গত তিন দশকে বাংলাদেশের শিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের উল্লেখযোগ্য সাফল্যের পেছনে কিছু দূরদর্শী নীতির ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর মধ্যে ১৯৯৩ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি সরকারের চালু করা খাদ্য বা টাকার বিনিময়ে শিক্ষা কর্মসূচি বাংলাদেশের শিক্ষা খাতে এক মাইলফলক হয়ে ওঠে।

দারিদ্র্যপ্রবণ পরিবারের মেয়েদের স্কুলমুখী করার এই যুগান্তকারী উদ্যোগ বাংলাদেশের সমাজকাঠামোকে আমূল পরিবর্তন করে এবং দীর্ঘমেয়াদি জনমিতির ও অর্থনৈতিক সুফল বয়ে আনে। বর্তমানে বিএনপির ঘোষিত ৩১ দফা রাষ্ট্র মেরামতের কর্মসূচি এই ঐতিহাসিক উদ্যোগের শিক্ষা ও অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে, যা অন্তর্ভুক্তিমূলক, প্রমাণভিত্তিক উন্নয়নের প্রতি বিএনপির প্রতিশ্রুতিকে নতুনভাবে সামনে নিয়ে আসে।

একটি রূপান্তরকামী কর্মসূচির সূচনা

১৯৯০-এর দশকের শুরুতে বাংলাদেশের শিক্ষা খাত গভীর সংকটে ছিল। দারিদ্র্য, সামাজিক কুসংস্কার এবং লিঙ্গবৈষম্যের কারণে লাখ লাখ শিশু, বিশেষ করে মেয়েরা, স্কুলের বাইরে থেকে যেত। এ বঞ্চনা বাল্যবিবাহ, উচ্চ জন্মহার এবং নারীর অশিক্ষার এক দুষ্টচক্রকে স্থায়ী করে তোলে, যা জাতীয় উন্নয়নে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

এ সংকট মোকাবিলায় ১৯৯৩ সালে বিএনপি সরকার ‘ফুড ফর এডুকেশন’ কর্মসূচি চালু করে, যা পরে নগদ সহায়তা পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়। এই কর্মসূচির মূলনীতি ছিল দরিদ্র পরিবারগুলোকে খাদ্যশস্য বা নগদ অর্থ দেওয়ার শর্তে তাদের মেয়েসন্তানদের নিয়মিত বিদ্যালয়ে পাঠানো। এ উদ্যোগ দরিদ্র পরিবারের জন্য শিক্ষার খরচ কমিয়ে দেয় এবং মেয়েসন্তানদের শিক্ষা গ্রহণে শক্তিশালী উৎসাহ সৃষ্টি করে।

রাজনৈতিক গুরুত্ব: দরিদ্রবান্ধব উন্নয়নের অঙ্গীকার

খাদ্য বা টাকার বিনিময়ে শিক্ষা কর্মসূচির রাজনৈতিক গুরুত্ব ছিল অত্যন্ত গভীর। এটি বিএনপিকে দরিদ্রবান্ধব, তৃণমূলমুখী উন্নয়নের অগ্রদূত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। যেখানে সরকারের অনেক নীতি কেবলই সামষ্টিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ওপর গুরুত্ব দিত, এ কর্মসূচি সরাসরি সাধারণ মানুষের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন নিয়ে আসে, বিশেষ করে গ্রামের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে।

বেগম খালেদা জিয়ার সাহসী নেতৃত্বে নারীর শিক্ষাকে জাতীয় অগ্রাধিকারের শীর্ষে তুলে ধরা সে সময়ের সমাজব্যবস্থার পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতার জন্য এক যুগান্তকারী চ্যালেঞ্জ ছিল। কর্মসূচির সফল বাস্তবায়ন জনগণের মধ্যে বিএনপির প্রতি আস্থা বৃদ্ধি করে এবং দলকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মানব উন্নয়নমুখী শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। বিএনপির ৩১ দফা সংস্কার কর্মসূচি স্পষ্টভাবে এই সাফল্যের ধারাবাহিকতাকে এগিয়ে নিতে শিক্ষা ভাতা, সামাজিক নিরাপত্তা এবং নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধির ওপর জোর দিয়েছে।

অর্থনৈতিক প্রভাব: জনমিতির লভ্যাংশের দ্বার উন্মোচন

খাদ্য বা টাকার বিনিময়ে শিক্ষা কর্মসূচির অর্থনৈতিক প্রভাব ছিল বহুদূরপ্রসারী। আন্তর্জাতিক খাদ্য নীতি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান (আইএফপিআরআই), বিশ্বব্যাংকসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মূল্যায়নে নিশ্চিত হয়েছে যে এই কর্মসূচির ফলে বিদ্যালয়ে ভর্তি এবং ধারাবাহিক উপস্থিতি উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়, বিশেষ করে মেয়েদের ক্ষেত্রে।

আইএফপিআরআইয়ের গবেষণায় দেখা গেছে, কর্মসূচির কারণে মেয়েদের গড়ে ১৪ থেকে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত শিক্ষাজীবন বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে বাংলাদেশ দ্রুত জনমিতিক পরিবর্তনের পথে এগিয়ে যায়। বর্তমানে দেশের মোট প্রজননহার প্রায় ২.

