সরকারি কর্ম কমিশন পিএসসি সংস্কারের আন্দোলন চলছে। গত ২৯ এপ্রিল আন্দোলনকারীরা ৮ দফা দাবি বাস্তবায়নে এক সপ্তাহের আলটিমেটাম দিয়েছেন। সরকারি চাকরিতে নিয়োগ প্রক্রিয়ার সাংবিধানিক এই প্রতিষ্ঠান তারুণ্যের কাঙ্ক্ষিত বিসিএস পরীক্ষা পরিচালনা ও নিয়োগের সুপারিশও করে থাকে।

পিএসসি নিয়ে সবচেয়ে বড় অভিযোগ, নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ধীরগতি। একেকটি বিসিএস শেষ হতে চার বছর লেগে যায়। গত বছর ৪১তম বিসিএসের সব কার্যক্রম শেষ হয়েছে। বিজ্ঞপ্তি থেকে যোগদান পর্যন্ত হিসাব করলে সব কার্যক্রম শেষ হতে সাড়ে চার বছর লেগেছে। ২০২১ সালের জানুয়ারিতে এক সাক্ষাৎকারে পিএসসির তৎকালীন চেয়ারম্যান সোহরাব হোসাইন যদিও সমকালকে বলেছিলেন, এক বছরেই বিসিএসের নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা সম্ভব। বাস্তবে তা দেখিয়ে যেতে পারেননি।

বস্তুত নিয়োগের আগে কয়েক ধাপের পরীক্ষা নিতে গিয়ে কয়েক ব্যাচের মধ্যে তালগোল এবং নিয়োগের পর ক্যাডার ও নন-ক্যাডারের নানা পদোন্নতি পরীক্ষার ভারে ন্যুব্জ পিএসসির পক্ষে এক বছরে একটি বিসিএস সম্পন্ন করা কঠিনই। তাই বলে তো এমন দীর্ঘসূত্রতা চলতে পারে না। এ ছাড়া গত বছর আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগ মুহূর্তে জুলাইয়ে বিসিএসের প্রশ্ন ফাঁসের যে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন চ্যানেল টোয়েন্টিফোরে প্রকাশ হয়, তাও ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেয়। সব মিলিয়ে জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের পর পিএসসি সংস্কারের প্রশ্নটিও জোরালো ও জরুরি হয়ে ওঠে। 
৪৬তম বিসিএস প্রিলিমিনারির প্রশ্ন ফাঁসের খবরে পরীক্ষাটি বাতিলের আন্দোলন করেন প্রার্থীরা। কিন্তু অক্টোবরে পিএসসি চেয়ারম্যানসহ সব সদস্য পদত্যাগ করেন। নতুন দায়িত্বপ্রাপ্তরা সে ফল প্রকাশ করলেও প্রথম ধাপে উত্তীর্ণ হন ১০ হাজার ৬৩৮ জন। পরে আরও ১১ হাজার প্রার্থীকে উত্তীর্ণ ঘোষণা করে আপাতত ৪৬তম বিসিএস প্রিলিমিনারি বাতিলের আন্দোলন সামাল দেওয়া হয়। এই বিসিএসের লিখিত পরীক্ষা ৮ মে থেকে শুরুর কথা ছিল। সেটাও শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে গত সপ্তাহে স্থগিত হয়ে যায়।

