দেশ কাঁপানো নৃশংস জঙ্গি হামলার ৯ বছরেও সে দিনের ভয়াবহতা ভুলতে পারেননি কিশোরগঞ্জবাসী। ভয়ার্ত সেই দিনের কথা মনে পড়লে আজো শিউরে ওঠেন সবাই। স্বজন হারানোর দুঃসহ স্মৃতি তাড়িয়ে বেড়ায় শোলাকিয়ার মানুষদের। বাড়ি ঘরের দেয়ালগুলোতে এখনো যেন আবছা হয়ে ফুটে ওঠে গুলির চিহ্ন।

২০১৬ সালের ৭ জুলাই সকালের শুরুটা ভালো হলেও শেষটা মোটেই ভালো ছিল না। ঈদুল ফিতরের দিন সকাল পৌনে ৯টার দিকে শোলাকিয়া ঈদগাহে ছিল মানুষের ঢল। আজিমউদ্দিন হাইস্কুল সংলগ্ন রাস্তার মুফতি মুহাম্মদ আলী মসজিদের সামনে পুলিশের একটি নিরাপত্তা চৌকিতে অতর্কিত হামলা চালায় অস্ত্রধারী জঙ্গিরা। প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে জঙ্গিদের সঙ্গে চলে পুলিশের বন্দুকযুদ্ধ।

জঙ্গিরা গলাকেটে হত্যা করে পুলিশের দুই কনস্টেবল জহিরুল ইসলাম ও আনসারুল হককে। আহত হয় পুলিশের অন্তত আটজন সদস্য। পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে ঘটনাস্থলে নিহত হন আবির রহমান নামে এক জঙ্গি। জঙ্গিদের এলোপাতাড়ি গুলিতে নিজের ঘরে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান গৃহবধূ ঝর্ণা ভৌমিক। 

আরো পড়ুন:

গাজা যুদ্ধে প্রশ্নের মুখে বিবিসির সম্পাদকীয় নীতি

ঠাকুরগাঁওয়ে এনসিপির গাড়িবহরে হামলা

শোলাকিয়া জঙ্গি হামলা ঘটনার পর পুলিশ ও র‌্যাবের অভিযানে গুরুতর আহত অবস্থায় শফিউল ইসলাম ডন নামে এক জঙ্গি আটক হন। তানিম নামে স্থানীয় এক সন্দেহভাজন যুবককে আটক করা হয়।

এ ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলায় মোট ২৪ জনকে আসামি করা হয়। তাদের মধ্যে ১৯ জন জঙ্গি হামলা চালাতে গিয়ে ও পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে বিভিন্ন সময় মারা যায়। পরে জেএমবি সদস্য মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজান, আনোয়ার হোসেন, সোহেল মাহমুদ, রাজীব গান্ধী ও জাহিদুল হক তানিম নামে বাকি পাঁচজনকে মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি করা হয়। বর্তমানে ৫ জনের মধ্যে ৪ জন জামিনে মুক্তি পেয়েছেন, একজন কারাগারে আছেন।

মামলার সর্বশেষ তদন্ত কর্মকর্তা কিশোরগঞ্জ মডেল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আরিফুর রহমান ২০১৮ সালের ২৬ জুলাই আদালতে আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। দ্রুত স্বাক্ষ্য গ্রহণের মাধ্যমে আসামিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন কিশোরগঞ্জবাসী।

জঙ্গি হামলার দিনের ঘটনাস্থল সবুজবাগ গলির নাম এখন ‘ঝর্ণা রানী ভৌমিক সড়ক’। গলির ভেতরে বিভিন্ন বাসার দেয়ালে এখনো গুলির চিহ্ন রয়েছে। এগুলো মুছে যায়নি। আট বছরেও এলাকাবাসী ভুলতে পারেননি সেই দুঃসহ স্মৃতি। সেই ভৌমিক নিবাসে আজও শোকের আবহ। যে জানালাটা ভেদ করে গুলি ভেতরে গিয়ে ঝর্ণা রানী মারা যান, সেই জানালাটার পাশে টানানো হয় ঝর্ণার ছবি। তার স্বামী গৌরাঙ্গ গত বছরের ১৮ জুন মারা গেছেন।

ঝর্ণা-গৌরঙ্গ দম্পতির সন্তান শুভ দেব পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করছেন।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, এখনো সেদিনের কথা মনে হলে তারা আঁতকে ওঠেন। বিশেষ করে তখন যারা ছোট ছিল, তাদের মন থেকে এ ঘটনার স্মৃতি দূর হচ্ছে না কিছুতেই।

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের একজন মুফতি মুহাম্মদ আলী মসজিদের ইমাম দ্বীন ইসলাম। তিনি বলেন, ‍“সেদিনের ঘটনার কথা মনে পরলে আজও গা শিউরে ওঠে, হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যায়।” 

