দিনাজপুরে ধান ক্ষেতে দক্ষিণা হাওয়ায় দোল খাচ্ছে কৃষকের সোনালী স্বপ্ন। শুরু হয়েছে বোরো ধান কাটা-মাড়াইয়ের মহোৎসব। বাজারে ধানের দাম ভাল থাকায় খুশি ধানচাষিরা। আবহাওয়া ভাল থাকায় কাটা-মাড়াইয়ে স্বস্তি পাচ্ছেন তারা।

চলতি মৌসুমে এবার জেলায় বোরো ধানের চাষ হয়েছে ১ লাখ ৭৪ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে। প্রায় ২০% জমির ধান কাটা-মাড়াই হয়েছে বলে জানিয়েছে জেলা কৃষি অধিদপ্তর। 

জেলার বিভিন্ন উপজেলার বোরো ক্ষেত ঘুরে দেখা যায়, মাঠে মাঠে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সোনালি রঙের পাকা ধান। মনের সুখে এসব ধান কাটছে শ্রমিকরা। কাটা-মাড়াই খরচ মিলে শ্রমিকরা নিচ্ছেন বিঘাপ্রতি ৩ হাজার ৫০০ টাকা থেকে ৪ হাজার টাকা। বাজারে ধানের ভালো দাম থাকায় উৎপাদনে মনোযোগী হয়ে উঠছেন চাষিরা। 

বিরামপুর উপজেলার কাটলা গ্রামের বোরো চাষি মাসুদ রানা বলেন, “এবার আমি ১৩ বিঘা জমিতে ধানের চাষ করেছি। মাঠে ধানের ফলন অনেক ভাল দেখা যাচ্ছে। ধান কাটা-মাড়াই শুরু করেছে। যে মাঠে ধান বেশি পাক ধরেছে, ঐ মাঠের ধান কাটতেছি। আশা করছি বাজারে দামও ভাল পাবো।”

হাকিমপুর উপজেলার কাকড়াবালি গ্রামের কৃষক তোফাজ্জল হোসেন বলেন, “সাড়ে তিন বিঘা জমিতে ধানচাষ করেছি। ধান লাগানো থেকে বর্তমান কাটা-মাড়াই পর্যন্ত খরচ অনেক বেশি হবে। তবে ফলন ভাল, বিঘাপ্রতি ২২ থেকে ২৫ মণ ধান পাবো। এছাড়াও বাজারে ধানের দাম অনেকটা ভাল, ১২২০ থেকে ১২৩০ টাকা মণ। আগামীতে আরও দাম বেশি হতে পারে।” 

হাকিমপুর উপজেলার কৃষি অফিসার আরজেনা বেগম বলেন, “চলতি বোরো মৌসুমে এ উপজেলায় চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৭ হাজার ১১৫ হেক্টর জমি। সেখানে চাষ হয়েছে ৭ হাজার ৫৯৫ হেক্টর জমি। মাঠে বোরো ধানের ফলন এখন পর্যন্ত ভালো আছে। বিভিন্ন চিকন জাতের ধান বিঘাপ্রতি ২৫-২৬ মণ হচ্ছে। এছাড়াও উন্নত জাতের বীজ থেকে প্রতি শতকে ১ মণ হারে কৃষকরা ধান পাচ্ছেন। আশা করছি আবহাওয়া ভালো থাকলে কৃষকরা তাদের কাঙ্ক্ষিত ফসল ঘরে তুলতে পারবেন।”

দিনাজপুর জেলা কৃষি অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো.

নুরুজ্জামান বলেন, “জেলার ১৩টি উপজেলায় মোট ১ লাখ ৭৪ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে বোরো ধান চাষ হয়েছে। এ জেলা ধানের জন্য বিখ্যাত, পাশাপাশি অন্যান্য ফসলও অনেক ভালো হয়ে থাকে। আমরা কৃষকদের সার্বিক সহযোগিতা করে আসছি। আশা করছি, কৃষকরা লাভবান হবে।”

ঢাকা/মোসলেম/টিপু 

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর উপজ ল র

এছাড়াও পড়ুন:

সংস্কার নিয়ে আর অবহেলা নয়

কী উদ্দেশ্যে জুলাই গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছিল, তা নিয়ে এর অংশীজনের মধ্যেই রয়েছে বিতর্ক। তবে এর প্রেক্ষাপট নিয়ে বিতর্ক নেই। সবাই দেখেছি, সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার নিয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন কীভাবে চলে গিয়েছিল সরকার পতনের দিকে। আর কোনো সংস্কারের বিষয় তখন সামনে ছিল না। সরকার এর সহজ নিষ্পত্তির দিকে গেলে আন্দোলনের দ্রুত সমাপ্তি ঘটত বলেই ধারণা। 
এর বদলে নিষ্ঠুরভাবে আন্দোলন দমনের চেষ্টা সরকারের পতনকে করে ত্বরান্বিত। সরকার পতনের মাত্র দু’দিন আগে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের জনসমাবেশ থেকে আসে সরকারের পদত্যাগের পাশাপাশি রাষ্ট্র সংস্কারের ঘোষণা। 