১-এ নেমে এসেছে, যা প্রতিস্থাপন স্তরের কাছাকাছি। শিক্ষিত নারীরা দেরিতে বিয়ে করেন, কম সন্তান ধারণ করেন এবং পরিবারে স্বাস্থ্য ও শিক্ষায় বেশি বিনিয়োগ করেন, যা আন্তপ্রজন্ম উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করেছে।

এই জনমিতিক পরিবর্তনের দৃশ্যমান ফল হলো নারীর শ্রমবাজারে অংশগ্রহণের ক্রমাগত বৃদ্ধি। ২০২৪ সালে নারীর শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৪.২ শতাংশে। এই প্রবৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি ছিল মেয়েদের শিক্ষার বিস্তার। নারী শ্রমিকেরা বিশেষ করে দেশের রপ্তানিমুখী পোশাকশিল্পে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে শুরু করে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশে নিম্ন আয়ের দেশ থেকে নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে উত্তরণের পথ সুগম হয়। শিক্ষার বিস্তারের মাধ্যমে মানবসম্পদ উন্নয়ন, উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি এবং কর্মসংস্থান সম্প্রসারণের ফলে দারিদ্র্য উল্লেখযোগ্যভাবে কমে এসেছে, যা খাদ্য বা নগদ টাকার বিনিময়ে শিক্ষা কর্মসূচির দীর্ঘমেয়াদি অবদানকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরে।

বাংলাদেশের খাদ্য বা টাকার বিনিময়ে শিক্ষা কর্মসূচি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছে। এটি বর্তমানে বিশ্বব্যাপী বিদ্যালয়ে উপস্থিতি বৃদ্ধি এবং লিঙ্গবৈষম্য দূর করার একটি সেরা উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হয়।সামাজিক রূপান্তর: মানসিকতার পরিবর্তন ও নারীর ক্ষমতায়ন

অর্থনৈতিক সুফলের পাশাপাশি, খাদ্য বা টাকার বিনিময়ে শিক্ষা কর্মসূচি বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থায় গভীর পরিবর্তন এনেছে। যেখানে একসময় মেয়েদের শিক্ষাকে অপ্রয়োজনীয় বা অগ্রহণযোগ্য মনে করা হতো, সেখানে পরিবারগুলো এখন মেয়েদের শিক্ষার গুরুত্ব উপলব্ধি করছে। মেয়েরা স্কুলে দীর্ঘ সময় ধরে থাকায় বাল্যবিবাহের হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে।

সাম্প্রতিক তথ্যে দেখা যায়, এখনো প্রায় ২৯ শতাংশ মেয়ে ১৫ বছর বয়সের আগে এবং ৬৫ শতাংশ ১৮ বছরের আগে বিয়ে করে। তবে এই হার ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে। শিক্ষিত নারীরা বর্তমানে পরিবারের আয়ের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার এবং সমাজে তাদের মর্যাদা বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে নারীরা স্থানীয় পর্যায়ে উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় প্রতিনিধিত্ব করছে। বাংলাদেশের দক্ষিণ এশিয়ায় লিঙ্গসমতার শীর্ষস্থান অর্জনের পেছনে এই পরিবর্তনের বিশাল অবদান রয়েছে।

আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি: বৈশ্বিক অনুকরণীয় মডেল

বাংলাদেশের খাদ্য বা টাকার বিনিময়ে শিক্ষা কর্মসূচি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছে। এটি বর্তমানে বিশ্বব্যাপী বিদ্যালয়ে উপস্থিতি বৃদ্ধি এবং লিঙ্গবৈষম্য দূর করার একটি সেরা উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হয়। আইএফপিআরআইয়ের মূল্যায়ন বলেছে, কর্মসূচির সুফল যেমন উচ্চবিদ্যালয়ে উপস্থিতি, দেরিতে বিয়ে, কম জন্মহার এবং শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ কর্মসূচি শেষ হওয়ার অনেক বছর পরেও স্থায়ী হয়েছে। বাংলাদেশের এই মডেল বিশ্বের অনেক নিম্ন আয়ের দেশে অনুপ্রেরণা হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

