জীবনে কঠিন সময় আসা অবশ্যম্ভাবী। এগুলো আল্লাহর পক্ষ থেকে মানুষের জন্য পরীক্ষার অংশ। কঠিন মুহূর্তে আমরা যদি পাপের পথ পরিহার করে আল্লাহর বিধানের দিকে অগ্রসর হই, তবে তাঁর নৈকট্য লাভ করতে পারি। এই পরীক্ষায় সর্বোত্তম উদাহরণ হলেন আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সা.)। তাঁর জীবন ছিল দুর্যোগ, চ্যালেঞ্জ এবং অন্ধকার সময়ের এক অবিচলিত সংগ্রাম। অজ্ঞ সমাজকে আলোকিত করতে গিয়ে তিনি ঘরে-বাইরে অসংখ্য দুর্লঙ্ঘ বাধার সম্মুখীন হয়েছেন। তাঁর প্রাণনাশের চেষ্টা, সপরিবার গিরিখাতে বন্দিজীবন, অপবাদ, যুদ্ধের ভয়াবহতা, বিষাক্ত খাবারের মুখোমুখি হওয়া—তাঁর জীবনে এমন কোনো কষ্ট ছিল না, যা তিনি পাননি। তবু তিনি কখনো হতাশ হননি, হারিয়ে যাননি। প্রতিটি সংকটে তিনি অবিচল থেকে জয়ী হয়েছেন। এই আর্টিকেলে আমরা তাঁর জীবনের কিছু কঠিন মুহূর্ত এবং সেগুলো জয়ের কৌশল নিয়ে আলোচনা করব।

 মহানবী (সা.

)-এর জীবনে কঠিন সময়ের চিত্র

 নবী (সা.)-এর জীবন ছিল কঠিন পরীক্ষার এক অবিরাম ধারা। তিনি যে চ্যালেঞ্জগুলোর মুখোমুখি হয়েছিলেন, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু হলো:

ব্যক্তিগত ক্ষতি ও নির্যাতন: একই বছরে তিনি তাঁর প্রিয় চাচা আবু তালিব এবং স্ত্রী খাদিজা (রা.)-কে হারান, যারা তাঁকে মানসিক ও শারীরিকভাবে সমর্থন দিতেন। এই সময় তিনি মক্কার কুরাইশদের তীব্র শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন। (সিরাতে ইবনে হিশাম, পৃষ্ঠা: ১৮৫-১৮৮)

আরও পড়ুনকীভাবে মহানবী (সা.)-কে ভালোবাসব২৭ এপ্রিল ২০২৫

অপমান ও ঘৃণা: মক্কায় নবী (সা.)-কে পাগল, মিথ্যাবাদী, জাদুকর, কবি বলে অপমান করা হতো। তাঁর নাম মুহাম্মদ (প্রশংসনীয়) থাকা সত্ত্বেও তাঁকে ‘মুদথাম্মাম’ (নিন্দিত) বলা হতো। একটি ঘটনায়, তিনি সিজদায় থাকা অবস্থায় কুরাইশ নেতা উকবা ইবনে আবি মুয়িত তাঁর পিঠে উটের পেটের নোংরা অংশ রাখে। তাঁর কন্যা ফাতিমা (রা.) এসে তা সরিয়ে দেন এবং অপমানকারীদের গালি দেন। নবী (সা.) শান্তভাবে মাথা তুলে তাদের জন্য প্রার্থনা করেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৫২০)

তায়েফ যাত্রা: মক্কায় নির্যাতনের মধ্যে নবী (সা.) তায়েফের মানুষের কাছে ইসলামের বার্তা পৌঁছাতে ৫০ মাইল পথ হেঁটে যান। কিন্তু তাইফবাসী তাঁকে উপহাস করে, পাথর ছুড়ে এবং তাঁর স্যান্ডেল রক্তে ভিজিয়ে দেয়। এই ঘটনা তাঁর জীবনের অন্যতম কঠিন মুহূর্ত ছিল। (আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৩/১৩৫-১৩৮)

