আইএমএফের ঋণের চতুর্থ কিস্তি পায়নি বাংলাদেশ। তৃতীয় কিস্তি পেয়েছিল বিগত সরকারের আমলের শেষদিকে। উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অতিরিক্ত অর্থ পেয়ে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভও বেড়েছিল। রিজার্ভে বড় অবনতি এবং এটা ঘিরে শঙ্কা থেকেই মূলত আইএমএফের শরণাপন্ন হয়েছিল শেখ হাসিনা সরকার। সাড়ে তিন বছরে সাত কিস্তিতে ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ লাভের চুক্তি হয়েছিল। শর্ত পরিপালন সাপেক্ষে এটা পাওয়ার কথা। বিগত শাসনামলে এ ক্ষেত্রে কিছু জটিলতা সৃষ্টি হলেও কিস্তি পেতে বেশি বেগ পেতে হয়নি। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে দেখা যাচ্ছে ভিন্ন চিত্র। ইতোমধ্যে ঋণের চতুর্থ কিস্তি পাওয়ার সময় পেরিয়ে গেছে। এখন আশা, আগামী জুনের মধ্যে চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তি একযোগে পাওয়া যাবে।
মাঝে আইএমএফ মিশন ঘুরে যাওয়ার সময়ই বোঝা গিয়েছিল, ঋণ কর্মসূচিতে কিছু জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। পরে অর্থ উপদেষ্টা, গভর্নর ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারীর বক্তব্যেও বিষয়টি স্পষ্ট হয়। তাদের বক্তব্যের সারকথা হলো– আইএমএফের পরবর্তী কিস্তি পাওয়া নাও যেতে পারে; কিন্তু এতে তেমন অসুবিধার সৃষ্টি হবে না। সংস্থাটি শর্ত পরিপালন ঘিরে চাপ সৃষ্টি করলে বাংলাদেশ তা মানতে নারাজ। আইএমএফের শর্তাবলি নিয়ে দুনিয়াজুড়েই সমালোচনা রয়েছে। দীর্ঘমেয়াদি ঋণ কর্মসূচিতে তারা ক্রমে আরও বেশি ‘শর্তের জালে’ জড়িয়ে ফেলে বলে অভিযোগ নতুন নয়। অন্তর্বর্তী সরকারের কর্তাব্যক্তিদের কথাবার্তায়ও মনে হচ্ছে, শর্ত নিয়ে এখন বেশি চাপাচাপি করছে সংস্থাটি। এ ঋণ চুক্তিতে মোট ৩৮টি শর্ত দেওয়া হয়েছিল। এখন নাকি জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে চারটি শর্ত (মতান্তরে দুটি) পরিপালন নিয়ে। এর মধ্যে বেশি আলোচিত ডলারের দাম বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার বিষয়টি।
গত বছরের মে মাসের শুরুতে আইএমএফের শর্ত পরিপালন করতে গিয়েই ডলারের দাম নির্ধারণে নতুন পদ্ধতি চালু করা হয়। দামের উল্লম্ফন রোধে একটি নির্দিষ্ট সীমায় ওঠা-নামার সুযোগ করে দেওয়া হয় ডলারের দামকে। তা সত্ত্বেও পদ্ধতিটি চালুর পরপরই ডলারের দাম ৭ টাকা বেড়ে যায়। ডলারের দাম বাড়লে প্রবাসে উপার্জনকারী আর রপ্তানি খাতের উদ্যোক্তারা খুশি হলেও আমদানিকাররা চিন্তিত হন। কারণ বেশি টাকা দিয়ে ডলার কিনে আমদানি করতে হয় তাদের। সরকারি খাতে আমদানিও তখন ব্যয়বহুল হয়ে পড়ে। এর পরিণতিতে মূল্যস্ফীতি বেড়ে উঠতে দেখা যায়। আর মূল্যস্ফীতি, বিশেষত খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতির প্রভাবের কথা তো সবারই জানা।
