সময়ক্ষেপণের খেলায় মত্ত পুতিন, শান্তি কেবলই দূরে
Published: 21st, May 2025 GMT
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ অবসানে এ পর্যন্ত সব প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে এখন পর্যন্ত শুধু আশ্বাসের ওপরই রেখেছেন রাশিয়ান নেতা ভ্লাদিমির পুতিন। গত সোমবার ট্রাম্পের সঙ্গে ফোনালাপের পর পুতিন আবারও শান্তি ফেরাতে ইউক্রেনের সঙ্গে সমঝোতায় পৌঁছার আশ্বাস দেন। এই অবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে, পুতিন কি আসলেই যুদ্ধবিরতি চান? নাকি তিনি হামলা আরও দীর্ঘায়িত করার জন্য আলোচনায় বসার নামে শুধু সময়ক্ষেপণ করছেন। ওই ফোনালাপের পর মস্কো-কিয়েভ পাল্টাপাল্টি ড্রোন হামলাও হয়েছে।
সিএনএনের বিশ্লেষণে বলা হয়, একদিকে ট্রাম্প পুতিনের ওপর বিশ্বাস করতে চান, অন্যদিকে ট্রাম্পের পদক্ষেপ ভালো ফল বয়ে আনতে পারে বলে মনে করেন পুতিন। এভাবেই দুই নেতা পরিস্থিতি শুধু অনিশ্চয়তার দিকেই ঠেলে দিচ্ছেন। শান্তি কেবলই দূরে চলে যাচ্ছে।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য ছাড়াই ইউক্রেনকে ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা থেকে রক্ষা করার কথা বিবেচনা করছেন ইউরোপের নেতারা। এ ক্ষেত্রে ইউরোপীয় বিমানবাহিনী ব্যবহার করার বিষয়টি বিবেচনা করা হচ্ছে। ‘স্কাইশিল্ড’ নামের অভিযান পরিকল্পনাটি প্রথমবারের মতো ন্যাটো বিমান ও পাইলটদের ইউক্রেনের আকাশসীমায় প্রবেশ করাতে পারে, যা রাশিয়াকে বার্তা পাঠাবে যে, ইউরোপ ইউক্রেনের প্রতিরক্ষার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
গার্ডিয়ান বলছে, যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের দেশগুলো রাশিয়ার বিরুদ্ধে বড় ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপের চিন্তা করছে। পুতিন-ট্রাম্প ফোনালাপের পর পুতিনের কাছ থেকে কোনো ভালো কিছু আশা করছেন না তারা। এ জন্য রাশিয়ার সামরিক সরঞ্জাম, জ্বালানি রপ্তানি এবং তথ্য যুদ্ধকে সমর্থনকারী ও ইউক্রেনে আক্রমণের অর্থায়নে সহায়তাকারী আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে।
ইইউর পররাষ্ট্রনীতিপ্রধান কাজা ক্যালাস এক্স পোস্টে বলেছেন, ‘রাশিয়ার প্রায় ২০০টি জাহাজের ছায়া নৌবহরের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের অনুমোদন দিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। আরও নিষেধাজ্ঞার প্রক্রিয়া চলছে। রাশিয়া যত দীর্ঘ যুদ্ধ চালাবে, আমাদের প্রতিক্রিয়া তত কঠোর হবে।’
সোমবার পুতিনের সঙ্গে দুই ঘণ্টার বেশি আলাপ করেন ট্রাম্প। একই দিন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গেও তিনি কথা বলেন। হোয়াইট হাউস দাবি করেছে, পুতিনের সঙ্গে ট্রাম্পের স্পষ্ট আলাপ হয়েছে। পুতিন যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে পৌঁছাতে আলোচনায় বসতে রাজি হয়েছেন।
তবে জেলেনস্কি এই আলাপের পর খুশি হননি। গতকাল মঙ্গলবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক পোস্টে বলেন, রাশিয়া যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া ও দখলদারিত্ব ধরে রাখার জন্য ‘সময় কিনে নেওয়া’র চেষ্টা করছেন। তিনি রয়টার্সকে বলেন, যুদ্ধবিরতির চুক্তিতে স্পষ্ট ও বাস্তবসম্মত প্রস্তাব থাকতে হবে। জার্মান প্রতিরক্ষামন্ত্রী বরিস পিস্টোরিয়াস বলেন, পুতিন প্রকৃতপক্ষে ইউক্রেনে শান্তি ফেরাতে আগ্রহী নন। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনার নামে কেবলই সময় নিয়ে খেলছেন।