মদিনায় চ্যালেঞ্জ: হিজরতের পরও মদিনায় তাঁর জীবন সহজ ছিল না। মুনাফিকদের অপমান, আয়েশা (রা.)-এর বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ, ইহুদি গোত্রগুলোর বিশ্বাসঘাতকতা এবং আরব গোত্রগুলোর যুদ্ধের চ্যালেঞ্জ তাঁকে মোকাবিলা করতে হয়। উহুদ যুদ্ধে তিনি চাচা হামজা (রা.)-সহ ৭০ সাহাবির শাহাদাতের সাক্ষী হন। (সিরাতে ইবনে হিশাম, পৃষ্ঠা: ৩৭০-৩৮০)

অবরোধ ও বিশ্বাসঘাতকতা: খন্দকের যুদ্ধে ১০ হাজার সৈন্য মদিনা অবরোধ করে, যা শহরের অস্তিত্বের জন্য হুমকি ছিল। এ ছাড়া তাঁর শিক্ষাদানের জন্য পাঠানো অনেক সাহাবিকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়, যেমন রাজি‘ ও বিরে মাউনার ঘটনায় যথাক্রমে ১২ এবং ৭০ সাহাবি শহীদ হন। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৪০৮০; আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৪/৯০-৯৫)

মহানবী (সা.) কীভাবে এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করে আরও শক্তিশালী ও প্রভাবশালী হয়ে উঠলেন? তিনি যে কৌশলগুলো গ্রহণ করেছিলেন, তা কোরআনের শিক্ষা, তাঁর ব্যক্তিগত গুণাবলি এবং ব্যবহারিক পদক্ষেপের সমন্বয়। এই কৌশলগুলো আমাদের জন্যও শিক্ষণীয়।

কষ্টকে পরীক্ষা হিসেবে গ্রহণ

নবীজি (সা.) বিশ্বাস করতেন, কষ্ট আল্লাহর পক্ষ থেকে অবশ্যম্ভাবী পরীক্ষা। কোরআনে বলা হয়েছে: ‘লোকেরা কি মনে করে যে তারা বলবে, “আমরা ইমান এনেছি” আর তাদের পরীক্ষা করা হবে না?’ (সুরা আনকাবুত: ২; তাফসির ইবনে কাসির)

এই বিশ্বাস তাঁকে কষ্টের মুখে অটল থাকতে সাহায্য করেছিল। তিনি জানতেন, সত্যের পথে চলতে গেলে পরীক্ষা আসবেই। ‘আপনি কি মনে করেন যে আপনারা জান্নাতে প্রবেশ করবেন, অথচ আপনাদের পূর্ববর্তীদের মতো পরীক্ষা আপনাদের জন্য আসেনি? (সুরা বাকারা: ২১৪; তাফসির ইবনে কাসির) 

আরও পড়ুনমহানবী (সা.)-কে ভালোবাসার ৭টি নিদর্শন০৬ মার্চ ২০২৫

আল্লাহর ইচ্ছায় বিশ্বাস

 নবীজি (সা.) বিশ্বাস করতেন, আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া কিছুই ঘটে না। তিনি তাঁর ভাইপো আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.)-কে বলেছিলেন: ‘জানো, যা তোমাকে আঘাত করেছে, তা তোমাকে এড়িয়ে যেত না।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২,৬৬৪)

কোরআনে বলা হয়েছে: ‘কোনো দুর্ভাগ্য আসে না, যদি না তা আল্লাহর ইচ্ছায় হয়।’ (সুরা তাগাবুন: ১১; তাফসির ইবনে কাসির)

এই বিশ্বাস তাঁকে কষ্টের মধ্যেও মানসিক শান্তি দিয়েছে।

আল্লাহর শরণাপন্ন হওয়া

কঠিন সময়ে নবীজি (সা.) সব সময় আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করতেন। তায়েফ থেকে ফিরে তিনি প্রার্থনা করেছিলেন: ‘হে আল্লাহ, আমি আমার দুর্বলতা তোমার সামনে প্রকাশ করছি... তুমি যদি আমার প্রতি ক্রুদ্ধ না হও, তবে আমি কোনো কিছুর পরোয়া করি না।’ (আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৩/১৩৮)

