হিজরি নতুন বর্ষ শুরু হলো এই কিছুদিন আগে। ইসলামে চারটি মাসকে পবিত্র হিসেবে গণ্য করা হয়, যার মধ্যে মহররম একটি। মহররম শব্দের অর্থ হচ্ছে পবিত্র, নিষিদ্ধ, সম্মানিত ইত্যাদি। সুপ্রাচীনকাল থেকে আরবরা এই মাসসহ বছরের আরও তিন মাসে সম্মান প্রদর্শনপূর্বক যুদ্ধবিগ্রহ থেকে বিরত থাকতেন।

অতীতের কল্যাণকর বিষয় হিসেবে ইসলামও এই রীতি বহাল রেখেছে। তাই মহররমকে সম্মানিত মাস হিসেবে গণ্য করা হয়। কালের বিবর্তনে এই মাসকে সম্মান প্রদর্শনের ক্ষেত্রে নানা বৈচিত্র্য, ঘটনা ও বিশ্বাসের মিশ্রণ ঘটেছে।

আইয়ামে জাহেলিয়াতের সময়ে মক্কার কুরাইশরা এই রোজা পালন করতেন বলে হজরত আয়েশা (রা.

) বর্ণনা করেছেন। সহিহ বুখারি, হাদিস: ২০০২

ইসলামের প্রথম যুগে ও ইসলাম–পূর্ব আমলে মহররমকে উদ্‌যাপন করা হতো মূলত রোজা পালনের মাধ্যমে। মহররম মাসের ১০ তারিখে রোজা রাখা ছিল সাধারণ প্রচলন, একে আশুরার রোজা বলা হতো। আইয়ামে জাহেলিয়াতের সময়ে মক্কার কুরাইশরা এই রোজা পালন করতেন বলে হজরত আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেছেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ২০০২)

পরবর্তীকালে মদিনায় হিজরতের পর দেখা গেল সেখানকার ইহুদিরাও মহররমের ১০ তারিখ সিয়াম পালন করেন। তাঁরা এই দিনে মিসরের অত্যাচারী বাদশাহ ফেরাউনের কবল থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন বলে দিনটিকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করতেন। তখন রাসুল (সা.) সাহাবায়ে কেরামকে এই রোজা পালন করতে নির্দেশ দেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ২০০৪)

এমনকি যত দিন রমজান মাসের রোজা ফরজ না হয়েছে, তত দিন এটি ফরজ রোজা হিসেবে পালিত হয়ে এসেছে। পরে এর আবশ্যিকতা বহাল না থাকলেও একটি ফজিলতপূর্ণ আমল হিসেবে এটি সব সময়ই মুসলমানদের কাছে গুরুত্ববহ ছিল।

আরও পড়ুনমহররমের গুরুত্ব, তাৎপর্য ও ইসলামি ঐতিহ্য৩০ অক্টোবর ২০১৪শিয়া মতবাদের আবির্ভাব

রাশেদুন খলিফাদের আমলেও মোটাদাগে মহররম উদ্‌যাপন ছিল আশুরার রোজাকেন্দ্রিক। উমাইয়া আমলে এই রীতিতে পরিবর্তনের সূচনা হয়, যার কেন্দ্রবিন্দু ছিল ৬১ হিজরিতে কারবালার প্রান্তরে হজরত হোসাইন (রা.)–এর শাহাদাত, ঘটনাক্রমে সেই দিনটি ছিল মহররমের ১০ তারিখ আশুরার দিন। ফলে মুসলমানদের স্বাভাবিক উদ্‌যাপনের পাশাপাশি এই মর্মান্তিক ঘটনা মহররমের একটি অনুষঙ্গে পরিণত হয়।

সাধারণ সব মুসলিমের কাছে ঘটনাটি শোকাবহ হলেও আলী (রা.)–এর এবং তাঁর পরিবার, বিশেষ করে হাসান, হোসাইন ও ফাতেমা (রা.)–এর প্রতি ভালোবাসা রাখেন, এমন গোষ্ঠীর কাছে মহররমের দিনে এই শোক হয়ে ওঠে প্রধান অনুষঙ্গ। তাদেরকে শিয়া নামে আখ্যায়িত করা হয়।

