পিএসসি সংস্কার: প্রশ্নটা গতি ও স্বচ্ছতার
Published: 4th, May 2025 GMT
সরকারি কর্ম কমিশন পিএসসি সংস্কারের আন্দোলন চলছে। গত ২৯ এপ্রিল আন্দোলনকারীরা ৮ দফা দাবি বাস্তবায়নে এক সপ্তাহের আলটিমেটাম দিয়েছেন। সরকারি চাকরিতে নিয়োগ প্রক্রিয়ার সাংবিধানিক এই প্রতিষ্ঠান তারুণ্যের কাঙ্ক্ষিত বিসিএস পরীক্ষা পরিচালনা ও নিয়োগের সুপারিশও করে থাকে।
পিএসসি নিয়ে সবচেয়ে বড় অভিযোগ, নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ধীরগতি। একেকটি বিসিএস শেষ হতে চার বছর লেগে যায়। গত বছর ৪১তম বিসিএসের সব কার্যক্রম শেষ হয়েছে। বিজ্ঞপ্তি থেকে যোগদান পর্যন্ত হিসাব করলে সব কার্যক্রম শেষ হতে সাড়ে চার বছর লেগেছে। ২০২১ সালের জানুয়ারিতে এক সাক্ষাৎকারে পিএসসির তৎকালীন চেয়ারম্যান সোহরাব হোসাইন যদিও সমকালকে বলেছিলেন, এক বছরেই বিসিএসের নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা সম্ভব। বাস্তবে তা দেখিয়ে যেতে পারেননি।
বস্তুত নিয়োগের আগে কয়েক ধাপের পরীক্ষা নিতে গিয়ে কয়েক ব্যাচের মধ্যে তালগোল এবং নিয়োগের পর ক্যাডার ও নন-ক্যাডারের নানা পদোন্নতি পরীক্ষার ভারে ন্যুব্জ পিএসসির পক্ষে এক বছরে একটি বিসিএস সম্পন্ন করা কঠিনই। তাই বলে তো এমন দীর্ঘসূত্রতা চলতে পারে না। এ ছাড়া গত বছর আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগ মুহূর্তে জুলাইয়ে বিসিএসের প্রশ্ন ফাঁসের যে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন চ্যানেল টোয়েন্টিফোরে প্রকাশ হয়, তাও ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেয়। সব মিলিয়ে জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের পর পিএসসি সংস্কারের প্রশ্নটিও জোরালো ও জরুরি হয়ে ওঠে।
৪৬তম বিসিএস প্রিলিমিনারির প্রশ্ন ফাঁসের খবরে পরীক্ষাটি বাতিলের আন্দোলন করেন প্রার্থীরা। কিন্তু অক্টোবরে পিএসসি চেয়ারম্যানসহ সব সদস্য পদত্যাগ করেন। নতুন দায়িত্বপ্রাপ্তরা সে ফল প্রকাশ করলেও প্রথম ধাপে উত্তীর্ণ হন ১০ হাজার ৬৩৮ জন। পরে আরও ১১ হাজার প্রার্থীকে উত্তীর্ণ ঘোষণা করে আপাতত ৪৬তম বিসিএস প্রিলিমিনারি বাতিলের আন্দোলন সামাল দেওয়া হয়। এই বিসিএসের লিখিত পরীক্ষা ৮ মে থেকে শুরুর কথা ছিল। সেটাও শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে গত সপ্তাহে স্থগিত হয়ে যায়।
পিএসসি সংস্কার আন্দোলনের আট দফার মধ্যে রয়েছে– ৪৬তম বিসিএস লিখিত পরীক্ষার আগেই প্রশ্ন ফাঁসে জড়িতদের বরখাস্ত ও শাস্তির ব্যবস্থা এবং ভবিষ্যতে এই বিসিএস বাতিলের শঙ্কা তৈরি না হওয়ার নিশ্চয়তা। পাশাপাশি জুনের মধ্যে ৪৪তম বিসিএসের চূড়ান্ত ফল প্রকাশ। তাদের দাবির মধ্যে আরও আছে ৪৫তম বিসিএস থেকে মৌখিক পরীক্ষার নম্বর ১০০ করা, ৪৫তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার ফল জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে প্রকাশ। আন্দোলনকারীরা প্রতিটি বিসিএস পরীক্ষা এক থেকে দেড় বছরের মধ্যে সম্পন্ন করার সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপেরও দাবি জানিয়েছেন। প্রিলিমিনারি, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার নম্বর প্রকাশ এবং লিখিত পরীক্ষার অন্তত দু’মাস আগে সূচি ঘোষণার কথা বলেছেন। এসব দাবি যুক্তিগ্রাহ্য। পরীক্ষায় গতি ও স্বচ্ছতা আনতে এগুলোর বাস্তবায়ন দরকার।
