সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে সরাসরি ভোটে নারী সংসদ সদস্য নির্বাচন নিয়ে গত ২৯ এপ্রিল সমকালে প্রকাশিত নিবন্ধের ওপর মতামত দিয়েছেন অনেকেই। অনেকেই একমত, একটি আসনে একই সঙ্গে সাধারণ ও সংরক্ষিত সংসদ সদস্য থাকলে দ্বৈত প্রতিনিধিত্ব সৃষ্টি হবে; যার প্রভাব ভয়াবহ হতে বাধ্য। সে কারণে নারী সংসদ সদস্য নির্বাচনে ঘূর্ণায়মান পদ্ধতি চালুর সুপারিশ করেছে নির্বাচনী ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন। এই ব্যবস্থা চালু হলে অদূর ভবিষ্যতে এক ঝাঁক নারী নেত্রীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন হবে এবং তারা পুরুষদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে নির্বাচনে জয়ী হতে পারবেন। 

কমিশন বর্তমান এক কক্ষের পরিবর্তে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ চালুর সুপারিশ করেছে। বর্তমান ব্যবস্থার মতো প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হবে ৪০০ আসনের নিম্নকক্ষ। এর মধ্যে ১০০ জন নারী ঘূর্ণায়মান পদ্ধতিতে সংরক্ষিত আসন থেকে সরাসরি নির্বাচিত হবেন। আইন পাসের ক্ষমতা থাকবে নিম্নকক্ষের কাছে, মেয়াদ চার বছর।

ঘূর্ণায়মান পদ্ধতি কী? এ পদ্ধতিতে মোট ৪০০ আসনের মধ্যে ‘লটারি অথবা অন্য কোনো পদ্ধতি’তে ১০০টি আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে। এসব আসনে রাজনৈতিক দলগুলোকে কেবল নারী প্রার্থী মনোনয়ন দিতে হবে। চাইলে যে কোনো নারী স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে পারবেন। এ ছাড়া পুরুষদের সঙ্গে সাধারণ আসনে নির্বাচন করতে পারবেন নারীরা। পরের নির্বাচনে ওই ১০০ আসন বাদে বাকি ৩০০ আসনের মধ্য থেকে নতুন করে ১০০ আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত ঘোষণা করা হবে। এভাবে চার মেয়াদে দেশের সব আসনে নারী সংসদ সদস্য নির্বাচিত হবেন। কমিশন মনে করে, এভাবে চলতে থাকলে একসময় নারীরা পুরুষদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে সক্ষম হয়ে উঠবেন। 

তাত্ত্বিকভাবে প্রস্তাবটি ভালো। নির্বাচনী ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান ড.

বদিউল আলম মজুমদারের মতে, এটি ‘ইতিবাচক বৈষম্য’, যা জুরিসপ্রুডেন্সে গ্রহণযোগ্য এবং বাংলাদেশের বর্তমান সংবিধানেও এমন বিধান আছে। তবে রাতারাতি সংসদ নির্বাচনে ২৫ শতাংশ আসন ঘূর্ণায়মান ব্যবস্থার মাধ্যমে নারীর জন্য সংরক্ষিত রাখা হলে রাজনৈতিক দলগুলো মানবে না। তৃণমূল রাজনীতির দিকে তাকালে বোঝা যাবে, কেন মানবে না। 