প্রথম যুগে মহররমের উদ্‌যাপনে বৈচিত্র্য

উমাইয়া ও আব্বাসি শাসনকালে শিয়ারা ছিলেন মোটাদাগে একটি বিদ্রোহী গোষ্ঠী। খ্রিষ্টীয় দশম শতকের শুরুর দিকে প্রতিষ্ঠিত ফাতিমি খেলাফতে মহররমের উদ্‌যাপনে শিয়া দৃষ্টিভঙ্গি প্রধান হয়ে দাঁড়ায়।

এর আগে মহররমের শিয়া ধারার উদ্‌যাপন অনেকটা গোপনে ব্যক্তিপর্যায়ে পরিচালিত হতো। প্রখ্যাত শিয়া আলেমগণ এ সময় হোসাইন (রা.)–এর জন্য শোকগাথা রচনা করতেন। যেমন শিয়া ইমাম জাফর সাদিক কারবালার শোকগাথা রচনা করেছেন, এর আবৃত্তিকারদের দাওয়াত করেছিলেন বলে জানা যায়। (মুহাম্মাদ রেজা ফখর রুহানিকৃত আশুরা শীর্ষক প্রবন্ধ)

উমাইয়া সেনাপতি হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ আশুরার দিনটিকে উৎসবের দিন হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। তারপরও উমাইয়া আমলে মহররমের উদ্‌যাপনে কারবালার শোক খুব কমই প্রভাব বিস্তার করেছিল।

আরও পড়ুনমহররম মাসের ৫ ইবাদত০৩ জুলাই ২০২৫আশুরার দিনে হোসাইন (রা.)–এর স্মরণে নারীরা বিক্ষিপ্ত চুল ও কালো মুখ নিয়ে বুক চাপড়াতে চাপড়াতে রাস্তায় বের হন। বাজারঘাট সেদিন বন্ধ থাকে।ইবনে জারির তাবারি, তারিখে তাবারি, ১১/৩৯৭

আব্বাসি খেলাফতের প্রথম দিকে শাসকদের প্রতি শিয়াদের সমর্থন ছিল। আহলে বাইতের প্রতি অত্যাচারকে উপজীব্য করেই উমাইয়াদের বিরুদ্ধে আব্বাসীয়রা বিদ্রোহের সূচনা করেছিল এবং এর ফলে উমাইয়াদের পতন ঘটে। (ইমাম মুহাম্মাদ আবু যাহরাকৃত ইমাম আবু হানিফা, হায়াতুহু ওয়া আসরুহু)

আব্বাসি খেলাফতের শুরুর দিকে প্রথমবারের মতো প্রকাশ্যে কারবালার শোক সভা অনুষ্ঠিত হয়। অল্পকালের মধ্যেই আব্বাসীয়রা ক্ষমতার প্রশ্নে আহলে বাইতের প্রতি অনুরক্ত গোষ্ঠীর সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়ে।

ইতিহাসে প্রথম রাষ্ট্রীয়ভাবে হোসাইন (রা.)–এর প্রতি শোক প্রকাশ করে, কারবালাকে স্মরণ করে আশুরার দিন উদ্‌যাপনের একটি বর্ণনা পাওয়া যায় তারিখে তাবারিতে, যা ৩৫২ হিজরির ঘটনা। ইবনে জারির তাবারি লেখেন, এই বছর আশুরার দিনে হোসাইন (রা.)–এর স্মরণে নারীরা বিক্ষিপ্ত চুল ও কালো মুখ নিয়ে বুক চাপড়াতে চাপড়াতে রাস্তায় বের হন। বাজারঘাট সেদিন বন্ধ থাকে। (তারিখে তাবারি, ১১/৩৯৭)

