জীবনে কঠিন সময় আসা অবশ্যম্ভাবী। এগুলো আল্লাহর পক্ষ থেকে মানুষের জন্য পরীক্ষার অংশ। কঠিন মুহূর্তে আমরা যদি পাপের পথ পরিহার করে আল্লাহর বিধানের দিকে অগ্রসর হই, তবে তাঁর নৈকট্য লাভ করতে পারি। এই পরীক্ষায় সর্বোত্তম উদাহরণ হলেন আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সা.)। তাঁর জীবন ছিল দুর্যোগ, চ্যালেঞ্জ এবং অন্ধকার সময়ের এক অবিচলিত সংগ্রাম। অজ্ঞ সমাজকে আলোকিত করতে গিয়ে তিনি ঘরে-বাইরে অসংখ্য দুর্লঙ্ঘ বাধার সম্মুখীন হয়েছেন। তাঁর প্রাণনাশের চেষ্টা, সপরিবার গিরিখাতে বন্দিজীবন, অপবাদ, যুদ্ধের ভয়াবহতা, বিষাক্ত খাবারের মুখোমুখি হওয়া—তাঁর জীবনে এমন কোনো কষ্ট ছিল না, যা তিনি পাননি। তবু তিনি কখনো হতাশ হননি, হারিয়ে যাননি। প্রতিটি সংকটে তিনি অবিচল থেকে জয়ী হয়েছেন। এই আর্টিকেলে আমরা তাঁর জীবনের কিছু কঠিন মুহূর্ত এবং সেগুলো জয়ের কৌশল নিয়ে আলোচনা করব।

 মহানবী (সা.

)-এর জীবনে কঠিন সময়ের চিত্র

 নবী (সা.)-এর জীবন ছিল কঠিন পরীক্ষার এক অবিরাম ধারা। তিনি যে চ্যালেঞ্জগুলোর মুখোমুখি হয়েছিলেন, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু হলো:

ব্যক্তিগত ক্ষতি ও নির্যাতন: একই বছরে তিনি তাঁর প্রিয় চাচা আবু তালিব এবং স্ত্রী খাদিজা (রা.)-কে হারান, যারা তাঁকে মানসিক ও শারীরিকভাবে সমর্থন দিতেন। এই সময় তিনি মক্কার কুরাইশদের তীব্র শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন। (সিরাতে ইবনে হিশাম, পৃষ্ঠা: ১৮৫-১৮৮)

আরও পড়ুনকীভাবে মহানবী (সা.)-কে ভালোবাসব২৭ এপ্রিল ২০২৫

অপমান ও ঘৃণা: মক্কায় নবী (সা.)-কে পাগল, মিথ্যাবাদী, জাদুকর, কবি বলে অপমান করা হতো। তাঁর নাম মুহাম্মদ (প্রশংসনীয়) থাকা সত্ত্বেও তাঁকে ‘মুদথাম্মাম’ (নিন্দিত) বলা হতো। একটি ঘটনায়, তিনি সিজদায় থাকা অবস্থায় কুরাইশ নেতা উকবা ইবনে আবি মুয়িত তাঁর পিঠে উটের পেটের নোংরা অংশ রাখে। তাঁর কন্যা ফাতিমা (রা.) এসে তা সরিয়ে দেন এবং অপমানকারীদের গালি দেন। নবী (সা.) শান্তভাবে মাথা তুলে তাদের জন্য প্রার্থনা করেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৫২০)

তায়েফ যাত্রা: মক্কায় নির্যাতনের মধ্যে নবী (সা.) তায়েফের মানুষের কাছে ইসলামের বার্তা পৌঁছাতে ৫০ মাইল পথ হেঁটে যান। কিন্তু তাইফবাসী তাঁকে উপহাস করে, পাথর ছুড়ে এবং তাঁর স্যান্ডেল রক্তে ভিজিয়ে দেয়। এই ঘটনা তাঁর জীবনের অন্যতম কঠিন মুহূর্ত ছিল। (আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৩/১৩৫-১৩৮)

