ফোন ডায়েট কী
ফোন ডায়েট বা ডিজিটাল ডায়েট হলো মুঠোফোনের ব্যবহারে নিয়ন্ত্রণ রাখা। বিশেষজ্ঞরা ই-মেইল, হোয়্যাসটঅ্যাপ, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টিকটক, ইউটিউবসহ বিভিন্ন মাধ্যম ব্যবহারের সময়সীমা দিনে এক ঘণ্টার মধ্যে আনার পরামর্শ দিচ্ছেন। আর সপ্তাহে এক দিন স্মার্টফোনকে ছুটিতে পাঠাতেও পরামর্শ দিচ্ছেন তাঁরা। ওই দিন কেবল কথা বলা ছাড়া আর কোনো কাজে ফোন ব্যবহার করতে মানা। এটিই স্মার্টফোন ডায়েটের একটি আদর্শ রূপ। যখন আপনি কেবল এক ঘণ্টা ফোন ব্যবহার করবেন, স্বাভাবিকভাবে তখন কেবল অতি প্রয়োজনীয় কাজই সারবেন।
ফোন ডায়েটের প্রধান দুটি শর্ত২৪ ঘণ্টায় ১ ঘণ্টা ফোন ব্যবহার করা।
সপ্তাহে এক দিন স্মার্টফোনকে ছুটি দেওয়া।
আরও পড়ুনসঙ্গী সারাক্ষণ ফোনে ব্যস্ত, কী করবেন১৫ ডিসেম্বর ২০২৩কেন করবেন ফোন ডায়েটফোন ডায়েটের ফলে আপনার মনোযোগের স্থায়িত্ব বাড়বে। যেকোনো কাজ সর্বোচ্চ মনোযোগ দিয়ে করতে পারবেন। ‘ডিসট্রাকশন’ বা মনোযোগ ছুটে যাওয়ার সমস্যা কমবে। শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখা হবে সহজ। ডিজিটাল ডিভাইস বা পর্দা থেকে বিকিরিত নীল আলো কমে যাওয়ার ফলে ঘুমের মান ভালো হবে। নির্দিষ্ট সময়ে ঘুমাতে যাওয়া ও ঘুম থেকে উঠতে সুবিধা হবে। রুটিনমাফিক স্বাস্থ্যকর জীবন যাপন করা হবে সহজ।
গবেষণা জানাচ্ছে, অনিয়ন্ত্রিত ফোন স্ক্রলিংয়ের সঙ্গে স্থূলতার সম্পর্ক আছে। কেউ যখন ফোন স্ক্রল করতে করতে খান, তখন তিনি খুব কমই সে খাবার উপভোগ করতে পারেন। তাই বার্গার, পিৎজা বা ফাস্টফুডের মতো খাবারে আগ্রহী হন। ফোন ডায়েটে থাকলে স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনে আগ্রহী হওয়া সম্ভব। পরিবার ও কাছের মানুষদের সঙ্গে সময় কাটানো যায়। মানসিক স্বাস্থ্যের পাশাপাশি চোখ, মস্তিষ্ক ও হার্টের স্বাস্থ্য ভালো রাখতেও ফোন ডায়েট কার্যকর।
গবেষণা জানাচ্ছে, মাত্র ৭২ ঘণ্টা বা ৩ দিন স্মার্টফোন ছাড়া থাকলেই আপনার মস্তিষ্কের কার্যকারিতায় উল্লেখযোগ্য ইতিবাচক পরিবর্তন আসে।
ফোন ডায়েটের আগে–পরেগবেষণাটি পরিচালনা করেছে জার্মানির দুটি বিশ্ববিদ্যালয়—হাইডেলবার্গ ইউনিভার্সিটি ও ইউনিভার্সিটি অব কোলন। গবেষণাটি পরিচালিত হয় ২৫ জন তরুণের ওপর, যাঁদের সবার বয়স ১৮ থেকে ৩০ বছর। গবেষণাটি শুরু করার আগে এই ২৫ তরুণের মস্তিষ্কের এমআরআই (ম্যাগনেটিক রেজন্যান্স ইমেজিং) করা হয়। এ ছাড়া তাঁদের একটা মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষাও নেওয়া হয়।
তারপর তিন দিন এই তরুণদের ফোন ডায়েটে রাখা হয়, অর্থাৎ ৭২ ঘণ্টা তাঁরা স্মার্টফোন ব্যবহার করেননি। স্বাভাবিকভাবে অন্যদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করেছেন। আর নিজেদের দৈনন্দিন ও পেশাগত কাজকর্মও করেছেন। ৭২ ঘণ্টা পর আবার তাঁদের এমআরআই টেস্ট ও একই মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষা নেওয়া হয়। পরীক্ষায় এই তরুণদের চালু স্মার্টফোন, বন্ধ স্মার্টফোন, ফুল, প্রকৃতি প্রভৃতির ছবি দেখানো হয়। আর মস্তিষ্ক সেসব ছবি দেখে কীভাবে সাড়া দেয়, তা লিপিবদ্ধ করা হয়। এরপর এই দুই পরীক্ষার পার্থক্য থেকে গ্রহণ করা হয় সিদ্ধান্ত।
আরও পড়ুনশিশুকে মোবাইল ফোন থেকে দূরে রাখার উপায়গুলো জেনে রাখুন৩১ মার্চ ২০২৫এই গবেষণায় যে আশ্চর্য ফলাফল পাওয়া যায়পরীক্ষায় দেখা যায়, অন্য যেকোনো ধরনের আসক্তি মস্তিষ্কে যেভাবে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে, দিনে ব্যক্তিভেদে তিন–চার ঘণ্টার বেশি স্মার্টফোনের ব্যবহারও একইভাবে ব্যক্তির মস্তিষ্ককে প্রভাবিত করে।