স্মরণীয় বিষয় হচ্ছে সে সময় আব্বাসি খেলাফত বাগদাদে ক্ষমতাসীন থাকলেও তা ছিল আদতে আল বুয়েইদ খেলাফতের অধীন, এ ছাড়া উত্তর আফ্রিকা ও মিসরের বড় অংশ ছিল ফাতিমিদের অধীন। এই দুটি রাজবংশই ছিল শিয়ামতাবলম্বী। তাই ধরে নেওয়া যায় হিজরি চতুর্থ শতকের মাঝামাঝি থেকে আশুরার উদ্‌যাপনে কারবালার স্মরণে প্রকাশ্যে শোক ও মাতমের ধারা শুরু হয়। তবে কয়েক বছরের মধ্যেই মুসলিম সমাজের প্রভাবশালী ধারার প্রবল বিরোধিতার মুখে এর উদ্‌যাপন বন্ধ হয়ে যায়। (Ali J. Hussain, The Evolution of Ritual Commemoration of the Battle of Karbala)

রাষ্ট্রীয়ভাবে কারবালাকেন্দ্রিক আশুরা উদ্‌যাপনের পরবর্তী ধারাটি শুরু হয় হিজরি দশম শতাব্দীর শেষে ইরানে সাফাভিদ রাজবংশের প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। এর প্রতিষ্ঠাতা প্রথম ইসমাইল ইরানকে শিয়া ইসনা আশারিয়া ধারায় পরিচালিত করেন।আশুরার অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্ব

রাষ্ট্রীয়ভাবে কারবালাকেন্দ্রিক আশুরা উদ্‌যাপনের পরবর্তী ধারাটি শুরু হয় হিজরি দশম শতাব্দীর শেষে ইরানে সাফাভিদ রাজবংশের প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। এর প্রতিষ্ঠাতা প্রথম ইসমাইল ইরানকে শিয়া ইসনা আশারিয়া ধারায় পরিচালিত করেন। অন্যান্য মুসলিম অঞ্চলের তুলনায় ইরানে এটি কম প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়েছিল। অদ্যাবধি ইরানে কারবালাকেন্দ্রিক আশুরা উদ্‌যাপন জারি আছে।

সাফাভিদ আমলেই আশুরা উদ্‌যাপন নানা অনুষঙ্গে বিচিত্র আকার ধারণ করে। কারবালার ঘটনা বর্ণনার জন্য মজলিসের আয়োজন করা হয়, যা মহররমের প্রথম ১০ দিন ধরে চলত। এই সময়ের একটি বিখ্যাত রচনা হচ্ছে রাওজাত আশ শুহাদা, যা আওড়িয়ে কারবালার ঘটনা স্মরণ করা হতো। তবে আবৃত্তিকারদের নিজস্ব কল্পনাপ্রসূত বর্ণনার কারণে এই রচনা পাঠ করা একসময় নিষিদ্ধ করা হয়।

আরও পড়ুনহিজরি নববর্ষ ও মহররম মাসের ইতিবৃত্ত২৯ জুলাই ২০২২

সাফাভিদ আমলেই কারবালার স্মরণে আরও নানা উপাদান যুক্ত করা হয়, যেমন শিকল দিয়ে নিজেকে আঘাত করা, তাজিয়া মিছিল করা, বুক চাপড়ানো, কারবালার ঘটনা অভিনয় করে দেখানো ইত্যাদি। এসব কর্মকাণ্ড কারবালার আদি উদ্‌যাপনগুলোতে পাওয়া যায় না, সেখানে শোক প্রকাশ ও মর্সিয়া গাওয়াটাই ছিল প্রধান। (Momen, M., 1985, An Introduction to Shi'i Islam.)