মদিনায় চ্যালেঞ্জ: হিজরতের পরও মদিনায় তাঁর জীবন সহজ ছিল না। মুনাফিকদের অপমান, আয়েশা (রা.)-এর বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ, ইহুদি গোত্রগুলোর বিশ্বাসঘাতকতা এবং আরব গোত্রগুলোর যুদ্ধের চ্যালেঞ্জ তাঁকে মোকাবিলা করতে হয়। উহুদ যুদ্ধে তিনি চাচা হামজা (রা.)-সহ ৭০ সাহাবির শাহাদাতের সাক্ষী হন। (সিরাতে ইবনে হিশাম, পৃষ্ঠা: ৩৭০-৩৮০)

অবরোধ ও বিশ্বাসঘাতকতা: খন্দকের যুদ্ধে ১০ হাজার সৈন্য মদিনা অবরোধ করে, যা শহরের অস্তিত্বের জন্য হুমকি ছিল। এ ছাড়া তাঁর শিক্ষাদানের জন্য পাঠানো অনেক সাহাবিকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়, যেমন রাজি‘ ও বিরে মাউনার ঘটনায় যথাক্রমে ১২ এবং ৭০ সাহাবি শহীদ হন। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৪০৮০; আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৪/৯০-৯৫)

মহানবী (সা.) কীভাবে এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করে আরও শক্তিশালী ও প্রভাবশালী হয়ে উঠলেন? তিনি যে কৌশলগুলো গ্রহণ করেছিলেন, তা কোরআনের শিক্ষা, তাঁর ব্যক্তিগত গুণাবলি এবং ব্যবহারিক পদক্ষেপের সমন্বয়। এই কৌশলগুলো আমাদের জন্যও শিক্ষণীয়।

কষ্টকে পরীক্ষা হিসেবে গ্রহণ

নবীজি (সা.) বিশ্বাস করতেন, কষ্ট আল্লাহর পক্ষ থেকে অবশ্যম্ভাবী পরীক্ষা। কোরআনে বলা হয়েছে: ‘লোকেরা কি মনে করে যে তারা বলবে, “আমরা ইমান এনেছি” আর তাদের পরীক্ষা করা হবে না?’ (সুরা আনকাবুত: ২; তাফসির ইবনে কাসির)

এই বিশ্বাস তাঁকে কষ্টের মুখে অটল থাকতে সাহায্য করেছিল। তিনি জানতেন, সত্যের পথে চলতে গেলে পরীক্ষা আসবেই। ‘আপনি কি মনে করেন যে আপনারা জান্নাতে প্রবেশ করবেন, অথচ আপনাদের পূর্ববর্তীদের মতো পরীক্ষা আপনাদের জন্য আসেনি? (সুরা বাকারা: ২১৪; তাফসির ইবনে কাসির) 

আরও পড়ুনমহানবী (সা.)-কে ভালোবাসার ৭টি নিদর্শন০৬ মার্চ ২০২৫

আল্লাহর ইচ্ছায় বিশ্বাস

 নবীজি (সা.) বিশ্বাস করতেন, আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া কিছুই ঘটে না। তিনি তাঁর ভাইপো আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.)-কে বলেছিলেন: ‘জানো, যা তোমাকে আঘাত করেছে, তা তোমাকে এড়িয়ে যেত না।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২,৬৬৪)

কোরআনে বলা হয়েছে: ‘কোনো দুর্ভাগ্য আসে না, যদি না তা আল্লাহর ইচ্ছায় হয়।’ (সুরা তাগাবুন: ১১; তাফসির ইবনে কাসির)