এর আগে ট্রাম্প ও ইউরোপীয় নেতারা ৩০ দিনের যুদ্ধবিরতির জন্য পুতিনের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছিলেন। তবে মস্কো তা প্রত্যাখ্যান করে জানায়, পুতিন চূড়ান্ত চুক্তির জন্য আলোচনায় জোর দিচ্ছেন। বিশ্লেষকদের মতে, পুতিন মাসের পর মাস সময় নিয়ে আলোচনা চালানোর কৌশল নিয়েছেন। যাতে হামলা আরও বাড়ানো যায়। তাঁর এই কৌশলের প্রধান শিকার নিরীহ মানুষ।
এদিকে ট্রাম্পের পদক্ষেপ কতটা ফলপ্রসূ হবে, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। কারণ, পুতিন যুদ্ধবিরতি বারবার প্রত্যাখ্যান করায় ট্রাম্প এই প্রচেষ্টা থেকে সরে আসারও হুমকি দিয়েছিলেন। এই অবস্থায় বিশ্লেষকরা বলছেন, ট্রাম্প গাজায় যখনই যুদ্ধবিরতির কথা তোলেন, তখনই ইসরায়েল হামলা বাড়িয়ে দেয়। ইউক্রেনেও একই ঘটনা ঘটতে পারে।
মার্কিন জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার সাবেক উপপরিচালক বেথ স্যানার মনে করেন, দুই ঘণ্টার ফোনালাপে শান্তিচুক্তির ব্যাপারে ট্রাম্প পুতিনকে সর্বোচ্চ অনুরোধ করেন। পুতিনের সহকারী ইউরি উশাকভ বলেন, দুই নেতা কেউই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দিতে চাননি।
ইউক্রেনের বিমানবাহিনী জানিয়েছে, ফোনালাপের পর রাশিয়া ১০৮টি শাহেদ ড্রোন দিয়ে হামলা চালায়। ৯৩টি ঠেকিয়ে দিয়েছে তারা। অন্যদিকে, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালকে রাশিয়ায় অবাঞ্ছিত ঘোষণা করায় সংস্থাটির সেক্রেটারি জেনারেল অ্যাগনেস কালামার মস্কোর কড়া সমালোচনা করেছেন।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ফ ন ল প র পর ইউক র ন র র জন য ইউর প র ওপর করছ ন
এছাড়াও পড়ুন:
লরা উলভার্ট: হিমালয়ের চূড়ায় এক নিঃসঙ্গ শেরপা
লরা উলভার্ট- দক্ষিণ আফ্রিকা নারী ক্রিকেট দলের অধিনায়ক। বয়স মাত্র ছাব্বিশ, কিন্তু মনের দৃঢ়তায় যেন পাহাড়। এবারের ২০২৫ নারীদের ওয়ানডে বিশ্বকাপে তিনি ছিলেন প্রোটিয়া আশার একমাত্র আলোকবর্তিকা। নিজের একক নৈপুণ্যে, এক অসম্ভব সাহসিকতায় দলকে টেনে তুলেছিলেন ফাইনালের মঞ্চে।
সেমিফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে খেলে ফেলেছিলেন ১৬৯ রানের অনবদ্য ইনিংস। যেন একক নাটকের একমাত্র নায়িকা তিনি। আর ফাইনালে ভারতের বিপক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন হিমালয়ের মতো দৃঢ় হয়ে। একপ্রান্ত আগলে রেখেছিলেন অনবদ্যভাবে। শতরান ছুঁয়ে যখন আকাশে ছুড়লেন ব্যাট, তখন মনে হচ্ছিল, স্বপ্নের ট্রফি যেন হাতের নাগালেই। কিন্তু ক্রিকেটের নির্মম বাস্তবতা! উলভার্ট যখন সাজঘরে ফিরলেন, ঠিক তখনই প্রোটিয়া শিবিরে নেমে এল নীরবতা। জয় হাতছাড়া হলো নিঃশ্বাস দূরত্বে।
আরো পড়ুন:
আরব আমিরাতকে ৪৯ রানে গুঁড়িয়ে ইতিহাস গড়ল যুক্তরাষ্ট্র
মিতালিকে ছাড়িয়ে ইতিহাস গড়লেন মান্ধানা
চোখের কোণে জলের কণা তখনও ঝলমল করছিল। সেটা ঘামের ছিল, নাকি অপূর্ণতার অশ্রু, তা কেউ জানে না। কিন্তু বোঝা যাচ্ছিল, হৃদয়ের গভীরে আগুন জ্বলছে। একটা স্বপ্নের দগ্ধ ছাই হয়ে যাওয়ার যন্ত্রণা।
তবুও এই ব্যর্থতার মাঝেই উলভার্টের জয় আছে। বিশ্বকাপে তিন ফাইনাল, টানা তিনবার! এবং প্রতিবারই দলের একমাত্র ভরসা ছিলেন তিনি। এবারের বিশ্বকাপে করেছেন ৯ ম্যাচে ৫৭১ রান, গড়ে ৭১.৩৭। যা নারীদের ওয়ানডে বিশ্বকাপ ইতিহাসে এক আসরে সর্বোচ্চ। এর আগে অ্যালিসা হিলির ৫০৯ রান ছিল শীর্ষে।