পিএসসি সংস্কার আন্দোলনের আট দফার মধ্যে রয়েছে– ৪৬তম বিসিএস লিখিত পরীক্ষার আগেই প্রশ্ন ফাঁসে জড়িতদের বরখাস্ত ও শাস্তির ব্যবস্থা এবং ভবিষ্যতে এই বিসিএস বাতিলের শঙ্কা তৈরি না হওয়ার নিশ্চয়তা। পাশাপাশি জুনের মধ্যে ৪৪তম বিসিএসের চূড়ান্ত ফল প্রকাশ। তাদের দাবির মধ্যে আরও আছে ৪৫তম বিসিএস থেকে মৌখিক পরীক্ষার নম্বর ১০০ করা, ৪৫তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার ফল জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে প্রকাশ। আন্দোলনকারীরা প্রতিটি বিসিএস পরীক্ষা এক থেকে দেড় বছরের মধ্যে সম্পন্ন করার সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপেরও দাবি জানিয়েছেন। প্রিলিমিনারি, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার নম্বর প্রকাশ এবং লিখিত পরীক্ষার অন্তত দু’মাস আগে সূচি ঘোষণার কথা বলেছেন। এসব দাবি যুক্তিগ্রাহ্য। পরীক্ষায় গতি ও স্বচ্ছতা আনতে এগুলোর বাস্তবায়ন দরকার।
আন্দোলনকারীরা চান দ্রুত অধ্যাদেশ জারি করে পিএসসির সদস্য সংখ্যা ২৫ থেকে ৩০-এ উন্নীত করা হোক। তাতে সাক্ষাৎকার পর্ব দ্রুত শেষ করা সম্ভব হবে। লিখিত খাতা মূল্যায়নে গতি আনার পাশাপাশি নিরাপত্তা ও নিরপেক্ষতার জন্য পিএসসিতে বসে খাতা দেখার ব্যবস্থা চাইছেন আন্দোলনকারীরা।

পিএসসি ঘিরে যেসব অভিযোগ ও অসন্তোষ, সেগুলো মেটানোর দায় প্রতিষ্ঠানকেই নিতে হবে, বলা বাহুল্য। একই সঙ্গে মৌখিক পরীক্ষার আগে ফের ক্যাডার পছন্দক্রম বাছাইয়ের সুযোগ দেওয়ার বিষয়ও ইতিবাচক। অনেকে শুরুতে না বুঝেও পছন্দক্রম দিতে পারেন। সে জন্য যারা লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবেন, ফের তাদের ক্যাডার বাছাইয়ের সুযোগ দেওয়া যেতেই পারে।
বিসিএসে যারা উত্তীর্ণ হন তাদের ভেরিফিকেশনে হয়রানি বন্ধে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। এর আগে লিখেছিলাম– বিসিএসের স্বপ্ন বনাম ভেরিফিকেশনের দুঃস্বপ্ন (৬ জানুয়ারি, ২০২৫)। ফৌজদারি মামলা ও রাষ্ট্রদ্রোহের সুস্পষ্ট অভিযোগ ছাড়া চূড়ান্ত সুপারিশপ্রাপ্ত প্রার্থীর নিয়োগ আটকানোও উচিত হবে না। পাশাপাশি বিসিএস মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ সবার চাকরির ব্যবস্থা করলে তা সরকারের জন্য যেমন সাশ্রয় হবে, তেমনি প্রার্থীর জন্যও স্বস্তি আনবে।  

এসব দাবির বাইরে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পিএসসিকে চাপমুক্ত রাখাও এক ধরনের সংস্কার। অনিয়ম, স্বজনপ্রীতিমুক্ত তো হতেই হবে; প্রশ্ন ফাঁসে জড়িতদের বিচার করা জরুরি। তবে দীর্ঘ মেয়াদে পিএসসির চাপ কমাতে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন তিনটি পিএসসি গঠনের যে সুপারিশ করেছে, সেগুলোও সুবিবেচনাপ্রসূত। এর মধ্যে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সার্ভিস ছাড়া বাকি সার্ভিসের নিয়োগ ও পদোন্নতির পরীক্ষার জন্য একটি পিএসসি হবে। এর নাম হবে পিএসসি (সাধারণ)। আর শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সার্ভিসের নিয়োগ ও পদোন্নতির জন্য পৃথক দুটি পিএসসি করার সুপারিশ করা হয়েছে।
শিক্ষার্থীদের সাম্প্রতিক আন্দোলনের মধ্যেই দুটি পিএসসি গঠনের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। সেখানে ক্যাডার সার্ভিসের জন্য একটি, নন-ক্যাডারের জন্য আরেকটি। অন্তত দুটি হলেও পিএসসির চাপ কিছুটা লাঘব হতে পারে।