এই বিশ্বাস তাঁকে কষ্টের মধ্যেও মানসিক শান্তি দিয়েছে।

আল্লাহর শরণাপন্ন হওয়া

কঠিন সময়ে নবীজি (সা.) সব সময় আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করতেন। তায়েফ থেকে ফিরে তিনি প্রার্থনা করেছিলেন: ‘হে আল্লাহ, আমি আমার দুর্বলতা তোমার সামনে প্রকাশ করছি... তুমি যদি আমার প্রতি ক্রুদ্ধ না হও, তবে আমি কোনো কিছুর পরোয়া করি না।’ (আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৩/১৩৮)

 এই দোয়া তাঁর আল্লাহর ওপর পূর্ণ নির্ভরতার প্রকাশ।

আরও পড়ুননবী প্রেমের প্রতিদান কী২৭ এপ্রিল ২০২৫

নিজের কর্ম পরীক্ষা করা

 মহানবী (সা.) কষ্টকে আত্মপর্যালোচনার সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করতেন। তায়েফের প্রার্থনাতেও তিনি বলেছিলেন: ‘যদি তুমি আমার প্রতি ক্রুদ্ধ না হও, তবে আমি আর কোনো পরোয়া করি না।’

 কোরআন বলে: ‘তোমাদের ওপর যে দুর্ভাগ্য আসে, তা তোমাদের নিজ হাতের কাজের ফল।’ (সুরা শুরা: ৩০; তাফসির ইবনে কাসির)

 এই শিক্ষা আমাদের কষ্টের সময় নিজের ভুলত্রুটি পরীক্ষা করতে উৎসাহিত করে।

  আশাবাদী মনোভাব

 নবী (সা.) কঠিন সময়েও আশাবাদী ছিলেন। মক্কায় নির্যাতনের সময় সাহাবি খাব্বাব (রা.) নির্যাতনের কথা বললে তিনি বলেন: ‘আল্লাহর কসম, আল্লাহ এই দ্বীনকে পূর্ণ করবেন, যতক্ষণ না একজন মুসাফির সানা থেকে হাদরামৌত পর্যন্ত শুধু আল্লাহ ও তাঁর পশুকে ভয় করে ভ্রমণ করতে পারবে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৩,৮৫২)

তিনি সাহাবিদের মধ্যে আশাবাদ ছড়াতেন, বলতেন: ‘আমি শুভ লক্ষণ পছন্দ করি।’ এবং ব্যাখ্যা করতেন, ‘এটি একটি ভালো শব্দ।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২,২৫৫)

বিভ্রান্ত না হওয়া

কষ্টের মধ্যেও নবী (সা.) তাঁর মিশন থেকে বিচ্যুত হননি। কোরআন বলে, ‘তারা যেন তোমাকে আল্লাহর প্রকাশিত আয়াত থেকে বিচ্যুত না করে।’ (সুরা কাসাস, আয়াত: ৮৭)

তিনি নির্যাতন সত্ত্বেও ইসলামের বার্তা প্রচার অব্যাহত রাখেন।

আরও পড়ুনহজরত জাবের (রা.)–এর কাহিনি২৬ জানুয়ারি ২০২৫

প্রতিফলের প্রত্যাশা

 নবী (সা.) কষ্টের মধ্যে ধৈর্য ধারণ করে আল্লাহর প্রতিফলের প্রত্যাশা করতেন। কোরআন বলে, ‘নিশ্চয়ই কষ্টের সঙ্গে স্বস্তি আছে। নিশ্চয়ই কষ্টের সঙ্গে স্বস্তি আছে।’ (সুরা আশ-শারহ: ৫-৬)

এ ছাড়া ‘যারা বিপদে ধৈর্য ধারণ করে এবং বলে, “আমরা আল্লাহরই এবং তাঁর দিকেই ফিরে যাব”, তাদের ওপর তাদের রবের নিয়ামত ও রহমত বর্ষিত হবে।’ (সুরা বাকারা: ১৫৫-১৫৭)

