কঠিন সময়ে মহানবী (সা.)-এর জয়ের কৌশল
Published: 11th, May 2025 GMT
জীবনে কঠিন সময় আসা অবশ্যম্ভাবী। এগুলো আল্লাহর পক্ষ থেকে মানুষের জন্য পরীক্ষার অংশ। কঠিন মুহূর্তে আমরা যদি পাপের পথ পরিহার করে আল্লাহর বিধানের দিকে অগ্রসর হই, তবে তাঁর নৈকট্য লাভ করতে পারি। এই পরীক্ষায় সর্বোত্তম উদাহরণ হলেন আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সা.)। তাঁর জীবন ছিল দুর্যোগ, চ্যালেঞ্জ এবং অন্ধকার সময়ের এক অবিচলিত সংগ্রাম। অজ্ঞ সমাজকে আলোকিত করতে গিয়ে তিনি ঘরে-বাইরে অসংখ্য দুর্লঙ্ঘ বাধার সম্মুখীন হয়েছেন। তাঁর প্রাণনাশের চেষ্টা, সপরিবার গিরিখাতে বন্দিজীবন, অপবাদ, যুদ্ধের ভয়াবহতা, বিষাক্ত খাবারের মুখোমুখি হওয়া—তাঁর জীবনে এমন কোনো কষ্ট ছিল না, যা তিনি পাননি। তবু তিনি কখনো হতাশ হননি, হারিয়ে যাননি। প্রতিটি সংকটে তিনি অবিচল থেকে জয়ী হয়েছেন। এই আর্টিকেলে আমরা তাঁর জীবনের কিছু কঠিন মুহূর্ত এবং সেগুলো জয়ের কৌশল নিয়ে আলোচনা করব।
মহানবী (সা.
)-এর জীবনে কঠিন সময়ের চিত্র
নবী (সা.)-এর জীবন ছিল কঠিন পরীক্ষার এক অবিরাম ধারা। তিনি যে চ্যালেঞ্জগুলোর মুখোমুখি হয়েছিলেন, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু হলো:
ব্যক্তিগত ক্ষতি ও নির্যাতন: একই বছরে তিনি তাঁর প্রিয় চাচা আবু তালিব এবং স্ত্রী খাদিজা (রা.)-কে হারান, যারা তাঁকে মানসিক ও শারীরিকভাবে সমর্থন দিতেন। এই সময় তিনি মক্কার কুরাইশদের তীব্র শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন। (সিরাতে ইবনে হিশাম, পৃষ্ঠা: ১৮৫-১৮৮)
আরও পড়ুনকীভাবে মহানবী (সা.)-কে ভালোবাসব২৭ এপ্রিল ২০২৫অপমান ও ঘৃণা: মক্কায় নবী (সা.)-কে পাগল, মিথ্যাবাদী, জাদুকর, কবি বলে অপমান করা হতো। তাঁর নাম মুহাম্মদ (প্রশংসনীয়) থাকা সত্ত্বেও তাঁকে ‘মুদথাম্মাম’ (নিন্দিত) বলা হতো। একটি ঘটনায়, তিনি সিজদায় থাকা অবস্থায় কুরাইশ নেতা উকবা ইবনে আবি মুয়িত তাঁর পিঠে উটের পেটের নোংরা অংশ রাখে। তাঁর কন্যা ফাতিমা (রা.) এসে তা সরিয়ে দেন এবং অপমানকারীদের গালি দেন। নবী (সা.) শান্তভাবে মাথা তুলে তাদের জন্য প্রার্থনা করেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৫২০)
তায়েফ যাত্রা: মক্কায় নির্যাতনের মধ্যে নবী (সা.) তায়েফের মানুষের কাছে ইসলামের বার্তা পৌঁছাতে ৫০ মাইল পথ হেঁটে যান। কিন্তু তাইফবাসী তাঁকে উপহাস করে, পাথর ছুড়ে এবং তাঁর স্যান্ডেল রক্তে ভিজিয়ে দেয়। এই ঘটনা তাঁর জীবনের অন্যতম কঠিন মুহূর্ত ছিল। (আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৩/১৩৫-১৩৮)
মদিনায় চ্যালেঞ্জ: হিজরতের পরও মদিনায় তাঁর জীবন সহজ ছিল না। মুনাফিকদের অপমান, আয়েশা (রা.)-এর বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ, ইহুদি গোত্রগুলোর বিশ্বাসঘাতকতা এবং আরব গোত্রগুলোর যুদ্ধের চ্যালেঞ্জ তাঁকে মোকাবিলা করতে হয়। উহুদ যুদ্ধে তিনি চাচা হামজা (রা.)-সহ ৭০ সাহাবির শাহাদাতের সাক্ষী হন। (সিরাতে ইবনে হিশাম, পৃষ্ঠা: ৩৭০-৩৮০)
অবরোধ ও বিশ্বাসঘাতকতা: খন্দকের যুদ্ধে ১০ হাজার সৈন্য মদিনা অবরোধ করে, যা শহরের অস্তিত্বের জন্য হুমকি ছিল। এ ছাড়া তাঁর শিক্ষাদানের জন্য পাঠানো অনেক সাহাবিকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়, যেমন রাজি‘ ও বিরে মাউনার ঘটনায় যথাক্রমে ১২ এবং ৭০ সাহাবি শহীদ হন। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৪০৮০; আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৪/৯০-৯৫)