রাজনৈতিক দলের স্থানীয় পর্যায়ের নেতাদের মধ্যে স্বপ্ন থাকে, তিনি এক সময় এমপি হবেন। সে জন্য ১০-১৫ বছর ধরে এলাকায় অবস্থান তৈরির চেষ্টা করেন। হঠাৎ সেই আসনটি নারীর জন্য সংরক্ষিত হয়ে গেলে তিনি মানবেন? কোনো দলের প্রধানের নির্বাচনী আসনটি রাতারাতি সংরক্ষিত নারী আসন হিসেবে ঘোষণা করা হলে তিনি কি মানবেন? 
দেখা যাবে, কোনো আসন সংরক্ষিত ঘোষণা হওয়ার পর সেখানকার পুরুষ নেতা তাঁর মা, স্ত্রী বা মেয়েকে প্রার্থী করে পেছন থেকে কলকাঠি নাড়বেন। মা জায়েদা খাতুনকে মেয়র বানিয়ে নিজে সব কাজ করতেন গাজীপুর সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলম। নোয়াখালীর হাতিয়া আসনের মোহাম্মদ আলী নির্বাচনে অযোগ্য হওয়ায় তাঁর স্ত্রী সংসদ সদস্য হয়েছিলেন। 
এমনকি নারীর প্রতি রাজনৈতিক প্রতিহিংসা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে। নির্বাচনের পর পুরুষ নেতারা ওই আসনের নারী প্রার্থীদের মামলা, হামলা দিয়ে বাড়িছাড়া করতে পারেন, যাতে ভবিষ্যতে কোনো নারী প্রতিদ্বন্দ্বিতার সাহস না করেন। এমন পরিস্থিতিতে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন হবে, না পিছিয়ে যাবে?

ঢাকার কথাই ধরা যাক। কমিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী ঢাকা জেলার মোট আসন সংখ্যা দাঁড়াবে ২৫, যার মধ্যে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন হবে পাঁচটি। এই পাঁচ আসনে কি স্থানীয় পর্যায়ের রাজনীতি করা নারী মনোনয়ন পাবেন? মনোনয়ন পেলেও নির্বাচিত হতে পারবেন? দুই-একটি বাদে বাকি আসনে তৃণমূলে রাজনীতি করা নারীদের সংসদ নির্বাচন করার মতো আর্থিক ও সাংগঠনিক সক্ষমতাই নেই। এ অবস্থার সুযোগ নিতে পারেন টাকাওয়ালারা। অর্থের বিনিময়ে বিভিন্ন দল থেকে মনোনয়ন কিনতে পারেন অর্থবান পুরুষের স্ত্রী, শ্বাশুড়ি, কন্যা বা নিকটাত্মীয়। যেহেতু সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী দলের বিপক্ষে ভোট দেওয়ার সুযোগ থাকবে, তারা আইন প্রণয়নে ব্যাপক প্রভাব খাটাতে পারেন ওই সংসদ সদস্যদের মাধ্যমে।  

দেখা যাবে, ঢাকায় বসবাসকারী ব্যবসায়ী পরিবারের নারীরা নির্বাচনী এলাকায় গিয়ে টাকা ছিটাতে শুরু করবেন। তাদের হয়ে কাজ করবেন পুরুষ টাউটরা। এদের টাকার কাছে স্থানীয় পর্যায়ের রাজনীতি করা নারীরা অসহায় হয়ে যাবেন। এক পর্যায়ে তারাও টাকার কাছে বিক্রি হয়ে যাবেন। ফলে স্থানীয় রাজনীতি করবেন তৃণমূলের দরিদ্র নারীরা। আর সংসদ সদস্য হবেন ঢাকার এলিটরা। 
২০০৯ সালে সংরক্ষিত আসন থেকে এমপি হওয়ার পর ২০১৪ এবং ’১৮ সালে মানিকগঞ্জের সিংগাইর আসন থেকে এমপি হন গায়িকা মমতাজ বেগম। তিনি সেখানে হাসপাতাল বানিয়েছেন। মানুষের সেবা করেছেন। কিন্তু মানুষ তাঁকে মেনে নেননি; ২০২৪ সালের ভোটারবিহীন নির্বাচনেও হেরে গেছেন স্থানীয় এক পুরুষ নেতার কাছে। সরকার পতনের পর থেকে তিনি লাপাত্তা। 

অন্যদিকে ২০১৪ সালে সংরক্ষিত নারী আসনে এমপি হয়ে এলাকায় কাজ করেছেন, সংসদে গঠনমূলক ভূমিকা রেখেও পরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাননি হবিগঞ্জ-১ আসনের আমাতুল কিবরিয়া কেয়া চৌধুরী। প্রচুর পরিশ্রম করে মানুষের মন জয় করেছেন। ২০২৪ সালেও আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র নির্বাচন করে জয়ী হয়েছেন।