কারও মৃত্যুতে আরবের সাধারণ রীতি ছিল কবিতা আবৃত্তির মাধ্যমে তাঁদের স্মরণ করা। সাফাভিদের আমলে যা যা যুক্ত হয়েছে, ইয়াতজহাক নাকাশের মতে, এগুলোর মূল ছিল উত্তর ইরানের তুর্কিভাষী ককেশাস ও আজারবাইজান অঞ্চল থেকে উদ্ভূত। সাফাভিদ রাজবংশের সেনাবাহিনীর মূল ছিল যে কিজিলবাস গোষ্ঠী, তাদের মাধ্যমে শিয়া ধারায় শোক প্রকাশের এই ব্যাপারগুলো প্রবেশ করে।

সতের শতকের শেষের দিকে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হোসেনি দালান, তখন থেকেই শিয়াদের প্রধান কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত হয়। কারবালাকেন্দ্রিক আশুরা উদ্‌যাপনের সবচেয়ে বড় অনুষ্ঠান এখানেই হয়ে থাকে।বাংলায় মহররম সংস্কৃতি

বাংলা অঞ্চলে খ্রিষ্টীয় সপ্তদশ শতকের আগে কারবালাকেন্দ্রিক মহররম উদ্‌যাপনের প্রমাণ পাওয়া যায় না। মোগল আমলের আগে এই অঞ্চলে যতগুলো মুসলিম শাসন ছিলেন, তাঁরা সবাই সুন্নি মূলধারার ছিলেন। অনেক পর এই অঞ্চলে মোগল প্রশাসক এবং অভিজাত একটি শ্রেণির আগমনে শিয়া ধারার পৃষ্ঠপোষক ও অনুসারী তৈরি হয়।

সতের শতকের শেষের দিকে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হোসেনি দালান, তখন থেকেই শিয়াদের প্রধান কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত হয়। কারবালাকেন্দ্রিক আশুরা উদ্‌যাপনের সবচেয়ে বড় অনুষ্ঠান এখানেই হয়ে থাকে।

এ ছাড়া মুর্শিদাবাদের নবাব, নবাব সিরাজউদ্দৌলা, নবাব আলিবর্দী খানদের উদ্যোগে মহররম উদ্‌যাপিত হতো। ইরান থেকে আসা শিয়া দরবারি, সৈনিক ও ব্যবসায়ীগণ এই উদ্‌যাপনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতেন। ব্রিটিশ শাসনামল ও তারপর ঢাকা ও কলকাতায় এই উদ্‌যাপনের জনপ্রিয়তা বাড়ে।

স্বাধীনতা–পরবর্তীকালে পুরান ঢাকার তাজিয়া মিছিল একটি ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। শিয়ামতাবলম্বীদের ছাপিয়ে এর আবেদন ছড়িয়ে পড়েছে সাধারণ জনমানস, সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে। পুরান ঢাকাকেন্দ্রিক সাহিত্যকর্মগুলোতে, যেমন কবি শামসুর রাহমানের স্মৃতির শহর বইটিতে এই উদ্‌যাপনের বর্ণিল চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। হোসেনি দালানকেন্দ্রিক এই উদ্‌যাপনের ধারা এখনো বহাল।

লেখক: অনুবাদক, লেখক ও শিক্ষক

[email protected]

আরও পড়ুনহতাশা মানে কি ইমান দুর্বল হওয়া২৩ জুন ২০২৫

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: মহররম র অন ষ ঠ ন ক রব ল র র স মরণ পরবর ত কর ছ ল প রক শ হ স ইন শতক র করত ন র ঘটন ইসল ম প রথম

এছাড়াও পড়ুন:

মৌলভীবাজারে আশুরার দিনে গায়েবি মোকামে মাতম-বিলাপের জারি

কবে থেকে পবিত্র আশুরার দিনে মৌলভীবাজারে গায়েবি মোকাম ঘিরে মাতম-বিলাপ করা, জারি গাওয়া শুরু হয়েছিল, তার নির্দিষ্ট কোনো সাল-তারিখ কারও জানা নেই। পূর্বপুরুষেরা ওই দিনে গায়েবি মোকাম প্রাঙ্গণে এ রকম জারি করেছেন, মাতম করেছেন। ঐতিহ্য হিসেবে সেই ধারাবাহিকতা এখনো সীমিত পরিসরে হলেও টিকিয়ে রেখেছেন তাঁদের উত্তরাধিকার, স্থানীয় মানুষ। মহররমের ১০ তারিখ আশুরার দিন, যা অনেকের কাছে কতলের দিন নামে পরিচিত। সেই দিনে একদল তরুণ-প্রবীণ জারি গেয়ে দিনটিকে স্মরণ করেন, করুণ কাহিনি নিয়ে বিলাপ করেন।