 মহানবী মুহাম্মদ (সা.) তাঁর জীবনের কঠিন সময়গুলোকে আল্লাহর পরীক্ষা হিসেবে গ্রহণ করেছেন, তাঁর ওপর পূর্ণ ভরসা রেখেছেন এবং ধৈর্য, আশাবাদ ও আত্মপর্যালোচনার মাধ্যমে সেগুলো জয় করেছেন। তাঁর এই কৌশলগুলো আমাদের জন্য শিক্ষা। কষ্টের মুখে আমরাও যদি তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করি—আল্লাহর শরণাপন্ন হই, নিজের কর্ম পরীক্ষা করি, আশাবাদী থাকি এবং তাঁর প্রতিফলের প্রত্যাশা করি—তবে আমরাও জীবনের চ্যালেঞ্জগুলো জয় করতে পারব। তাঁর জীবন আমাদের জন্য আলোকবর্তিকা, যা আমাদেরকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে পরিচালিত করে।

সূত্র: তাফসির ইবনে কাসির, দার তাইয়্যিবা, রিয়াদ, ১৯৯৯; আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, দারুল ফিকর, বৈরুত, ১৯৮৮; সিরাতে ইবনে হিশাম, দারুল কুতুব আল ইলমিয়্যা, বৈরুত, ২০০০।

আরও পড়ুননবীজি (সা.)–এর কাছে রহস্যময় অতিথি১৯ ডিসেম্বর ২০২৪

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: দ র জন য আল ব দ য জ বন র আম দ র র জ বন আল ল হ পর ক ষ গ রহণ ক রআন করত ন র ওপর

এছাড়াও পড়ুন:

সাইবেরিয়ান হাঁস

১.

নদীকে স্ফীত করে ফেলে যে কুয়াশা, তার ভেতর দাঁড়িয়ে ছিল মেয়েটি। তার গায়ের রং মেঘের মতোই ধোঁয়াশা সাদা। চোখ থেকে ঝরে পড়ছিল বৃষ্টি শেষের রোদ্দুর। আমি তার ছবির গ্রাহক। কথা প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তার সব ছবিই কুয়াশায় আচ্ছন্ন কেন?

‘আমি এক সন্তানহারা রমণীর গল্প ফেরি করি আর ভালোবাসি কুয়াশা’; সে বলেছিল আমাকে উদ্দেশ করে।

এ কথার উত্তরে আমাকে বোবা হয়ে যেতে দেখে সে স্বগতোক্তির মতো করে বলে, ‘আমার মা ছিল সাইবেরিয়ান শীতের জমাট কুয়াশা, আর বাবা ছিল আটলান্টিক ওশানের আইসি ওয়াটার। আমি আর কীই–বা করতে পারতাম, বলো?

ওয়েল, ‘তুমি চাইলে অনেক কিছুই হতে পারতে।’

‘আমার ইচ্ছা ছিল সাইবেরিয়ান হাঁস হব। কুয়াশার ওপর দিয়ে মেঘের সাথে উড়ে বেড়াব। কিন্তু আমি হয়েছি আটলান্টিক স্যামন। আইসি ওয়াটারে সাঁতার কাটাই যার নিয়তি।’

আমি আর কথা না বাড়িয়ে ছবিটা বগলদাবা করে হাঁটা দিলাম। ওর কথায় চারদিক থেকে কুয়াশা নেমে আসতেছিল।

২.

জিপসি মেয়ের কাছ থেকে আনা ছবিটা আমার পড়ার ঘরের দেয়ালে টাঙালাম। সেটা থেকে কুয়াশা ঝরে পড়ছে। দৃষ্টিতে শীতলতা নিয়ে আমি তার ওম দেখি।

মেয়েটির নাম জানা হয়নি। ওর নামটা কি স্নো পড়া শুভ্রতাকে মনে করিয়ে দেবে? কেন যে আমি আর একটু থাকলাম না ওর সাথে, কেন আরও কিছু কথা শুনলাম না, কেন যে!