শেখ হাসিনা সরকারের শেষ সময়টার মতো এখনও মূল্যস্ফীতি উচ্চ পর্যায়ে। কোনো কোনো মাসে সামান্য কমলেও আবার বৃদ্ধির প্রবণতা দেখাচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্তরা মূল্যস্ফীতি লাগামছাড়া হয়ে যাওয়ার শঙ্কাতেও ডলারের দাম পুরোপুরি বাজারে ছাড়তে নারাজ।
আন্তর্জাতিক পণ্যবাজার অবশ্য এ মুহূর্তে ইতিবাচক। জ্বালানিসহ যেসব পণ্য আমরা আমদানি করে থাকি, সেগুলোর দাম কমতির দিকে। বিশ্ববাজারে চালের দাম হ্রাসও বড় খবর। হালে আমরা কিছু চালও আমদানি করছি। সরকারের দাবি, ডলারের দাম স্থিতিশীল থাকায় আমদানি কার্যক্রমে সমস্যা হচ্ছে না। বিশ্ববাজারে পণ্যসামগ্রীর দাম কমে এলে এ অবস্থায় আরও বেশি সুফল মিলবে।
এ যুক্তিতেই কেউ কেউ বলছেন, এটাই ডলারের দর বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার উৎকৃষ্ট সময়। কেননা, এতে দাম কিছুটা লাফিয়ে বাড়লেও বিশ্ববাজার কমতির দিকে থাকায় আমদানি ব্যয় পুষিয়ে যাবে। আইএমএফ হয়তো এটাই বলতে চাইবে। কিন্তু সরকার এখনই ডলারকে পুরোপুরি বাজারের হাতে ছাড়তে নারাজ। হালে প্রবাসী আয়ের প্রবাহ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে রিজার্ভে এক ধরনের স্বস্তি এলেও সরকার মনে করছে, উল্লিখিত সংস্কারের সময় এখনও আসেনি।
সরকারের বক্তব্যে মনে হতে পারে, আইএমএফের চলমান ঋণ কর্মসূচি থেকে বেরিয়ে যেতে হলেও পরোয়া নেই। সার্বিকভাবে অর্থনীতিতে স্থবিরতা চললেও তারা হয়তো দেখছেন, প্রবাসী আয়ের পাশাপাশি রপ্তানি আয় পরিস্থিতি ইতিবাচক। ট্রাম্প প্রশাসন মাঝে অনেক বেশি শুল্ক বাড়ালেও তা একযোগে প্রতিযোগী দেশগুলোর জন্য কোনো কোনো ক্ষেত্রে আরও বেশি করে প্রযোজ্য বলে বাংলাদেশ বরং এ থেকে সুবিধা পাবে। এ অবস্থায় আইএমএফের প্রতিশ্রুত বিদেশি মুদ্রা না পেলেও চলবে। কিন্তু বিষয়টা কেবল বিদেশি মুদ্রাবাজার বা রিজার্ভ ঠিকঠাক রাখার সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। অর্থনীতি গতি হারানোয় আমদানি চাহিদা বেশি না হওয়াতেও সরকার হয়তো ডলারের প্রবাহ নিয়ে স্বস্তিতে আছে। সে কারণে কমেছে আইএমএফের ঋণ পাওয়ার তীব্র চাহিদা। তবে এর সঙ্গে দেশের ভাবমূর্তি জড়িত। বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর আস্থা রাখা-না রাখার বিষয়ও এখানে সম্পর্কিত। এ ঋণের অঙ্ক তেমন উল্লেখযোগ্য না হলেও চুক্তি অনুযায়ী সেটি পেতে থাকার গুরুত্ব অনস্বীকার্য।
প্রায় একই সময়ে শ্রীলঙ্কা আর পাকিস্তানও আইএমএফের সঙ্গে ঋণ চুক্তিতে গিয়েছিল। শ্রীলঙ্কা তো নজিরবিহীন সংকটে পড়েই শরণাপন্ন হয় আইএমএফের। তখন বাংলাদেশও অব্যাহত রিজার্ভ ক্ষয়ের ঘটনায় পড়ে শঙ্কার মধ্যে। আমদানি হ্রাসেও তখন বাধ্য হয় সরকার। ওই অবস্থায় আইএমএফের সঙ্গে ঋণ চুক্তি ‘বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ’ বলেই বিবেচিত হয়েছিল। কিন্তু হালে কর্মসূচিটি জটিলতায় নিপতিত বললে ভুল হবে না। এর কারণ কি রাজনৈতিক?
