মহাখালীর হোটেলের ঘটনা এবং বিএনপির প্রতি বার্তা
Published: 7th, July 2025 GMT
রাজধানীর মহাখালীতে হোটেল জাকারিয়াতে অতি সম্প্রতি যে ঘটনা ঘটে গেছে, এটি নিয়ে বিস্তর বিশ্লেষণ করার দরকার আছে। জাকারিয়া হোটেল একটি পুরোনো হোটেল ও দীর্ঘদিন ধরে তারা নিজেদের ব্যবসা সেখানে করে যাচ্ছে। এর আগে কখনো এমন ঘটনা ঘটতে দেখা যায়নি।
বনানী থানার যুবদলের আহ্বায়ক মনির হোসেন তাঁর দলবল নিয়ে যে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করলেন! ভিডিওগুলো এরই মধ্যে পুরো দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, হোটেলে ভাঙচুর করা হচ্ছে, হোটেলের কর্মচারীদের ওপর আঘাত করা হচ্ছে। সেখানে কয়েকজন নারীও চরমভাবে আক্রান্ত হলেন। একটা নারকীয় পরিস্থিতি!
ঘটনাটা যে কারণেই ঘটে থাকুক, বিষয়টা হচ্ছে এটি ঘটেছে এবং দেশের মানুষ এ ঘটনার ভিডিও দেখেছে। এর ফলে আমরা কী দেখতে পেলাম?
যুবদলের ওই আহ্বায়ককে বহিষ্কার করা হয়েছে। কিন্তু বহিষ্কারই কি সবকিছু? আমরা তো অতীতের এমন অনেক ঘটনার কথা জানি, যাদের বহিষ্কার করা হয়েছে, তারা আবার স্বপদে ফিরে এসেছে। এখন কিছু যে এ ক্ষেত্রে ঘটবে না, এর কি কোনো নিশ্চয়তা আছে? তা ছাড়া ধারণা করি, বনানীসহ ঢাকার বেশির ভাগ মানুষই মনির হোসেনের নাম হয়তো জানত না। তারা জানত না, বনানীর যুবদলের আহ্বায়ক আসলে কে।
এ ঘটনা যে মনির হোসেনের নাম পুরো দেশে আরও বেশি করে ছড়িয়ে দিতে সাহায্য করেছে, সেটা বলাই যায়। এখন আমরা অনেকেই তাঁর নাম জানি। ভবিষ্যতে ফিরে এসে তিনি যে আরও ভয়ংকর কোনো ঘটনা ঘটাবেন না, এর কোনো নিশ্চয়তা কি আছে?
এটি সত্য যে বিএনপির মূল নেতৃত্ব এসব ঘটনার ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নিচ্ছেন। ওই আহ্বায়ককে বহিষ্কার করেছে। কিন্তু এটিও সত্য, ছাত্রলীগ, যুবলীগ ঠিক যে কায়দায় জবরদখল করত, সন্ত্রাসী, লুটপাট, টেন্ডারবাজি করত; এর কিছু নমুনা আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি। খোদ ঢাকাতেই যদি এমন ঘটনা ঘটে থাকে, তাহলে স্থানীয় পর্যায়ে যে এমন ঘটনা নিয়মিত ঘটছে না, সেটা নিশ্চয় জোর দিয়ে বলা যাবে না।
বিএনপি কি আদৌ তাদের পুরো দলকে এক সুতোয় বাঁধতে পেরেছে? মূল নেতৃত্ব যা বলছে, স্থানীয় পর্যায়ে কি এর কোনো প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে? সেটি যদি না হয়, তাহলে কিন্তু জনমনে একটা শঙ্কার জন্ম দেবে। মানুষ ভাবতে শুরু করবে, কোথাও কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না কিংবা হবে না। সোজা বাংলায় যাকে বলে, ‘যেই লাউ, সেই কদু!’বিএনপি কি আদৌ তাদের পুরো দলকে এক সুতোয় বাঁধতে পেরেছে? মূল নেতৃত্ব যা বলছে, স্থানীয় পর্যায়ে কি এর কোনো প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে? সেটি যদি না হয়, তাহলে কিন্তু জনমনে একটা শঙ্কার জন্ম দেবে। মানুষ ভাবতে শুরু করবে, কোথাও কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না কিংবা হবে না। সোজা বাংলায় যাকে বলে, ‘যেই লাউ, সেই কদু!’
এই যে মহাখালীতে একটা ঘটনা ঘটেছে। অপরাধীদের কি গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা হয়েছে? বহিষ্কার করে বিএনপি আপাতত তার দায়িত্ব সেরেছে। কিন্তু মনির হোসেন তার দলবল নিয়ে যার করেছেন তা তো ফৌজদারি অপরাধ। সরকার এ ধরনের অপরাধীর বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নিচ্ছে সেটা এক বড় প্রশ্ন। সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাজ তো অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা। তাহলে তারা কেন করতে পারছে না?
