কসমেটিকস বাজার: রাজস্ব বৃদ্ধি, দেশীয় শিল্প বিকাশে অন্তরায় এনবিআর নীতি
Published: 14th, May 2025 GMT
দেশে কসমেটিকস ও স্কিন কেয়ার সামগ্রীর বার্ষিক বাজার প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকার। এর মধ্যে ফিনিশড গুডস হিসেবে আমদানীকৃত পণ্যের পরিমাণ প্রায় ৭০ শতাংশ। কিন্তু আমদানিকারকরা কসমেটিকস পণ্য ফিনিশড গুডস হিসেবে আমদানি করলেও নীতিমালার ফাঁক গলে শুধু মূল উপাদানের শুল্ক পরিশোধ করছেন। তাছাড়া, দেশীয় উৎপাদনের কাঁচামালের ৯০ ভাগই আমদানীকৃত। দেশীয় প্রসাধনীর বাজার জনপ্রিয় করতে নানা উদ্যোগ নেওয়া হলেও সম্পূরক ভ্যাট, অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ এ খাতের বিকাশে অন্যতম বাধা।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এর পেছনে দায়ী খোদ জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। সরকারের রাজস্ব বিবেচনা করে নেওয়া নীতিমালা অজ্ঞাত কারণে পরিবর্তন করা হয় বলেও তারা জানান।
২০১৭ সালে এ বিষয়ে জারি করা এক আদেশে বলা হয়েছে, প্যাকিং ম্যাটেরিয়ালস বা প্যাকিং কনটেইনার একটি ডিউটি ফ্যাক্টর হিসেবে পরিগণিত হবে। অদৃশ্য কারণে ঠিক তার পরের বছর ২০১৮ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি এনবিআরের শুল্ক নীতি ও আইসিটি বিষয়ক সদস্য মো.
স্থগিতাদের সুযোগ নিয়ে আমদানীকারকরা কাজল, লিপস্টিক, লিপজেল বা আইলাইনারের মতো প্রসাধনী পণ্যের ক্ষেত্রে আমদানিকারকরা শুধু ভেতরের লিকুইড অনুযায়ী শুল্ক পরিশোধ করছেন। এ ক্ষেত্রে ১৫৭ শতাংশ হারে শুল্ক পরিশোধের পরও সেটা অনেক কমই থাকছে।
এদিকে, দেশের বাজারে বিদেশি প্রসাধনীর উচ্চ দাম। এতে স্থানীয় উৎপাদনকারীরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। অসম এই প্রতিযোগিতায় ঝুঁকিতে স্থানীয় বিনিয়োগ। এমন পরিস্থিতিতে যথাযথ পদক্ষেপ না নেওয়া হলে দেশীয় সম্ভাবনাময় এই শিল্প মুখ থুবড়ে পড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। বর্তমানে স্থানীয় উৎপাদন পর্যায়ে মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক আরোপযোগ্য পণ্যের তালিকায় রয়েছে ওষ্ঠাধার প্রসাধন, চক্ষু প্রসাধন, হাত, নখ বা পায়ের প্রসাধন, পাউডার, সুগন্ধিযুক্ত বাথ সল্ট এবং অন্যান্য গোসল সামগ্রী।
এই খাত সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, কসমেটিকস ও স্কিন কেয়ার পণ্যের কাঁচামাল আমদানির শুল্ক কমালে দেশীয় বাজার আরো সম্প্রসারিত হবে। কারণ এসব কাঁচামালের প্রায় ৯০ শতাংশই উচ্চমূল্যে আমদানি করতে হয়। মিথ্যা ঘোষণায় আমদানি, লাগেজ পার্টি, চোরাইপথে পণ্য এবং নকল ও ভেজাল উৎপাদন বন্ধ করতে না পারলে স্থানীয় উৎপাদন ব্যাহত হয়ে ফের আমদানি নির্ভর হয়ে পড়বে এই খাত।
খাত সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের কোনো মহলের ভূমিকা রহস্যজনক এবং দেশীয় শিল্পবিরোধী। ফলে স্থানীয় বিনিয়োগ অসম প্রতিযোগিতা ও ঝুঁকির মুখোমুখি। তাদের মতে, কোনো কোনো মহলের শিল্পায়নবিরোধী মনোভাব তাদের পিছিয়ে দিচ্ছে। সরকার যেখানে রাজস্ব বাড়াতে নানা উপায় খুঁজছে সেখানে এমন একটি দৃশ্যমান খাত থেকে কাদের ইশারায় হাজার কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে বিষয়টি তদন্তের প্রয়োজন।