শুরুটা ছিল নিস্তরঙ্গ- প্রথম ম্যাচে মাত্র ৫, পরেরটিতে ১৪। কিন্তু ধীরে ধীরে আগুন জ্বলে উঠল তার ব্যাটে। ভারতের বিপক্ষে ৭০, শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে অপরাজিত ৬০, পাকিস্তানের বিপক্ষে ৯০, আর সেমিতে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ১৬৯। প্রতিটি ইনিংস যেন নিজের সীমাকে ছাপিয়ে যাওয়া একেকটি যাত্রা।
তবে উলভার্টের কীর্তি শুধু এই বিশ্বকাপেই নয়। ২০২৩ ও ২০২৪ দুই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেই ছিলেন সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক। প্রতিবারই দলকে তুলেছিলেন ফাইনালে। কিন্তু ভাগ্য যেন নিষ্ঠুরভাবে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে তার দিক থেকে। তিনটি ফাইনাল, তিনটি পরাজয়।
তবু লরার গল্পটা হারের নয়- এ এক অনমনীয়তার গল্প, এক নিঃসঙ্গ অভিযাত্রার গল্প। যেমন শেরপা অক্সিজেনহীন উচ্চতায় পৌঁছে দেয় অন্যদের। কিন্তু নিজে ফিরে আসে নীরবে, তেমনি উলভার্টও দলের স্বপ্নগুলো কাঁধে তুলে বয়ে নিয়েছেন, একা।
ফাইনাল শেষে ভারতীয় খেলোয়াড়রাও যখন এগিয়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরলেন, তখন বোঝা গেল; এই হার, এই অশ্রু, এই নীরবতা- সবই সম্মানের প্রতীক।
রবিবার ফাইনাল শেষে লরা বলেছেন অনেক কথা। সেখানে হাতাশার কিছু পাওয়া যায়নি। পাওয়া গেছে প্রেরণা ও সামনে এগিয়ে যাওয়ার সাহস।
“আমি মনে করি, ২০২৩ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের (নিউল্যান্ডসে অনুষ্ঠিত) পর থেকেই আমাদের জন্য অনেক পরিবর্তনের সূচনা হয়েছিল। সেই সময় থেকেই ঘরোয়া পর্যায়ে কেন্দ্রীয় চুক্তির ব্যবস্থা চালু হয়। আমাদের দলের গভীরতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে এটা ছিল এক বিশাল পদক্ষেপ।”
“এরপরের (২০২৪ সালের) বিশ্বকাপটা আমাদের দলের নামটা বিশ্ব ক্রিকেটে আরও বড় করে তুলেছে, আমার তাই মনে হয়। এখন আমরা এমন একটি দল, যারা নিয়মিত ফাইনালে পৌঁছাচ্ছে। যেখানে আগে এটা একবারের সাফল্য বলেই ধরা হতো।”
“টানা তিনবার ফাইনালে উঠতে পারাটা সত্যিই গর্বের বিষয়। এটা প্রমাণ করে আমরা ঘরোয়া ক্রিকেটে এবং দলীয় কাঠামোয় সঠিক দিকেই এগোচ্ছি। ধারাবাহিক পারফরম্যান্সের এই ফলেই আমরা এখানে পৌঁছেছি। আশা করি, আমরা এমন আরও ফাইনাল খেলতে থাকব… আর একদিন, হ্যাঁ, একদিন আমরা অবশ্যই একটা জিতব।”
টুর্নামেন্টের পারফরম্যান্স নিয়ে উলভার্ট বলেন, “আমার মনে হয়, আমাদের এই আসরটা অসাধারণ কেটেছে। ফাইনাল পর্যন্ত পৌঁছানোই একটা বড় সাফল্য। আমরা পুরো টুর্নামেন্ট জুড়ে দারুণ ক্রিকেট খেলেছি। এই বিষয়টা নিয়েই আমি সবচেয়ে বেশি গর্বিত।”
“একপর্যায়ে আমরা টানা পাঁচটা ম্যাচ জিতেছিলাম। যা আমাদের দলের জন্য অনেক বড় প্রাপ্তি। দুই দলের মধ্যকার সিরিজগুলোতে আমরা সবসময় এই ধারাবাহিকতা পাই না। তাই বড় মঞ্চে, বড় টুর্নামেন্টে এমন পারফরম্যান্স দিতে পারাটা সত্যিই গর্বের। আমরা প্রমাণ করেছি, বড় আসরে দক্ষিণ আফ্রিকাও এখন বড় দল।”
সত্যিই তাই। লরার নেতৃত্বে দক্ষিণ আফ্রিকা এখন বড় দল। হয়তো একদিন, কোনো এক প্রভাতে, লরা উলভার্ট সেই অধরা ট্রফিটা ছুঁয়ে দেখবেন। কিন্তু আজকের দিনে, তিনি রয়েছেন বিশ্বকাপের হিমালয়ের চূড়ায়, এক নিঃসঙ্গ শেরপা হয়ে। যিনি নিজের কীর্তিতে চূড়ায় উঠেছেন।
ঢাকা/আমিনুল