এর কয়েক দিন পর এক সাইবেরিয়ান রমণীর সাথে দেখা। তার কাছে শুনলাম জিপসি মেয়েটির নাম ক্যাথিয়া। তার মায়ের নাম তাতিয়া আর বাবা ভ্লাদ। ওরা সাইবেরিয়া থেকে যাত্রা শুরু করেছিল, পথই ওদের দেশ। অবিরাম চলতে থাকা তাতিয়া আর ভ্লাদ পথের পাশেই একদিন কুড়িয়ে পেয়েছিল ক্যাথিয়াকে। ক্যাথিয়া নামটা তাতিয়া বহু বছর আগেই ঠিক করে রেখেছিল। সে জানত, লাল টুকটুকে জামা পরা একটা মেয়েকে সে কোনো একদিন রাস্তার পাশে কুড়িয়ে পাবে। ও মেয়েটির নাম দেবে ক্যাথিয়া। দেশে দেশে, পথে পথে লাগাতার সাত বছর ওরা খুঁজে বেড়াবে ক্যাথিয়ার মা-বাবাকে, কিন্তু পাবে না। সাত বছর পর এই মেয়েটি ওর হবে। এই স্বপ্নই তাতিয়াকে পথে নামিয়েছিল। ক্যাথিয়া তার স্বপ্নের রাজকন্যা, তাকে বাস্তাবে পাওয়া যাবে কি না, তার তা জানা নাই।

আমি যতই তাতিয়ার কথা শুনছিলাম, ততই কুয়াশার ভেতর ঢুকে যাচ্ছিলাম।

অবিরাম চলতে থাকা তাতিয়া আর ভ্লাদ পথের পাশেই একদিন কুড়িয়ে পেয়েছিল ক্যাথিয়াকে। ক্যাথিয়া নামটা তাতিয়া বহু বছর আগেই ঠিক করে রেখেছিল। সে জানত, লাল টুকটুকে জামা পরা একটা মেয়েকে সে কোনো একদিন রাস্তার পাশে কুড়িয়ে পাবে।৩.

আগের দিনের যে কুয়াশাকে আমি রোমান্টিসাইজ করতেছিলাম, পরের দিনে সকালে তা–ই ভাসিয়ে দিচ্ছিল আমার পড়ার ঘর। দরজা খুলতেই গলগল করে কুয়াশা বের হয়ে রওনা করেছে ড্রয়িংরুমের দিকে।

আমি তাড়াতাড়ি দরজা বন্ধ করে দিলাম। কুয়াশার ভেতর দাঁড়িয়ে থেকে টের পাচ্ছিলাম একটা মনোরম ওম, যা হাঁসের পাখার নিচে লুকিয়ে থাকে।

আমি জানি, আমার বউ এই সব দেখলে রাগারাগি করবে। এমনকি ছবিটা গ্যারেজে নিয়েও রেখে দিতে পারে বা দিয়ে দিতে পারে সালভোসের অপ সপে। এর আগেও এমন হয়েছে।

একটা ছবি আমি কিনে এনেছিলাম ভিক্টোরিয়া রাজ্যের একদম শেষ প্রান্তের একটা ছোট্ট শহর মৌলামাইন থেকে। ছবিটা ছিল খুবই অর্ডিনারি, দিনের আলোতে সে খুবই নিরীহ একটা অতি সাধারণ ছবি।

কিন্তু রাতের বেলায় আবছা আলোতে সে জীবন্ত হয়ে উঠত। শোনা যেত শোঁ শোঁ, সাঁই সাঁই বাতাসের শব্দ, ঢেউ ভাঙার গর্জন। প্রথমে আস্তে আস্তে, তারপর মনোযোগটা টেনে নেওয়ার পর শুরু হতো উথালপাতাল ঢেউয়ের সাথে ঝোড়ো হাওয়ার তাণ্ডব। আমাদের ঘরটা তখন হয়ে যেত উত্তাল সমুদ্রে ঝড়ে পড়া ডিঙি। আর আমরা হয়ে যেতাম সেই ছবির মধ্যে নৌকায় টলমল করতে থাকা তিনজন যাত্রী; যারা নিরুদ্দেশের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছে।