মাত্র তিন দিন স্মার্টফোন ব্যবহার বন্ধ করার ফলে এমআরআই পরীক্ষায় মস্তিষ্কের স্মৃতি সংরক্ষণ, চিন্তা ও সৃজনশীলতার অংশ ভালোভাবে সাড়া দেয়। এর কারণ হলো মানুষ সামাজিক জীবন যাপন করবে, চিন্তা করবে, সমস্যা সমাধান করবে—মানুষের মস্তিষ্ক এভাবেই কাজ করার জন্য উপযোগী। তাই যখন মস্তিষ্ককে যখন কোনো অস্বাস্থ্যকর, চ্যালেঞ্জিং পরিবেশ থেকে স্বাস্থ্যকর পরিবেশ দেওয়া হয়, মস্তিষ্ক তখন সেটির সঙ্গে দ্রুত মানিয়ে নেয় ও ইতিবাচকভাবে সাড়া দেয়।
মানুষ যখন স্মার্টফোন ব্যবহার করে, তখন সে সৃজনশীল চিন্তা করার অবকাশ পায় না। ফলে উদ্ভাবনী ক্ষমতা, যুক্তি বিশ্লেষণের মাধ্যমে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা বাধাগ্রস্ত হয়। মস্তিষ্ক দ্রুত বৃদ্ধ হতে থাকে। ফলে কম বয়সেই স্ট্রোক, আলঝেইমারস ডিজিজ, পারকিনসনের মতো সেরিব্রোভাস্কুলার ও নিউরোডিজেনারেটিভ রোগের ঝুঁকি বাড়ে আশঙ্কাজনক হারে।
স্মার্টফোনের ব্যবহার নিয়ন্ত্রিত করার মাধ্যমে আপনি সৃজনশীল কাজে আরও ভালোভাবে মনোনিবেশ করতে পারেন। মস্তিষ্কের স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্য স্মার্টফোনের ব্যবহার নিয়ন্ত্রিত করার কোনো বিকল্প নেই।
সূত্র: মায়ো ক্লিনিক
আরও পড়ুনযে কারণে কিছুক্ষণ পরপর আপনি ফোন চেক করেন, জানলে অবাক হবেন২৪ এপ্রিল ২০২৫.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ফ ন ব যবহ র কর ফ ন র ব যবহ র স ব স থ যকর পর ক ষ
এছাড়াও পড়ুন:
জোরজবরদস্তি করে সরকার এসব চুক্তি করছে
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান কাজ হলো একটু সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক রূপান্তর এগিয়ে নেওয়া। এ জন্য যে ধরনের সংস্কার দরকার, সেই সংস্কার নিশ্চিত করা। আর কয়েক মাস পর নির্বাচন। নির্বাচন ভালোমতো করার জন্য যা যা করা দরকার, সেটি করার জন্য এখন মনোযোগ দেওয়া দরকার। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য দরকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক করা। পাশাপাশি সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে নিরাপত্তাবোধ ফিরিয়ে আনা। অথচ এসব দিকে সরকারের মনোযোগ বা সক্রিয়তা দেখা যাচ্ছে না।
নির্বাচনের এসব বিষয়ে মনোযোগ না দিয়ে যেটিতে তাদের এখতিয়ার নেই, সেই দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতেই সরকারের যত আগ্রহ। রীতিমতো জোরজবরদস্তি করে সরকার এসব চুক্তি করছে। দেশের মানুষ, বিশেষজ্ঞ—কারও কথা না শুনে, জাতীয় স্বার্থ বিবেচনা না করে ভয় দেখিয়ে একের পর এক চুক্তি করছে সরকার।
একটা দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি করার কোনো এখতিয়ার এ রকম অস্থায়ী সরকারের থাকে না। এসবের জন্য নির্বাচিত সরকার দরকার হয়। শুধু নির্বাচিত সরকারও এভাবে করতে পারে না। নির্বাচিত সরকার এ ধরনের চুক্তি করলে সেগুলো সংসদে তুলতে হবে, সেখানে তর্ক-বিতর্ক হবে, দেশের মানুষ জানবে। আর কয় মাস পর নির্বাচন। এই সময় সরকারের এই ধরনের চুক্তিতে এত আগ্রহ কেন? বন্দর নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি যদি দেশের উন্নয়নের জন্যই হয়, তাহলে এত গোপনীয়তা, অস্বচ্ছতা ও তাড়াহুড়া কেন?
