়ারায় সংঘটিত এই ঘটনা ‘পরকৌড়া গণহত্যা’ নামে পরিচিত। ইউনিয়নের বাথুয়াপাড়া, পূর্ব কৈন্যারা ও পরৈকোড়ায় চালানো হয় এই হত্যাযজ্ঞ। ওই দিন সুরজিৎ দাশের বাড়িতে ঢুকে তাঁর বাবা রমনীমোহন দাশসহ নয়জনকে হত্যা করা হয়।
পরৈকোড়ার এ ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ মেলে লেখক জামাল উদ্দিনের ‘আনোয়ারা একাত্তরের গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধ’ বইতে। ওই দিন ১৭৬ জন নিহত হওয়ার কথা উল্লেখ করে ওই বইতে লেখা হয়েছে, ‘১৯ মে ভিংরোল গ্রামের সাবেক এমএনএ জামাল ছত্তার গোপন সূত্রে খবর পান পরৈকোড়া গ্রামে পাকিস্তানি আর্মি অপারেশন চালাবে। তিনি গ্রামের মুরব্বিদের জানান বিষয়টি। অন্যত্র সরে যাওয়ার পরামর্শ দেন।…২১ মে সকাল নয়টায় পাকিস্তানি বাহিনীর বহর কালিগঞ্জ ব্রিজে এসে পৌঁছায়। তাদের স্বাগত জানান মুসলিম লীগ নেতা খয়রাতি মিয়া ও সহযোগীরা।’
ওই দিনের ঘটনায় বাবাসহ স্বজন হারানো সুরজিৎ দাশের সঙ্গে গত শনিবার চট্টগ্রাম নগরের একটি বাসায় কথা হয়। তিনি জানান, তাঁর বাবা, ভগ্নিপতি, বোনের শ্বশুর, ভাগনেসহ নয়জনকে ওই দিন হত্যা করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী।
সুরজিৎ দাশ বলেন, ‘আমরা চার ভাই-বোনের মধ্যে আমি সবার ছোট। মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল দিনগুলোতে উচ্চমাধ্যমিক পাস করে স্যার আশুতোষ কলেজে স্নাতকে ভর্তি হয়েছিলাম। ছাত্র অবস্থাতেই বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিই। ১৯৭১ সালের এপ্রিলের শেষ দিকে বোয়ালখালীতে যখন পাকিস্তানি বাহিনী শেলিং শুরু করে তখন আমরা নৌকায় করে চলে যাই আনোয়ারায় আমাদের গ্রামে। আমরা ২৫ থেকে ৩০ মুক্তিযোদ্ধা থ্রি নট থ্রি রাইফেল, বন্দুক, পিস্তল ইত্যাদি নিয়ে গ্রামে পাহারা দিতাম’
তাঁদের কিছু অস্ত্র চট্টগ্রাম নগরে অস্ত্র বিক্রির দোকান থেকে লুট করা বলে জানান সুরজিৎ দাশ। তিনি বলেন, ‘পরৈকোড়া গ্রামের পাশেই আমাদের বাথুয়াপাড়া গ্রাম। সেখানে তখন শহর এবং বিভিন্ন স্থান থেকে আত্মীয়স্বজন প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে এসে আশ্রয় নিয়েছেন। পাড়াপড়শি ও আশ্রয় নেওয়া আত্মীয়দের পাহারায় দল গঠন করি আমরা।’
সুরজিৎ বলেন, ‘১৯ মে কালিগঞ্জ সেতু পার হয়ে ভাঙা ইটের রাস্তা ধরে পাঞ্জাবিদের জিপ ও ট্রাকের বহর ঢুকে এলাকায়। সেখানে তাদের সঙ্গে আমাদের গুলি বিনিময় হয়। পরে আমরা খাল পার হয়ে অন্য জায়গায় চলে যাই। এরপরেই শুরু হয় তাণ্ডব।’ তিনি বলেন, ‘ঘরে ঘরে আগুন দেওয়া হয়। আমার বাড়িতে ঢুকেও হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে হানাদাররা। নিজের হাতে অস্ত্র থাকা সত্ত্বেও ওই দিন আমি বাবা ও স্বজনদের রক্ষা করতে পারিনি। ঘটনার পরে বাড়ি ফিরে দেখি উঠানে-রাস্তায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে লাশ পড়ে আছে।’
পরিবারের লোকজনকে হারিয়ে অনেকটা উন্মাদ হয়ে পড়েন জানিয়ে সুরজিৎ দাশ বলেন, নৃশংস এই ঘটনার পর ভাত মুখে ওঠে না। এখনো সেই স্মৃতি তাড়া করে ফেরে। এক দিনের জন্যও সেই ঘটনা ভুলতে পারেন না।
সুরজিৎ দাশ অকৃতদার। তিনি চট্টগ্রাম নগরে এক ভাগনের বাসায় থাকেন। লেখক জামাল উদ্দিন বলেন, বীর মুক্তিযোদ্ধা সুরজিৎ দাশের বাবা রমনীমোহন দাশ ছিলেন গ্রাম চিকিৎসক। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের মহানায়ক মাস্টারদা সূর্য সেনের বিপ্লবী দলের অন্যতম এক যোদ্ধা তিনি। যেসব বিপ্লবী গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হতেন, তাঁদের গোপনে চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করে তোলার দায়িত্ব পালন করতেন রমনীমোহন।
জামাল উদ্দিন বলেন, ‘ব্রিটিশ সরকার রমনীমোহনকে গ্রেপ্তার করে কারাগারেও পাঠিয়েছিল। দীর্ঘ সময় পর তিনি কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করলেও ১৯৭১ সালে ৮৫ বছর বয়সে তিনি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গুলিতে শহীদ হন।’
সুরজিৎ দাশের প্রতিবেশী সজল ভট্টাচার্য বলেন, ‘সুরজিৎ দাশকে আমরা বহুবার চেষ্টা করেছি ভাত খাওয়াতে। তাঁকে কিছুতেই রাজি করানো যায় না। তিনি ভাত না খেয়ে কেবল কলা-রুটি, বিস্কুট ইত্যাদি খেয়ে জীবনধারণ করে আসছেন।’