রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতাল পার হয়ে বারিধারা ডিওএইচএসের দিকে যাওয়ার পথে গন্ধটা নাকে এসে লাগে। বারিধারা ডিওএইচএসের কাছে আসতেই এ গন্ধ আরও তীব্র হয়ে ওঠে। এখানেই চোখে পড়ে গুলশান লেকের শেষাংশ। এ অংশে লেকের সব বর্জ্য এসে জমা হয়। পানির ওপর চার–পাঁচ ইঞ্চি পুরো থিকথিকে ময়লার একটা স্তর তৈরি হয়েছে। এসব বর্জ্য পচে তীব্র দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে।

উৎকট গন্ধে লেকের দুই পাশে গড়ে ওঠা অভিজাত ভবনের ট্যারেস ও বারান্দায় কেউ বসতে চান না। লেকমুখী ভবনের দুই থেকে চারতলার বাসিন্দারা দুর্গন্ধের কারণে বাসার দরজা–জানালা বন্ধ রাখেন।

এবার কোরবানির পশুর নাড়িভুঁড়ি ও রক্ত মিশে লেকের পরিবেশের আরও অবনতি হয়েছে।

এ এলাকায় গুলশান ও কালাচাঁদপুরকে আলাদা করেছে একটি কালভার্ট। এ কালভার্টের ওপর চায়ের দোকান করেন মো.

আয়নাল। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখানে ১৪ বছর ধরে দোকান করি। গন্ধে টেকা যায় না। বৃষ্টি হইলে গন্ধ একটু কমে। কোরবানিতে অবস্থা আরও খারাপ হইছে। ময়লা সাফ করতে সরকারি কোনো লোক দেহি নাই।’

আয়নালের চায়ের দোকানে বারিধারার অফিস থেকে নিয়মিত চা খেতে আসেন আরিয়ান মাহমুদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘অফিস থেকে বের হলেই নাকে দুর্গন্ধ এসে লাগে। সব সময় এ রকম দেখে আসছি। তীব্র দুর্গন্ধের মধ্যে চা খেতে হয়।’

কোরবানির বর্জ্যও মিশেছে 

গত সোমবার দুপুরে বারিধারা লেক ব্রিজ নামের অ্যাপার্টমেন্টের পেছনে বর্জ্য পরিষ্কার করতে দেখা গেল খায়রুল ইসলাম নামের একজনকে। সেখানে কথা হয় তাঁর সঙ্গে।

খায়রুল প্রথম আলোকে বলেন, ‘লোকজন কোরবানির সময় পশুর নাড়িভুঁড়ি ফেলছে লেকে। এগুলো পচে ব্যাপক গন্ধ হইয়া গেছে। সকাল থেইকা এসব পরিষ্কার করছি।’

শুধু কোরবানির বর্জ্যই নয়, এখানে চিপসের প্যাকেট, পানির বোতল, পলিথিনও খায়রুলের নিড়ানির সঙ্গে উঠে আসতে দেখা গেল।

খায়রুলকে ময়লা পরিষ্কারের জন্য নিয়ে এসেছেন নার্সারিমালিক মো. মালেক। লেক ব্রিজ ভবনটির ঠিক পাশেই ২০১৪ সাল থেকে তিনি নার্সারি করেন। দীর্ঘদিন ধরে লেকের এ অংশ পরিষ্কারে কাজ করে যাচ্ছেন।

মালেক বলেন, আগে নার্সারির গাছে লেকের পানি দিলে সমস্যা হতো না। ইদানীং লেকের পানিতে গাছ মরে যাচ্ছে।

বারান্দায় দাঁড়ানো দায়

লেকের পাড়ে থাকা ৭২ নম্বর সড়কের একটি ভবনের বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, দুই পাড়ে থাকা ভবন থেকে নিয়মিত ময়লা ফেলা হয় লেকে। এ ছাড়া এসব ভবনের পয়োবর্জ্যে এসে লেকে পড়ে। সব মিলিয়ে যে লেকটি হতে পারত নাগরিক কোলাহলে প্রশান্তির উৎস, সেটি এখন ময়লার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে।

জানতে চাইলে গুলশান সোসাইটির সভাপতি ব্যারিস্টার ওমর সাদাত প্রথম আলোকে বলেন, ‘এক বছর ধরে নিজেদের খরচে গুলশান লেকের যত ময়লা সব ভাসমান এক্সকাভেটর দিয়ে পরিষ্কার করেছি। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে গুলশান–বনানী ও বারিধারা ডিওএইচএসের যত পয়োবর্জ্য সব ফেলা হয় গুলশান লেকে।’

বারবার কর্তৃপক্ষকে বলার পরও কোনো কাজ হচ্ছে না জানিয়ে ওমর সাদাত বলেন, ‘আমরা এলাকাবাসী সম্পূর্ণ অসহায়। ওয়াসাকে আমরা যে বিল পরিশোধ করি, সেটার একটা অংশ দিই পানির জন্য এবং আরেকটা অংশ দিই পয়োবর্জ্য শোধনের জন্য। যে পয়োবর্জ্য দাশেরকান্দিতে শোধন করার কথা, সেটা ফেলা হচ্ছে গুলশান লেকে। গুলশান লেককে ঢাকার একটা দোজখ বানানো হয়েছে। একটা সভ্য দেশে এ রকম হতে পারে, সেটা অবিশ্বাস্য!’