সংস্কারের প্রশ্ন সামনে এনেছিল গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দানকারী শিক্ষার্থী-তরুণেরা। তবে সংস্কারের প্রশ্নটি নতুন নয়। নব্বইয়ে সেনাশাসন অবসানের পর গঠিত প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেই রাষ্ট্র সংস্কারে সুপারিশ প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। সেই সরকারের অন্যতম উপদেষ্টা ড. রেহমান সোবহানের উদ্যোগে ২৯টি টাস্কফোর্সে দুই শতাধিক বিশেষজ্ঞ কাজ করেন স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে। পরবর্তীকালে তাদের সুপারিশ বাস্তবায়নের প্রয়াস থাকলে সংস্কারের প্রশ্নটি এখন এত তীব্রভাবে সামনে আসত না। 

সংস্কার এ দেশে অবহেলিত বিষয়। অনেক ক্ষেত্রে জনসমর্থিত সংস্কারের বিপরীতেও কাজ করা হয়েছে। জাতীয় নির্বাচনকালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের বিষয়টি এ ক্ষেত্রে উল্লেখ্য। শেখ হাসিনা সরকার এটা করে নির্বাচন ব্যবস্থাই ধ্বংস করে দিয়েছিল। এ প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বিনষ্টসহ বিভিন্ন অনাচারে নিমজ্জিত হয় সরকার। তাতে জাতিও অপরিমেয় ক্ষতির শিকার হয়েছে। জুলাই গণঅভ্যুত্থান সেখান থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ সৃষ্টি করেছে বৈ কি। সংস্কারের প্রশ্নটি আর অবহেলিত না রেখে সেটা করা গেলে গণতন্ত্রপ্রিয় কারোরই আপত্তি থাকার কথা নয়। 
গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র সংস্কারে গুরুত্ব দিচ্ছে শুরু থেকেই। মুহাম্মদ ইউনূস এর প্রধান হওয়ায় বিষয়টি আরও গতি পেয়েছে। স্মর্তব্য, ড. রেহমান সোবহানের উদ্যোগে গঠিত একটি টাস্কফোর্সের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি। সংস্কার ছাড়া শুধু একটি নির্বাচন আয়োজনে তারা কোনো অর্থ দেখেন না। আশার কথা, গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী কোনো দলও সংস্কারের বিরোধিতা করছে না। সরকার নিজে থেকে ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন করলে তাদের সবাই একে স্বাগত জানায়। কমিশনগুলোর রিপোর্ট থেকে বাছাই করা সুপারিশের ওপর সংলাপেও অংশ নিচ্ছে তারা। এর দ্বিতীয় পর্যায় চলমান। 

প্রথম পর্যায়ের সংলাপে যেসব প্রশ্নে ঐকমত্য মেলেনি, সেগুলোয় ঐকমত্য আনতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সংবিধান সম্পর্কিত কিছু সংস্কারকে তারা বলছে ‘মৌলিক সংস্কার’। এর বাইরে অনেক সুপারিশে রাজনৈতিক দলগুলো কিন্তু একমত হয়েছে। বাছাই করা অনেক সুপারিশ নিয়ে আলোচনার আদৌ প্রয়োজন নেই বলে মনে করে সরকার। এ নিয়ে কেউ আপত্তি জানায়নি। বরং প্রশ্ন রাখা হচ্ছে– কেন এগুলোর বাস্তবায়ন শুরু হয়নি। এর মধ্যে কিছু আইনগত ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার করতে গিয়ে সরকার বিপাকে পড়েছে অবশ্য। এ অভিজ্ঞতার কারণেও অন্যান্য ক্ষেত্রে হাত দিতে তারা অনুৎসাহী হতে পারে। অর্থনীতি বিষয়ে কমিটি আর টাস্কফোর্সের রিপোর্ট বাস্তবায়নেও আগ্রহ দেখাচ্ছে না সরকার। এ অবস্থায় মৌলিক সংস্কারে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার জন্য আয়োজিত সংলাপ শেষে ‘জুলাই সনদ’ ঘোষণাতেই সরকার উৎসাহী। জুলাইয়ের মধ্যেই নাকি এটি সম্পন্ন হবে। 

সংস্কার সুপারিশের যেসব বিষয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করা গেল না, সেসবও থাকবে জুলাই সনদে। সংস্কারের কতখানি বর্তমান শাসনামলে আর কতখানি নির্বাচিত সরকারের আমলে বাস্তবায়িত হবে, সেটাও স্পষ্ট করা হবে। একতরফাভাবে সংস্কার চাপিয়ে দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। চলমান সংলাপে যেসব ঐকমত্য মিলবে, সেগুলোও অনুমোদিত হবে নির্বাচিত সংসদে। সে অর্থে জুলাই সনদ হবে রাষ্ট্র সংস্কারের অঙ্গীকারনামা। নব্বইয়ের পট পরিবর্তনের পরও রাজনৈতিক দলগুলো কিছু অঙ্গীকারে পৌঁছেছিল, যা ‘তিন জোটের রূপরেখা’ নামে পরিচিত। এটি বাস্তবায়নের অভিজ্ঞতাও খারাপ। দীর্ঘদিন পর যে জুলাই সনদ আসতে যাচ্ছে, তা বাস্তবায়নের অভিজ্ঞতা কি ভিন্ন হবে? 