আন্দোলনকারীরা চান দ্রুত অধ্যাদেশ জারি করে পিএসসির সদস্য সংখ্যা ২৫ থেকে ৩০-এ উন্নীত করা হোক। তাতে সাক্ষাৎকার পর্ব দ্রুত শেষ করা সম্ভব হবে। লিখিত খাতা মূল্যায়নে গতি আনার পাশাপাশি নিরাপত্তা ও নিরপেক্ষতার জন্য পিএসসিতে বসে খাতা দেখার ব্যবস্থা চাইছেন আন্দোলনকারীরা।
পিএসসি ঘিরে যেসব অভিযোগ ও অসন্তোষ, সেগুলো মেটানোর দায় প্রতিষ্ঠানকেই নিতে হবে, বলা বাহুল্য। একই সঙ্গে মৌখিক পরীক্ষার আগে ফের ক্যাডার পছন্দক্রম বাছাইয়ের সুযোগ দেওয়ার বিষয়ও ইতিবাচক। অনেকে শুরুতে না বুঝেও পছন্দক্রম দিতে পারেন। সে জন্য যারা লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবেন, ফের তাদের ক্যাডার বাছাইয়ের সুযোগ দেওয়া যেতেই পারে।
বিসিএসে যারা উত্তীর্ণ হন তাদের ভেরিফিকেশনে হয়রানি বন্ধে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। এর আগে লিখেছিলাম– বিসিএসের স্বপ্ন বনাম ভেরিফিকেশনের দুঃস্বপ্ন (৬ জানুয়ারি, ২০২৫)। ফৌজদারি মামলা ও রাষ্ট্রদ্রোহের সুস্পষ্ট অভিযোগ ছাড়া চূড়ান্ত সুপারিশপ্রাপ্ত প্রার্থীর নিয়োগ আটকানোও উচিত হবে না। পাশাপাশি বিসিএস মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ সবার চাকরির ব্যবস্থা করলে তা সরকারের জন্য যেমন সাশ্রয় হবে, তেমনি প্রার্থীর জন্যও স্বস্তি আনবে।
এসব দাবির বাইরে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পিএসসিকে চাপমুক্ত রাখাও এক ধরনের সংস্কার। অনিয়ম, স্বজনপ্রীতিমুক্ত তো হতেই হবে; প্রশ্ন ফাঁসে জড়িতদের বিচার করা জরুরি। তবে দীর্ঘ মেয়াদে পিএসসির চাপ কমাতে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন তিনটি পিএসসি গঠনের যে সুপারিশ করেছে, সেগুলোও সুবিবেচনাপ্রসূত। এর মধ্যে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সার্ভিস ছাড়া বাকি সার্ভিসের নিয়োগ ও পদোন্নতির পরীক্ষার জন্য একটি পিএসসি হবে। এর নাম হবে পিএসসি (সাধারণ)। আর শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সার্ভিসের নিয়োগ ও পদোন্নতির জন্য পৃথক দুটি পিএসসি করার সুপারিশ করা হয়েছে।
শিক্ষার্থীদের সাম্প্রতিক আন্দোলনের মধ্যেই দুটি পিএসসি গঠনের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। সেখানে ক্যাডার সার্ভিসের জন্য একটি, নন-ক্যাডারের জন্য আরেকটি। অন্তত দুটি হলেও পিএসসির চাপ কিছুটা লাঘব হতে পারে।
বিসিএস ও সরকারি চাকরি এখন অধিকাংশ শিক্ষার্থীর আরাধ্য বিষয়। অনেক শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষায় পদার্পণের পর থেকেই এ চাকরির জন্য প্রস্তুতি নেন। এখানে আসন কম প্রতিযোগিতা বেশি বলে লাখ লাখ তরুণ বছরের পর বছর প্রস্তুতি নিয়ে থাকেন। ফলে বড় সংস্কার হওয়া উচিত মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ। মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে কম সময়ের মধ্যে নিয়োগ সম্পন্ন হলে চাকরিপ্রত্যাশীদের দুর্ভোগ কমবে এবং বছরের পর বছর অপেক্ষা করে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময়ও অপচয় হবে না।
মাহফুজুর রহমান মানিক: জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক, সমকাল
mahfuz.