কারণ আমরা সবাই হয়তো ব্যাপারটা জানি। বিগত ১১ মাসে জায়গায় জায়গায় মব-সন্ত্রাস যেমন আমরা দেখেছি, তেমনি দেখেছি অপরাধীদের থানা থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে, এমনকি গলায় ফুলের মালা পরানো হয়েছে। হয়তো প্রেক্ষাপট ভিন্ন ছিল। দলও ভিন্ন ছিল। কিন্তু এসব তো ঘটেছে।
এটি তো পরিষ্কার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিজেদের মতো করে কাজ করতে পারছে না। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোকেই বরং এগিয়ে আসতে হবে। মনির হোসেনকে শুধু দল থেকে বহিষ্কার নয়, তাকে যেন আইনের আওতায় আনা হয় সেই উদ্যোগ নিয়ে বিএনপি নজির স্থাপন করতে পারত। দেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বিএনপি সব চেয়ে বড় দল। তাদের প্রতি মানুষের যেমন প্রত্যাশা আছে, দল হিসেবে বিএনপিকেও সেই আস্থাটুকু অর্জন করতে হবে।
মনে রাখতে হবে, সামনে যখনই নির্বাচন হোক। সেই নির্বাচন যদি সুষ্ঠু হয়, মানুষ কিন্তু ভোট দিতে গিয়ে সবকিছু বিচার-বিবেচনা করবে। বিএনপির মূল নেতৃত্বের উচিত হবে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোকে ‘বিচ্ছিন্ন’ ঘটনা হিসেবে বিবেচনা না করে ঘটনাগুলোর পুনরাবৃত্তি যাতে না ঘটে, সেদিকে খেয়াল রাখা।
মানুষ হয়তো বিএনপিকে এবার সুযোগ দিতে পারে। কিন্তু দল হিসেবে বিএনপি কি সে সুযোগ নিতে আদৌ প্রস্তুত?
একটা আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে। জুলাই-আগস্টের সংগ্রাম শুরু হয়েছিল কোটাবিরোধী আন্দোলন দিয়ে আর শেষ হয়েছে বৈষম্যহীন সমাজের স্বপ্ন নিয়ে। সেই বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণের জন্য দল হিসেবে বিএনপি কতটুকু প্রস্তুত?
আগের দলটার মতো বিএনপিও যদি একই রকম আচরণ করতে থাকে, তাহলে মানুষ কিন্তু নিজেদের বিকল্প খুঁজে নেবে। যুগে যুগে সেটাই হয়েছে। তাই বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে মূল নেতৃত্বকে এখনই দেশের সব পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের এক ছাতায় আনতে হবে। কেউ যদি কোনো অপরাধ করে সঙ্গে সঙ্গে অ্যাকশন নিতে হবে এবং সেই অপরাধী যেন আর কোনো দিন এই দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে না পারে।
বৈষম্যহীন সমাজ যদি সত্যিই প্রতিষ্ঠা করতে হয় আর বিএনপিকে যদি এ দেশের জনগণ সুযোগ দেয় রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য। দেশের সব মত-পথের মানুষকে নিয়ে রাজনীতি করতে হবে। যেটা বিএনপির ৩১ দফার প্রথম দফা। দেশটা যেন শুধু বিএনপির নয়, সবার হয়। দেশের শেষ মানুষটাও যেন ভাবতে শিখে, বিপদে রাষ্ট্রই তার দেখভাল করবে।
আমিনুল ইসলাম প্রভাষক, এস্তোনিয়ান এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ ইউনিভার্সিটি
[email protected]
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: মন র হ স ন ব এনপ র পর য য় র জন ত অপর ধ
এছাড়াও পড়ুন:
সাংবাদিক এহসান মাহমুদের প্রতি অসম্মানজনক আচরণের প্রতিবাদ ৩২ নাগরিকের
জুলাই গণ–অভ্যুত্থান স্মরণে ১ জুলাই ঢাকায় বিএনপির অনুষ্ঠানে সাংবাদিক ও লেখক এহসান মাহমুদ যে আচরণের শিকার হয়েছেন, সেটিকে ‘অসম্মান ও অসদাচরণ’ আখ্যায়িত করে দেশের ৩২ জন নাগরিক বলেছেন, এহসান মাহমুদের প্রতি যে আচরণ করা হয়েছে, তা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, মুক্তচিন্তা এবং স্বাধীন মতপ্রকাশ ও সাংবাদিকতার ওপরই একধরনের আক্রমণ। এই আচরণের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন তাঁরা।
সোমবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে ৩২ নাগরিক এসব কথা বলেছেন। বিবৃতিতে স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে আছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান ও সামিনা লুৎফা, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আ-আল মামুন ও ইফতিখারুল আলম, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আর রাজী, মোশরেকা অদিতি হক ও সায়মা আলম, লেখক রাখাল রাহা, সালাহ উদ্দিন শুভ্র ও জিয়া হাশান, কবি হাসান রোবায়েত, মোহাম্মদ রোমেল, মৃদুল মাহবুব, রাজু আলাউদ্দিন ও কাজল শাহনেওয়াজ, সংস্কৃতিকর্মী অমল আকাশ, প্রকাশক মোহাম্মদ নাজিমউদ্দিন ও সাঈদ বারী, সাংবাদিক দেলোয়ার হাসান ও ইসমাঈল হোসেন এবং অ্যাকটিভিস্ট সাইয়েদ আব্দুল্লাহ।
বিবৃতিতে বলা হয়, ‘জুলাই অভ্যুত্থানে এহসান মাহমুদসহ অনেক লেখক, শিল্পী, অ্যাকটিভিস্ট জান বাজি রেখে রাজপথে দাঁড়িয়েছেন, দমন-পীড়নের মুখে থেকেও আপস করেননি। দীর্ঘ এই লড়াইয়ে তাঁদের ব্যক্তিজীবন যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, পেশাগত জীবন ঝুঁকির মুখে পড়েছে। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের কোপানলে পড়ে এহসান মাহমুদ বারবার চাকরি হারালেও অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেননি।’
বিবৃতিতে বলা হয়, ‘মহান জুলাই অভ্যুত্থানের স্মরণে ১ জুলাই রাজধানীতে একটি রাজনৈতিক দল আয়োজিত অনুষ্ঠানে অসম্মান ও অসদাচরণের শিকার হয়েছেন সাংবাদিক এহসান মাহমুদ। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ফ্যাসিবাদবিরোধী দীর্ঘ আন্দোলনে সোচ্চার থেকেছেন এবং সত্যের পক্ষে কলম ধরেছেন তিনি। তাঁর সঙ্গে এ ধরনের আচরণ আওয়ামী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে লড়াই চালানো লেখক, শিল্পী, গণতন্ত্রকামী নাগরিক ও সমমনাদের স্তম্ভিত করেছে। আমরা এর তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি। আমাদের বিশ্বাস, এই ঘটনা জুলাই অভ্যুত্থানকে বিতর্কিত করার বৃহত্তর রাজনৈতিক প্রয়াসের অংশ। সেই বিপ্লবের সাহসী যোদ্ধাদের ভাবমূর্তি নষ্ট করতে এবং ইতিহাসকে বিকৃত করতে এ ধরনের অপপ্রচার ও অসম্মানের আশ্রয় নেওয়া হচ্ছে।’
প্রকাশক সমিতির প্রতিবাদসাংবাদিক ও লেখক এহসান মাহমুদের সঙ্গে অসদাচরণের নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে বৈষম্যবিরোধী সৃজনশীল প্রকাশক সমিতি। এতে বলা হয়, তরুণ লেখক ও সাংবাদিক এহসান মাহমুদের সম্মানহানির জন্য সম্প্রতি একটি পরিকল্পিত ও হীন অপচেষ্টা চালানো হয়েছে। দেশের একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দলের জুলাই স্মরণে আয়োজিত উদ্বোধনী অনুষ্ঠান চলাকালে তাঁর সঙ্গে যে অসদাচরণ করা হয়েছে, তা ছিল উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, অপমানজনক এবং একজন মুক্তমনা সাংবাদিকের কণ্ঠরোধ করার ঘৃণ্য প্রয়াস। আমরা এই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ ও ঘোর নিন্দা জানাই। এহসান মাহমুদের প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করছি এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষায় সব বিবেকবান নাগরিককে এগিয়ে আসার আহ্বান জানাচ্ছি।
বৈষম্যবিরোধী সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির সভাপতি সাঈদ বারী ও সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হাসানের পাঠানো এই বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এহসান মাহমুদ দীর্ঘদিন ধরে লেখালেখি ও সাংবাদিকতার মাধ্যমে সত্য উচ্চারণ করে আসছেন। ফ্যাসিবাদবিরোধী অবস্থান নেওয়া ও খুনি হাসিনার সরকারের অন্যায়-নিপীড়নের বিরুদ্ধে তাঁর সরব ও সাহসী ভূমিকা সর্বজনবিদিত। এই কারণেই তাঁকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে, বারবার ভয়ভীতি ও হয়রানির মুখে পড়তে হয়েছে। কিন্তু কোনো অপচেষ্টা তাঁকে সত্যের পথ থেকে সরিয়ে রাখতে পারেনি। তিনি সমমনাদের সঙ্গে নিয়ে আন্দোলন চালিয়ে গেছেন।