Samakal:
2025-05-08@23:29:13 GMT

সাপবিষয়ক জটিলতা

Published: 8th, May 2025 GMT

সাপবিষয়ক জটিলতা

কছিম পাগল নাচ ধরলেই গ্রামে কোনো সংকট নেমে আসে। গ্রামের বাসিন্দাদের মনে শঙ্কা– কী আপদ আবার ভর করবে এই শস্য-শ্যামল গ্রামের উঠানে? একে একে ওরা সমবেত হতে থাকে গ্রামের মাঝ বরাবর খেজুরগাছ তলায়। সেখানেই নাচছে কছিম পাগল। কোনোদিকে তাকায় না, কেবল চরকির মতো তার নাচ চালিয়ে যায়। হেলেদুলে, হাত দুটো ওপরে তুলে, মাথাটা মাটির দিকে ঝুঁকিয়ে চলতে থাকে নৃত্য।
খেজুরতলার চারপাশে চারটি পায়ে হাঁটা সরু পথ। মনের মধ্যে শঙ্কাটা জিইয়ে রেখে যে যার মতো ঘরে ফিরতে থাকে। ধীরে ধীরে ভিড় কমে আসে। কছিমের নাচ চলছে তখনও। শেষ যে দু’চারজন দর্শক ছিল তারাও বিষন্নমনে হাঁটা ধরে যে যার পথে। চৈত্রের আগুনে কছিমের দেহ পুড়তে থাকে।
সূর্য পশ্চিমে ঢলে নামিয়ে আনে সন্ধ্যা। গ্রামের ঘরে ঘরে আখায় আগুন জ্বলে ওঠে। শজিনা ফুলের মতো ভাতের বলক ফুটতে থাকে। মেয়েরা বঁটিতে আলু ও বেগুন কুটতে কুটতে তোলে কছিম পাগলের নাচের গল্প। তাদের চেহারায় ভয়ের আভা দোল খায়। অনেকে মনে মনে মানত করে সদকা দেওয়ার।
বাতাসের তরঙ্গে এই খবর ভাসতে ভাসতে পবন মণ্ডলের কানে আসে, এমাজ ফকিরের দরজায় কড়া নাড়ে, এমনকি আলিমুদ্দিন সরদারের চাতালে গড়াগড়ি খায়। গ্রামের চায়ের দোকানে, বটতলার হাটের মধ্যে চাউর হয়ে যায়। চিন্তায় পড়ে সবাই। একবার আকাশের দিকে, একবার মাটির দিকে তাকিয়ে থাকে। এই নাচের কোনো মাজেজা তাদের সামনে ধরা দেয় না।
ক্ষেতখামারের কাজ শেষে প্রতিদিন বিকেল হলেই পবন মণ্ডল ও এমাজ ফকির সাপলুডু খেলে। লুডুর ছক্কার চাল দেয় এমাজ ফকির। চার পড়ে। চুরানব্বইয়ের ঘর থেকে উঠে আসে সাতানব্বইয়ের ঘরে। সেই ঘরে হাঁ করে ছিল বিশাল এক সাপ, একবারে তার মুখে পড়ে এমাজ ফকির। তাকে খপ করে গিলে ফেলে সাপ। পেটের মধ্যে সেঁধিয়ে নিয়ে লেজের গোড়ায় ছাড়ে। এমাজ ফকির দেখে সে বারোর ঘরে বসে আছে। পবন মণ্ডল ভালোভাবে ছক্কাটা ঝাঁকিয়ে নিয়ে লুডুর ওপর ফেলে। ছক্কা গড়িয়ে গড়িয়ে থামে, পড়ে পাঁচ। পবন পঞ্চাশের ঘরে যায়। একটা মই সেই ঘরে। পবন মণ্ডল আনন্দে লাফিয়ে তিরানব্বইয়ের ঘরে উঠে যায়। 
নিত্যদিনের সাপলুডু খেলার মাঝেই একদিন খবর আসে খোশতার চেয়ারম্যানের বাড়িতে মানুষের জটলা পেকেছে। লুডুটা ভাঁজ করে পবন মণ্ডল ও এমাজ ফকির চেয়ারম্যানের বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করে। লিচুবাগান পেরিয়ে ধানক্ষেতের সরু আইল বেয়ে চেয়ারম্যানের বাড়ির কান্টায় ওঠে তারা। বাড়িতে লোকভর্তি সমাবেশ। মানুষের ফাঁকফোকর সরিয়ে পবন ও এমাজ দেখে কছিম পাগল মাথা নিচু করে মাটির দিকে মুখ করে বসে আছে। মাথা ন্যাড়া। চোখ দিয়ে অঝোরে ঝরছে পানি। হাতের আঙুল দিয়ে মাটিতে কী যেন আঁকিবুঁকি করছে।