বিএনপির আসিফা আশরাফী পাপিয়া রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্র রাজনীতি করে হল সংসদের ভিপি নির্বাচিত হন। ছাত্র রাজনীতি শেষ করে বিএনপির রাজনীতি করেন। তাঁর স্বামী বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য হারুনুর রশীদের চেয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা বিএনপির রাজনীতিতে কোনো অংশে পিছিয়ে নেই তিনি। সেটি সম্ভব হয়েছে প্রান্ত থেকে রাজনীতি করেছেন বলেই। 
তৃণমূল নারীদের রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে আরেকটি সুপারিশ করা উচিত নির্বাচনী সংস্কার কমিশনের। সেটি হলো, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারে আছেন অথবা কোনো সংস্কার কমিশনের সদস্য হয়ে কাজ করেছেন, তাদের মধ্যে কোনো নারী যেন আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে উচ্চকক্ষ অথবা নিম্নকক্ষের নির্বাচনে অংশ নিতে না পারেন। অন্তত শুধু আগামীবারের জন্য। না করলে সেটি হবে স্বার্থের সংঘাত।  
নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের কথা এলেই বলা হয়– সংসদে নারীদের আনতে হবে। অবশ্যই নারীদের সংসদে আনতে হবে। কিন্তু তৃণমূল পর্যায় থেকে রাজনীতির সুযোগ না দিয়ে রাতারাতি বিভিন্ন আইনকানুনের মাধ্যমে জাতীয় সংসদের সদস্য বানালে কী লাভ হবে? বরং সমাজে নারী-পুরুষ বিরোধ বেড়ে যাবে। 

নির্বাচনী ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন বলেছে, পুরুষদের বিরোধিতার মুখে ঘূর্ণায়মান পদ্ধতি বাদ দেওয়া সঠিক কাজ হবে না। কারণ পশ্চিমবঙ্গে স্থানীয় তৃণমূল পর্যায়ে ঘূর্ণায়মান পদ্ধতি চালু করে নারীদের রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন বেড়েছে। আমরাও স্থানীয় নির্বাচন দিয়ে ঘূর্ণায়মান পদ্ধতি শুরু করতে পারি। রাজনৈতিক দলগুলো এখন চাপের মধ্যে আছে। এই অবস্থায় তাদের দিয়ে নারীর প্রকৃত রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে গ্রহণযোগ্য ও বাস্তবায়নযোগ্য ব্যবস্থা চালু করার জন্য রাজি করানো যাবে। কিন্তু সবকিছু চাপিয়ে দেওয়া হলে কোনোটিই বাস্তবায়িত হবে না।

কামরান রেজা চৌধুরী: সাংবাদিক, গবেষক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: র র জন য ব যবস থ সদস য হ ব এনপ র ক জ কর পর য য় কর ছ ন প রব ন আসন র

এছাড়াও পড়ুন:

বিশ্ব সংগীত দিবস উদযাপনে দুই আয়োজন

একটাই দিন। একটি বিশেষ উপলক্ষ। কিন্তু দুইটি ভিন্ন ভেন্যুতে আয়োজনের ভাবনা ছিল একই- ‘সুরের ছোঁয়ায় শান্তি ও সুস্থতা’। ২১ জুন ছিল বিশ্ব সংগীত দিবস। সংগীতের মাধ্যমে বিশ্বজনীন সংহতি, সাম্য ও মানবতার বার্তা ছড়িয়ে দেওয়ায় ছিল দিবসের লক্ষ্য।

জাতীয় নাট্যশালায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির ব্যানারে এক বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা, অন্যদিকে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘সৃষ্টি বিশ্বময়’-এর নিবেদনে এক মরমি পরিবেশনা। দুই মঞ্চে দুই রকম সুর, তবে চেতনায় অভিন্ন।