দুই–তিনবার এমন হওয়ার পর আমি আর ছবিটাকে রক্ষা করতে পারি নাই। কিছুদিন গ্যারেজে থাকার পর একদিন আমার বউ তাকে হার্ড রাবিশের সাথে রাস্তায় রেখে আসে।

আমি সারাক্ষণ চোখ রাখতেছিলাম, কে নেয় ছবিটা দেখার জন্যে। কিন্তু কখন যে ছবিটা উধাও হয়ে গেল; কে যে নিল, তা কিছুতেই খেয়াল রাখতে পারলাম না।

ছবিটার জন্যে এখনো আমার মন খারাপ হয়। মনে হয়, আমাদের বিদেশ–বিভুঁইয়ে, এই নিস্তরঙ্গ জীবনে সেটা ছিল একমাত্র আলোড়নের সম্ভাবনা। ছিল জাগতিক ভয়ের ঊর্ধ্বে ঐশ্বরিক এক শিহরণের স্বর্গীয় সম্ভাবনাকে জিইয়ে রাখার অবলম্বন। কিন্তু আমার বউ তা বুঝল না। এবারও সে বুঝবে না এবং আমার এই ক্রমাগত কুয়াশা বিচ্ছুরণের নিষ্পাপ উৎসকে কালিমা লেপে বাতিল করার ষড়যন্ত্রে উঠে–পড়ে লাগবে। আমি জানি, ও লাগবেই।

৪.

জিপসি মেয়েটাকে কীভাবে খুঁজে পাব, তার কোনো দিশা আমি ঠিক করতে পারতেছিলাম না। ওর সাথে দেখা হয়েছিল সানডে মার্কেটে। আমি ভিক্টোরিয়া রাজ্যের সানডে মার্কেট কখন কোথায় হয়, দেখতে গিয়ে দেখি, প্রায় গোটা বিশেক সানডে মার্কেট, মেলবোর্নের আশপাশেই বসে। আবার সময়েরও হেরফের আছে। কোনো মার্কেট হয়তো মাসের প্রথম সপ্তাহে বসে আর কোনোটা দ্বিতীয়, কোনোটাবা মাসের চতুর্থ সপ্তাহে।

কোনটা দিয়ে শুরু করব বুঝতেছি না।

আবার ও তো একটা মার্কেটে দুইবার বসে না। প্রতি সানডেতে সে একটা নতুন এলাকায় চলে যায় এবং সেখানকার সানডে মার্কেটে বসে। এটা খুবই হতে পারে যে ও যে মার্কেটে বসতেছে, সেখান আমি যাচ্ছি না। আমি যেখানে যাচ্ছি সেখানে সে নাই। একটা গোলকধাঁধার ভেতর ঢুকে যাচ্ছি, নিয়ন্ত্রণহীন, হাওয়ার ভেসে বেড়ানো বেলুনের মতো।

দিনের আলোতে সে খুবই নিরীহ একটা অতি সাধারণ ছবি। কিন্তু রাতের বেলায় আবছা আলোতে সে জীবন্ত হয়ে উঠত। শোনা যেত শোঁ শোঁ, সাঁই সাঁই বাতাসের শব্দ, ঢেউ ভাঙার গর্জন। প্রথমে আস্তে আস্তে, তারপর মনোযোগটা টেনে নেওয়ার পর শুরু হতো উথালপাতাল ঢেউয়ের সাথে ঝোড়ো হাওয়ার তাণ্ডব।৫.