কাস্টমস ক্লিয়ারেন্সের সাম্প্রতিক তথ্যে দেখা গেছে, কানাত এন্টারপ্রাইজ নামের একটি প্রতিষ্ঠান ফ্লোরমার ব্র্যান্ডের কসমেটিকস আমদানি করেছে। প্রতিষ্ঠানটি একটি আইলাইনার আমদানিতে ওজন ঘোষণা দিয়েছে মাত্র ৪ দশমিক ৮০ গ্রাম। ঘোষিত ওজনের পরিপ্রেক্ষিতে সব ধরনের শুল্ক ও পরিবহন ব্যয়সহ পণ্যের আমদানি খরচ পড়েছে ৪ টাকা ৩১ পয়সা। যদিও পণ্যটির মোড়ক, কন্টেইনারসহ প্রকৃত ওজন প্রায় ১০ গ্রাম। এ ক্ষেত্রে ৫ দশমিক ২ গ্রাম ওজন ফাঁকি দিয়ে পণ্যটি বাজারে বিক্রি করছে ৯৪০ টাকা।
অন্যদিকে, স্থানীয় উৎপাদকদের একই হারে ব্যয় করে কাঁচামাল আমদানি করে পণ্য উৎপাদন করছেন। এ ক্ষেত্রে ১০ ভাগ শুল্ক ও ১৫ভাগ ভ্যাট পরিশোধ করতে হচ্ছে। ফলে আমদানি পণ্যের তুলনায় স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত পণ্যের ব্যয় বাড়ছে। এতে দেশীয় উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো অসম প্রতিযোগিতায় পড়েছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, শুধু কালার কসমেটিকস খাতে চলতি বছরে আমদানি প্রায় ৫০০ কোটি টাকার। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বেশিরভাগ প্রসাধনী আমদানিকারক আন্ডার ইনভয়েস এবং ওজনে ফাঁকি দিয়ে পণ্য আমদানি করেন। তাই প্রকৃতপক্ষে তা টাকার অঙ্কে হওয়ার কথা ন্যূনতম ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। সে হিসেবে শুধু আমদানিতেই ফাঁকি হচ্ছে প্রায় ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা। তবে শুল্ক ফাঁকি দিলেও দেশের বাজারে বিদেশি কোনো প্রসাধনীর দাম ৫০০ টাকার নিচে নেই। যেমন কমপক্ষে ১০ থেকে ১২ গ্রাম ওজনের তুরস্কের একটি আইলাইনার আমদানিতে প্রতি পিস নীট ওজন ঘোষণা দেওয়া হয়েছে ০.০০১২০ গ্রাম। যার শুল্ক, ইন্স্যুরেন্স, ল্যান্ডিং, পরিবহনসহ মোট ব্যয় ৩ থেকে সাড়ে ৪ টাকা। অথচ এই আইলাইনার দেশের বাজারে বিক্রি হচ্ছে প্রায় সাড়ে ৫০০ টাকায়। কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে সরকারের অগ্রাধিকার নীতির পরিপন্থি।
অ্যাসোসিয়েশন অব স্কিন কেয়ার অ্যান্ড বিউটি প্রোডাক্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স বাংলাদেশের (এএসবিএমইবি) জেনারেল সেক্রেটারি জামাল উদ্দীন বলেন, “এই খাতে লক্ষাধিক মানুষের কর্মসংস্থান রয়েছে। কিন্তু সরকারের নীতি সহায়তার অভাবে শিল্পের আকার ও ব্যাপকতা আটকে আছে। আমদানি বিকল্প দেশীয় শিল্পের বিকাশ ঘটলে বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হয়। তাছাড়া, কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি রপ্তানির মাধ্যমে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব।
তিনি বলেন, “বাজারে মানহীন ও ভেজাল পণ্যের ছড়াছড়ি। এসব ভেজাল পণ্য ব্যবহারে ক্রেতারা প্রতারিত হচ্ছেন, পড়ছেন স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে। তাই স্থানীয় উৎপাদনকে নীতি সহায়তা দিয়ে মানসম্মত পণ্য উৎপাদনের পথ সুগম করতে হবে। যদিও কসমেটিকস শিল্প খাতের গুরুত্ব অনুধাবন করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন এই শিল্পের নীতি প্রণয়নে চারটি সুপারিশ করেছে। কিন্তু অজানা কারণে সেসব সুপারিশ আমলে নেওয়া হচ্ছে না। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই খাতে গুরুত্ব দিয়ে নীতি সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। সেখানে দেশে সম্ভাবনাময় এই খাতটিতে উল্টো নীতি গ্রহণে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।”