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ল খ ত পর ক ষ ম খ ক পর ক ষ ম ব স এস ব স এস র পর ক ষ র ব স এস প ব যবস থ প এসস র র জন য সরক র র বছর
এছাড়াও পড়ুন:
বাসদের ৪৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে লাল পতাকা মিছিল, ‘বাম বিকল্প’ গড়ার আহ্বান
বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) ৪৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী এবং সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ১০৮তম বার্ষিকী আজ ৭ নভেম্বর, শুক্রবার। দিনটি উপলক্ষে আজ বিকেলে রাজধানী ঢাকায় লাল পতাকা মিছিল করেছে বাসদ। এর আগে দলটির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর সমাবেশে মুক্তিযুদ্ধ ও গণ-অভ্যুত্থানের চেতনায় ‘বাম বিকল্প’ গড়ে তোলার আহ্বান জানানো হয়।
বেলা সাড়ে তিনটার দিকে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে বাসদের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর সমাবেশ হয়। সমাবেশ শেষে লাল পতাকা মিছিল বের করা হয়। মিছিলটি প্রেসক্লাব, পল্টন, শহীদ নূর হোসেন স্কয়ার, গোলাপ শাহ মাজার, বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ ও বায়তুল মোকাররম ঘুরে পল্টন মোড়ে গিয়ে শেষ হয়।
১৯৮০ সালের ৭ নভেম্বর বাসদের আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল। সময়ের পরিক্রমায় দলটি কয়েক ভাগে বিভক্ত হয়েছে। আজ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে লাল পতাকা মিছিলের আগে প্রেসক্লাবের সামনে সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন বাসদের সাধারণ সম্পাদক ও বাম গণতান্ত্রিক জোটের সমন্বয়ক বজলুর রশীদ ফিরোজ। আরও বক্তব্য দেন দলের কেন্দ্রীয় সহকারী সাধারণ সম্পাদক রাজেকুজ্জামান রতন, সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য নিখিল দাস ও সদস্য জুলফিকার আলী। তাঁরা মুক্তিযুদ্ধ ও গণ-অভ্যুত্থানের চেতনায় বাম বিকল্প গড়ে তোলার আহ্বান জানান।
সমাবেশে নেতারা বলেন, চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানে ছাত্র, শ্রমিক, জনতা রক্ত দিয়ে অভ্যুত্থান করে স্বৈরাচারী সরকারকে হটাল। এরপর অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলেও গণমানুষের স্বার্থের বদলে সংস্কার, আদেশ, গণভোট ইত্যাদি অপ্রয়োজনীয় বিতর্কে সময়ক্ষেপণ করছে।
বাসদের নেতারা বলেন, চব্বিশের অভ্যুত্থানের পরও বৈষম্যবিরোধী চেতনার বিপরীতেই দেশ পরিচালিত হচ্ছে। তাঁদের অভিযোগ, শ্রমিকের চাকরি, মজুরি, কৃষকের ফসলের ন্যায্য দাম নিশ্চিত করা, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ, বেকারত্ব দূর করা, নারীদের লাঞ্ছনা, অপমান ও নির্যাতন রোধ এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষদের নিরাপত্তা নিয়ে রাষ্ট্র কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিচ্ছে না।
সমাবেশে নেতারা আরও বলেন, আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণা দেওয়া হলেও সম্প্রতি নির্বাচন বানচালের নানামুখী ষড়যন্ত্র দেখা যাচ্ছে। খুনোখুনিসহ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্রমেই অবনতি ঘটছে।
নেতারা মনে করেন, নির্বাচন বানচালের যেকোনো ষড়যন্ত্র দেশকে আরও ভয়ানক সংকটে ঠেলে দেবে। দেশবাসীকে গণতন্ত্র ও ভোটাধিকারবিরোধী যেকোনো ষড়যন্ত্র প্রতিরোধ করতে হবে।