বিসিএস ও সরকারি চাকরি এখন অধিকাংশ শিক্ষার্থীর আরাধ্য বিষয়। অনেক শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষায় পদার্পণের পর থেকেই এ চাকরির জন্য প্রস্তুতি নেন। এখানে আসন কম প্রতিযোগিতা বেশি বলে লাখ লাখ তরুণ বছরের পর বছর প্রস্তুতি নিয়ে থাকেন। ফলে বড় সংস্কার হওয়া উচিত মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ। মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে কম সময়ের মধ্যে নিয়োগ সম্পন্ন হলে চাকরিপ্রত্যাশীদের দুর্ভোগ কমবে এবং বছরের পর বছর অপেক্ষা করে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময়ও অপচয় হবে না।

মাহফুজুর রহমান মানিক: জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক, সমকাল
mahfuz.

manik@gmail.com
 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ল খ ত পর ক ষ ম খ ক পর ক ষ ম ব স এস ব স এস র পর ক ষ র ব স এস প ব যবস থ প এসস র র জন য সরক র র বছর

এছাড়াও পড়ুন:

পিএসসি আইন ও বিধি অনুযায়ী চলুক

বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস-বিসিএস পরীক্ষা লইয়া সরকারি কর্ম কমিশন- পিএসসিতে যাহা চলিতেছে তাহা দুর্ভাগ্যজনক। শুক্রবার প্রকাশিত সমকালের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর পুনর্গঠিত পিএসসি ৪৬তম বিসিএসের লিখিত ও ৪৭তম বিসিএসের প্রিলিমিনারির তারিখ পিছাইয়াছে। ইহার পূর্বে ৪৪তম বিসিএসের মৌখিক পরীক্ষার তারিখ দুই দফা পিছাইয়াছেন তাহারা। দফায় দফায় লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা স্থগিত হইবার কারণে রীতিমতো বিসিএসে জট সৃষ্টি হইয়াছে, যাহার সমাধান দ্রুত না হইলে পরিস্থিতি আরও জটিল রূপ ধারণ করিতে পারে। কারণ বারংবার বিসিএস পরীক্ষা পিছাইলে শুধু চাকুরিপ্রার্থীরাই ক্ষতিগ্রস্ত হইবেন না; রাষ্ট্রও উহার নানাবিধ কার্যক্রম পরিচালনায় প্রয়োজনীয় দক্ষ ও মেধাবী কর্মকর্তা নিয়োগে ব্যর্থ হইবে। এহেন পরিস্থিতিতে শেষাবধি ক্ষতিগ্রস্ত হইবেন বিভিন্ন সরকারি সেবাপ্রত্যাশী মানুষ।

প্রতিবেদনমতে, চার বৎসর যাবৎ কোনো বিসিএসের চূড়ান্ত ফল না হইবার কারণে বিপুলসংখ্যক প্রার্থী ৪৪ হইতে ৪৭তম– এই চারটি বিসিএসেই আবেদন করিয়াছেন। চাকুরিস্থলে প্রবেশের বয়স বজায় থাকিতেই তাহারা এই সকল পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করিতে চান। স্বাভাবিকভাবেই এই চার বিসিএস লইয়া প্রবল চাপ তৈয়ার হয় পিএসসির উপর। চাকরিপ্রার্থীদের কথা বিবেচনা করিয়া পিএসসিও দ্রুত সকল পরীক্ষা সম্পন্নকরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কিন্তু ৪৪তম বিসিএসের মৌখিক পরীক্ষা ও ৪৬তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষাসূচি একই সময়ে নির্ধারণ করায় বিপত্তি বাধে। উপরন্তু ৪৫তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার ফল প্রকাশের পূর্বেই ৪৬তমের লিখিত পরীক্ষাসূচি ঘোষণা করিবার কারণে অনেক প্রার্থী তিনটি বিসিএসে (৪৪, ৪৫ ও ৪৬তম) অবতীর্ণ হইতে বাধ্য হইতেছেন। তদুপরি, ৪৭তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষার তারিখও ঘোষণা করে পিএসসি। তিনটি লিখিত পরীক্ষা দিয়া আবার ৪৭তম প্রিলিমিনারির জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ এই সকল প্রার্থীর জন্য সত্যই কষ্টকর। তবে দুঃখজনক হইল, বিষয়টি লইয়া দফায় দফায় পিএসসি চেয়ারম্যান ও সদস্যদের সহিত তাহারা আলোচনা করিবার পরও সমাধান পান নাই।

