ইসরায়েলের বর্বর হামলায় বিধ্বস্ত গাজার দাতব্য সংস্থার একটি স্যুপ কিচেনের চারপাশে জড়ো হয়েছেন ফিলিস্তিনিরা। খালি পাত্র হাতে এক কাপ ডালের আশায় ভিড় ঠেলে এগিয়ে যান চার সন্তানের বাবা মাহমুদ আল-হাও। সন্তানের মুখে কিছুটা হলেও খাবার তুলে দিতে প্রতিদিন মাহমুদ জাবালিয়া শরণার্থী ক্যাম্পের ধ্বংসাবশেষের আশেপাশে ছুটে চলেন। ছয় ঘণ্টা পর্যন্ত অপেক্ষা করে কোনো কোনো দিন তার ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয় এবং ডালের স্যুপ খুঁজে পান। তবে মাঝেমধ্যে তাকে ফিরতে হয় খালি হাতে। সেই দিনগুলোয় তিনি সন্তানদের মুখের দিকে তাকাতে পারেন না। 

৩৯ বছর বয়সী মাহমুদ রয়টার্সকে বলেন, আমার একটি অসুস্থ মেয়ে আছে। আমি তাকে কিছু দিতে পারি না। রুটি নেই, কিছুই নেই। সকাল ৮টা থেকে ৬ ঘণ্টা ধরে এক বাটি ডালের জন্য এখানে দাঁড়িয়ে আছি। একজনের জন্য যথেষ্ট না হলেও ডালটুকু আমার ৬ জনের পরিবারকে খেতে হবে।

মাহমুদ এক বাটি ডাল নিয়ে ঘরে ঢুকলে তার ছেলেমেয়ে চুপচাপ এগিয়ে এসে খাওয়া শুরু করে। তিনি বলেন, ‘সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ, আজকে খাবার পেয়েছি। আপনি যে খাবার দেখতে পাচ্ছেন, এটি আমাদের সকালের নাস্তা, দুপুর ও রাতের খাবার। যদিও আগের দিন খাওয়ার জন্য কিছুই ছিল না। আমি চাই বিশ্বের সবাই অনুগ্রহ করে আমাদের পাশে দাঁড়ান। আমাদের শিশুরা ধীরে ধীরে মারা যাচ্ছে।’ 

রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত মার্চ মাসের শুরু থেকেই ইসরায়েল গাজায় চিকিৎসা, খাদ্য ও জ্বালানি সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা ২৪ লাখ ফিলিস্তিনির আবাসস্থল অবরুদ্ধ এই এলাকায় দুর্ভিক্ষের আশঙ্কার বিষয়ে সতর্ক করেছেন। 

আন্তর্জাতিক চাপ বৃদ্ধির পর সীমিত মানবিক সহায়তা বিতরণ পুনরায় শুরু করতে ইসরায়েল সম্মত হওয়ার পর সোমবার কিছু ট্রাক গাজায় প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। তবে জাতিসংঘ জানিয়েছে, ইসরায়েল অনুমতি না দেওয়ায় খাদ্যগুলো বিতরণ কেন্দ্রে নেওয়া যায়নি। এ কারণে বুধবার পর্যন্ত কোনও সাহায্য বিতরণ করা সম্ভব হয়নি। 

খাবারসহ মৌলিক উপকরণের তীব্র ঘাটতির সঙ্গে সঙ্গে গাজায় হামলা জোরদার করেছে দখলদার দেশটি। অঞ্চলটির চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, ইসরায়েলি হামলায় গত আট দিনে ৫০০ জনেরও বেশি ফিলিস্তিনির মৃত্যু হয়েছে। 

চিকিৎসা সূত্র আল জাজিরাকে জানিয়েছে, সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত গাজাজুড়ে ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় কমপক্ষে ৪২ ফিলিস্তিনির মৃত্যু হয়েছে। ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের মতে, গাজায় ইসরায়েলের হামলায় এখন পর্যন্ত ৫৩ হাজার ৫৭৩ জনেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। সূত্র: রয়টার্স ও আল-জাজিরা

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ইসর য় ল আম দ র ইসর য

এছাড়াও পড়ুন:

আইরিশ নাবিকের চোখে বাংলার হজযাত্রী

১৯৫৪ সালে আইরিশ নাবিক নরম্যান ফ্রিম্যানের লেখা ‘অ্যান আইরিশম্যানস ডায়েরি অন আ পিলগ্রিম শিপ টু জেদ্দা’ প্রবন্ধে বাংলার হজযাত্রীদের একটি প্রাণবন্ত বর্ণনা পাওয়া যায়। প্রবন্ধটি ‘আইরিশ টাইমস’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এতে ব্রিটিশ ইন্ডিয়া কোম্পানির জাহাজ সারধানাতে ফ্রিম্যানের অভিজ্ঞতার বিবরণ পাওয়া যায়। এই জাহাজে তিনি চাকরিরত অবস্থায় ১ হাজার ৫০০ হজযাত্রীকে জেদ্দা থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছে দেওয়ার একটি কন্ট্রাক্টে অংশ নেন।