খোশতার চেয়ারম্যান চেয়ার ছেড়ে উঠে পবন ও এমাজের উদ্দেশ্যে বলে, ‘শালাক দিনু নাড়া করি। ওর চুলের জট ঝাঁকি দিয়া নাচ দেখলেই আমার গা গুলায়া যায়।’ এ কথা শুনে পবন মণ্ডল ও এমাজ ফকির বলে, ‘এটা কি ঠিক হইল চেয়ারম্যান সাব? একটা লোকেক আপনি এভাবে অপমান নাও করতি পারতেন।’ জড়ো হওয়া বাকি লোকজন কোনো প্রতিবাদ করল না। নিজের মাথার মূল্য সকলেই বোঝে। কে চায় নিজের মাথাটা পাওয়া যাক পূর্বপাড়ার পাগারে! ‘এই শালাক য্যান এই গ্রামে না দেখি’ বলেই গজগজ করে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে গেল খোশতার চেয়ারম্যান। চেয়ারম্যানের পিছু পিছু বাকি সবাই সুড়সুড় করে হাঁটা দিল। শুধু অনড় পাথরের মতো বসে রইল কছিম পাগল।
গ্রামে রোজই দেখা মিলত কছিম পাগলের। কখনও এপথ থেকে ওপথে, কখনও পথের মোড়ে, কখনও হাটের মধ্যে দেখা যেত তাকে। উশকোখুশকো জটা চুল ও দাড়িতে অদ্ভুত দেখাত কছিম পাগলকে। লুঙ্গি কিংবা প্যান্টের ভেতর শার্ট গুঁজে ঘুরে বেড়াত। রাস্তায় পড়ে থাকা কাগজ, পলিথিন, বিড়ি-সিগারেটের প্যাকেট, ম্যাচের বাক্স যেখানেই যা পেত কুড়িয়ে জড়ো করত শার্টের ভেতরে। ফলে তার পেট উঁচু হয়ে থাকত পোয়াতি মেয়েমানুষের মতো। রূপপুর গ্রামের মেয়েরা এ দৃশ্য দেখে মুচকি মুচকি হাসত। একদল ছেলেমেয়ে কছিম পাগলকে রাস্তায় পেলেই তার পিছু নিত। পুকুর থেকে কাদা তুলে ছুড়ে মারত, বাঁশের কঞ্চি দিয়ে গুঁতো দিয়ে মজা পেত। জ্বালাতনের মাত্রা বেড়ে গেলে সেই ডানপিটে ছেলেমেয়েদের ভয় দেখাত কছিম। তাড়া করতে করতে রেখে আসত গ্রামের মুখে। আবার ফিরে আসত তারা। ফের জ্বালানো শুরু করত। কছিমের পেটে গুঁতো দিয়ে বলত ‘এই পাগলা, তোর পেটেত কী, ছাওয়াল নাকি।’ কছিম চোখ পাকিয়ে চিৎকার করে বলত, ‘আমার পেটের মইদ্যে আচে সাপ! ডানাওয়াল সাপ! পালা পালা ছাইড়ি দিবো!’ 
এ কথা শুনে ভয় পেত ছেলেমেয়েরা। কছিম শার্টের ভেতরে হাত ঢোকালেই পালিয়ে যেত ওরা।
সে রাতে পূর্ণিমা। পশ্চিমপাড়ার বটতলায় বসেছে মাদার গানের আসর। রাত যতই বাড়ছে গ্রামের লোকজনের জমায়েত বাড়ছে ততই। খোশতার চেয়ারম্যানও সদলবলে উপস্থিত হয় সেখানে। লোকজন দাঁড়িয়ে তাকে সম্মান জানায়। আসন পেতে বসার জায়গা করে দেয়। গ্রামের লোকজন যারা নিজেদের রোগ-শোক সারানোর মানত করেছিল তারা প্রার্থনায় বসে। প্রার্থনা শেষে কয়েকজন দোহার-বায়েন খেজুরের পাটিতে গোল হয়ে বসে। শুরু হয় মাদার পীরের বন্দনা গান। গোল হয়ে বসে থাকা দোহার-বায়েনের চারপাশে ঘুরতে থাকেন দরবেশের মতো পোশাক পরা মাদার পীর। তার পেছন পেছন শিষ্য জুমল শাহ গান গাইতে থাকেন। গ্রামের লোক চুপ করে শোনে। কেউ কেউ একটু দূরে গিয়ে বিড়িতে টান দিয়ে আসে। গান চলতেই থাকে, সঙ্গে অভিনয়।