এদিকে গত বৎসরের এপ্রিলে অনুষ্ঠিত ৪৬তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ উত্থাপিত হয়। পিএসসি তাহা আমলে না লইলে আন্দোলনকারীরা আরও বিক্ষুব্ধ হইয়া উঠেন। স্পষ্টত, পরীক্ষা-সংক্রান্ত বিষয়াদি সুসম্পন্নকরণে পিএসসি তালগোল পাকাইয়া ফেলিয়াছে। ইহার খেসারত দিতে হইতেছে সাধারণ বিসিএস প্রার্থীদের। তবে দফায় দফায় পরীক্ষার তারিখ পিছাইবার পশ্চাতে পিএসসির উপর ‘অদৃশ্য প্রভাব’ ক্রিয়াশীল বলিয়া আলোচনা বিস্তর। অভিযোগ উঠিয়াছে, সরকারের দুইজন উপদেষ্টা এবং একটি রাজনৈতিক দলের চাপের কারণে পিএসসি কোনো সিদ্ধান্তে স্থির থাকিতে পারিতেছে না। প্রতিবেদনে বলা হইয়াছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে সাংবাদিক সমিতির অফিসে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি এবং পিএসসি সদস্যদের মধ্যকার দীর্ঘ আলোচনার পর পিএসসি লিখিত পরীক্ষা আপাত স্থগিতকরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। তাহা ঘোষণা করেন পিএসসির জনৈক সদস্য। এই বিস্ময়কর ঘটনাটি ঘটিয়াছে সরকারের একজন উপদেষ্টার চাপাচাপির ফলে। পিএসসি একটা সাংবিধানিক, স্বাধীন ও স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান। উহার কার্যক্রমে সরকারের উপদেষ্টারা অযাচিত হস্তক্ষেপ করিলে প্রতিষ্ঠানটির স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হইবারই কথা। স্মরণ করা যাইতে পারে, অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর পিএসসির পুনর্গঠন লইয়াও বহু নাটকীয়তা পরিলক্ষিত হইয়াছে। প্রথমে এক দল সদস্যকে নিযুক্তির পর রহস্যময় কারণে অত্যন্ত দ্রুততায় সকলের নিয়োগ বাতিল হইয়া যায়। নিযুক্ত করা হয় নূতন ১৫ জনকে। একটা সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে এহেন কাণ্ড কল্পনাতীত।

সাম্প্রতিক অতীতে বিসিএস পরীক্ষা লইয়া বহু কিছু ঘটিয়াছে। বিসিএসে নিয়োগ শিক্ষার্থীদের নিকট কতটা আরাধ্য বিষয়, সম্ভবত উহা ব্যাখ্যা করিবার কিছু নাই। যেই দেশে এখনও লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা সমাপ্ত করিয়া বৎসরের পর বৎসর বিসিএসের জন্য অপেক্ষমাণ, সেই দেশে যখন পিএসসির অভ্যন্তরীণ সমস্যা বা সরকারের অযাচিত হস্তক্ষেপের কারণে বিসিএস পরীক্ষা বারংবার পিছাইয়া যায়, তাহা একেবারেই গ্রহণযোগ্য হইতে পারে না। আমাদের প্রত্যাশা, সরকার পিএসসিকে নিজস্ব আইন ও বিধি অনুযায়ী চলিতে দিবে এবং পিএসসি অবিলম্বে চাকুরিপ্রত্যাশীদের আকাঙ্ক্ষা পূরণে যৌক্তিক পদক্ষেপ গ্রহণ করিবে। 

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • পিএসসি আইন ও বিধি অনুযায়ী চলুক