১৯৫৪ সালের আগস্ট মাসে হজ অনুষ্ঠিত হয়। সে সময় বিমানযাত্রার বিস্তৃতির কারণে জাহাজে হজযাত্রী পরিবহন উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গিয়েছিল। তবে সারধানা জাহাজ এই কন্ট্রাক্টের মাধ্যমে জেদ্দা থেকে চট্টগ্রামে হজযাত্রী পরিবহনের দায়িত্ব পায়। এটি ফ্রিম্যান ও তাঁর ক্রুদের জন্য একটি অনন্য অভিজ্ঞতা ছিল, কারণ তাদের কোম্পানির অন্যান্য জাহাজ অতীতে হাজার হাজার হজযাত্রী পরিবহন করলেও এ ধরনের কাজ তখন বিরল হয়ে পড়েছিল।

হজযাত্রীদের দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রা এবং হজ পালনের ক্লান্তি, সৌদি আরবের প্রচণ্ড গরম আবহাওয়া ও ভিড়ের কারণে অনেকে দুর্বল বা অসুস্থ হতে পারেন—এই সম্ভাবনা বিবেচনা করে জাহাজে একজন ডাক্তার, তিনজন মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট এবং তিনজন নার্স নিয়োগ করা হয়। জাহাজের ভারতীয় ক্রুরা দরিদ্র হজযাত্রীদের জন্য লোয়ার ডেকে বাংক, দড়ির ঝুলন্ত বিছানা এবং কাঠের মেঝেতে ম্যাটের ব্যবস্থা করে। প্রস্তুতি সম্পন্ন করে খালি জাহাজটি করাচি থেকে জেদ্দার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে। পথে আপার ডেকে ইউরোপীয় ক্রুরা টেবিল টেনিস খেলে সময় কাটাত। তবে ভারত মহাসাগর থেকে আরব সাগরে প্রবেশের সময় জাহাজের রোলিং সামলাতে ক্যাপ্টেন ও ক্রুদের দক্ষতার প্রয়োজন হতো।

আরও পড়ুনবিরে শিফা: একটি অলৌকিক কুয়ার গল্প০৫ মে ২০২৫

জেদ্দা বন্দরে পৌঁছে ফ্রিম্যান ও তাঁর ক্রুরা এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের সম্মুখীন হন। সৌদি পুলিশ হজযাত্রীদের ইহরামের কাপড়ে খোলা আকাশের নিচে প্রচণ্ড গরমে গাদাগাদি করে রেখেছিল। অনেক হজযাত্রী দুর্বল, এমনকি কঙ্কালসার অবস্থায় ছিলেন। এই দৃশ্য ক্রুদের মনে গভীর বেদনার সৃষ্টি করে। গ্যাংওয়ে (জাহাজে ওঠার সিঁড়ি) নামানোর পর হজযাত্রীরা ধীরে ধীরে জাহাজে উঠতে শুরু করেন। শারীরিক দুর্বলতার কারণে অনেককে সাহায্য করতে হয়। সব হজযাত্রী জাহাজে উঠতে অনেক সময় লাগে। অবশেষে গ্যাংওয়ে উঠিয়ে দীর্ঘ হর্ন বাজিয়ে সাদা রঙের সারধানা জাহাজ চট্টগ্রামের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে।

জাহাজে একজন ইমাম ছিলেন, যিনি চমৎকার গলায় আজান দিতেন। প্রতিদিন নামাজের সময় তিনি জাহাজের পাবলিক অ্যাড্রেস সিস্টেমে আজান দিতেন এবং হজযাত্রীরা জাহাজের সামনের ডেকে জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজ আদায় করতেন। ডেকের কাঠের মেঝেতে নামাজের জন্য লাইন ধরে জায়নামাজ সাজানো থাকত।

অপুষ্টি ও ক্লান্তির কারণে অনেক হজযাত্রী অসুস্থ হয়ে পড়েন। জাহাজের মেডিকেল স্টাফ সাধ্যমতো তাঁদের সেবা দিলেও চারজন হজযাত্রী মারা যান। তবে ফ্রিম্যান উল্লেখ করেন, নিয়মিত জাহাজের তুলনায় এই সংখ্যা ছিল অনেক কম। আরব সাগর ও ভারত মহাসাগর পাড়ি দেওয়ার সময় ইমামের নেতৃত্বে জানাজা পড়ে মৃত হজযাত্রীদের ইহরামের কাপড়ে কাফন পরিয়ে, ক্যানভাসে মুড়ে এবং ভারী সিসা বেঁধে ভারত মহাসাগরে সমাধিস্থ করা হয়।

দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রার পর জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছায়। ক্লান্ত হজযাত্রীরা তাঁদের সামান্য মালপত্র নিয়ে ধীরে ধীরে জাহাজ থেকে নামেন। হজ পালনের কঠিন ও কষ্টকর পরিশ্রম তাঁদের ফ্রিম্যান এবং জাহাজের ক্রুদের কাছে এক অনন্য মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করে।

(সূত্র: পুণ্যপথের যাত্রীরা: হজ হজযাত্রী ও পথ,মুহাম্মদ সাঈদ হাসান শিকদার, প্রথমা প্রকাশন)

আরও পড়ুনবদর যুদ্ধক্ষেত্রে একটি দিন২০ জুলাই ২০২৩

সম্পর্কিত নিবন্ধ