চুক্তি নিয়ে এই সরকারের অতি আগ্রহ বড় সন্দেহের কারণ। মনে হচ্ছে বিদেশি কোম্পানির কিছু লবিস্ট এই সরকার চালাচ্ছে। তাদের কাজ হলো কোনো না কোনোভাবে বিদেশি কোম্পানির স্বার্থ রক্ষায় গোপনে অস্বচ্ছভাবে চুক্তি করে ফেলা। সেটা দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি, যাতে পরবর্তী কোনো সরকার এসে কিছু করতে না পারে। কিন্তু এই চুক্তির বোঝা বাংলাদেশের মানুষকে ভোগ করতে হবে বহু বছর।
গণ–অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জনগণের যে প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল, স্বচ্ছতা নিয়মনীতি মেনে কাজ হবে, তার প্রতি এটা বিশ্বাসঘাতকতা ছাড়া আর কিছু নয়। একই সঙ্গে যেসব রাজনৈতিক দল সরকারের সঙ্গে বিভিন্ন সময় আলাপ-আলোচনা করছে, অথচ সরকারের জাতীয় স্বার্থবিরোধী তৎপরতা নিয়ে তারা যে নিশ্চুপ থাকল, সেটার দায়িত্বও তাদের নিতে হবে।
আমরা দেখেছি, এ রকম চুক্তির আগে সব সময় যুক্তি দেওয়া হয়, বিদেশি কোম্পানি বিশ্বের শ্রেষ্ঠ কোম্পানি। আবার মানুষের মধ্যে এই বোধ তৈরি করা হয় যে আমরা পারব না। আমাদের পক্ষে কিছুই সম্ভব নয়। বিদেশিরা এলে কাজ হবে। আবার আমরা থাকলে দুর্নীতি হবে। বিদেশিরা এলে দুর্নীতি হবে না। এই হীনম্মন্যতা তৈরি করে এবং তার ওপর ভর করে বিদেশি কোম্পানিকে সুবিধা দেওয়ার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরা হয়। বিদেশিদের পক্ষে বিজ্ঞাপনী প্রচার চালাতে থাকে তাদের সুবিধাভোগী দেশি লোকজন। কিন্তু বিদেশিরা এলে যে দুর্নীতি হবে না, সেটার নিশ্চয়তা কীভাবে দেওয়া হয়? আন্তর্জাতিকভাবে কি দুর্নীতি হয় না? চুক্তির আগে মাশুল যে বাড়ানো হলো, এটাও তো দুর্নীতির একটা ধরন।
বিদেশি কোম্পানি যে দক্ষ, আন্তর্জাতিক যে স্বীকৃতি, সেই কোম্পানিগুলো কিন্তু এমনিতেই গড়ে ওঠেনি। জাতীয় সক্ষমতার প্রক্রিয়ার মধ্যে গড়ে ওঠেছে এসব কোম্পানি। বাংলাদেশকেও জাতীয় সক্ষমতার ওপর দাঁড়াতে হবে। সে জন্য নিজেদের প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। একটা দেশ শক্তভাবে দাঁড়াতে পারে, যখন নিজের সক্ষমতা তৈরি হয়। এই সরকার দেশকে বিপন্ন করে তার উল্টো দিকে যাত্রা করছে।
লেখক পরিচয়: অর্থনীতিবিদ ও সম্পাদক, সর্বজনকথা