মৌলভীবাজার সদর উপজেলার মোস্তফাপুর ইউনিয়নের গয়ঘরে খোজার মসজিদ এলাকায় রয়েছে এই গায়েবি মোকাম। আশুরার দিন বিকেলে আশপাশের বিভিন্ন গ্রাম থেকে অনেক নারী-পুরুষ এখানে সমবেত হন। তরুণ-প্রবীণ মিলে জারি গাইতে গাইতে বিলাপ করেন, শোক প্রকাশ করেন। ১০ মহররম সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে যুদ্ধ করতে গিয়ে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর দৌহিত্র হজরত ইমাম হোসেন (রা.) ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা কারবালার প্রান্তরে ফোরাত নদীর তীরে শহীদ হয়েছিলেন।

গতকাল রোববার বিকেলে ঝমঝমে বৃষ্টি নামে। আগে থেকেই আকাশ মেঘলা ছিল, এই মেঘ, এই রোদের কিছুটা খেলা ছিল। ওই সময় গয়ঘর খোজার মসজিদের কাছাকাছি গায়েবি মোকামের কাছে জারি গাওয়ার জন্য অনেকে সমবেত হতে শুরু করেছেন। অনেকে জারি শুনতে, অংশ নিতে নানা জায়গা থেকে আসছেন। এখানে আশুরার দিনে জারি গাওয়ার প্রচলন আছে শত বছরের। আগের সেই জমজমাট অবস্থা এখন আর নেই। তারপরও প্রচলিত ধারায় ছেদ পড়েনি। স্থানীয় অপেশাদার জারিশিল্পীরা তা এখনো টিকিয়ে রেখেছেন। বৃষ্টি থামতেই অনেকে ছুটে আসেন। ভিড় করেন গায়েবি মোকামের কাছে। সবাই মিলে গায়েবি মোকাম ঘিরে কয়েক চক্কর দিয়ে একটা সময় শুরু হয় জারি গাওয়া। কারবালার প্রান্তরের শহীদদের জন্য বুকের কান্না তাঁরা ঢেলে দেন জারির কথা ও সুরে। কারবালার কাহিনির নানা অংশ গাইতে গাইতে মাতম করেন। এ উপলক্ষে নানা পণ্যের কিছু দোকানও বসেছিল স্থানটিতে।

গয়ঘর গ্রামটি খোজার মসজিদের নামে অনেকের কাছে পরিচিত, প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের কারণে অনেকের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। পাঁচশত বছর আগের এই ‘গয়ঘর ঐতিহাসিক খোজার মসজিদ’। মসজিদটি নির্মাণ করা হয় সুলতান বরবক শাহের পুত্র সুলতান শামস উদ্দীন ইউছুফ শাহের আমলে। হাজী আমীরের পৌত্র ও মুসার পুত্র বিখ্যাত মন্ত্রী মজলিস আলম ৮৮১ হিজরিতে (১৪৭৬ খ্রিষ্টাব্দ) এই মসজিদ নির্মাণ করান। এই খোজার মসজিদের পূর্ব দিকেই একটি ছোট মোকাম আছে, যা স্থানীয় মানুষের কাছে গায়েবি মোকাম নামে পরিচিত। গায়েবি টাকায় মসজিদটি নির্মিত হয়েছিল বলে লোকমুখে গায়েবি মোকাম নামে এই মাজারের পরিচিতি আছে।