বিএনপির ৩১ দফা কর্মসূচি: সাফল্যের ধারাবাহিকতা

বিএনপি ঘোষিত ৩১ দফা সংস্কার কর্মসূচিতে শিক্ষা ও সামাজিক নিরাপত্তাব্যবস্থার শক্তিশালীকরণের জন্য একটি বিস্তৃত পরিকল্পনা অন্তর্ভুক্ত করেছে। নতুন অ্যাজেন্ডা স্পষ্টভাবে খাদ্য বা টাকার বিনিময়ে শিক্ষা কর্মসূচির শিক্ষা থেকে উদ্ভূত। এতে শিক্ষা খাতে জিডিপির কমপক্ষে ৫ শতাংশ ব্যয় করার অঙ্গীকার করা হয়েছে, যেখানে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।

এ ছাড়া শিক্ষার্থীদের নিয়মিত বিদ্যালয়ে উপস্থিতির সঙ্গে শর্তযুক্ত খাদ্য ও নগদ সহায়তা এবং পুষ্টি কার্যক্রম সম্প্রসারণের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। এই পরিকল্পনার মাধ্যমে সামাজিক সুরক্ষা ও শিক্ষা একীভূতভাবে দরিদ্র পরিবারগুলোর জন্য আরও কার্যকর ও টেকসই সহায়তা নিশ্চিত করা হবে। বিএনপির এই অন্তর্ভুক্তিমূলক দৃষ্টিভঙ্গি একটি টেকসই ও ন্যায়ভিত্তিক বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

শেষ কথা

খাদ্য বা টাকার বিনিময়ে শিক্ষা কর্মসূচি বাংলাদেশের অন্যতম সফল সামাজিক উদ্ভাবন, যা শিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং দারিদ্র্য হ্রাসে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। এই কর্মসূচির প্রভাব কেবল ইতিহাসের অংশ নয়, এটি আজও দেশের নীতিনির্ধারণে সক্রিয়ভাবে প্রভাব বিস্তার করছে এবং বিএনপির ভবিষ্যৎ রাষ্ট্র মেরামতের দর্শনের অন্যতম স্তম্ভ হয়ে উঠেছে। বর্তমানে যখন বাংলাদেশ শিক্ষার মানোন্নয়ন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং ক্রমবর্ধমান বৈষম্যের মতো নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি, তখন এই যুগান্তকারী কর্মসূচির মূল নীতিগুলোকে পুনর্জীবিত ও আধুনিকায়ন করা অত্যন্ত সময়োপযোগী।

বিএনপি তাদের ৩১ দফা সংস্কার কর্মসূচির মাধ্যমে এই সাফল্যকে আরও সম্প্রসারিত করার একটি সুস্পষ্ট ও বিশ্বাসযোগ্য পথ দেখাচ্ছে। খাদ্য বা টাকার বিনিময়ে শিক্ষা কর্মসূচির গল্প শুধু বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি অধ্যায় নয়, এটি দেশের ভবিষ্যৎ রূপান্তরের জন্য একটি জীবন্ত পথনকশা।

ড. জিয়াউদ্দিন হায়দার বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য এবং বিশ্বব্যাংকের সাবেক স্বাস্থ্য ও পুষ্টিবিশেষজ্ঞ

*মতামত লেখকের নিজস্ব

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ব শ ষ কর ব শ বব য উপস থ ত ব এনপ র ক র কর ত ক পর স ফল য র জন য র পর ব পর ব র দর দ র গ রহণ র একট জনম ত র ওপর অবদ ন

এছাড়াও পড়ুন:

ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশে কেড়ে নেওয়া হচ্ছে রূপান্তরিত সাঁতারুর পদক

দ্বিতীয় দফা যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতা গ্রহণের পর পররাষ্ট্রনীতিতে আরও কড়াকড়ি আরোপের মতো ক্রীড়াঙ্গনেও কঠোর নীতি চালু করেছেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। যার মধ্যে একটি হলো মেয়েদের খেলায় রূপান্তরিত (ট্রান্সজেন্ডার) ক্রীড়াবিদদের নিষিদ্ধ করা।

ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তের খড়্গ নেমে এসেছে লিয়া টমাসের ওপর। যুক্তরাষ্ট্রের এই রূপান্তরিত সাঁতারুর ব্যক্তিগত অর্জন বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে। ফলে তাঁর রেকর্ড মুছে ফেলার পাশাপাশি শিগগিরই পদক কেড়ে নেওয়া হবে।

রূপান্তরিত সাঁতারু লিয়া টমাসের পদক কেড়ে নেওয়া হবে

সম্পর্কিত নিবন্ধ