ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে হজ বন্ধ বা সীমিত হওয়ার পেছনে রাজনৈতিক সংঘাত ও নিরাপত্তাহীনতা যেমন ছিল, তেমনি মহামারি ও প্রাকৃতিক দুর্যোগও অনেকাংশে দায়ী হয়েছে। প্রথম পর্বে আমরা রাজনৈতিক ও নিরাপত্তাগত কারণগুলো নিয়ে আলোচনা করেছি। এই দ্বিতীয় পর্বে আমরা অভাব ও বন্যার মতো মহামারি ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রভাব বিশ্লেষণ করব।

মহামারির প্রতিবন্ধকতা

মহামারি মানব ইতিহাসে বারবার ধর্মীয় ও সামাজিক কার্যক্রমকে ব্যাহত করেছে। হজে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লাখো মানুষের সমাগম ঘটায় তা মহামারির সময় বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। যেমন সাম্প্রতিক সময়ের কোভিড-১৯ মহামারি। ১৪৪১-১৪৪২ হিজরি (২০২০-২০২১ খ্রিষ্টাব্দ) সনে হজ অত্যন্ত সীমিত পরিসরে অনুষ্ঠিত হয়। সৌদি আরব সরকার হাজিদের সংখ্যা কয়েক হাজারে সীমাবদ্ধ করে, যা সাধারণত কয়েক মিলিয়ন হয়ে থাকে। এই সিদ্ধান্তের পেছনে ছিল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধের প্রয়োজন। সৌদি আরব সরকার মাস্ক পরা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা এবং স্বাস্থ্য পরীক্ষার মতো কঠোর ব্যবস্থা প্রয়োগ করে হাজিদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করলেও বিশ্বব্যাপী মুসলিমদের জন্য হজে অংশগ্রহণের সুযোগ সীমিত হয়ে পড়ে। এ ঘটনা ফিকহের দৃষ্টিকোণ থেকেও নতুন প্রশ্ন উত্থাপন করে। হানাফি ও মালিকি ফকিহরা ঐতিহাসিকভাবে ‘ইস্তিতাআত’ বা সামর্থ্যের শর্ত হিসেবে পথের নিরাপত্তার কথা উল্লেখ করেছেন।

আরও পড়ুনসাহাবিরা যেভাবে মহানবী (সা.

)-কে মানতেন২৯ এপ্রিল ২০২৫

প্রাকৃতিক দুর্যোগ: পানির অভাব

প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বিশেষ করে পানির অভাব, হজের ইতিহাসে বারবার বাধা সৃষ্টি করেছে। হজের জন্য হাজিদের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হতো, আরব উপদ্বীপের মরুভূমির মধ্য দিয়ে যাওয়া এই পথে পানির অভাব একটি মারাত্মক সমস্যা ছিল। ইমাম যাহাবি (মৃত্যু: ৭৪৮ হিজরি) তাঁর আল-ইবার গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে ৩৬৩ হিজরি (৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দ) সনে ইরাক থেকে আগত হাজিরা সুমাইরায় পৌঁছে দেখেন যে পথে পানি নেই। ফলে তাঁরা মদিনায় ফিরে যান এবং সে বছর তাঁরা হজ পালন করতে পারেননি।

আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেছিল ৪০৬ হিজরি (১০১৬ খ্রিষ্টাব্দ) সনে। ইবনে জাওজি (মৃত্যু: ৫৯৭ হিজরি) তাঁর আল-মুনতাজাম গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন যে এই বছর ২০ হাজার হাজির মধ্যে মাত্র ৬ হাজার জন বেঁচে ফিরতে পারেন। পানির অভাবে অনেকে পিপাসায় মারা যান, এমনকি কেউ কেউ উটের মূত্র পান করতে বাধ্য হন।

আব্বাসি খলিফা মাহদির (মৃত্যু: ১৬৯ হিজরি) একটি ঘটনাও এখানে উল্লেখযোগ্য। ইবনে সা’দ (মৃত্যু: ২৩০ হিজরি) তাঁর আত-তাবাকাত আল-কুবরা গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন যে ১৬৮ হিজরি সনে খলিফা মাহদি হজে যাওয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হন। কিন্তু পথে পানির অভাব দেখে তিনি তাঁর সঙ্গীদের জন্য পিপাসার আশঙ্কা করেন এবং ফিরে আসেন।