খোশতার চেয়ারম্যানও মনোযোগ দিয়ে গান শোনে। মাথা ন্যাড়া করা কছিম পাগলকেও সেই আসরে একঝলক দেখে পবন মণ্ডল, এমাজ ফকির ও আলিমুদ্দিন সরদার। ঢোল, কাসর, মন্দিরা ও হারমোনিয়াম বাজতে থাকে। গানের তালে তালে নাচতে থাকে ছুকরিরা। মুখে-হাতে রংমাখা ছুকরিদের চোখ ধাঁধানো পোশাক গ্রামের লোকের নজরে লেগে থাকে। কেউ কেউ বারোভাজা চাবাতে চাবাতে চুমকি বসানো শাড়ির দিকে চেয়ে থাকে। নাচের সময় এক ছুকরির বুক থেকে জরির ওড়না মাটিতে পড়ে গেলে কে যেন শিস বাজিয়ে ওঠে। খোশতার চেয়ারম্যান তখন ধমক লাগিয়ে উঠে দাঁড়ায়। রাত গভীর হতে থাকে। জোছনার আলোয় গ্রামের লোকজন শুনতে থাকে মাদার পীরের গান।
একজন দৌড়ে এসে হঠাৎ ভিড়ের ভেতর ঢুকে পড়ে। গানের আসরের লোকজন ঘাবড়ে যায়। ভিড়ের মধ্যে ঢুকে পড়া লোকটা খুঁজতে থাকে চেয়ারম্যানকে। চেয়ারম্যানের চোখাচোখি হতেই লোকটা তার কাছে যায়। কানে কানে কী যেন বলে। খোশতার চেয়ারম্যান তড়াক করে উঠে দাঁড়ায়। দৌড়াতে থাকে বাড়ির দিকে। তার পেছন পেছন দলের লোকজন দৌড়ায়। গান শুনতে আসা লোকজন ভ্যাবাচ্যাকা খায়। একে অন্যের দিকে মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। পরে গানের দিকে মনোযোগ দেয়। গোল হয়ে ঘুরতে থাকেন মাদার পীর। গান গাইতে থাকেন জুমল শাহ।
কিছুক্ষণ পরেই খবরটা রটতে রটতে গানের আসরে আসে। সাপে কেটেছে চেয়ারম্যানের মেয়েকে। তাকে হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছে।
ভ্যান দ্রুত চালানোর তাগিদ দেয় খোশতার চেয়ারম্যান। ভ্যানের ওপর শুইয়ে রাখা হয়েছে চেয়ারম্যানের ক্লাস সেভেনপড়ুয়া মেয়ে রোখসানাকে। বন্ধ হয়ে আসে রোখসানার চোখের পাতা। আশেপাশের সবকিছু ঝাপসা দেখতে থাকে। চেয়ারম্যান ভ্যানচালক আবুলকে তাড়া দেয়। কাঁচা রাস্তা বেয়ে এগিয়ে চলেছে ভ্যান। সাঁকোর ওপর উঠতেই কোত্থেকে এক কুকুর চাকার নিচে পড়ে আর্তনাদ করে ওঠে! ঢোক গিলতে অসুবিধা হয় রোকসানার। গলা বন্ধ হয়ে আসে। ক্রমেই শরীর ফুলে উঠতে থাকে তার। কিছুদূর ভ্যান এগিয়ে যেতেই পেছন থেকে কুকুরটা দৌড়ে এসে ভ্যানের সামনে দাঁড়িয়ে আবারও ঘেউ ঘেউ করতে থাকে। আবুল ক্রিং ক্রিং করে ভ্যানের বেল বাজায়, ছেই ছেই করে, কুকুর সরে না। রাস্তার ওপর শুয়ে পড়ে। ওর শরীরের ওপর টর্চের আলো ফেলে খোশতার চেয়ারম্যান। কুচকুচে কালো কুকুরটার কান বেয়ে রক্ত ঝরতে দেখে। ধীরে ধীরে শরীর ঝিমিয়ে আসে রোকসানার। চোখ দুটোর পাতা সে খোলে না আর। আবুলকে ভ্যান ঘুরিয়ে বাড়ির দিকে নিয়ে যেতে নির্দেশ দেয় খোশতার চেয়ারম্যান।
সকাল হতেই এ খবর ছড়িয়ে পড়ে গ্রামের এমাথা থেকে ওমাথায়। পিঁপড়ার মতো সার বেঁধে গ্রামের লোকজন আসতে থাকে চেয়ারম্যানের বাড়িতে। পবন মণ্ডল, এমাজ ফকির ও আলিমুদ্দিন সরদারকে দেখা যায় শপরীর ডাল ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে। গ্রামের লোকজন আফসোস করে। চেয়ারম্যানের বউ কাঁদতে কাঁদতে জ্ঞান হারায়। গ্রামের বউ-ঝিরা তার মাথায় পানি ঢালে। গ্রামের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা সাইকেলের টায়ার চালাতে চালাতে এসে জড়ো হয় সেই ভিড়ের মধ্যে এবং কছিম পাগলের ডানাওয়ালা সাপ নিয়ে গল্প করে।