 এই দোয়া তাঁর আল্লাহর ওপর পূর্ণ নির্ভরতার প্রকাশ।

আরও পড়ুননবী প্রেমের প্রতিদান কী২৭ এপ্রিল ২০২৫

নিজের কর্ম পরীক্ষা করা

 মহানবী (সা.) কষ্টকে আত্মপর্যালোচনার সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করতেন। তায়েফের প্রার্থনাতেও তিনি বলেছিলেন: ‘যদি তুমি আমার প্রতি ক্রুদ্ধ না হও, তবে আমি আর কোনো পরোয়া করি না।’

 কোরআন বলে: ‘তোমাদের ওপর যে দুর্ভাগ্য আসে, তা তোমাদের নিজ হাতের কাজের ফল।’ (সুরা শুরা: ৩০; তাফসির ইবনে কাসির)

 এই শিক্ষা আমাদের কষ্টের সময় নিজের ভুলত্রুটি পরীক্ষা করতে উৎসাহিত করে।

  আশাবাদী মনোভাব

 নবী (সা.) কঠিন সময়েও আশাবাদী ছিলেন। মক্কায় নির্যাতনের সময় সাহাবি খাব্বাব (রা.) নির্যাতনের কথা বললে তিনি বলেন: ‘আল্লাহর কসম, আল্লাহ এই দ্বীনকে পূর্ণ করবেন, যতক্ষণ না একজন মুসাফির সানা থেকে হাদরামৌত পর্যন্ত শুধু আল্লাহ ও তাঁর পশুকে ভয় করে ভ্রমণ করতে পারবে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৩,৮৫২)

তিনি সাহাবিদের মধ্যে আশাবাদ ছড়াতেন, বলতেন: ‘আমি শুভ লক্ষণ পছন্দ করি।’ এবং ব্যাখ্যা করতেন, ‘এটি একটি ভালো শব্দ।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২,২৫৫)

বিভ্রান্ত না হওয়া

কষ্টের মধ্যেও নবী (সা.) তাঁর মিশন থেকে বিচ্যুত হননি। কোরআন বলে, ‘তারা যেন তোমাকে আল্লাহর প্রকাশিত আয়াত থেকে বিচ্যুত না করে।’ (সুরা কাসাস, আয়াত: ৮৭)

তিনি নির্যাতন সত্ত্বেও ইসলামের বার্তা প্রচার অব্যাহত রাখেন।

আরও পড়ুনহজরত জাবের (রা.)–এর কাহিনি২৬ জানুয়ারি ২০২৫

প্রতিফলের প্রত্যাশা

 নবী (সা.) কষ্টের মধ্যে ধৈর্য ধারণ করে আল্লাহর প্রতিফলের প্রত্যাশা করতেন। কোরআন বলে, ‘নিশ্চয়ই কষ্টের সঙ্গে স্বস্তি আছে। নিশ্চয়ই কষ্টের সঙ্গে স্বস্তি আছে।’ (সুরা আশ-শারহ: ৫-৬)

এ ছাড়া ‘যারা বিপদে ধৈর্য ধারণ করে এবং বলে, “আমরা আল্লাহরই এবং তাঁর দিকেই ফিরে যাব”, তাদের ওপর তাদের রবের নিয়ামত ও রহমত বর্ষিত হবে।’ (সুরা বাকারা: ১৫৫-১৫৭)

 মহানবী মুহাম্মদ (সা.) তাঁর জীবনের কঠিন সময়গুলোকে আল্লাহর পরীক্ষা হিসেবে গ্রহণ করেছেন, তাঁর ওপর পূর্ণ ভরসা রেখেছেন এবং ধৈর্য, আশাবাদ ও আত্মপর্যালোচনার মাধ্যমে সেগুলো জয় করেছেন। তাঁর এই কৌশলগুলো আমাদের জন্য শিক্ষা। কষ্টের মুখে আমরাও যদি তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করি—আল্লাহর শরণাপন্ন হই, নিজের কর্ম পরীক্ষা করি, আশাবাদী থাকি এবং তাঁর প্রতিফলের প্রত্যাশা করি—তবে আমরাও জীবনের চ্যালেঞ্জগুলো জয় করতে পারব। তাঁর জীবন আমাদের জন্য আলোকবর্তিকা, যা আমাদেরকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে পরিচালিত করে।

