এক দিনের নিমন্ত্রণে ওমর সানীর ‘শ্বশুরবাড়ি’তে
Published: 25th, May 2025 GMT
দুপুরবেলার আকাশটা ছিল একটু অভিমানী। মেঘের আড়ালে লুকানো সূর্য, যেন কিছু ভুলে গিয়ে নিজেকেই আড়াল করেছে। এমন এক নরম আবহে আমরা রওনা হলাম মানিকগঞ্জের অরঙ্গবাদের দিকে—নব্বইয়ের দশকের জনপ্রিয় নায়ক ওমর সানীর ‘শ্বশুরবাড়ি’ রেস্টুরেন্টে এক দিনের নিমন্ত্রণে। গন্তব্য কেবল একটি খাবারের জায়গা নয়, বরং স্মৃতিমাখা গল্পের ভিতর ঢুকে পড়ার অভিপ্রায়।
রাস্তার ধারে দিগন্তবিস্তৃত ক্ষেত, হেলে পড়া বাঁশঝাড়, আর দূরের নদীর ডাক—সব মিলিয়ে যেন আমরা এক পুরনো সিনেমার সেটে ঢুকে পড়েছি, যেখানে প্রতিটি ফ্রেমে মিশে আছে জীবনের গন্ধ।
‘শ্বশুরবাড়ি’তে পা রাখতেই চোখে পড়ে সবুজের ছায়াঘেরা মায়া। টিনের চালা, বাঁশের ছাউনি, কাঠের বেঞ্চ, আর দেয়ালে ঝোলানো পুরনো সিনেমার পোস্টার—সব মিলিয়ে এটি যেন ওমর সানীর রূপালী অতীতের এক ব্যক্তিগত জাদুঘর।
আরো পড়ুন:
সপ্তম বাংলাদেশি হিসেবে এভারেস্ট জয় করলেন শাকিল
তিন দিনের ছুটিতে পর্যটকে মুখর কুয়াকাটা
প্রথম অভ্যর্থনা আসে সরাসরি হৃদয় থেকে। নিজ হাতে অতিথি বরণ করে নেন ওমর সানী। আনুষ্ঠানিকতা ভুলে, যেন আত্মীয়ের বাড়িতে নিমন্ত্রণে এসেছি। খাবারের টেবিলে সাজানো—সবজি- খিচুড়ি, মুরগির ঝাল ফ্রাই, গরুর মাংস, নদীর মাছ ভাজিসহ নানা রকমের পদ। প্রতিটি পদেই ঘরোয়া আবেগের ছোঁয়া। খিচুড়ির প্রসঙ্গে সানী বলেন, “মায়ের মৃত্যুর দিন খিচুড়ি করি—এ যেন এক প্রার্থনা।” তার কণ্ঠে তখন শুধুই সন্তানসুলভ কোমলতা।
খাওয়ার পরে আমরা হেঁটে যাই লেমুবাড়ি বাজারে। সরের চায়ের কাপে জমে ওঠে কথার জোয়ার। সেখান থেকে নদীর দিকে যাত্রা। মেশিনচালিত নৌকায় নদী পাড়ি—পাশ দিয়ে চলে যায় মাছ ধরা জেলেরা, আর আমাদের চোখে ভাসে এক জীবন্ত জলজ উপাখ্যান। লেমুবাড়ি চরে কিছু সময় কথা হয় স্থানীয় মানুষের সঙ্গে। এসবের মধ্যে ভূমিকায় পরিবর্তন—নায়ক নিজেই হাতে নেন মাইক্রোফোন, নেন সাংবাদিকদের সাক্ষাৎকার। পুরনো গল্পে ভেসে ওঠে নব্বইয়ের রোমান্স, হারিয়ে যাওয়া সম্পর্ক, আর একাকিত্বের আত্মজিজ্ঞাসা।
এরপর ধলেশ্বরী নদীর ব্রিজে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখি—নিঃশব্দে। চারপাশে কেবল আলো ও ছায়ার ছলনায় সন্ধ্যা গড়ায়। ফিরে এলাম ‘শ্বশুরবাড়ি’ রেস্টুরেন্টে। শুরু জমপেশ আড্ডা। কথোপকথনের কেন্দ্রে চলচ্চিত্রের রাজনীতি, হারানো সম্পর্ক, ক্ষোভ ও অভিমান। কিছু ক্ষুব্ধ কথা উঠে আসে—শাকিব খানকে লাঞ্ছনার ঘটনার বর্ণনা, পপি নিয়ে ব্যক্তিগত মত। ওমর সানীর কণ্ঠে তখন কেবল এক অভিনেতা নয়, একজন মানুষের জবানবন্দি।