এ প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক সৈয়দ আহসানুল আলম পারভেজ বলেন, “প্রায় ৩০০ কোটি ডলারের কসমেটিকস বাজারের শিল্পে বিদ্যমান সম্পূরক শুল্ক ও ভ্যাট স্থানীয় উদ্যোক্তাদের জন্য বৈষম্যের কারণ। এই শিল্পের বার্ষিক গড় প্রবৃদ্ধির হার সাড়ে ১২ শতাংশ। তাই দেশীয় শিল্পে বিনিয়োগ আকর্ষণে নীতি সহায়তা জরুরি।”
ঢাকা/হাসান/ইভা
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর র আমদ ন সহ য ত এই খ ত পর শ ধ সরক র উৎপ দ করছ ন
এছাড়াও পড়ুন:
জাম্বিয়ার ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদলের ওয়ালটন কারখানা পরিদর্শন
গাজীপুরের চন্দ্রায় দেশের শীর্ষ ইলেকট্রনিক্স, ইলেকট্রিক্যাল, হোম ও কিচেন অ্যাপ্লায়েন্স এবং প্রযুক্তিপণ্য উৎপাদন প্রতিষ্ঠান ওয়ালটনের কারখানা পরিদর্শন করেছেন জাম্বিয়ার উচ্চ পর্যায়ের ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদল।
মঙ্গলবার (১৩ মে) জাম্বিয়ান কমার্স, ট্রেড অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী সচিব ক্রুসিভিয়া সি. হিসিকুম্বা’র নেতৃত্বে ১২ সদস্যের ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদল ওয়ালটন কারখানা পরিদর্শনে আসেন। প্রতিনিধিদলের মধ্যে ছিলেন দিল্লিস্থ জাম্বিয়ান রাষ্ট্রদূত পার্সি প্যাটসন চান্দাসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সদস্যরা।
অতিথিরা কারখানায় পৌঁছানোর পর তাদেরকে স্বাগত জানান ওয়ালটন হাই-টেক ইন্ডাস্ট্রিজ পিএলসি হেডকোয়ার্টার্সের অ্যাডমিন বিভাগের প্রধান মেজর (অব.) জাহিদুল হাসান, ডেপুটি অব এ.এম.ডি নাজমুস সায়াদাত ও গ্লোবাল বিজনেস প্রতিনিধি আবু সালেহ মো. কায়সার প্রমুখ।
আরো পড়ুন:
ওয়ালটনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ফায়ার সেইফটি প্রশিক্ষণ
৯ মাসে ওয়ালটনের মুনাফা হয়েছে ৬৯৬.৪৪ কোটি টাকা
এরপর ফ্যাক্টরির কনফারেন্স রুমে অতিথিদের উদ্ধেশ্যে স্বাগত বক্তব্য দেন হেডকোয়ার্টার্সের অ্যাডমিন বিভাগের প্রধান মেজর (অব.) জাহিদুল হাসান।
পরে অতিথিরা ওয়ালটনের ভিডিও ডকুমেন্টারি উপভোগ করেন। পরবর্তীতে অতিথিরা ওয়ালটনের সুসজ্জিত প্রোডাক্ট ডিসপ্লে সেন্টারসহ ওয়ালটনের রেফ্রিজারেটর এবং মোল্ড অ্যান্ড ডাই ম্যানুফ্যাকচারিং প্ল্যান্টস ও কারখানার আউটসাইড এরিয়া পরিদর্শন করেন।
পরিদর্শন শেষে জাম্বিয়ান কমার্স, ট্রেড অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী সচিব ক্রুসিভিয়া বলেন, “ওয়ালটনের সুবিশাল অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ম্যানুফ্যাকচারিং প্লান্টস দেখে আমরা অভিভূত।আজকের এই ভিজিটের মাধ্যমে জাম্বিয়া ও বাংলাদেশ তথা ওয়ালটনের সাথে বাণিজ্য সম্প্রসারণের পারস্পরিক দ্বার উন্মোচন হলো। এটি শেষ নয় বরং নতুন সম্পর্ক ও বাণিজ্য সম্ভাবনা শুরু হলো।”
ওয়ালটন কারখানা পরিদর্শনের জন্য অতিথিদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানিয়ে সমাপনী বক্তব্য রাখেন ওয়ালটন হাই-টেক পিএলসির অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ ইউসুফ আলী।
ঢাকা/পলাশ/সাইফ