এনবিআরের নীতি ও বাস্তবায়ন বিভাগকে আলাদা করার মতো পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। তবে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থতা নিয়ে জটিলতা নাকি রয়েই গেছে। গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী নজিরবিহীন পরিস্থিতিতে এমনটি যে অস্বাভাবিক নয়– সেটা তো আইএমএফের বোঝার কথা। মূল্যস্ফীতি কমাতেও সরকার কম সচেষ্ট নয়। আইএমএফ প্রস্তাবিত সংকোচনমূলক মুদ্রানীতিও কিন্তু অনুসৃত হচ্ছে। ব্যাংক খাতে স্বচ্ছতা আনতেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক কম উদ্যোগী নয়। তাহলে?
অতিসম্প্রতি ভারত-পাকিস্তান সামরিক সংঘাতের মধ্যেও পাকিস্তানের জন্য ঋণের কিস্তি ছাড় করেছে আইএমএফ। ভারতের তীব্র আপত্তি সত্ত্বেও এ ঘটনা বিশেষভাবে আলোচিত হচ্ছে। একই সময়ে আবার আইএমএফের প্রভাবশালী সদস্য যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগে যুদ্ধবিরতিতে এসেছে অগ্রগতি। অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে পাকিস্তান ভালো করছে বলেই মনে করে আইএমএফ।
তবে কি বাংলাদেশের অর্থনীতির ‘ঘুরে দাঁড়ানো’ বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের দাবির সঙ্গে আইএমএফ একমত নয়? বাংলাদেশ কিন্তু উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বর্ধিত সহায়তাও চেয়ে বসে আছে সংস্থাটির কাছে। বাড়তি অর্থ সহায়তা চেয়ে তেমন সাড়া পাচ্ছে না বিশ্বব্যাংক, জাইকার কাছ থেকেও। বিদেশি ঋণের প্রতিশ্রুতি এবং অর্থ ছাড় হালে উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে বলেও
খবরে প্রকাশ। সরকার অবশ্য বিদেশি দায়দেনা পরিশোধে বড় অগ্রগতি এনেছে। এতে বাংলাদেশের ওপর আস্থা বাড়বে।
ঋণের একটি-দুটি কিস্তি নিয়ে জটিলতা সৃষ্টির পর সেটা অবশ্য কেটে যেতেও দেখা যায়। শ্রীলঙ্কার বেলায় এমনটি ঘটেছে। আমাদের ক্ষেত্রেও এটি ঘটতে পারে।
হতে পারে গণতন্ত্রে উত্তরণের সঙ্গে বিষয়টি অনেকখানি সম্পর্কিত। এ বিষয়ে সরকারের এক ধরনের রোডম্যাপও রয়েছে। এমনও হতে পারে, জুনের শুরুতে বাজেট ঘোষণার আগে-পরে কিস্তিবিষয়ক সুখবরটি ঠিকই পাব আমরা। সবচেয়ে বড় কথা, আইএমএফসহ উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে হবে।
হাসান মামুন: সাংবাদিক, কলাম লেখক
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: আইএমএফ র সরক র র উল ল খ আমদ ন র ওপর
এছাড়াও পড়ুন:
যুদ্ধের উত্তেজনার মধ্যেই পাকিস্তানকে আইএমএফের ঋণ, ভারতের তীব্র আপত্তি
চলতি ৭০০ কোটি ডলারের ঋণ কর্মসূচির আওতায় পাকিস্তানের জন্য নগদ ১০০ কোটি ডলার ছাড় করেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। এদিকে দেশটিকে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে সংস্থাটির প্রতি ব্যাপক পর্যালোচনা করার অনুরোধ জানিয়েছে পাকিস্তানের চিরবৈরী প্রতিবেশী ভারত।