আলোচনার এক পর্যায়ে উঠে এল পুরনো এক বিতর্কিত প্রসঙ্গ—চিত্রনায়ক শাকিব খানকে নিয়ে। কিছু বছর আগে ঘটে যাওয়া সেই ঘটনার কথা বলতে গিয়ে তার কণ্ঠে চাপা ক্ষোভের সঙ্গে মিশে ছিল অভিজ্ঞতার ভার। বললেন, “সেই সময় এক পক্ষ মৌসুমীকে জোর করে হারিয়ে দিয়েছিল। শাকিব বিষয়টা বুঝতে পেরে প্রতিবাদ করেছিল বলেই অপমানিত হয়েছিল। তারা তখন ক্ষমতা ব্যবহার করেছে কতিপয় কিছু মানুষ। শাকিব নির্দোষ ছিল, তবুও শিকার হয়েছিল লাঞ্ছনার।”
একটু থেমে, চোখ সরিয়ে, হয়তো পুরনো অভিমান গিলে নিয়ে আবার বললেন—“সবাই জানে, কিন্তু কেউ বলে না। আমি বলি, কারণ আমি দেখেছি, আমি টের পেয়েছি।”
আড্ডা তখন আরও খোলামেলা। প্রসঙ্গ এল আরেক নায়িকা পপিকে নিয়ে। ওমর সানীর কণ্ঠে তখন কিছুটা বিরক্তি, কিছুটা করুণ অভিব্যক্তি। বললেন, “ও একটা স্টুপিড। সিনেমা না করলে, কে চিনত ওকে? সে কি কোটিপতির মেয়ে? তার স্বামীও তাকে বিয়ে করত না, যদি সে নায়িকা না হতো। সিনেমাকে সে যেভাবে ছোট করেছে, তাতে আমি তার দুলাভাই হিসেবে বলতেই পারি—ও একেবারে অবিবেচক।”
এ যেন কেবল ব্যক্তিগত ক্ষোভ নয়—এক সময়ের রূপালী দুনিয়ার নৈতিক অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে এক অভিমানী মানুষের উচ্চারণ।
আড্ডায় উঠে আসে মৌসুমী-সানীর এক ভক্তের গল্পও। লুৎফর নামের ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার, যিনি দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে তাদের নামে উপহার সামগ্রী দিয়ে থাকেন অসহায় মানুষদের। প্রতিবছর তাদের জন্মদিনে কেক কাটেন এবং খিচুড়ি খাওয়ান এলাকাবাশিদের। এমনকি মৌসুমীকে জমি লিখে দেওয়ার কথাও বলেন লুৎফর।
ওমর সানী বললেন, “আমি মানুষের খুব কাছাকাছি থাকতে চাই। শহরের হিংসা, হানাহানি, চাকচিক্য ছেড়ে এখানে এসেছি। এখানেই শান্তি।” এমন কথাগুলো শুনে মনে হয়, তার গ্ল্যামার-পোড়া মন আজ আর আলোয় নয়, ছায়ার প্রশান্তিতেই বাঁচে।
ততক্ষণে ধুম করে নামে বৃষ্টি। খোলা আকাশের নিচে জমে ওঠা আড্ডায় ছেদ পড়ে, আমরা ছুটে যাই রেস্টুরেন্টের ভিতরে। আমাদের জন্য প্রস্তুত ‘জামাই প্লেট’—ঘরোয়া চাপ ও লেমুবাড়ি নদীর তাজা মাছ ভাজি। বাইরে বৃষ্টি, ভিতরে কুয়াশামাখা কণ্ঠে গল্প বলছেন ওমর সানী—সিনেমার, জীবনের, কিছু অতৃপ্তি আর কিছু স্মৃতি। আর শেষে আসে কাঁচা আমের জুস—ফলের টকমিষ্টি স্বাদে শেষ হয় এক দীর্ঘ আড্ডার দিন।
একসময় মনে হলো, এ যেন কোনো ডকুমেন্টারি নয়, কোনো রিপোর্টিং নয়—এ এক ব্যক্তিগত যাত্রা। যেখানে খাবার, নদী, আড্ডা আর মানুষের আন্তরিকতা মিলে তৈরি করেছে এক দিন, যেটা আর কোনো ক্যালেন্ডারে নেই, শুধু হৃদয়ের পাতায় লেখা। দিনটা যেন ছিল শুধুই আমাদের জন্য। যেন পর্দার বাইরের এক নায়ক, বাস্তবের ভেতর দাঁড়িয়ে বলছেন—“আসো, জীবনটাকে একটু অন্যভাবে দেখি।”