ঢাকা ওয়াসার উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) এ কে এম সহিদ উদ্দিন প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, গুলশান–বনানী এলাকার কোনো পয়োবর্জ্য গুলশান লেক বা বনানী লেকে পড়ছে না। এগুলো তেজগাঁও স্যুয়ারেজ লিফট স্টেশন হয়ে দাশেরকান্দি পয়োবর্জ্য শোধনাগারে চলে যাচ্ছে।

সহিদ উদ্দিন বলেন, ‘গুলশান লেকের দূষণ বন্ধে ১০ বছর আগে একটি লাইন করা হয়েছিল। সেটিকে আমরা সাময়িকভাবে ব্যবহারের আওতায় এনে তরল বর্জ্যগুলো দাশেরকান্দি পাঠাব, গুলশান–বনানী এলাকার জন্য নতুন স্যুয়ারেজ লাইন না হওয়া পর্যন্ত।’

এ ব্যাপারে বক্তব্য জানতে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজকে ফোন করা হলে তিনি ফোন ধরেননি।

লেকের দূষণের মাত্রা

গুলশান লেকের দূষণ নিয়ে কাজ করেছিলেন স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের ডিন আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের গবেষণায় দেখেছি, গুলশান লেকে দ্রভীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ মানমাত্রার চেয়ে অর্ধেকের কম। যেমন প্রতি লিটার পানিতে দ্রভীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ থাকা উচিত কমপক্ষে ৫ মিলিগ্রাম। গুলশান লেকের পানিতে সেটি ২ গ্রাম। এ ছাড়া লেকের পানিতে দ্রভীভূত কঠিন পদার্থের পরিমাণও মানমাত্রার দ্বিগুণ। এসব কারণে লেকের জলজ বাস্তুতন্ত্র মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মাঝেমধ্যে মাছের মড়ক লাগে এ কারণে।’

কামরুজ্জামান মজুমদার আরও বলেন, বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে নিয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক উপায়ে দূষণের প্রতিকার খুঁজতে হবে।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: প রথম আল ক পর ষ ক র র জন য রব ন র ভবন র র একট

এছাড়াও পড়ুন:

৬০ বছর পর গোল্ডলিফ–বেনসনের কারখানা ঢাকা থেকে সরছে

ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ কোম্পানি লিমিটেডের (বিএটি বাংলাদেশ) নিবন্ধিত প্রধান কার্যালয় রাজধানীর মহাখালীর নিউ ডিওএইচএস থেকে আশুলিয়ায় স্থানান্তর করা হচ্ছে। কোম্পানিটির পরিচালনা পর্ষদ এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) ওয়েবসাইটে দেওয়া বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে।

ডিএসইর বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, ২০২৫ সালের ১ জুলাই থেকে বিএটি বাংলাদেশের নতুন অফিসের ঠিকানা হবে: ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ কোম্পানি লিমিটেড, দেহোরা, ধামসোনা, বলিভদ্র বাজার, আশুলিয়া, ঢাকা-১৩৪৯। একই দিনে বন্ধ হয়ে যাবে কোম্পানিটির ঢাকা কারখানার কার্যক্রম।

আজ এ প্রতিবেদন লেখার সময় ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকোর শেয়ারের দাম ছিল ২৮৪ দশমিক ৯০ টাকা। কোম্পানিটি ২০২৪ সালে ৩০০ শতাংশ, ২০২৩ সালে ১০০ শতাংশ, ২০২২ সালে ২০০ শতাংশ ও ২০২১ সালে ২৭৫ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিয়েছে।

১৯৬৫ সালে যখন ঢাকার মহাখালী ডিওএইচএস এলাকায় ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশের এই কারখানা স্থাপন করা হয়, এটি ছিল বাংলাদেশে তাদের দ্বিতীয় কারখানা। এর আগে ১৯৪৯ সালে চট্টগ্রামের ফৌজদারহাটে প্রথম কারখানা স্থাপন করা হয়।

মহাখালীর এই কারখানা আবাসিক এলাকায় অবস্থিত হওয়ায় পরিবেশবাদীরা তা সরানোর দাবি করে আসছিলেন অনেক দিন ধরে।

জানা যায়, কারখানার জায়গা ইজারা নিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করছিল কোম্পানিটি। প্রতি ইজারা চুক্তির মেয়াদ ৩০ বছর এবং মেয়াদ নবায়নের সুযোগ ছিল সর্বোচ্চ ৯০ বছর পর্যন্ত। ৬০ বছর কার্যক্রম পরিচালনার পর বাকি ৩০ বছরের জন্য ইজারা নবায়নের আবেদন করেছিল বিএটি বাংলাদেশ, কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তা নবায়ন না করলে কোম্পানিটি আইনি লড়াইয়ে নামে।

কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ গত ২৮ মে বিএটি বাংলাদেশের করা আপিল খারিজ করে দেন। এরপর আজ বিএটি বাংলাদেশ প্রধান কার্যালয় স্থানান্তর ও কারখানা বন্ধের ঘোষণা দিল।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ৬০ বছর পর গোল্ডলিফ–বেনসনের কারখানা ঢাকা থেকে সরছে