বিশ্ব সংগীত দিবস উপলক্ষে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে শুক্রবার বিকেলে এক আন্তরিক আয়োজন করে ‘সৃষ্টি বিশ্বময়’। যার শিরোনাম ছিল ‘সুরের ছোঁয়ায় শান্তি’। মূল উদ্দেশ্য, সংগীতকে মানুষের কাছে একটি নিরাময় শক্তি হিসেবে উপস্থাপন করা, যাকে ঘিরে গড়ে উঠতে পারে যুদ্ধহীন এক মানবিক সমাজ।

অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন- বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব খায়রুল আলম সবুজ। তিনি বলেন, ‘সংগীতের শক্তি এমনই যে, তা হৃদয়ের অন্ধকার দূর করে মননে আলোক ছড়াতে পারে। সংগীতই পারে হানাহানিমুক্ত পৃথিবীর পথে মানুষকে নিয়ে যেতে।’

অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন উদযাপন পর্ষদের আহ্বায়ক সাংবাদিক বাসুদেব ধর ও সদস্যসচিব অলক দাশগুপ্ত। আয়োজনের সূচনায় চর্যাপদের পদ, আবৃত্তি ও আধুনিক বাদ্যযন্ত্রের এক ব্যতিক্রমধর্মী কম্পোজিশন পরিবেশন করেন লাইসা বিনতে কামাল, রত্না দত্ত, সন্দীপা বিশ্বাসসহ একঝাঁক তরুণ শিল্পী। নৃত্য পরিবেশন করেন অংকিতা অথৈ। এছাড়া একক সংগীত, দলীয় পরিবেশনা ও আবৃত্তি পরিবেশন করেন বর্ষা রাহা, রজত শুভ্র, ফয়সাল আহমেদ, সানোয়ারা জাহান নিতু, ব্যান্ডদল ‘ব্রেথলেস’সহ অনেকেই। 

বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির উদ্যোগে জাতীয় নাট্যশালায় অনুষ্ঠিত হয় আরেক আয়োজন-‘সুরের সম্মিলন’। সন্ধ্যায় নাট্যশালার সম্মুখে জাতীয় সংগীতের সুর ও বেলুন উড়িয়ে এ উৎসবের উদ্বোধন করেন একাডেমির সচিব ও দায়িত্বপ্রাপ্ত মহাপরিচালক মোহাম্মদ ওয়ারেছ হোসেন। সঙ্গে ছিলেন একাডেমির সংগীত, নৃত্য ও আবৃত্তি বিভাগের পরিচালক মেহজাবীন রহমান ও বিশিষ্ট সংগীতশিল্পীরা।

সভাপতির বক্তব্যে ওয়ারেছ হোসেন বলেন, ‘যে দেশে যত বেশি সাংস্কৃতিক চর্চা হয়, সে দেশে যুদ্ধ ও সহিংসতা টিকে থাকতে পারে না। সংগীত মানুষের হৃদয়ের কালো দাগ মুছে দিতে পারে।’

শোভাযাত্রার পর মূল মিলনায়তনে শুরু হয় সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। প্রথমে ছিল যন্ত্রসঙ্গীত ও কণ্ঠসংগীতের কোলাজ পরিবেশনা। এরপর মঞ্চে আসে আদিবাসী ব্যান্ড ‘চিম্বুক’ ও ‘বম শিল্পীগোষ্ঠী’। পরে জনপ্রিয় তারকা শিল্পীদের সমবেত পরিবেশনায় মুখর হয় মিলনায়তন। শেষ পর্বে কোলাজ ব্যান্ডের পরিবেশনায় জমে ওঠে সমাপ্তি অনুষ্ঠান।

উল্লেখ্য, বিশ্ব সংগীত দিবসের সূচনা হয় ১৯৮২ সালে ফ্রান্সে, তৎকালীন সংস্কৃতি মন্ত্রী জ্যাক ল্যাং ও সংগীত পরিচালক মরিস ফ্লেয়োরে’র উদ্যোগে। ২১ জুন, গ্রীষ্মের দীর্ঘতম দিনে, সংগীতকে সকলের জন্য উন্মুক্ত করতে এই দিবস উদযাপন শুরু হয়, যা এখন বিশ্বব্যাপী পালিত হয়।

সম্পর্কিত নিবন্ধ