এটি এক অনুভব, এক আত্মগমন। ওমর সানীর ‘শ্বশুরবাড়ি’ শুধুই একটি রেস্টুরেন্ট নয়—এ এক নির্জন আত্মার আশ্রয়।
ঢাকা/রাহাত/লিপি
.উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ভ রমণ ওমর স ন র বলল ন
এছাড়াও পড়ুন:
গ্রেপ্তারকৃতদের তদন্তে মালয়েশিয়াকে সহায়তা করবে বাংলাদেশ
সম্প্রতি মালয়েশিয়ার পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া ৩৫ বাংলাদেশির বিরুদ্ধে জঙ্গিবাদের অভিযোগ তদন্তে মালয়েশিয়ার সঙ্গে কাজ করবে বাংলাদেশ। শুক্রবার কুয়ালালামপুরে মালয়েশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ বিন হাজি হাসানের সঙ্গে এক বৈঠকে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন এ আশ্বাস দেন।
শুক্রবার রাতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, কুয়ালালামপুরে ৩২তম আসিয়ান আঞ্চলিক ফোরামের (এআরএফ) মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকের ফাঁকে তাঁরা এক দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেন।
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে সরকারের দৃঢ় অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করেন এবং তথ্য ও তদন্তের ফলাফল বিনিময়ের মাধ্যমে অভিযোগের অভ্যন্তরীণ তদন্তে মালয়েশিয়ার সহযোগিতা চান। মালয়েশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশকে সহায়তার আশ্বাস দেন।
এর আগে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রসচিব ডেভিড ল্যামির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তাঁরা বিভিন্ন দ্বিপক্ষীয়, আঞ্চলিক ও বহুপক্ষীয় বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। উভয়ই বাংলাদেশে চলমান সংস্কার, রোহিঙ্গা সংকট, এলডিসি-পরবর্তী সহায়তা ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা করেন।
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা নিউজিল্যান্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইনস্টন পিটার্স, শ্রীলঙ্কার পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিজিথা হেরাথ এবং কোরিয়া প্রজাতন্ত্রের উপমন্ত্রী ও প্রতিনিধিদলের প্রধান পার্ক ইউনজুর সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেন। এ সময় দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়।
বাংলাদেশ ২০০৬ সালে এআরএফের সদস্য হয়। নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে ফোরামটি প্রতিষ্ঠিত হয়।