আরও পড়ুনকীভাবে মহানবী (সা.)-কে ভালোবাসব২৭ এপ্রিল ২০২৫

বন্যা ও অন্যান্য

পানির অভাবের পাশাপাশি বন্যাও হজপথে বাধা হয়েছে। ইবনে জাওজি তাঁর আল-মুনতাজাম গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে ৪০১ হিজরি (১০১১ খ্রিষ্টাব্দ) সনে দজলা নদীতে মারাত্মক বন্যা হয়। এই বন্যায় বাগদাদ ও ইরাকের অনেক গ্রাম ও দুর্গ ডুবে যায়, ফলে ইরাক থেকে কেউ হজে যেতে পারেননি। ইবনে আসির (মৃত্যু: ৬৩০ হিজরি) তাঁর আল-কামিল গ্রন্থে এ ঘটনার নিশ্চিতকরণ দিয়ে বলেছেন যে দজলা নদীর পানি ২১ হাত উচ্চতায় পৌঁছে, যা হজের পথে যাত্রাকে অসম্ভব করে তোলে।

এ ছাড়া প্রচণ্ড গরম ও বালুঝড়ও হজের পথে বাধা সৃষ্টি করত। আল-জাযারি (মৃত্যু: ৯৭৭ হিজরি) তাঁর আদ-দুরার আল-ফারাইদ গ্রন্থে ৯৬৬ হিজরি (১৫৫৯ খ্রিষ্টাব্দ) সনের একটি ঘটনা বর্ণনা করেছেন। মিসর থেকে আগত হাজিরা প্রচণ্ড গরম ও বিষাক্ত বাতাসের সম্মুখীন হন। পথের পানি ছিল অপর্যাপ্ত ও দূষিত, যার ফলে অনেক পথচারী ও দরিদ্র হাজি মারা যান।

ফিকহের দৃষ্টিকোণ

প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে হজ বন্ধ হওয়া ফিকহের আলোচনায়ও গুরুত্বপূর্ণ স্থান পেয়েছে। হানাফি ফকিহরা পথের নিরাপত্তা এবং সামর্থ্যের শর্ত হিসেবে জল ও খাদ্যের প্রাপ্যতার ওপর জোর দিয়েছেন। ইমাম কাসানি (মৃত্যু: ৫৮৭ হিজরি) তাঁর বাদাইউস সানাই গ্রন্থে বলেছেন যে পথে খাদ্য ও পানির অভাব হজের বাধ্যবাধকতাকে বাতিল করে। মালিকি ফকিহরা, বিশেষ করে আন্দালুস ও মাগরিবের আলেমরা, দীর্ঘ পথে পানির অভাব ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে হজের বাধ্যবাধকতা স্থগিত করার ফতোয়া দিয়েছিলেন। উদাহরণস্বরূপ, ইবনে রুশদ (জাদ্দ) (মৃত্যু: ৫২০ হিজরি) এবং তুরতুশি (মৃত্যু: ৫২০ হিজরি) আন্দালুস ও মাগরিবের মানুষের জন্য হজকে নিষিদ্ধ বলে ফতোয়া দিয়েছিলেন, কারণ পথের প্রাকৃতিক ঝুঁকি তাঁদের জীবনকে বিপন্ন করত।

 আল–জাজিরা ডট নেট অবলম্বনে

আরও পড়ুনবিরে রুমা: মদিনার পানির সংকট দূর করেছে যে কুয়া০৩ মে ২০২৫

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: কর ছ ন য গ রন থ উল ল খ র জন য

এছাড়াও পড়ুন:

সচিবালয়ে দপ্তর ছেড়ে নিচে নেমে কর্মচারীদের বিক্ষোভ

‘সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’-এর খসড়া অনুমোদনের প্রতিবাদে সচিবালয়ের ভেতরে আজ রোববার দ্বিতীয় দিনের মতো বড় ধরনের বিক্ষোভ মিছিল করেছে বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদ। ‘নিবর্তনমূলক ও কালাকানুন’ আখ্যায়িত করে এই অধ্যাদেশ প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে আসছে সংগঠনটি।

আজ সকালে সচিবালয়ে দেখা যায় শত শত কর্মচারী দপ্তর ছেড়ে নিচে নেমে মিছিলে যোগ দেন । বিপুলসংখ্যক কর্মচারীর উপস্থিতিতে মিছিল থেকে স্লোগান দেওয়া হচ্ছে ‘অবৈধ কালো আইন মানব না’ ইত্যাদি । মিছিল সচিবালয়ের ভেতরে বিভিন্ন এলাকা প্রদক্ষিণ করছে।

গত বৃহস্পতিবার অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮ সংশোধন করে ‘সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’-এর খসড়া অনুমোদন দেওয়া হয়।

অভিযোগ উঠেছে, সাড়ে চার দশক আগের বিশেষ বিধানের কিছু ‘নিবর্তনমূলক ধারা’ সংযোজন করে অধ্যাদেশের খসড়াটি করা হয়েছে। এর মাধ্যমে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে সহজেই শাস্তি, এমনকি চাকরি থেকে বরখাস্ত করার সুযোগ তৈরি করা হয়েছে বলে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হচ্ছে। অধ্যাদেশের খসড়াটিকে সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক আখ্যায়িত করে তা পুনর্বিবেচনারও দাবি করছেন কর্মচারীরা।

সম্পর্কিত নিবন্ধ