মহানবী (সা.) কীভাবে এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করে আরও শক্তিশালী ও প্রভাবশালী হয়ে উঠলেন? তিনি যে কৌশলগুলো গ্রহণ করেছিলেন, তা কোরআনের শিক্ষা, তাঁর ব্যক্তিগত গুণাবলি এবং ব্যবহারিক পদক্ষেপের সমন্বয়। এই কৌশলগুলো আমাদের জন্যও শিক্ষণীয়।
কষ্টকে পরীক্ষা হিসেবে গ্রহণ
নবীজি (সা.) বিশ্বাস করতেন, কষ্ট আল্লাহর পক্ষ থেকে অবশ্যম্ভাবী পরীক্ষা। কোরআনে বলা হয়েছে: ‘লোকেরা কি মনে করে যে তারা বলবে, “আমরা ইমান এনেছি” আর তাদের পরীক্ষা করা হবে না?’ (সুরা আনকাবুত: ২; তাফসির ইবনে কাসির)
এই বিশ্বাস তাঁকে কষ্টের মুখে অটল থাকতে সাহায্য করেছিল। তিনি জানতেন, সত্যের পথে চলতে গেলে পরীক্ষা আসবেই। ‘আপনি কি মনে করেন যে আপনারা জান্নাতে প্রবেশ করবেন, অথচ আপনাদের পূর্ববর্তীদের মতো পরীক্ষা আপনাদের জন্য আসেনি? (সুরা বাকারা: ২১৪; তাফসির ইবনে কাসির)
আরও পড়ুনমহানবী (সা.)-কে ভালোবাসার ৭টি নিদর্শন০৬ মার্চ ২০২৫আল্লাহর ইচ্ছায় বিশ্বাস
নবীজি (সা.) বিশ্বাস করতেন, আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া কিছুই ঘটে না। তিনি তাঁর ভাইপো আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.)-কে বলেছিলেন: ‘জানো, যা তোমাকে আঘাত করেছে, তা তোমাকে এড়িয়ে যেত না।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২,৬৬৪)
কোরআনে বলা হয়েছে: ‘কোনো দুর্ভাগ্য আসে না, যদি না তা আল্লাহর ইচ্ছায় হয়।’ (সুরা তাগাবুন: ১১; তাফসির ইবনে কাসির)
এই বিশ্বাস তাঁকে কষ্টের মধ্যেও মানসিক শান্তি দিয়েছে।
আল্লাহর শরণাপন্ন হওয়া
কঠিন সময়ে নবীজি (সা.) সব সময় আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করতেন। তায়েফ থেকে ফিরে তিনি প্রার্থনা করেছিলেন: ‘হে আল্লাহ, আমি আমার দুর্বলতা তোমার সামনে প্রকাশ করছি... তুমি যদি আমার প্রতি ক্রুদ্ধ না হও, তবে আমি কোনো কিছুর পরোয়া করি না।’ (আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৩/১৩৮)
এই দোয়া তাঁর আল্লাহর ওপর পূর্ণ নির্ভরতার প্রকাশ।
আরও পড়ুননবী প্রেমের প্রতিদান কী২৭ এপ্রিল ২০২৫নিজের কর্ম পরীক্ষা করা
মহানবী (সা.) কষ্টকে আত্মপর্যালোচনার সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করতেন। তায়েফের প্রার্থনাতেও তিনি বলেছিলেন: ‘যদি তুমি আমার প্রতি ক্রুদ্ধ না হও, তবে আমি আর কোনো পরোয়া করি না।’
কোরআন বলে: ‘তোমাদের ওপর যে দুর্ভাগ্য আসে, তা তোমাদের নিজ হাতের কাজের ফল।’ (সুরা শুরা: ৩০; তাফসির ইবনে কাসির)
এই শিক্ষা আমাদের কষ্টের সময় নিজের ভুলত্রুটি পরীক্ষা করতে উৎসাহিত করে।
আশাবাদী মনোভাব
নবী (সা.) কঠিন সময়েও আশাবাদী ছিলেন। মক্কায় নির্যাতনের সময় সাহাবি খাব্বাব (রা.) নির্যাতনের কথা বললে তিনি বলেন: ‘আল্লাহর কসম, আল্লাহ এই দ্বীনকে পূর্ণ করবেন, যতক্ষণ না একজন মুসাফির সানা থেকে হাদরামৌত পর্যন্ত শুধু আল্লাহ ও তাঁর পশুকে ভয় করে ভ্রমণ করতে পারবে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৩,৮৫২)
তিনি সাহাবিদের মধ্যে আশাবাদ ছড়াতেন, বলতেন: ‘আমি শুভ লক্ষণ পছন্দ করি।’ এবং ব্যাখ্যা করতেন, ‘এটি একটি ভালো শব্দ।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২,২৫৫)