লাগাতার কয়েক মাস সানডে মার্কেটে ঘোরাঘুরির পর একদিন তাতিয়াকে পেয়ে যাই। তাতিয়া তামা বা রুপার তার দিয়ে গহনা বানায়। সেগুলো সে কার্নিভ্যালে ঘুরে ঘুরে বিক্রি করে আর যখন কার্নিভ্যাল থাকে না, তখন সানডে মার্কেটে।

‘তুমি লাল জামা পরে ঘুরে বেড়াচ্ছ কি মেয়েদেরকে হর্নি করার জন্যে?’ তাতিয়া আমাকে বলে। আমি লজ্জায় আরও একটু লাল হয়ে ওরে জিজ্ঞেস করি, ‘লাল জামা কি হর্নি করে নাকি?’

‘হ করে তো,’ ও বলে।

‘মেয়েরা কি এই জন্যেই লাল জামা পরতে পছন্দ করে?’ আমি জিজ্ঞেস করি।

ও বলে, ‘না। মেয়েরা লাল জামা তখনই পরে, যখন সে তার মা ও মাটিকে মিস করে। একটা নস্টালজিক মুগ্ধতার ভেতর থাকে তারা, সে সময়।’

‘রিয়েলি!’ আমি বলি।

তাতিয়া আমার দিকে এমনভাবে তাকায়, যেন সে কুয়ায় পড়ে যাওয়া কোনো বালককে দেখার চেষ্টা করতেছে।

আমার চোখ ওর চোখ থেকে সরিয়ে নিই। দেখি, দোকানে সাজিয়ে রাখা গয়নার ভেতর ঘাপটি মেরে থাকা শূন্যতাকে। আর বলি, ‘তোমার গয়নাগুলো সুন্দর। আমার কেউ নাই, থাকলে আমি একজোড়া কিনে নিতাম।’

‘তুমি গয়না কিনতে আসো নাই, আমি জানি।’

আমার নীরবতা ওর কথাকে আর আগাতে দেয় না।

আমি চলে আসার মুহূর্তে তাতিয়া আমাকে বলে, ‘ক্যাথি আর ভ্লাদ বিয়ে করেছে। ওরা এখন অন্য শহরে থাকে।’

তাতিয়া এমন বাড়তি নির্লিপ্ততার সাথে কথাগুলো বলল, যেন কথা বলছে না, উগরে দিচ্ছে কতগুলো পরিত্যক্ত লোহালক্কড়। আর তারপরই দৃঢ় পদে আমার সামনে থেকে একজন কাস্টমারকে উদ্দেশ্য করে হেঁটে গেল, ওর দৃঢ়তা এবং স্থিরতা আমাকে পাহাড় ডিঙানো মহিষের কথা মনে করিয়ে দেয়।

আমি আর কথা না বাড়িয়ে কুয়াশায় অন্ধকার হয়ে যাওয়া পথহীন একটা দুনিয়ার পথ ধরে মহিষের মৌনতা নিয়ে হাঁটতে থাকি।

৬.

বাড়ি এসে আমি নিজেই ছবিটা সালভোসের অপ সপে দিয়ে আসতে যাই। ছবিটা থেকে এখন আর কুয়াশা ঝরছে না, যেন মৃত কুয়াশাকে কবর দেওয়ার জন্যে তাতিয়া নিয়ে যাচ্ছে গোরস্তানে। একটা লাশ বহনকারী গাড়ির পেছন পেছন আমি হাঁটি। একটা দীর্ঘ ক্লান্তিকর ভ্রমণের পর সালভোসের দোকানে পৌঁছাই।

দোকানে গিয়ে দেখি, ক্যাথিয়ার আরও একটা ছবি সেখানে রাখা।

ছবিটার নিচের দিকে কুয়াশার ভেতর থেকে উঁকি দিচ্ছে হাজার হাজার মাকড়সার বাচ্চা, সেই মাকড়সার চেইন দিয়ে লেখা হয়েছে দুইটা লাইন:
‘তোমার অপেক্ষা বিফলে যাবে,
দমকা বাতাস উড়িয়ে নিয়ে যাবে নিস্ফলা গাছের শেষ পাতাটি।’

সম্পর্কিত নিবন্ধ