রূপপুরের রাস্তায় পড়ে থাকে পলিথিন, বিড়ি-সিগারেটের প্যাকেট, ম্যাচের বাক্স, কাগজের ঠোঙা। বাতিল এই বর্জ্য যখন বাড়তে থাকে গ্রামের মধ্যে তখন তাদের মনে পড়ে কছিম পাগলের কথা। গ্রামের রাস্তায়, মোড়ে, হাটে-মাঠে, নদীর কিনারে, চায়ের দোকানে, বটতলায়, খেজুরতলায়, কারও বাড়ির কান্টায় দেখা মেলে না তার। কোথায় যে নিরুদ্দেশ কছিম পাগল, কেউ জানে না। ধীরে ধীরে সাপের প্রকোপ বাড়তে থাকে গ্রামে। ঝোপঝাড়ে, ক্ষেতে, গোয়ালঘরে, মাঠালে, গোলাঘরে, হেঁশেলে, পথে-ঘাটে, বাজারে সাপ দেখতে পায় মানুষজন। প্রতিদিনই কাউকে না কাউকে ছোবল দেয় সাপ। কেউ মরে, কেউবা বেঁচে ওঠে। ছোট-বড় সবাই সমঝে পা ফেলে বাড়ির বাইরে। এই আপদ থেকে বাঁচতে চেয়ারম্যানের কাছে যায় গ্রামের লোকজন।
খোশতার চেয়ারম্যান সাপ মারার সায় দিয়ে বলে, ‘যেখানেই সাপ দেখবা মারি নাশ করি ফেলাও।’ গ্রামের লোকজন তার পরের দিন থেকেই সাপ মারার অভিযানে নামে। ঝোপঝাড়ে, ক্ষেতে, গোয়ালঘরে, মাঠালে, গোলাঘরে, হেঁশেলে, পথে-ঘাটে, বাজারে যেখানেই সাপের দেখা মেলে পিটিয়ে মেরে ফেলে এবং সবগুলো এক জায়গায় করে আউড় জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেয়।
মানুষেরা তাদের আগার-পাগার, বাড়ির আশেপাশের ঝোপঝাড় কেটে পরিষ্কার করে। ঘরের কোণে, জঙ্গলে কিংবা যেখানেই ফুটোফাটা দেখে শাবল দিয়ে খুঁচিয়ে ধ্বংস করে সাপের বাড়িঘর এবং দেখা মিললেই পিটিয়ে মেরে ফেলে। গ্রামের লোকজনের সাপ মারার অভিযান চলতেই থাকে।
কয়েক মাস পর কমে আসে সাপের প্রকোপ। এর ভেতর সাপের কামড়ে মাটির পেটে যায় ঊনত্রিশটা প্রাণ। ফকফকা ঝোপঝাড়, আগার-পাগার দেখে খুশি হয় খোশতার চেয়ারম্যান। বলে, ‘সাপ তো পগারপার।’ আগের মতো নিত্যদিন বিকেল হলেই সাপলুডু খেলতে বসে পবন মণ্ডল ও এমাজ ফকির। 
হঠাৎ তাদের সামনে এসে দাঁড়াল নতুন এক আপদ। গ্রামে বাড়তে থাকল ইঁদুর। ইঁদুরের অত্যাচারে বিষিয়ে উঠল তাদের জীবন। খাদ্যশস্য, কাপড়চোপড় কেটে কুটি কুটি করতে থাকল ইঁদুর-বাহিনী। ক্ষেতেখামারেও ওরা হামলা চালাল।
আবারও গ্রামের লোকেরা দল বেঁধে সমবেত হলো চেয়ারম্যানের বাড়িতে। ইঁদুরের অত্যাচার থেকে জানতে চাইল মুক্তির উপায়। খোশতার চেয়ারম্যান তাদের বাতলে দিল ফাঁদ ও কীটনাশকের ব্যবহারিক কৌশল। লোকেরা যে যার মতো ফিরে গেল ঘরে।
ইঁদুরধরা ফাঁদ ও কীটনাশকের ব্যবহার বাড়তে থাকল গ্রামে। মরতে থাকল ইঁদুর। তবে যতগুলো ইঁদুর মরে তার চেয়েও দ্বিগুণ আকারে চলে তাদের বংশবিস্তার। শহর থেকে ব্যবসায়ীরা গ্রামে এসে খুলল ফাঁদ ও কীটনাশকের দোকান। দিনে দিনে বাড়তে থাকল ইঁদুরধরা কলের দাম, বাড়তে থাকল কীটনাশকের দাম। গ্রামের গাছে গাছে বেড়ে গেল পাখির সংসার। তারা নষ্ট করল গাছের কাঁচা-পাকা ফল। গ্রামের ঘরে-বাইরে লাফাতে লাগল ব্যাঙ। হুহু করে গ্রামে বেড়ে গেল নিত্য জিনিসপত্রের দাম। 