বিভ্রান্ত না হওয়া
কষ্টের মধ্যেও নবী (সা.) তাঁর মিশন থেকে বিচ্যুত হননি। কোরআন বলে, ‘তারা যেন তোমাকে আল্লাহর প্রকাশিত আয়াত থেকে বিচ্যুত না করে।’ (সুরা কাসাস, আয়াত: ৮৭)
তিনি নির্যাতন সত্ত্বেও ইসলামের বার্তা প্রচার অব্যাহত রাখেন।
আরও পড়ুনহজরত জাবের (রা.)–এর কাহিনি২৬ জানুয়ারি ২০২৫প্রতিফলের প্রত্যাশা
নবী (সা.) কষ্টের মধ্যে ধৈর্য ধারণ করে আল্লাহর প্রতিফলের প্রত্যাশা করতেন। কোরআন বলে, ‘নিশ্চয়ই কষ্টের সঙ্গে স্বস্তি আছে। নিশ্চয়ই কষ্টের সঙ্গে স্বস্তি আছে।’ (সুরা আশ-শারহ: ৫-৬)
এ ছাড়া ‘যারা বিপদে ধৈর্য ধারণ করে এবং বলে, “আমরা আল্লাহরই এবং তাঁর দিকেই ফিরে যাব”, তাদের ওপর তাদের রবের নিয়ামত ও রহমত বর্ষিত হবে।’ (সুরা বাকারা: ১৫৫-১৫৭)
মহানবী মুহাম্মদ (সা.) তাঁর জীবনের কঠিন সময়গুলোকে আল্লাহর পরীক্ষা হিসেবে গ্রহণ করেছেন, তাঁর ওপর পূর্ণ ভরসা রেখেছেন এবং ধৈর্য, আশাবাদ ও আত্মপর্যালোচনার মাধ্যমে সেগুলো জয় করেছেন। তাঁর এই কৌশলগুলো আমাদের জন্য শিক্ষা। কষ্টের মুখে আমরাও যদি তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করি—আল্লাহর শরণাপন্ন হই, নিজের কর্ম পরীক্ষা করি, আশাবাদী থাকি এবং তাঁর প্রতিফলের প্রত্যাশা করি—তবে আমরাও জীবনের চ্যালেঞ্জগুলো জয় করতে পারব। তাঁর জীবন আমাদের জন্য আলোকবর্তিকা, যা আমাদেরকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে পরিচালিত করে।
সূত্র: তাফসির ইবনে কাসির, দার তাইয়্যিবা, রিয়াদ, ১৯৯৯; আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, দারুল ফিকর, বৈরুত, ১৯৮৮; সিরাতে ইবনে হিশাম, দারুল কুতুব আল ইলমিয়্যা, বৈরুত, ২০০০।
আরও পড়ুননবীজি (সা.)–এর কাছে রহস্যময় অতিথি১৯ ডিসেম্বর ২০২৪উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: দ র জন য আল ব দ য জ বন র আম দ র র জ বন আল ল হ পর ক ষ গ রহণ ক রআন করত ন র ওপর
এছাড়াও পড়ুন:
এনবিআরে তালা, সেবা বিঘ্নিত
সংস্কার নিয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) অচলাবস্থার নিরসন হয়নি; বরং পরিস্থিতি আরও জটিল হচ্ছে। সংস্থাটির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন।
পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচির অংশ হিসেবে গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুর থেকে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নিজেদের প্রধান কার্যালয়ে কলমবিরতি পালন শুরু করেন এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। পৌনে ১২টার দিকে এনবিআর প্রাঙ্গণে সেনাবাহিনী, বর্ডার গার্ড অব বাংলাদেশ (বিজিবি) ও পুলিশ সদস্যরা উপস্থিত হন। এ সময় এনবিআর প্রশাসনের পক্ষ থেকে এনবিআর ফটকগুলোতে তালা লাগিয়ে দেওয়া হয়।
এর পর থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা কাউকে ভেতরে ঢুকতে দেননি, বের হতেও দেননি। ফলে আন্দোলনকারীদের একাংশ ভেতরে আটকে পড়ে। আরেক অংশ প্রধান ফটকের সামনে অবস্থান নেয়। দুপুর ১২টার পর থেকে এনবিআরে কার্যত কোনো কাজ হয়নি।