গতকাল শুক্রবার ওই কর্মসূচির প্রথম পর্যায়ের মূল্যায়ন অনুমোদনের পর এ অর্থছাড় করা হয়। পাশাপাশি নিজেদের জলবায়ু সহনশীলতা তহবিলের আওতায় পাকিস্তানের জন্য ১৪০ কোটি ডলারের ঋণ অনুমোদন করেছে আইএমএফ।
আইএমএফ এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, বিশ্বজুড়ে চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতির মধ্যেই চলমান ঋণ কর্মসূচির আওতায় পাকিস্তানের নীতিগত পদক্ষেপগুলো দেশটির অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও আস্থা পুনর্গঠনে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি এনেছে।
আইএমএফ গত বছরের মাঝামাঝি পাকিস্তানের জন্য ৭০০ কোটি ডলারের ঋণ কর্মসূচি গ্রহণ করে, যার উদ্দেশ্য ছিল দেশটির দুর্বল অর্থনীতি চাঙা করা। কর্মসূচির আওতায় এখন পর্যন্ত মোট ২০০ কোটি ডলার ছাড় করা হয়েছে। তবে জলবায়ু সহনশীলতা তহবিলের নতুন ঋণ কর্মসূচি থেকে কোনো নগদ অর্থ এখনো ছাড় করা হয়নি।
পাকিস্তানকে ঋণ দেওয়ার ব্যাপারে আরও বিস্তৃত পর্যালোচনা করার জন্য আইএমএফের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছে প্রতিবেশী ভারত। গতকাল আইএমএফের বোর্ড সভায় ভারত দাবি করে, পাকিস্তান যে ঋণ পাচ্ছে, তা ‘সীমান্তে রাষ্ট্রীয় মদদপুষ্ট সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে’ ব্যবহৃত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
আরও পড়ুনমুরিদকেতে ভারত কি ‘সন্ত্রাসীদের ঘাঁটি’তে হামলা চালিয়েছে, নাকি মসজিদে১৭ ঘণ্টা আগেভারতের এ দাবির জবাবে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘আইএমএফের কর্মসূচি বানচাল করতে ভারতের চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে।’
পারমাণবিক শক্তিধর দুই প্রতিবেশী ভারত ও পাকিস্তান কয়েক দশকের মধ্যে এখন সবচেয়ে বড় সংঘাতে জড়িয়ে আছে। ভারত-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পেহেলগামে বন্দুকধারীদের হামলা এবং এর জেরে পাকিস্তান ও পাকিস্তাননিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে ভারতের ক্ষেপণাস্ত্র হামলাকে কেন্দ্র করে দুই দেশের মধ্যে কয়েক দিন ধরে পাল্টাপাল্টি হামলা চলছে।
আরও পড়ুনভারত–পাকিস্তানের পাল্টাপাল্টি ড্রোন হামলা ৬ ঘণ্টা আগেগত ২২ এপ্রিল পেহেলগামের হামলায় ২৬ জন নিহত হন। এর দায় পাকিস্তানের ওপর চাপিয়ে আসছে ভারত। তবে তা নাকচ করেছে পাকিস্তান। ওই ঘটনার জেরে পাল্টাপাল্টি বিভিন্ন পদক্ষেপও নিয়েছে দেশ দুটি। এমন উত্তেজনার মধ্যে মঙ্গলবার দিবাগত রাতে পাকিস্তান ও দেশটির নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে হামলা চালায় ভারত। এর পর থেকেই দুই দেশের মধ্যে চলছে পাল্টাপাল্টি হামলা।
আরও পড়ুনবৃহস্পতিবার রাতে ৩০০ থেকে ৪০০ ড্রোন দিয়ে হামলা চালায় পাকিস্তান: ভারত৭ ঘণ্টা আগে