তিনি জানান, ওই দিন তিনি মসজিদেই ছিলেন। মসজিদের সামনে নিরাপত্তা চৌকিতে মুসল্লিদের তল্লাশি করছিল পুলিশ। এ সময় পুলিশের ওপরে আচমকা হামলা করে জঙ্গিরা। কি ভয়াবহ একটি দিন ছিল সেটি। চারিদিকে গুলি আর ভয়ার্ত মানুষের আত্মচিৎকার।

সবুজবাগ এলাকার বাসিন্দা ব্যবসায়ী হাফিজুর রহমান রেনু। যিনি পুরো বিষয়টি পাঁচতলার বাসা থেকে দেখেছেন। তিনি জানান, পুলিশের সঙ্গে জঙ্গিদের গোলাগুলির সময় কান ঝালাপালা অবস্থা। জঙ্গিরা ঢুকে পড়ে তার বাসার সামনে সবুজবাগ গলিতে। ভয়ে তার বাসার সবাই দরজা-জানালা বন্ধ করে মেঝেতে শুয়ে পড়েন। 

তিনি জানান, বাসার চারতলায় গিয়ে জানালার পাশে অবস্থান নেন তিনি। তখন এক হামলাকারী পুলিশকে লক্ষ্য করে হাতবোমা নিক্ষেপ করে। এ সময় একজন হামলাকারী হাতে থাকা চাপাতি ঘোরাতে ঘোরাতে পুলিশকে আক্রমণ করতে যায়। পুলিশ সদস্যরা গুলি করে চাপাতি হাতে থাকা জঙ্গিকে মাটিতে ফেলে দেন বলেও জানান তিনি।

এ ব্যাপারে জেলা পাবলিক প্রসিকিউটর জালাল উদ্দিন বলেন, “২০১৬ সালের ৭ জুলাই জঙ্গিরা শোলাকিয়ায় অর্তকিত হামলা করে। তারা তাদের অবস্থান জানান দিতেই মূলত হামলাটি করেছিল। এ ঘটনার পর সন্ত্রাস দমন আইনে একটি মামলা হয়। মামলাটি দীর্ঘ পরিক্রমায় চার্জশিট হয়।” 

তিনি বলেন, “বর্তমানে সন্ত্রাস দমন ট্রাইবুন্যাল-২ কিশোরগঞ্জে মামলাটি বিচারাধীন। ইতোমধ্যে ৭৮ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে। শেষ পর্যায়ে ম্যাজিষ্ট্রেট, ডাক্তার, মামলার আইও সাক্ষীগ্রহণ রয়েছে। চলতি বছর ১৭ আগস্ট মামলার পরবর্তী তারিখ ঘোষণা করা হয়েছে। আমরা আশা করছি, অতিদ্রুত এ মামলার সাক্ষ্যগ্রহণসহ বিচার কার্যক্রম শেষ হবে।”

ঢাকা/মাসুদ

.

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ক শ রগঞ জ র রহম ন মসজ দ ঘটন র অবস থ

এছাড়াও পড়ুন:

নির্বাচনে কোন দল কত শতাংশ ভোট পেতে পারে, তরুণেরা যা ভাবছেন

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কোন দল কত শতাংশ ভোট পেতে পারে, সে বিষয়ে তরুণদের ওপর পরিচালিত একটি জরিপের ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ১৫ থেকে ৩৫ বছর বয়সী দুই হাজার তরুণের (নারী ও পুরুষ) মতামত নেওয়া হয়েছে। এসব তরুণের মতে, এবার নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি ৩৮ দশমিক ৭৬ শতাংশ ভোট বিএনপি পাবে। এরপরে জামায়াতে ইসলামী ২১ দশমিক ৪৫ শতাংশ এবং জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ১৫ দশমিক ৮৪ শতাংশ ভোট পাবে। এ ছাড়া বর্তমানে কার্যক্রম নিষিদ্ধ এবং নিবন্ধন স্থগিত থাকা আওয়ামী লীগ যদি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ পায় তাহলে ১৫ দশিমক ৮৪ শতাংশ ভোট পাবে বলে ওই তরুণেরা মনে করেন। তাঁদের মতে, অন্যান্য ইসলামিক দল ৪ দশমিক ৫৯ শতাংশ ভোট পেতে পারে।

এই জরিপে অংশগ্রহণকারী তরুণদের ৭৬ দশমিক ৭৮ শতাংশ আগামী নির্বাচনে ভোট দেবেন বলে ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। এখনো সিদ্ধান্ত নেননি ৫ দশমিক ৯ শতাংশ, ভোট দেবেন না বলে জানিয়েছেন ৪ দশমিক ১৪ শতাংশ। আর ১৩ দশমিক ৯৮ শতাংশ এখনো ভোটার হননি।

সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) এবং একশনএইড বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগে চলতি বছরের ২০ মে থেকে ৩১ মে পর্যন্ত এ জরিপ পরিচালনা করা হয়। দেশের আটটি বিভাগের প্রতিটি থেকে দুটি জেলা এবং প্রতি জেলার দুটি করে উপজেলা থেকে তরুণদের বাছাই করা হয়। জরিপের এই ফলাফল নিয়ে সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, কেবল ১৫ থেকে ৩৫ বছর বয়সী তরুণদের দৃষ্টিভঙ্গি বোঝার জন্য এই জরিপ পরিচালনা করা হয়েছে। এখানে যে মতামত এসেছে, তা শুধু বাছাই করা ওই তরুণদের মতামত। এটাকে দেশের পুরো জনগোষ্ঠীর বা অন্যান্য বয়সের মানুষের মতামত হিসেবে বিবেচনা করা উচিত হবে না। বিশেষ করে রাজনীতির মতো সংবেদনশীল বিষয়গুলোতে তা কখনোই করা সংগত হবে না।

জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের পরবর্তী সময়ে কর্মসংস্থান, শিক্ষা ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে তরুণদের ভাবনা সম্পর্কিত এ জরিপটি আজ সোমবার প্রকাশ করা হয়। রাজধানীর মহাখালীর ব্র্যাক সেন্টার ইনে জরিপের ফলাফল তুলে ধরেন সানেমের গবেষণা সহযোগী সাফা তাসনিম। অনুষ্ঠানে তরুণদের বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিনিধিরা আলোচনায় অংশ নেন।

জরিপে জুলাই আন্দোলনের পর শিক্ষাগত প্রস্তুতি, কর্মসংস্থান, রাজনৈতিক সচেতনতা এবং ভবিষ্যৎ আশাবাদের বিভিন্ন দিক উঠে এসেছে। জরিপের তথ্যমতে, তরুণদের ৮৭ দশমিক ৪ শতাংশ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে রাজনীতির তথ্য পান।

জরিপের একটি প্রশ্ন ছিল বাংলাদেশের প্রচলিত রাজনৈতিক দলগুলোর চেয়ে তরুণ নেতৃত্বের দলগুলোর রাজনীতিতে কোনো ইতিবাচক পরিবর্তনের আশা করেন কি না। এতে ৪২ শতাংশের বেশি তরুণ আশাবাদী বলে জানান। এ ছাড়া এই তরুণদের দলগুলো তরুণদের চাহিদা ও প্রয়োজনকে উপস্থাপন করতে পারছে কি না, সে প্রশ্নের জবাবে জরিপে দেখা যায়, নিশ্চিত নন ৪০ দশমিক ২৪ শতাংশ তরুণ এবং ৩০ শতাংশের বেশি তরুণ বলেছেন, এ দলগুলো তরুণদের চাহিদা ও প্রয়োজন কিছুটা উপস্থাপন করতে পারছে।

রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে ৬০ শতাংশ তরুণ পৃষ্ঠপোষকতা, স্বজনপ্রীতি ও রাজনৈতিক সহিংসতার অবসান বিষয়ক সংস্কার চান। তরুণদের প্রায় ৫১ দশমিক ৭৭ শতাংশ মনে করেন, ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য সহায়ক। আর সহায়ক নয় বলে মনে করেন ৪৮.২৩ শতাংশ তরুণ। ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর ক্রমবর্ধমান উত্থান নিয়ে উদ্বিগ্ন বলে জানিয়েছেন ৩৮ দশমিক ৩ শতাংশ তরুণ। একেবারে উদ্বিগ্ন নন বলে জানিয়েছেন ১১ দশমিক ৪ শতাংশ। আর ৩০ শতাংশ বলেছেন কখনো কখনো উদ্বিগ্ন বা এ বিষয়ে মতামত নেই।

কত সময়ের মধ্যে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল বাংলাদেশের ক্ষমতায় আসবে—এর উত্তরে ৩৯ শতাংশের বেশি বলেছেন, তাঁরা জানেন না এবং সাড়ে ২২ শতাংশ বলেছেন, কখনোই না। অন্যদিকে ১১ শতাংশের বেশি বলেছেন, পাঁচ বছরের মধ্যে ক্ষমতায় আসবে।

জরিপের ফলাফল প্রকাশ অনুষ্ঠানে একশনএইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবির বলেন, রাজনীতিতে যেসব তরুণ আসেন তাঁরা সুযোগ–সুবিধা পাওয়ার আশায় নাকি সত্যিকারের পরিবর্তন বা আদর্শ নিয়ে আসেন, তার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে। তিনি আরও বলেন, গণ–অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব সব সময় তরুণেরাই দিয়েছেন, কিন্তু নীতিনির্ধারণে গিয়ে আর এই তরুণেরা থাকেন না।

অনুষ্ঠানে সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, সবকিছু মিলিয়ে যে নতুন বাংলাদেশের কথা চিন্তা করা হচ্ছে সেখানে এই সময়টুকুকে কতটা কাজে লাগানো যাচ্ছে তা দেখতে হবে। পরিবর্তনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অংশীজনেরা যদি সুযোগের সদ্ব্যবহার না করে তাহলে বড় কোনো পরিবর্তন হবে না। জুলাই অভ্যুত্থানের আশা বাস্তবায়িত হবে না।

অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের যুগ্ম সচিব মুহাম্মদ মুনীরুজ্জামান ভূঁঞা এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ কুদ্দুছ আলী সরকার।

সম্পর্কিত নিবন্ধ