‘খোলাখুলি আলাপ করেছি এবং এই সমস্যার সমাধান তাড়াতাড়ি হবে। আগামী সপ্তাহে আরও একটি সভা করব। তখন চূড়ান্তভাবে বিষয়টি সমাধান করব।’সালেহউদ্দিন আহমেদ, অর্থ উপদেষ্টাসারা দেশে রাজস্ব সংগ্রহ করে এনবিআর। মূলত তাদের সংগৃহীত রাজস্ব দিয়ে সরকার চলে। এনবিআরের কার্যক্রমে বিঘ্ন ঘটলে দেশের বাণিজ্য বাধাগ্রস্ত হয়। প্রভাব পড়ে অর্থনীতিতে। সরকারের এমন গুরুত্বপূর্ণ একটি সংস্থায় ১২ মের পর থেকে এমন আন্দোলন চলছে। এর সূত্রপাত এনবিআরের সংস্কারে সরকারি উদ্যোগকে কেন্দ্র করে।
এনবিআর ও অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ (আইআরডি) বিলুপ্ত করে রাজস্বনীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ নামে দুটি বিভাগ করে গত ১২ মে অধ্যাদেশ জারি করে সরকার। উদ্দেশ্য হলো, করহার নির্ধারণের মতো নীতিগত কাজ এবং কর আদায়ের কাজ পৃথক রাখা। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের একটি শর্ত ছিল রাজস্বনীতি ও আদায়ের কাজে আলাদা সংস্থা করা।
এনবিআরের কর্মকর্তারা দুটি বিভাগ করা নিয়ে তেমন আপত্তি করছেন না। তবে তাঁরা মূলত ওই দুই বিভাগে পদায়নের ক্ষেত্রে রাজস্ব খাতের কর্মকর্তাদের অগ্রাধিকার চাইছেন। সরকার উপযুক্ত ব্যক্তিদের নিয়োগের কথা বলছে, যার মাধ্যমে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের নিয়োগ করা যায়।
এনবিআরের কর্মকর্তারা বর্তমান চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খানের পদত্যাগও দাবি করছেন। তাঁদের অভিযোগ, চেয়ারম্যান সরকারের নীতিনির্ধারকদের কাছে সঠিক তথ্য উপস্থাপন করেননি এবং এতে সংকট তৈরি হয়েছে।
ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) কার্যালয়ে গতকাল আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান বলেন, আন্দোলনে রাজস্ব আদায় কিছুটা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, ‘যেকোনো ধরনের সংস্কার করি, আইন করি বা আন্দোলন ও সংগ্রাম করি, সবই যেন আমাদের নিজেদের জন্য না হয়ে দেশের জন্য হয়।’
সারা দিন যা হলো২২ জুন থেকে এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দিনে তিন-চার ঘণ্টা কলমবিরতি পালন করে আসছেন। গতকাল দুপুর ১২টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত আন্তর্জাতিক যাত্রীসেবা ও রপ্তানি ব্যতীত কর, কাস্টমস ও ভ্যাট বিভাগের এনবিআরসহ সারা দেশের সব দপ্তরে অবস্থান কর্মসূচি ও কলমবিরতি কর্মসূচি ছিল। এনবিআরের প্রধান কার্যালয়ের সামনে গিয়ে গতকাল দেখা গেছে, এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা প্রধান ফটকের সামনে বসে এনবিআরের চেয়ারম্যানের অপসারণের দাবিতে স্লোগান দিচ্ছেন। এনবিআরের যৌক্তিক সংস্কারের দাবিতেও স্লোগান দিচ্ছিলেন তাঁরা। এভাবে দুপুর ১২টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত চলে।
কার্যালয়ের সামনে ছিলেন সেনাবাহিনী, বর্ডার গার্ড অব বাংলাদেশ (বিজিবি) ও পুলিশ সদস্যরা। কার্যালয়ের প্রবেশপথে তালা ঝুলছিল। সন্ধ্যা ছয়টার দিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা এনবিআর ভবনে ঢুকে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ভবন থেকে সরিয়ে দেন। পুরো ভবন খালি করা হয়। পাশাপাশি কর্মসূচি পালনের সুবিধার্থে ভাড়া করা চেয়ার, ম্যাট্রেস (জাজিম) নিয়ে সরিয়ে নেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা।
সারা দেশের শুল্ক-কর কার্যালয়েও গতকাল দুপুর ১২টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত কলমবিরতি কর্মসূচি পালন করা হয়। এ সময় স্বাভাবিক কাজকর্ম হয়নি।
এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের ব্যানারে এই আন্দোলন কর্মসূচি পালিত হচ্ছে। গতকাল বিকেল চারটার দিকে এনবিআরের সামনের রাস্তায় এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ সংবাদ সম্মেলন করে। এতে এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খানকে অপসারণের জন্য আজ শুক্রবার পর্যন্ত সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়। তা না হলে আগামীকাল শনিবার থেকে এনবিআরসহ সারা দেশের শুল্ক ও কর কার্যালয়ে লাগাতার ‘শাটডাউন’ কর্মসূচি পালনের ঘোষণা আসে।
সংবাদ সম্মেলনে সারা দেশের শুল্ক-কর কার্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ঢাকামুখী ‘মার্চ টু এনবিআর’ কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দেওয়া হয়।
সংবাদ সম্মেলনে এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের সভাপতি হাছান মুহম্মদ তারেক রিকাবদার বলেন, ‘এ মুহূর্তে এনবিআর চেয়ারম্যানের অপসারণ ছাড়া সংস্কারের আর কোনো পথ খোলা নেই। আমরা এনবিআর সংস্কারের পক্ষে। তবে তা সব পক্ষের মতামতের ভিত্তিতে হতে হবে। নিপীড়নমূলক বদলির আদেশ বাতিল করতে হবে।’
এনবিআরের অচলাবস্থা নিরসনে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের হস্তক্ষেপ কামনা করা হয় সংবাদ সম্মেলনে। পাশাপাশি কর্মকর্তাদের বদলি আদেশ প্রত্যাহার ও রাজস্ব সংস্কার সমন্বয় কমিটি পুর্নগঠনের দাবিও করা হয়।
এ দিকে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বিসিএস (কর) এবং বিসিএস (কাস্টমস ও এক্সাইজ) ক্যাডারের প্রতিনিধিদের আলোচনার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ে ডাকেন। তবে নির্ধারিত সময়ের এক ঘণ্টার বেশি সময় পর সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে তাঁরা অর্থ মন্ত্রণালয়ে উপস্থিত হন। সেখানে অর্থ উপদেষ্টার সঙ্গে তাঁদের প্রায় আড়াই ঘণ্টা বৈঠক হয়। বৈঠকে এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের কেউ যাননি।
এনবিআর ঐক্য পরিষদের সভাপতি হাছান মুহম্মদ তারেক রিকাবদার গতকাল সংবাদ সম্মেলনে দাবি করেন, তাঁদের ওই বৈঠকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। এ ধরনের বৈঠকে আমন্ত্রণ পেলে পরিষদের সবার সঙ্গে আলোচনা করে অংশ নেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন।
এদিকে বৈঠক শেষে অর্থ উপদেষ্টা সাংবাদিকদের বলেন, ‘তারা (সংস্কার ঐক্য পরিষদ) না এলেও সব সিনিয়র অফিসার, কমিশনাররা এসেছেন। এঁরা সবাই রেসপন্সিবল (দায়িত্বশীল)। যারা আন্দোলন করছে, বেশির ভাগই তাদের অধীনে কাজ করে।’ তিনি বলেন, ‘তাদের সঙ্গে খোলাখুলি আলাপ করেছি এবং এই সমস্যার সমাধান তাড়াতাড়ি হবে। আগামী সপ্তাহে আরও একটি সভা করব। তখন চূড়ান্তভাবে বিষয়টি সমাধান করব।’
শনিবারে এনবিআর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কর্মসূচির বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, সেটার ব্যাপারে তাঁদের অনুরোধ করা হয়েছে। দেশের স্বার্থে তাঁরা অনুরোধ রাখবেন বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