সাপের প্রকোপ, ইঁদুরের অত্যাচার, ফসল ধ্বংসকারী কীটপতঙ্গ জেরবার করে ফেলল গ্রামের জীবনপ্রবাহ। গচ্ছিত টাকাগুলোও ফুরিয়ে গেল তাদের। এর জন্য দায়ী কে? কছিম পাগল? খোশতার চেয়ারম্যান? আলিমুদ্দিন সরদারের চাতালে বসে ভাবতে থাকল গ্রামের নারী-পুরুষরা। 
চাতালের সুনসান ভাবনার ছেদ ঘটাল রহিমা বেওয়া। চেঁচিয়ে বলে উঠল, ‘পিচ্চি পিচ্চি ছাওয়ালেক কী খাওয়ামু, আমাক কেও বলি দ্যান।’ 
তার পরেই কৃষক তছলিম বলল, ‘মুনে হয় কছিম পাগলেক ওভাবি নাড়িয়া করা ঠিক হয়নি চিয়ারম্যান সাবের।’
লুঙ্গির গিঁট বাঁধতে বাঁধতে খামারি মোকছেদ বলল, ‘আমারেক এখুন খাওয়াক চিয়ারম্যান।’
আলিমুদ্দিন সরদার বলল, ‘চিয়ারম্যানেক আমি বুলিছিলাম কিছু গম দেও আমারেক, সে সাফ জানায় দিল, নাই।’
এ কথা শোনার পর চাতালজুড়ে মানুষের হাহাকার ভেসে উঠল। আলিমুদ্দিন সরদার দাঁড়িয়ে সবার উদ্দেশে বলল, ‘চুপ করো তুমরা, ধরযো ধরো। সব ঠিক হয়া যাবি।’ 
এক তরুণ চাতাল থেকে লাফিয়ে উঠে রাগীকণ্ঠে বলল, ‘কী ঠিক হয়া যাবি আলিমুদ্দিন চাচা? সব তো ছারখার হয়া গ্যাল। একমাত্র কছিমই আমারেক বাঁচাতি পারে, চিয়ারম্যানের দিন শ্যাষ।’
একদিন রাতের বেলা চেয়ারম্যানের বাড়ি ঘেরাও করল গ্রামের তরুণ-যুবকরা। বাড়ির মধ্যে ঢুকে তারা খুঁজে পেল বস্তা বস্তা গম। খোশতার চেয়ারম্যানকে তারা কোথাও খুঁজে পেল না। গমের বস্তাগুলো নিয়ে গেল তরুণ-যুবকরা। গ্রামের সবার মধ্যে ভাগাভাগি করে দিল সরকারি গম।
বহুদিন পর হঠাৎ একদিন দেখা মিলল কছিম পাগলের। আগের মতোই পরিত্যক্ত কাগজপত্র, বিড়ি-সিগারেটের প্যাকেট, ম্যাচের বাক্স কুড়াতে কুড়াতে গ্রামে ঢুকেছে সে। এই খবর ছড়িয়ে গেল পুরো গ্রামে। কছিম পাগল হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে থামল খেজুরগাছ তলায়। আগের মতোই নাচতে শুরু করল। খেজুরগাছের চারপাশে চারটি পায়ে হাঁটা সরু পথ দিয়ে দুপুরবেলায় পিঁপড়ার মতো লাইনে লাইনে আসতে থাকল গ্রামের মানুষজন। সবার পিছে ভিড়ের মধ্যে এসে যোগ দিল খোশতার চেয়ারম্যান। সেই জটা চুল-দাড়ি, পোয়াতির মতো পেট নিয়ে হেলেদুলে, হাত দুটো উপরে তুলে, মাথাটা মাটির দিকে ঝুঁকিয়ে নেচে যাচ্ছে কছিম পাগল।
‘আবার কোন আপদ নিয়ে গ্রামে ফিরল কছিম পাগল’ কেউ কেউ বলে উঠল এই কথা। গ্রামের বাসিন্দাদের বুক ধড়ফড় করা শুরু করল আবার। একটা অজানা শঙ্কা তাদের মনে উঁকি দিতে থাকল। কী আপদ আবার ভর করবে এই শস্য-শ্যামল গ্রামের উঠানে, কেউ জানে না। কখন থামবে কছিমের এই নাচ? কেউ বলতে পারে না। ধীরে ধীরে কমতে থাকল লোকজন। শেষ যে দু’চারজন ছিল তারাও বিষণ্ণমনে হাঁটা ধরল।
শুধু খোশতার চেয়ারম্যান দাঁড়িয়ে রইল একা। কছিম পাগলের নাচের সম্মোহন-মুদ্রায় তারও পা নড়ে উঠল। v