স্থানীয় জারিশিল্পী আছকর মিয়া জানান, মহররম মাসে গয়ঘরের গায়েবি মোকামের কাছে পূর্বপুরুষ থেকে জারি গাওয়া হয়ে আসছে। কবে, কখন থেকে এই জারি গাওয়া শুরু হয়েছে, কেউ বলতে পারেন না। তবে এখন আর আগের মতো জারির আয়োজন জমজমাট হয় না। আগে তাঁবু বসানো হতো, আশপাশের গ্রাম থেকে অনেক লোকজন আসতেন। লোকমুখে প্রচলিত আছে, স্থানীয় এক ব্যক্তির ঘরে গায়েবি টাকা ওঠে। ওই বাড়ির কেউ একজনকে স্বপ্নে মোকাম তৈরির জন্য বলা হয়। তখন মোকামের স্থানটিতে বিশাল একটি বটগাছ ছিল। সেই গাছ একসময় গোড়াসহ উপড়ে পড়ে। তারপর গায়েবিভাবে পাওয়া টাকা দিয়ে বটগাছের স্থানটিতে এই মোকাম তৈরি করা হয়েছে। কারও নামে এই মোকাম তৈরি হয়নি।

আছকর মিয়া বলেন, ‘জারি কারবালার কাহিনি। বিষাদ সিন্ধু থেকে জানছি। কারবালার ইতিহাস পড়ছি। জারিটা হলো বিলাপ। কারবালার কাহিনি বলতে গিয়ে লোকজন বিলাপ করছে, কাঁদছে। এটারে আমরা একটু জারি হিসেবে গাই। আমরা যত জারি গাই, তার অর্থ আছে। এই কাহিনি “বিষাদ–সিন্ধু”, “জমজমা”, “জঙ্গে কারবালা”তে পাওয়া যাবে।’

আরেক জারিশিল্পী কনর মিয়া বলেন, ‘আমরার জন্মের আগে থেকে ময়-মুরব্বিরা এখানে (গায়েবি মোকাম) জারি গাইছেন। এখন আমরা গাই। আমরা শুনছি এটা কারবালার ইতিহাস, সেই ইতিহাসটারে আমরা স্মরণ করি। ৫ মহররম থেকে শুরু হয়, ১০ মহররম কতলের দিনে (আশুরা) জমজমাট হয়। এরপরে কেউ যদি বলে, গাওয়া হয়। তবে আগে গাওয়া যেত, এখন গাওয়ার মানুষ নাই।’

রোববার বিকেলে যখন তরুণ ও প্রবীণরা মিলে জারি গাইছিলেন, মাতম করছিলেন। তখন পশ্চিমের আকাশে মেঘের কোলে লাল রং ছড়িয়ে দিয়েছিল বিদায়বেলার সূর্য। এ যেন কাজী নজরুল ইসলামের মহররম কবিতার মতো ‘কাঁদে কোন ক্রন্দসী কারবালা ফোরাতে/সে কাঁদনে আঁসু আনে সীমারেরও ছোরাতে!’ গায়েবি মোকামের প্রাঙ্গণ তখন একটুকরা ফোরাতের তীরই যেন হয়ে উঠেছিল। সবাই মিলে ফোরাত নদীর তীরে কারবালার মুহূর্তটিকে মনে করে প্রকৃতই কাতর হয়ে উঠেছিলেন। বুকের কান্নাকে তাঁরা জারির পঙ্‌ক্তি, তাল ও লয়ে প্রকাশ করতে থাকেন। তখন ধীরে ধীরে বিকেলটা সন্ধ্যার দিকে ঝুঁকছে, অন্ধকারের পর্দা নামছে চরাচরে। জারির আহাজারিতে সেই অন্ধকার আরও গাঢ় হয়ে উঠছে, আরও ইতিহাস–কাতর হয়ে উঠছে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • মৌলভীবাজারে আশুরার দিনে গায়েবি মোকামে মাতম-বিলাপের জারি
  • নতুন হিজরি বছরে জীবনের পরিকল্পনা সাজান সাত ধাপে
  • হোসনি দালান থেকে শোকাবহ তাজিয়া মিছিল শুরু
  • আশুরা উপলক্ষে পুরান ঢাকায় বের হয়েছে তাজিয়া মিছিল
  • আজ পবিত্র আশুরা
  • মহররম মাসের মর্যাদা ও করণীয়
  • হাওর অঞ্চলে মহররম-সংস্কৃতির নিজস্ব রূপান্তর
  • কারবালার ঘটনার সারসংক্ষেপ
  • ইমামবাড়াতে ভক্তদের মাতম