বৈঠক শেষে এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান বলেন, ‘বৈঠকে আমাদের মধ্যে যে ভুল-বোঝাবুঝিগুলো হয়েছে, তা কীভাবে হলো, কোথা থেকে হলো, সেগুলো নিয়ে একটা ধারণা পাওয়া গেছে। আমরা খুবই আশাবাদী যে একটা সুন্দর সমাধান হবে। অর্থ উপদেষ্টাও সেই দিকেই ইঙ্গিত দিয়েছেন। আমাদের সেই লক্ষ্যে কাজ চলছে, আলোচনা চলছে।’
এনবিআর চেয়ারম্যান আরও বলেন, ‘আন্দোলনরত কর্মকর্তারা আলোচনা করছেন। তাঁরা একটা সিদ্ধান্ত দিলে আমরা আশা করি যে আজকের মধ্যে একটা ভালো সমাধান আসবে। ভার্চ্যুয়াল ফোরামে মেসেজ বিনিময়ের মাধ্যমে, টেলিফোনের মাধ্যমে নানাভাবে আলোচনা করা যায়, সেই আলোচনা চলছে।’
বৈঠকে উপস্থিত এনবিআরের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, আলোচনায় তেমন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হয়নি। অর্থ উপদেষ্টা সকলকে অনুরোধ করেন যে, ঐক্য পরিষদ যেন আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেয়। তাহলে সরকার আলোচনা করবে। অন্যথায় সরকার কঠোর হবে।
দেড় মাসে যা হলোঅন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর গত অক্টোবর মাসে এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মজিদের নেতৃত্বে রাজস্ব খাত সংস্কারে পাঁচ সদস্যের পরামর্শক কমিটি গঠন করা হয়। তিন মাসের মধ্যে ওই কমিটি একটি অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন জমা দেয়। সেখানে রাজস্বনীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা নামে দুটি বিভাগ সৃষ্টি করার সুপারিশ করা হয়। মে মাসের শুরুতে উপদেষ্টা পরিষদের সভায় তা অনুমোদন দেওয়া হয়।
আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয় গত ১২ মে ‘রাজস্বনীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা অধ্যাদেশ ২০২৫’ জারি করে। এর পর থেকেই আন্দোলনে নামেন এনবিআর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। তাঁরা সব পক্ষের মতামতের ভিত্তিতে সংস্কারের দাবি করেন। মে মাসেও কলমবিরতিসহ নানা কর্মসূচি পালন করা হয়। পরে গত ২৬ মে সরকার ঘোষণা দেয়, আগামী ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এনবিআর নিয়ে জারি করা অধ্যাদেশের প্রয়োজনীয় সংশোধন করা হবে। সরকারের এই আশ্বাসের ভিত্তিতে আন্দোলন স্থগিত করে এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ।
পবিত্র ঈদুল আজহার ছুটির পর ১৯ জুন এনবিআরের ছয়জন সদস্য দিয়ে রাজস্ব সংস্কার সমন্বয় কমিটি নামে একটি কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটি সরকারের সঙ্গে রাজস্ব খাতের সংস্কার নিয়ে আলোচনা করবে বলে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু এই কমিটিতে আন্দোলনকারী এনবিআর ঐক্য পরিষদের কাউকে রাখা হয়নি।
এরপর পরিস্থিতি আবার জটিল হয়। এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ আবার আন্দোলনের ডাক দেয়। পাশাপাশি এনবিআর চেয়ারম্যানের অপসারণ দাবি করে তারা। ২২ জুন থেকে টানা পাঁচ দিন কলমবিরতি ও অবস্থান ধর্মঘটসহ নানা কর্মসূচি পালন করছেন আন্দোলনকারীরা।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, বাণিজ্য, বন্দর ইত্যাদি হলো অর্থনীতির ‘লাইফ লাইন’ (চালিকা শক্তি)। লাইফ লাইন চালু রাখতে কাজ করে এনবিআর। জাতীয় স্বার্থ ও অর্থনীতির দৃষ্টিতে বলা যায়, এনবিআরে অচলাবস্থায় সবাই ক্ষতিগ্রস্ত। তিনি বলেন, এই অচলাবস্থা দূর করতে হবে। আলোচনা ছাড়া সমাধানের পথ নেই।