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: গ র ম র ল কজন থ কল ই দ র র ওপর কজন দ

এছাড়াও পড়ুন:

সবার জন্য গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত না করলে সংকট আসবে: সরকারকে মান্না

অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশ্যে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেছেন, কোনোরকম পক্ষপাত করবেন না। সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করাই হবে এই সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। নইলে নানা রকম সংকট আসবে। গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে ‘মহান মে দিবস ও প্রাসঙ্গিক বাংলাদেশ’ শীর্ষক আলোচনা সভায় তিনি এসব কথা বলেন।
 
মান্না বলেন, জুলাই-আগস্টের আন্দোলন মনে করিয়ে দিয়েছিল, এবার বদলাতে হবে। কিন্তু কেউ মনে করছে, এই সরকার কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন করতে পারবে, কেউ মনে করছে– কিছুই হবে না। অনেক ক্ষেত্রেই পুলিশের আচরণ আগের মতো। সচিবালয়ে এখনও স্বৈরাচার সরকারের দোসরদের দাপট চলছে। গণঅভ্যুত্থানের আন্দোলনকারীদের নামে দুর্নীতির অভিযোগ শোনা যাচ্ছে। 

তিনি বলেন, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান লতিফুর রহমান এসেই ছয় ঘণ্টায় প্রশাসন রদবদল করেন। এই সরকার তেমন কিছুই করতে পারল না কেন? ৯ মাসে সরকার সংস্কার প্রক্রিয়া শুরুই করতে পারেনি।

মান্না বলেন, প্রফেসর ইউনূস সব কথা বিদেশিদের সঙ্গে বলেন। দেশের কারও সঙ্গে বলেন না। করিডোর নিয়ে কিছুই পরিষ্কার করেননি। কেউ বলছেন আগে বিচার, পরে নির্বাচন। মনে রাখতে হবে, পলিটিক্স ইজ দা কমান্ডার অব দা সোসাইটি।

আলোচনা সভায় আরও বক্তব্য রাখেন শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রধান সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ, নাগরিক ঐক্যের সাধারণ সম্পাদক শহীদুল্লাহ কায়সার, প্রেসিডিয়াম সদস্য জিন্নুর চৌধুরী দিপু, মোফাখখারুল ইসলাম নবাব প্রমুখ।

সম্পর্কিত নিবন্ধ