প্রধান দল বিএনপি অবশ্য প্রায় দু’বছর আগেই রাষ্ট্র মেরামতে ৩১ দফা ঘোষণা করেছিল। তারা বলছে, এখনকার সংস্কার প্রস্তাবের সিংহভাগই সেই ৩১ দফায় রয়েছে। তা সত্ত্বেও মৌলিক সংস্কারের কিছু প্রশ্নে তাদের ভিন্নমত স্পষ্ট। ছাড় দেওয়ার বেলায়ও সতর্ক দেখা যাচ্ছে দলটিকে। সত্যি বলতে, বিএনপির আপত্তি উপেক্ষা করে কোনো সংস্কার এগিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। এমনকি সংলাপে উপস্থিত সিংহভাগ দল একমত হলেও নয়। সংস্কারে থাকা চাই সব দলের ঐকমত্য। এটা অন্তর্বর্তী সরকারেরও অবস্থান। তার পক্ষে ঐকমত্য কমিশন কেবল চাইছে যতটা সম্ভব ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করতে। প্রধান উপদেষ্টা এ লক্ষ্যেই কমিশনটি গঠন করেছিলেন। এর মেয়াদও সুনির্দিষ্ট। 

এর মধ্যে নির্বাচনের রোডম্যাপও সুস্পষ্ট হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। বিচার ও সংস্কারে ‘পর্যাপ্ত অগ্রগতি’ এলে রমজানের আগে, ফেব্রুয়ারিতেও বহুল প্রত্যাশিত নির্বাচনটি করা যেতে পারে। আদর্শস্থানীয় না হলেও গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী অস্থির পরিস্থিতিতে দ্রুত নির্বাচন হওয়া যে প্রয়োজন, সেই মত এখন জোরালো। প্রায় ১১ মাসেও সংস্কারে অগ্রগতি না হওয়ায় সংস্কারবাদী অনেকেই এখন দ্রুত নির্বাচন দেখতে চাইছেন। ভঙ্গুর আইনশৃঙ্খলার সঙ্গে স্থবির অর্থনৈতিক পরিস্থিতিও নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রে উত্তরণের দাবিকে করে তুলেছে প্রবল। এ পরিস্থিতিতে নির্বাচন নিকটবর্তী করতে সরকারও দৃশ্যত প্রস্তুত বলে মনে হচ্ছে। 

ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের সম্ভাবনা তৈরি হওয়ায় সংস্কার আলোচনায়ও গতি এসেছে, বলতে হবে। নির্বাচন কমিশনকেও নড়েচড়ে বসতে দেখা যাচ্ছে। তারা অবশ্য ডিসেম্বরে নির্বাচন হতে পারে ধরে নিয়েই কাজ করছিল। ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হলে আরও প্রায় দু’মাস মিলবে। নির্বাচন কমিশনেরও কিছু সংস্কারের এজেন্ডা রয়েছে। আছে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সর্বসম্মত সুপারিশ বাস্তবায়নের প্রশ্ন। 
মৌলিক সংস্কারে শেষতক কতটা কী অগ্রগতি হয়, সেটা দেখতে বেশিদিন অপেক্ষা করতে হবে না। বড় ঐকমত্য না হলেও এ বিষয়ক বিতর্ক উপভোগ্য বৈ কি। বিশেষ করে ক্ষমতায় আসা-যাওয়া করা দলগুলো দূরদৃষ্টির পরিচয় দিলে অনেক আগেই এসব ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি আনা যেত বলে মনে হয়। মাঝে সাড়ে ১৫ বছর রাষ্ট্রকে করা হয়েছে কার্যত বিপরীতমুখী। এই বিপুল ক্ষয়ক্ষতি থেকে উঠে 
দাঁড়াতে সংস্কারের পথেই হাঁটতে হবে। তবে ‘প্রত্যাশিত সংস্কার’ করতে গিয়ে আবার নির্বাচনকে বেশি দূরে ঠেলা যাবে না। 
সংস্কার নির্বাচনের পরও করা যাবে; কিন্তু নির্বাচন আয়োজন না করে বসে থাকা যাবে না। ‘মৌলিক সংস্কার’ কাজে অগ্রগতি আসেনি বলে নির্বাচন করা অর্থহীন– এমন অবস্থানও গণতন্ত্রবিরোধী। নির্বাচিত সরকার এলে সংস্কারের সুযোগ অনুপস্থিত হয়ে যাবে– এটা মনে করারও কারণ নেই। এমন হতাশাজনক ভাবনায় আচ্ছন্ন না থেকে নির্বাচনী তপশিল ঘোষণার আগ পর্যন্ত সময়টাকে যতটা সম্ভব সংস্কার বাস্তবায়নে কাজে লাগানোই হবে দায়িত্বশীলদের করণীয়। 

হাসান মামুন: সাংবাদিক, কলাম লেখক

সম্পর্কিত নিবন্ধ