সূত্র: তাফসির ইবনে কাসির, দার তাইয়্যিবা, রিয়াদ, ১৯৯৯; আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, দারুল ফিকর, বৈরুত, ১৯৮৮; সিরাতে ইবনে হিশাম, দারুল কুতুব আল ইলমিয়্যা, বৈরুত, ২০০০।

আরও পড়ুননবীজি (সা.)–এর কাছে রহস্যময় অতিথি১৯ ডিসেম্বর ২০২৪

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: দ র জন য আল ব দ য জ বন র আম দ র র জ বন আল ল হ পর ক ষ গ রহণ ক রআন করত ন র ওপর

এছাড়াও পড়ুন:

কোটিপতি হলেও পরিচ্ছন্নতা কর্মীর কাজ করেন তিনি

পর্যাপ্ত অর্থ সঞ্চয় করতে পারলেই আমাদের অনেকে কায়িক পরিশ্রম ছেড়ে দেন। আরাম-আয়েশে জীবন কাটান। কিন্তু সবাই তা করেন না। এমন একজন জাপানের কোইচি মাতসুবারা। ৫৬ বছর বয়সী এই জাপানি নাগরিকের বার্ষিক আয় প্রায় ৩ কোটি ইয়েন (প্রায় ২ কোটি ৫০ লাখ টাকা) হওয়া সত্ত্বেও তিনি এখনো নিয়মিত পরিচ্ছন্নতাকর্মীর কাজ করেন।

মাতসুবারা সপ্তাহে তিন দিন, প্রতিদিন চার ঘণ্টা করে কাজ করেন। তিনি সরকারি পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে কাজ করেন। এ কাজের অংশ হিসেবে তাঁকে ছোটখাটো রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করতে হয়।

এ কাজ থেকে মাতসুবারা মাসে ১ লাখ ইয়েন (প্রায় ৮২ হাজার ৬৪ টাকা) আয় করেন, যা টোকিওর গড় বেতনের তুলনায় অনেক কম। তারপরও তিনি এ কাজ করেন। কারণ, তিনি এটাকে শারীরিক সক্রিয়তা ও মানসিক প্রশান্তির উপায় হিসেবে দেখেন।

মাতসুবারা ছোটবেলা থেকেই সঞ্চয়ী ছিলেন। মাধ্যমিকের পর তিনি একটি কারখানায় মাসে ১ লাখ ৮০ হাজার ইয়েন (প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা) বেতনে কাজ শুরু করেন। খরচ বাঁচিয়ে কয়েক বছরে প্রায় ৩০ লাখ ইয়েন (২৯ লাখ ২৫ হাজার টাকা) সঞ্চয় করে তিনি প্রথম স্টুডিও ফ্ল্যাট কিনেছিলেন।

পরে বাড়ি কেনার ঋণ আগেভাগে পরিশোধ করে ধীরে ধীরে আরও ফ্ল্যাট কেনেন এবং বিনিয়োগ বৃদ্ধি করেন মাতসুবারা। এখন টোকিও ও এর শহরতলিতে তাঁর সাতটি ফ্ল্যাট রয়েছে, যার সবই ভাড়া দিয়েছেন। পাশাপাশি তিনি শেয়ার ও মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ করেছেন।

ধনবান হলেও মাতসুবারা সাদাসিধে জীবন যাপন করেন। এখনো তিনি সস্তা ফ্ল্যাটে থাকেন, নিজের খাবার নিজে বানান, নতুন জামাকাপড় কেনেন না, সাধারণ স্মার্টফোন ব্যবহার করেন এবং প্রধানত সাইকেলে চলাচল করেন। তাঁর জীবনদর্শন—‘প্রতিদিন কিছু না কিছু করার আশা করি, সুস্থ থাকতে চাই এবং নিজেকে নিয়ে চিন্তা করতে চাই।’

স্থানীয় সংবাদমাধ্যমে মাতসুবারাকে ‘অদৃশ্য কোটিপতি’ বলে উল্লেখ করা হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁর গল্প ছড়িয়ে পড়েছে। জাপানে ধনীদের এমন সাধারণ জীবনধারা অস্বাভাবিক নয়। দেশটিতে সাদাসিধে জীবনযাপন অনেকের মধ্যে দেখা যায়।

সম্পর্কিত নিবন্ধ